শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৩

যুদ্ধাপরাধ বিচার// শুধু আইন নয় এবার সংবিধান সংশোধনেরও দাবি// কী আছে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান সংশোধনীতে?

২০/৫/১১


মেহেদী হাসান
যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের  বিচারের জন্য প্রণীত ১৯৭৩ সালের আইন  সংশোধনের সাথে এবার বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তনেরও দাবি জানানো হয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং আইনজ্ঞদের পক্ষ থেকে। যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে সর্বশেষ  গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পক্ষ থেকে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৭(ক) ধারা বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে।  এছাড়া যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ রাষ্ট্রদূত গত ২১ মার্চ বাংলাদেশের কাছে  সুপারিশসংবলিত যে দীর্ঘ চিঠি পাঠিয়েছেন তাতেও অপরাধের সংজ্ঞা নির্ধারণ, অভিযুক্তদের অধিকার রক্ষাসহ অনেকগুলো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধানে নতুন কিছু ধারা সংযোজনের দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায়  নিরপেক্ষ ন্যায়বিচার সম্ভব হবেনা বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তারা।

যুদ্ধাপরাধ বিচার বিষয়ে এ পর্যন্ত দেশী বিদেশী যেসব সংস্থা এবং  আইনজ্ঞ  মতামত প্রদান করেছেন তাদের মতে ১৯৭৩ সালের আইনে এমন কিছু ধারা আছে যা বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। সংবিধানে যে সর্বজনীন মৌলিক মানাবধিকারের ঘোষনা রয়েছে তা   ৭৩ সালের আইনে রহিত করা হয়েছে। সেজন্য ৭৩ সালের আইন পাশ এবং আইনটিকে সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে সংশোধনী আনতে হয়েছিল। ৪৭ (ক) ও ৪৭ (৩ ) নামে দুটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়।  সংবিধান এবং আইনবিশেষজ্ঞদের মতে  এই ধারা দুটি সয়ং সংবিধানের ৩৫ ধারা  এবং সংবিধানের  মূল চেতনার পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের চিঠিতে বলা হয়েছে ১৯৭৩ সালের আইন, আইনের বিধি বিধান এবং সংবিধানের  ৪৭ (ক) ধারা বাতিল না করলে  যুদ্ধাপরাধ বিচার নিরপেক্ষ এবং  আন্তর্জাতিক মানের হবেনা।

প্রথম সংবিধান সংশোধন ও যুদ্ধাপরাধ: যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের  লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ২০ জুলাই সংসদের একটি আইন পাশ হয়। এর নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার ক্রাইমস (ট্রাইবিউনালস ) এ্যাক্ট ১৯৭৩’। বাংলাদেশের সংবিধানের  প্রথম সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৩ সালের এ আইনটিকে পাশ করার জন্য। একটি আইন পাশ করতে সংবিধানে সংশোধনী আনার প্রয়োজন হয়েছিল কেন?  আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ স্টিভেন কে কিউসি, টবি ক্যাডম্যান,   বিচারপতি মাইকেল বেলফ,   বিশ্বে আইনজীবীদের সবচেয়ে বড় সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশন (আইবিএ), হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আরো বিভিন্ন  মানবাধিকার ও আইন বিষয়ক সংস্থা এবং আইনবিদদের মতে ১৯৭৩ সালের আইনে বাংলাদেশের সংবিধানে ঘোষিত কিছু মৌলিক অধিকার রহিত করা হয়েছে।  ৭৩ সালের  আইনে এমন কিছু ধারা আছে যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার সাথে সাংঘষিক। সেজন্য এ আইনকে যাতে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে এবং  আইনের অসাংবিধানিক  ধারাগুলোকে সুরক্ষার জন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান সংশোধনীতে ৪৭ অনুচ্ছেদের সাথে নতুন দুটি ধারা সংযোজন করা হয়। এ দুটি নতুন ধারা হল ৪৭ (ক) ও  ৪৭ (৩) । ৪৭ (৩) ধারায় বলা হয়েছে “ এই সংবিধানে যাহা বলা
হইয়াছে তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবাতা বিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক  আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা  বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক ফৌজদারীতে সোপর্দ কিংবা দণ্ডদান করিবার বিধান সংবলিত কোন
আইন বা আইনের বিধান সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া  গণ্য হইবেনা  কিংবা কখনো বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবেনা।”
 ৪৭ (ক) এ ১ ও ২ নামে দুটি উপধারা রয়েছে। ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে  “এই সংবিধানে যাহা বলা হাইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের  (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়,  এই সংবিধানের  অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবেনা।”

৪৭ ক (১) ধারায় বলা হয়েছে “যে বক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) ধারায় বর্ণিত কোন আআনি প্রযোজ্য হয়, সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ, ৩৫ অনুচ্ছেদের (১) ও (৩) দফা, এবং ৪৪ অনুচ্ছেদের অধীনে নিশ্চয়কৃত অধিকারসমূহ প্রযোজ্য ইবেনা। ”

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে  বলা হয়েছে “অপরাধের দায়যুক্ত কর্মসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবেনা  এবং অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দন্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবেনা।”
অর্থাৎ পূর্বে সংঘটিত অপরাধের জন্য পরে আইন করে শাস্তি দেয়া যাবেনা। সংবিধানের এই ৩৫ ধারাসহ  ৩১, ৩৩ এবং ৪৪ ধারায় বর্ণিত আরো কিছু মৌলিক  রহিত করা হয়েছে ১৯৭৩ সালের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে।

বিশেষজ্ঞদের মতে  সংবিধানে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদ সংযোজনের ফলে জুডিশিয়াল রিভিউর অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যেতে পারবেনা অভিযুক্ত ব্যক্তি।    বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বিষয়ে যে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করা হয়েছে তাতে এই  জুডিশিয়াল রিভিউকে সংবিধানের মূল কাঠামো হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর  এই জুৃডিশিয়াল রিভিউর বিধান রাখা হয়নি ১৯৭৩ সালের আইনে। এছাড়া সংবিধান সংশোধন করে ১৯৭৩ সালের আইনকে প্রটেকশন দেয়ার ফলে ট্রাইব্যুনাল গঠন, বিচারক নিয়োগ এবং রায় নিয়ে কোন আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবেনা।
যুক্তরাজ্য রানীর সাবেক কাউন্সেলর এবং  বিচারপতি মাইকেল জে বেলফ ১৯৭৩ সালের আইনে জুডিশিয়াল রিভিউ’র ক্ষমতা খর্ব করে  সংবিধানে যে প্রটেকশন দেয়া হয়েছে তাকে অসাংবিধানিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
যুগোশ্লাভিয়া এবং  রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনজীবী, যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ স্টিভেন  কিউসি  বলেন,  ১৯৭৩ সালের আইন এবং এ আইনকে সুরক্ষার জন্য যে সংবিধান সংশোধন করা হল তার মাধ্যমে এই প্রথমবারের মত বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় ‘অসাম্য’  প্রবর্তন করা হল।
১৯৭৩ সালের সংবিধানে নতুনভাবে সংযোজিত ৪৭  ক (১) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে  সংবিধানে অন্যান্য যেসব মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে  নির্দিষ্ট কিছু


লোকের ক্ষেত্রে। যুদ্ধাপরাধের বিচার যাতে কেউ উচ্চ আদালতে  চ্যালেঞ্জ করতে না পারে তার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে সংবিধানের এসব  ধারা সংযোজনের মাধ্যমে।
 ১৯৭৩ সালের সংবিধানে প্রথম যে সংশোধনী আনা হয়েছে তা যে বাংলাদেশের সযং ঐ সংবিধানেরই বিরোধী তা বোঝাতে স্টিভেন  ১৯৭২ সালের সংবিধানের  কয়েকটি ধারা উদাহরণ হিসেবে তুরে ধরেণ। যেমন , সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৭ অনুচ্ছেদে ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’ শিরোনামে  মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে পুনরায় উল্লেখ করে বলা হয়েছে “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।”
২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামাঞ্জস্য  সকল  প্রচলিত আইন যতখানি অসামাঞ্জস্যপূর্ণ , এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হাইয়া যাইবে (১) । রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামাঞ্জস্যপূর্ণ কোন  আইন প্রনয়ন  করিবেন না  এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত  যতখানি অসামাঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হাইয়া যাইবে (২)।
স্টিভেন বলেন, তথাপি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে যে প্রথম সংশোধনী আনা হয়  তাতে  সকল নাগরিক সমান- সাম্যের এই   আকাঙ্খা   রহিত করা হয়েছে।






এসব কারনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আরো অনেক সংস্থা এবং ব্যক্তিবর্গ  যুদ্ধাপরাধ বিচার আইনকে সুরক্ষার জন্য  ১৯৭৩ সালে  সংবিধানে যে ৪৭ (ক)  এবং ৪৭ (৩) ধারা সংযোজন করা হয় তা বাতিলের দাবি জানান।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ রাষ্ট্রদূত  স্টিফেন জে র‌্যাপ তার চিঠিতে বিচারকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ  এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার লক্ষ্যে সংবিধানে বেশ কিছু নতুন ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করেছেন।  র‌্যাপের চিঠিতে  বলা হয় বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের আইনে অপরাধের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা এবং ব্যাখা নেই। তাই আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে  অপরাধকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করার  নিশ্চয়তা বিধানের জন্যও সংবিধানে ধারা সংযুক্ত করা উচিত।   গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ  এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কাউকে দোষী সাব্যস্ত  করতে হলে  এসব অপরাধের  আন্তর্জাতিক স্বীকৃত  এবং গ্রহণযোগ্য যে সংজ্ঞা রয়েছে সে অনুযায়ী  সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে হবে। স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে হবে। তিনি বলেন,  আইসিসিপিআরসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যেসব আইনী সুরক্ষা এবং অধিকার  প্রদান করা হয়েছে সেগুলো যাতে অভিযুক্ত ব্যাক্তিরা পেতে পারেন তার নিশ্চয়তা বিধান করে সংবিধানে একটি ধারা সংযোজন করা উচিত। ‘অভিযুক্তর অধিকার রক্ষা করতে হবে’ শিরোনামে র‌্যাপ তার চিঠিতে বলেন, কোন ব্যক্তি যত বড় অপরাধের অভিযোগেই অভিযুক্ত হোকনা কেন অভিযুক্ত ব্যক্তির অধকার  রক্ষা করতে হবে। এভাবে আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে  তিনি সংবিধানে নতুন ধারা সংযোজনের প্রস্তাব    করেছেন।

৭৩ সালের আইনের সংশোধন: ২০০৯ সালে ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ  আইনের সংশোধন করা হয়। নতুন নাম হয় ‘দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইবিউনালস) (এমেন্ডমেন্ট) এ্যাক্ট ২০০৯’।  ১৯৭৩ সালে  এ আইন প্রণয়ন করা হয় ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তার বিচারের জন্য। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লীতে  ভারত-পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিদেশীয় চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষমা করা হয়। ফলে এ আইন এতদিন কোন কাজে আসেনি। আইনটি  প্রণয়ন করা হয়  সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী বা              সহায়ক বাহিনীর সদস্যদের বিচারের জন্য।   ২০০৯ সালে আইনটি সংশোধন  করে ‘একক ব্যক্তি বা ব্যাক্তিগোষ্ঠীকেও  বিচারের আওতায় আনা যাবে’ কথাগুলো যোগ করা হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন