মেহেদী হাসান
যুদ্ধারাধ তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র্যাপ বলেছেন, এটি কোন আন্তর্জাতিক আদালত নয়। বাংলাদেশের আইনের অধীনে এ আদালত স্থাপিত হয়েছে ।
স্টিফেন বলেন, বিশেষ কোন রাজনৈতিক বিবেচনায় গণহত্যার বিচার হতে পারেনা । বিশ্বের সমস্ত আন্তর্জাতিক আদালতে আন্তর্জাতিক আইনজীবী অংশ নিয়ে থাকে। বাংলাদেশেও যুদ্ধাপরাধী বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক আদালতে বিদেশের আইনজীবীদের অংশ নিতে দেয়া উচিত।
স্টিফেন জে র্যাপ বলেছেন, এ বিষয়ে তিনি বাংলাদেশের আইনমন্ত্রীকে প্রস্তাব পাঠাবেন। তাছাড়া বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচার দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে হওয়া উচিত বলে মনে করেণ তিনি।
সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে দৈনিক নিউ এজ পত্রিকার সাংবাদিক ডেভিড বার্গমানের সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ অভিমত ব্যক্ত করেণ স্টিফেন জে র্যাপ। গত ২১ জানুয়ারি তার পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি নিউএজ পত্রিকার সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন একস্ট্রায় প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া স্টিফেনের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক একটি প্রতিবেদন একই দিন নিউ্েজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উক্ত প্রতিবেদন এবং সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে দৈনিক নয়া দিগন্তের পাঠকদের জন্য এ প্রতিবেদন তৈরি করা হল।
স্টিফেন জে র্যপ বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যার মূলনীতি নির্ধারণ বিষয়ে ১৯৪৮ সালে যে খসড়া তৈরি করা হয় তাতে ‘রাজনৈতিক গ্রুপ’ কে ধ্বংস করা গণহত্যার সংজ্ঞার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে গণহত্যার সংজ্ঞায় জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ, ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার পাশাপাশি ‘রাজনৈতিক গ্রুপ’ কে ধ্বংস করার বিষয়টিও সম্প্রতি গণহত্যার সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কোন রাজনৈতিক গ্রুপকে আংশিক বা পুরোপুরিভাবে কেউ ধ্বংস করতে চেয়েছিল শুধুমাত্র এই অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে কোন এক বা একাধিক ব্যক্তির গণহত্যার দায়ে বিচার করা যায়না অথচ ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইনে সম্প্রতি এমন একটি ধারা যুক্ত হয়েছে। ১৯৭৩ সালের আইনের ৩ (২) (সি) ধারায় গনহত্যার সজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে কোন জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ, ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং
রাজনৈতিক গ্রুপকে আংশিক বা পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ পরিচালনা করা।
র্যাপ বলেন, “গণহত্যার দায়ে যদি কারো বিচার করতে হয় তবে ‘রাজনৈতিক কোন গ্রুপকে’ ধ্বংস করার অপরাধকে গণহত্যার অভিযোগ থেকে বাদ দিতে হবে। কারণ ১৯৪৮ সালে ‘গণহত্যা’ ও মূলনীতি নির্ধারণের জন্য যে খসড়া তৈরি করা হয়েছিল তাতে ‘রাজনৈতিক গ্রুপ’কে ধ্বংস করার বিষয়টি গণহত্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হবে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হয়। এবং এ বিষয়ে পওে আর কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।”
“সুতরাং বিশেষ কোন রাজনৈতিক বিবেচনায় গণহত্যার বিচার হতে পারেনা। কোন একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় যেমন ‘হিন্দু’ দের যদি কেউ পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের লক্ষ্যে পরিণত করে তবে তা গণহত্যার মধ্যে পড়বে। তার মানে হল, আন্তর্জাতিক আইনে কোন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গনহত্যার দায়ে বিচার করা যাবেনা এই অভিযোগে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিল বলে বা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিল বলে উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি তাদের ধ্বংস করতে চেয়েছিল। ”
র্যাপ বলেন আমি আমার পরিচিত সব আন্তর্জাতিক আদালতে আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের অংশ নিতে দেখেছি। এমনকি রুয়ান্ড যুদ্ধাপরাধ বিচার আদালতেও আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের অংশ নিতে দেয়া হয়েছে যে রুয়ান্ডার আদালতে সাধারণত বিদেশেী আইনজীবীরা অংশ নিতে পারেনা।
বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাদ বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষন করতে স্টিফেন জে র্যাপ গত ১০ থেকে ১৩ জানুয়ারি ঢাকা সফর করেন। তিনি সিয়েরা লিওনে যুদ্ধাপরাধ বিচারে একজন মূখ্য আইনজীবীর ভূমিক পালন করেণ।
নিউএজের সাথে সাক্ষাৎকারে স্টিফেন বলেন, অভিযুক্তদের অধিকার নিশ্চিত করতে ১৯৭৩ সালের আইনে বেশি কিছু বিষয় অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
১৯৭৩ সালের আইনের বিধিমালার সংশোধন করে একে আন্তর্জাতিক মানে উন্নয়ত করার জন্য স্টিফেন বেশ কিছু মতামত তুলে ধরেণ। সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান তাকে প্রশ্ন করেণ বাংলাদেশের সরকার যদি এসব পরিবর্তন না আনে তাহলে কি হবে। এর জবাবে স্টিফেন বলেন, এটা আমেরিকার কোন আদালত নয়। এটা কোন আন্তর্জাতিক আদালত নয়। এটা বাংলাদেশের আইনের মাধ্যমে স্থাপতি একটি আদালত । বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। বিষয় হল আমরা যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের অনেকে বন্ধু যেটা চায় তা হল বিচার প্রকৃয়া এমন হওয়া উচিত যাতে বাংলাদেশ এবং বিশ্ব সবেচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ভবিষ্যতে কোন অপরাধ ঠেকাতে এবং মানুষকে অপরাধের স্বীকার হওয়া থেকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রয়োগ করা উচিত যাতে বাংলাদেশের এ বিচার বিশ্বে একটি মডেল হতে পারে। সেজন্য বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে আইনের বিধিমালায় বেশ কিছু সংশোধনী আনতে হবে । সেজন্য ১৯৭৩ সালের আইনের পরিবর্তন দরকার নেই। বিধি সংশোধনের সুযোগ থাকা উচিত।
যে সময়ে এ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তখন বাংলাদেশের আইনের অধীনে ঐ অপরাধ করা হয়নি। সুতরাং বাংলাদেশের আইনে কি অভিযুক্তদের বিচার করা যায়? এ প্রশ্নের জবাবে স্টিফেন বলেন, আমি বিষয়ে অনেক কথা শুনেছি। এগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ। এবং ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ঠিক করেছে যে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে তাদের বিচার করা হবে। বাংলাদেশের আইনের অধীনে নয়। আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর কোন দেশ চাইলে আইন তৈরি করে তাদের বিচার করতে পারে। বাংলাদেশ চাইলে ২০১১ সালে একটি আইন তৈরি করতে ।
দ্বিতীয় বিষয়টি হল দেশীয় আইন। আমি শুনেছি ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইনকে সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশে প্রথমবারের মত সংবিধানে সংশোধনী আনতে হয়েছিল। আমি এ বিষয়ে কোন মতামত দিতে চাইনা।
স্টিফেন জে র্যাপ বলেন, এটা যদি একটি আন্তর্জাতিক আদালত হয় তবে এখানে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হবে। কিন্তু যেহেতু এ আদালতটি বাংলাদেশে অবস্থিত এবং বাংলাদেশ যেহেতু আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ করছে তাই এ আদালতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ করতে হবে। যেহেতু অতীতের অপরাধের বিচার হচ্ছে তাই প্রাথমিকভাবে অভিযুক্তদের এ বিষয়ে আইনী মোকাবেলার সুযোগ পাবেন। আমার মত হল বাংলাদেশের অন্যান্য অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত পক্ষ যেভাবে আইনী মোকাবেলার সুযোগ পায় এক্ষেত্রেও যেমন তাদের সে সুযোগ দেয়া হয়।
ডেভিড বার্গম্যান: অভিযুক্তদেরকে তাদের আইনজীবীদের সামনে কি প্রশ্ন করা উচিত?
স্টিফেন: অভিযুক্তদের তাদের আইনজীবীদের সামনেই জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যবস্থা থাকা উচিত আইনে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা বিষয়ক যে আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিসিপিআর) রয়েছে তার ১৪ নং ধারায় যেসব অধিকার প্রদান করা আছে সে অনুযায়ী হওয়া উচিত।
ডেভিড বার্গম্যান: কেস তৈরির জন্য অভিযুক্তদের কতদিন সময় দেয়া উচিত?
স্টিফেন: এটি তিন সিপ্তাহ হবেনা। আইসিসিপিআর অনুযায়ী কেসের জটিলতা অনুযায়ী এটি অনেক সপ্তাহ হতে হবে।
ডেভিড বার্গম্যান: বিদেশী আইনজীবীদের অংশ নিতে দেয়া উচিত কিনা?
স্টিফেন: আমি যত আন্তর্জাতিক আদালত দেখেছি তার সবগুলোতেই বিদেশী আইনজীবীরা অংশ নিয়েছেন। আমি আশা করব আদালত বিদেশী আইনজীবীদের এ বিচার কার্যক্রমে অংশ নিতে দেবে। বার কাউন্সিলও এ বিষয়টি ভেবে দেখবে বলে আশা করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন