শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৩

বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ২০০৯ -স্টিভেন কে কিউসি

১৫/১০/১০
যুগোশ্লাভিয়া এবং  রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনজীবী, যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ স্টিভেন  কিউসি বাংলাদেশের  যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের জন্য প্রণীতি আইন নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেছেন। বাংলায়  প্রবন্ধটির  পূর্ণ শিরোনাম হল ‘বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) (সংশোধন) এ্যাক্ট ২০০৯’ । এখানে প্রবন্ধটি   ভাষান্তর করে তুলে ধরা  হল। ভাষান্তর করেছেন মেহেদী হাসান।

সংবিধান হল আঠা যা দেশের জনসাধারণকে একসাথে বেঁধে রাখে।  নাগরিকের অধিকার এবং     দায়িত্ব বিষয়ে  এটি সরকার এবং জনগণের মধ্যে একটি চুক্তি যার ওপর ভিত্তি করে সরকার দেশ চালাবে।   সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া বিষয়ে   জাতিসংঘের  বিশেষ সহায়তা  ইউনিটির প্রতি  মহাসচিবের যে  দিক নির্দেশনা রয়েছে তাতেও এ বিষয়টি ফুটে উঠেছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের এ বিশেষ নির্দেশনায় বলা হয়েছে-
“একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রূপকল্প  রচনার ক্ষেত্রে সংবিধান প্রণয়ন বিশাল সুযোগ এনে দেয়। একটি রাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভের ক্ষেত্রে এর গভীর এবং সুদুরপ্রসারী ছাপ পড়ে।”

আন্তর্জাতিক যেসব মানবধিকার সংগঠন এবং অন্যান্য সংস্থা আছে তাদের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের এ  নির্দেশনা মেনে চলা হয়। জাতিসংঘের রুল অব ল ইউনিটের সহায়তায় ‘রুল অব ল কোঅর্ডিনেশন এন্ড রিসোর্স গ্রুপ’  নামে একটি সমন্বয়ক সংস্থা রয়েছে।  জাতিসংঘের উপমহাসচিব এর চেয়ারম্যান। মানবাধিকার রক্ষা বিষয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত যে সার্বজনীন নাগরিক সনদ রয়েছে রাষ্ট্রগুলো যেন তা মেনে চলে তা নিশ্চিত করা এ সংস্থার লক্ষ্য।  এছাড়া রাষ্ট্রগুলোকে এ নাগরিক অধকিার রক্ষায়ও সহয়তা করা হয় এ ইউনিটের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার  বিষয়ক যেসব  চুক্তি এবং ঘোষনা রয়েছে বিভিন্ন দেশের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার একটা প্রভাব আছে এবং এগুলোই হল ন্যায় বিচার  এবং সমঅধিকার  রক্ষা কবচ।

১৯৭২ সালের  সংবিধান
বাংলাদেশের  সংবিধানের একদম শুরুতে প্রস্তবনায় বলা হয়েছে“ আমরা আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক  পদ্ধতিতে এমন এক শোসনমুক্ত সমাজতান্ত্রিক  সমাজ প্রতিষ্ঠা-যেখানে সকল নাগরিকের জন্য  আইনের শাসন, মৌলিক  মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইব্”ে
সংবিধানের সাত ধারায় সংবিধানকে সবার উপরে স্থান দেয়া হয়েছে। গণতন্ত্র  এবং মানবাধিকার রক্ষার জাতীয় অঙ্গীকার ১১ ধারায় উল্লেখ আছে। ‘গণতন্ত্র   ও মানবাধিকার শিরোনামে’  সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে  বলা হয়েছে “প্রজাতন্ত্র  হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক  মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি  শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত  হইবে। এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হাইবে।”


সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৭ অনুচ্ছেদে ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’ শিরোনামে  মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে পুনরায় উল্লেখ করে বলা হয়েছে “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।”

২৬ অনুচ্ছেদে আরো বলা হয়েছে “এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামাঞ্জস্য  সকল  প্রচলিত আইন যতখানি অসামাঞ্জস্যপূর্ণ , এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হাইয়া যাইবে (১) । রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামাঞ্জস্যপূর্ণ কোন  আইন প্রনয়ন  করিবেন না  এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত  যতখানি অসামাঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হাইয়া যাইবে (২)।

তথাপি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে যে প্রথম সংশোধনী আনা হয়  তাতে  সকল নাগরিক সমান- সাম্যের এই   আকাঙ্খা   রহিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী ১৯৭৩
১৯৭৩ সালে সংবিধান সংশোধন  করে ৪৭ অনুচ্ছেদের ৩ উপধারা সংযোজন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে “ এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবাতা বিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক  আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা  বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক ফৌজদারীতে সোপর্দ কিংবা দণ্ডদান করিবার বিধান সংবলিত কোন আইন বা আইনের বিধান সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া  গণ্য হইবেনা  কিংবা কখনো বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবেনা।”

যুদ্ধাপরাধের বিচার যাতে কেউ উচ্চ আদালতে  চ্যালেঞ্জ করতে না পারে তার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে সংবিধানের এই ধারাটি সংযোজনের মাধ্যমে।

যেমন ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে  “এই সংবিধানে যাহা বলা হাইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের  (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়,  এই সংবিধানের  অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবেনা।”
এই ধারার ফলে   ট্রাইব্যুনালের বিচারে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি  তার নির্দোষীতা প্রমানে উচ্চ আদালতের কাছে বিচার চাইতে পারবেননা।

বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোকের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে  এখানে।  যে লোকগুলো এখন পর্যন্ত বিচারে দোষী প্রমানিত হয়নি কেবলমাত্র  অভিযোগ খাড়া করা হয়েছে  তাদের বিরুদ্ধে।

১৯৭৩ সালের সংবিধানে নতুনভাবে সংযোজিত ৪৭  ক (১) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে  সংবিধানে অন্যান্য যেসব মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে  নির্দিষ্ট কিছু

লোকের ক্ষেত্রে।  অথচ সংবিধানে বলা হয়েছে সকলেরই আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকার আছে এবং তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে আটক, আটককৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ, চার্জ গঠন প্রভৃতি ক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের যে  বিধান তা বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও বিচার ব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক। এই প্রথমবারের মত বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় ‘অসাম্য’  প্রবর্তন করা হল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন