শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৩

আসামীর নির্দোষ দাবির সুযোগ নেই১৯৭৩ সালের আইন ও ট্রাইব্যুনালে

মেহেদী হাসান
স্টিফেন জে র‌্যাপের চিঠিতে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধ বিচারের লক্ষ্যে প্রণীত ১৯৭৩ সালের আইন  এবং এ আইনের অধীনে গঠিত ট্রাইব্যুনালের কোনটিতেই আসামীর নিজেকে নিদোর্ষ  দাবির  সুযোগ নেই। সারা বিশ্বের সকল আন্তর্জাতিক আইন, ট্রাইব্যুনাল এবং আইনের  প্রতিষ্ঠিত বিধান হল কাউকে বিচারে দোষী সাব্যস্ত করার আগ পর্যন্ত আসামী নিজেকে নির্দোষ দাবী করতে পারবে। তাকে অপরাধী বলা যাবেনা। কিন্তু ১৯৭৩ সালের আইন এবং ট্রাইবুনালে এ বিষয়টি নির্দিষ্ট করে উল্লেখ নেই।

তাছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য সকল আদালতে ফৌজদারী মামলার ক্ষেত্রে  সাক্ষ্য আইন এবং ফৌজদারী দণ্ডবিধি  প্রয়োগযোগ্য হলেও ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে  এ দুটি প্রয়োগের বিধান রাখা হয়নি।

বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রনে  গত জানুয়ারি মাসে যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রকৃয়া বিষয়ে    জানার জন্য  ঢাকা সফরে আসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র‌্যাপ।   আইনমন্ত্রী, পরারাষ্ট্রমন্ত্রী, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ আইনজ্ঞ এবং বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকজনের সাথে আলোচনা শেষে ওয়াশিংটন ফিরে  একটি প্রতিবেদন তৈরি করেণ র‌্যাপ। বিভিন্ন সুপারিশ সংবলিত সে প্রতিবেদন গত মার্চ মাসে পররাষ্ট্র এবং আইনমন্ত্রীকে পাঠিয়েছেন র‌্যাপ।

র‌্যাপ তার চিঠিতে  বলেন, ইন্টারন্যাশনাল কনভেন্ট অন সিভিল এন্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর) এর ১৪ (২) ধারায় বলা  হয়েছে “বিচারে অপরাধী সাব্যস্ত  না হওয়া পর্যন্ত আইন অনুযায়ী যেকোন ফৌজদারী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজেকে নির্দোষ দাবী করতে পারবে” । কিন্তু ১৯৭৩ সালের আইনে এবং বর্তমানের ট্রাইব্যুানালে কোথাও অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য রায়ের আগে নিজেকে নির্দোষ দাবি বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কোন কিছু উল্লেখ করা নেই।

যেহেতু বাংলাদেশ আইসিসিআরপি  রুলস গ্রহণ করেছে এবং বাংলাদেশের প্রচলিত ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় আসামীর নির্দোষী দাবির ব্যবস্থা আছে তাই ট্রাইব্যুনালের  ক্ষেত্রে এ বিধান রাখার ব্যবস্থা করা উচিত। কম্পোডিয়ায় বিশেষ আদালতের জন্য যে মৌলিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় তাতেও এ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

আন্তর্জাতিক আদালতের উদাহরণ টেনে র‌্যাপ বলেন, ফৌজদারী  মামলার বিাচরের ক্ষেত্রে  আদালতের ওপর একটি দায়িত্ব থাকে ।  সেটি হল  আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে দূরতম কোন সন্দেহের অবকাশ থাকবেনা যে, সে অপরাধটি করেছে।

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত  ট্রাইব্যুনালের কার্যপ্রণালী বিধির ৫০ (১) এ বলা হয়েছে “অভিযোগ প্রমানের দায় আদালতের ওপর ন্যস্ত থাকবে” । কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য আদালতের কর্যিপ্রণালী



বিধিতে   এ বিষয়টি স্পষ্ট উল্লেখ থাকে যে, আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হতে হবে। বাংলাদেশের আদালতের ওপর বিষয়টি নির্দিষ্ট করে আরোপ করা হয়নি। উপরন্তু ট্রাইব্যুনালের ৫০ (২) ধারায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমানের বিষয়টি কয়েকটি ক্ষেত্রে বরং অব্যাহতি দেয়া হয়েছে আদালতকে।    আসামীকে নির্দোষ প্রমানের দায়িত্ব সয়ং আসামীর ওপর অর্পন করা হয়েছে।  আন্তজাতিক যেসব আইন এবং  ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত গঠিত হয়েছে সেখানে এ বিষয়টি ভালভাবে সুরাহা করা হয়েছে এবং তাতে আসামীকে নির্দোষী প্রমানের দায়িত্ব আসামীর ওপর ন্যাস্ত করা হয়নি। বরং আসামী পক্ষের দাবি মোতাবেক আদালতে  আসামী পক্ষকে নোটিশ দেয়  আসামী পক্ষের বক্তব, সাক্ষ্য প্রমান উপস্থাপন, প্রস্ততি  গ্রহণ  এবং সাক্ষীদের তালিকা আদালতে হাজির করার জন্য। হেগভিত্তিক  ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) এর ৭৯ ধারায়  বিষয়টি বিস্তারিত উল্লেখ আছে।

আসামীকে নির্দোষ প্রমান এবং আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে তার দোষ যাতে আদালত প্রমান করতে বাধ্য হয় তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সংবিধানে একটি ধারা সংযোজনের সুপারিশ করা হয়েছে র‌্যাপের চিঠিতে। আইসিসির ৭৯ ধারা এবং কম্বোডিয়ার বিশেষ আদালত এর  ইন্টারন্যাল রূসা  ২১ (ঘ)  মোতাবেক এ ধারা সংবিধানে সংযোজন করা যায়।


র‌্যাপ  বলেন, ৪০ বছর আগে ১৯৭১ সালে বর্বরতার জন্য দায়ী অনেকে  মারা গেছে। তাদেরকে কখনো  প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয়নি। যুদ্ধাপরাধ আদালতের প্রধান কৌশলীকে অনেক ধকল মোকাবেলা করতে হবে। তাছাড়া ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার বেশ সীমাবদ্ধ। ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী পাকিস্তান বা অন্য দেশে বসবাসরতদের বিচারের ক্ষমতা নেই ট্রাইব্যুনালের।

বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতে ফৌজদারী  অপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন এবং ফৌজদারী দণ্ডবিধি উভয়ই প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু ১৯৭৩ সালেল ২৩ ধারায় এর  একটিও রাখা হয়নি। ১৯৭৩ সালের ১৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, অপরাধ প্রমানের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল টেকনিক্যাল রুলস অব এভিডেন্স মেনে চলতে বাধ্য নয়। বরং পত্রিকা, ম্যাগাজিনে  প্রকাশিত ছবি, প্রতিবেদন, ফিল্ম এবং টেপ রেকর্ডে ধারাণকৃত বিষয়াদি এবং অন্যান্য নন টেকনিকাল  প্রকৃয়া আদালত প্রমান হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে।

র‌্যাপ  চিঠিতে লিখেছেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন  ট্রাইব্যুনালের বিধির সাথে এটির খুব বেশি পার্থক্য নেই। যেমন রুয়ান্ডার ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনালের ৮৯ ধারায় বলা হয়েছে “জাতীয় সাক্ষ্য আইন গ্রহণ করতে বাধ্য নয় ট্রাইব্যুনাল ।  সংবিধান, আইনের  প্রতিষ্ঠিত  নিয়ম এর আলোকে  এবং অপরাধ প্রমানের জন্য যেটি গ্রহণ করা উপযুক্ত বলে আদালত মনে করবে সেটি প্রমান হিসেবে গ্রহণ করবে। ”

তবে এসব আদালতের বিচারকরা এ ধারার প্রত্যেকটি শব্দের  ওপর হাজারো অর্থ এবং সিদ্ধান্ত আরোপ করেছেন এবং কম গরুত্বপূর্ণ কোন এভিডেন্স তারা গ্রহণ করেননি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন