শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৩

যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রী বিভিন্ন সময় যা বলেছেন

মেহেদী হাসান
যুদ্ধাপরাধ ও  মানবতার বিরুদ্ধে অপররাধ নিয়ে যেমন বিভ্রান্তি আছে  তেমনি বিভ্রান্তি চলছে বিচারের আগেই অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত  করে কাউকে কাউকে  ফাঁসিতে ঝোলানোর  দাবি নিয়ে। আবার  তদন্তের আগেই তালিকা প্রকাশ করে অনেককে  যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত  করে নানাভাবে হেনস্থা  করা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিচারের উদ্দেশ্য নিয়ে।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার সফিক আহমেদ বলেছেন, বিচারের আগে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবেনা। সন্দেহভাজদের গ্রেফতারের বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তা ও আদালতের ওপর নির্ভরশীল। তালিকা প্রকাশ বিষয়েও তার কিছু জানা নেই। অন্যদিকে  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন নিজামী-মুজাহিদসহ অনেককে  গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন।  আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন নিজামী মুজাহিদকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করে ফাঁসিতে ঝূলানো হবে।

২৭ মার্চ উত্তরায় একটি অনুষ্ঠানে  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছেন, নিজামী মুজাহিদসহ ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে লালমনিরহাটসহ যেসব  স্থানে  ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে তার প্রেক্ষিতে তাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতারে আর নতুন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নির্দেশ দেয়ার   প্রয়োজন নেই।
পয়লা  মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়ানের  তিন সদস্যের এক  প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকে আইনমন্ত্রী বলেছেন তদন্তের পরই যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। তদন্তের পরই জানা যাবে কারা যুদ্ধাপরাধী এবং কাদের বিচার করা হবে। যুদ্ধাপরাধীদের চূড়ান্ত তালিকাও এসময় প্রকাশ করা হবে। তদন্তের আগেই সরকারের যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা  প্রকাশ বিষয়ে তিনি বলেন এ বিষয়ে আমি অজ্ঞ। আমার কিছু জানা নেই।  সরকারের কারো সাথে এ নিয়ে আমার  আলোচনাও হয়নি।  অথচ  দেশের সকল থানায় যুদ্ধপারধীদের তালিকা পৌছনো হয়েছে  ইতোমধ্যে।
২০ মার্চ মানবাধিকার সংস্থা অধিকার আয়োজিত একটি বৈঠকে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িতদের  গ্রেফতার বিষয়ে বলেন, তদন্ত কাজ শুরু হলে পর তদন্ত কর্মকর্তাই ঠিক করবে এ বিষয়টি। তদন্তের স্বার্থে কাউকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করার  প্রয়োজন হলে তারা   ডাকবে। এ  জাতীয় বিধান  তদন্ত প্রক্রিয়ায় থাকবে।  

১৯ মার্চ রাজশাহীর গোদাগড়িতে মাটিকাটা কলেজ মাঠে  আয়োজিত এক সমাবেশে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, নিজামী-মুজাহিদদের মত যুদ্ধাপরাধীদের এদেশের মাটিতে বিচার করে ফােিসত ঝুালানো হবে।

বিচারের  আগেই বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, বিচারের আগে কাউকে অপরাধী বা অভিযুক্ত বলা ঠিক নয়। তদন্তই বলে দেবে কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে এবং কার বিরুদ্ধে নেই।
অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আর্ন্তজাতিক চাপ বিষয়েও সরকারের  মন্ত্রীরা পরষ্পর বিরোধী বক্তব্য রাখছেন।
গত বছর ১৯ আগস্ট জাতীয় প্রেসকাবে আয়োজিত ‘জঙ্গীবাদ ও বর্তমান বাংলাদেশ: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক বৈঠকে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাঁধা আসছে। একটা মহল আমাদের চাপ দিচ্ছে। সরকার এ বিষয়ে সজাগ আছে।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের  এ বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের ওপর কোন চাপ নেই। তবে বিচার যাতে সুষ্ঠু, আন্তর্জাতিক মানসম্মত এবং নিরপেক্ষ হয় সে বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থার তাগিদ রয়েছে। গত বছর ৩০ আগস্ট আইনমন্ত্রী তার দফতরে সাংবাদিকদের একথা বলেন। ২০ মার্চ মানবাধিকার সংস্থা অধিকার আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আছে। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিষয় এবং  এ বিষয়ে কেউ বিরোধীতা করবেনা।

২০ এপ্রিল আইনমন্ত্রী তার দফতরে সাংবাদিকদের বলেন,  সরকার শুধু চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনবে।  হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেনা । ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর যারা দোসর ছিল সেই সহযোগী বাহিনীর বিচার করা হবে। হানাদার বাহিনীকে যারা সহযোগীতা করেছে, হত্যা, ধর্ষণ লুটপাট করেছে তাদের মূল নায়কদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

আইনমন্ত্রী বলছেন যুদ্ধাপরাধ নয় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার হবে। অন্যদিকে   আইন  মন্ত্রণালয়ের প্রতিন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম  আগাগোড়া বলে আসছেন  যুদ্ধাপরাধের কথা। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রী এবং কর্মকর্তারাও বলছেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা। আওয়ামী লীগের নির্বাচিনী ইশতেহারেও বলা আছে যুদ্ধাপরাধের কথা। গত বছর ২৯ জানুয়ারি সংসদে যে প্রস্তাব পাশ হয় তাতেও যুদ্ধপরাধ শব্দটি আছে মানবাতর বিরুদ্ধে অপরাধ নয়। যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক  আহমেদ দেশে ফিরে যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেণ। ১৮ মার্চ    যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক এক বৈঠকে যুদ্ধাপরাধের  বদলে  মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের সিদ্ধান্ত হয়। ঐ বৈঠকে আইন  মন্ত্রী ব্যারিস্টার সফিক আহমেদ ছাড়াও আইনপ্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামও উপস্থিতি ছিলেন। বৈঠকের পর থেকে আইনমন্ত্রী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলা শুরু করলেও পরের দিনই একটি জনসভায় কামরুল ইসলাম যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গেলে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী উচ্চ পদস্থ জেনারেল যারা  পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তাদের বিচার করার বিষয়টি সামনে আসে। সেজন্য সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বদলে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের বিষয়টি সামনে এনেছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন