২৭/১২/২০১২
নতুন করে বিচার শুরুর আবেদনের ওপর আসামী পক্ষের যুক্তি উপস্থান অব্যাহত রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ । আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আজ শুনানীর সময় বলেন বিচারপতি নিজামুল হক এবং ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিন তাদের ১৭ ঘন্টার স্কাইপ সংলাপের সময় ২২ জন ব্যাক্তির নাম বলেছেন। এর মধ্যে সাতজন বিচার বিভাগের, ছয়জন প্রসিকিউটর (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী), চারজন জন নির্বাহী বিভাগের যথা মন্ত্রী এবং পাঁচজন অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে স্কাইপ সংলাপ ফাঁস হয়েছে কিন্তু এ সংলাপে তাদের জড়িয়ে যেসব কথাবার্তা উল্লেখ করা হয়েছে তার কোন কিছুই তাদের কেউই অস্বীকার করেনননি। কেউ কোন প্রশ্ন তোলেননি এ নিয়ে। কাজেই এটা যে সত্য তার প্রমান এটি।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক নতুন করে বিচার শুরুর দাবি জানিয়ে বলেন, এই কোর্ট চার্জ গঠনের আদেশ দিয়েছেন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। কাজেই সে আদেশ বাদ দেয়ার ক্ষমতাও তাদের রয়েছে। কারণ অভিযোগ আমলে নেয়া এবং চার্জ গঠন আদেশ দুটির ক্ষেত্রেই প্রতারনা ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, পুনরায় বিচার শুরুর পূর্ণ এখতিয়ার এ কোর্টের আছে। এটাই সোজা কথা। এটা কোর্টের সহজাত ক্ষমতা। ন্যায় বিচারের স্বার্থে তাদের শুরু থেকে এসব মামলা আবার শোনা দরকার।
আজ ১২টার দিকে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক শুনানী শেষ করেন। এরপর মিজানুল ইসলাম মাওলানা সাঈদীর বিচার পুনরায় দাবি করে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন। মিজানুল ইসলাম শুনানীর সময় স্কাইপ সংলাপ নিয়ে ট্রাইব্যুনালে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়।
স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পুনরায় বিচার শুরুর আবেদন করা হয়েছে আসামী পক্ষ থেকে। তবে তিনটি আবেদনই প্রায় এক হওয়ায় সবগুলো মিলিয়ে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক তার আইনী বক্তব্য পেশ করেছেন। এরপর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার পুনরায় শুরুর ওপর শুনানী শুরু করেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম।
মিজানুল ইসলামের যুক্তি: মিজানুল ইসলাম বলেন, গত ৬ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিচার কাজ শেষ হলে রায়ের তারিখ নির্ধারনের বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়। সেদিন বিচারপতি নিজামুল হক আল্লহর নামে শপথ করে বলেছিলেন তিনি ডানে বামে কোনদিন তাকাবেননা। তারা যেসব সাক্ষ্য প্রমান পেয়েছেন তার ওপর ভিত্তি করে রায় দেবেন।
কিন্তু তার আল্লাহর নামে এই শপথের সাথে মিল পাওয়া যায়না স্কাইপি সংলাপ এবং ইমেইল ডকুমেন্টের সাথে। আল্লার নামে শপথ নিয়ে তিনি গোপনে এসব কাজ করলেন বিচারের নামে। এছাড়া ১৯৯২ সালে জাহানা ইমামের নেতৃত্বে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত গণ তদন্ত কমিশনে জড়িত থাকার অভিযোগে বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগের দাবি করেছিলাম আমরা। সে বিষয়ক একটি আদেশে তিনি শপথ নিয়ে বলেছিলেন তিনি শপথ ভঙ্গ করবেননা। তার সেদিনের শপথও ছিল একটি প্রতারনা। এরপরেও তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন বারবার।
মিজানুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এটিএম ফজলে কবিরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মাওলানা সাঈদীর চার্জ গঠনের আদেশের সময় আপনি এখানে সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া একেএম জহির আহমেদও তখন ছিলেন। আমরা জানিনা বিচারপতি নিজামুল হক চার্জ গঠনের আদেশ বিষয়ে আপনার সাথে আলোচনা করেছিলেন কি-না। যদি না করে থাকেন তাহলে আমাদের নিবেদন আপনি এ বিষয়টি এ কে এম জহির আহমেদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারেন বিচারপতি নিজামুল হক চার্জ গঠন বিষয়ে তার সাথেও আলোচনা করেছিলেন কিনা। ইচ্ছা করলে তাকে ওপেন কোর্টে জিজ্ঞাসা করতে পারেন বা ক্যামেরা ট্রায়ালেল মাধ্যমেও করতে পারেন।
মিজানুল ইসলাম বলেন, আমাদের বিশ্বাস তিনি মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যে চার্জ গঠনের আদেশ দিয়েছেন তা অন্যের নির্দেশ মত লিখে এখানে পড়ে শুনিয়েছেন মাত্র।
মিজানুল ইসলাম বলেন, এই ট্রাইব্যুনালে বিচার চলাকলে ২টি রুল পরিবর্তন আনা হয়েছে। রুল পরিবর্তনের বিষয়টিও বেলজিয়াম থেকে এসেছে। অভিযোগ আমলে নেয়া, চার্জ গঠন আদেশ সবই তার কাছ থেকে এসেছে। তারপরও বলা হচ্ছে এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। এসময় এটর্নি জেনারেল মিজানুল ইসলামের কোন কোন বক্তব্যে আপত্তি জানালে মিজানুল ইসলাম বলেন, তাহলে তো আমাদের শুনানী করারই দরকার নেই। আমরা চলে যাই আর ওনারা বলুক সব মিথ্যা, সব আবেদন বাতিল হয়ে যাক। সেটাই তো ওনারা চান।
মিজানুল ইসলাম স্কাইপ সংলাপ তুলে ধরে বলেন, ট্রাইব্যুনালে একজন এমিকাস কিউরি নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হল। সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী শাহদিন মালিকের নাম উঠে আসে তাদের স্কাইপ আলোচনায়। বিচারপতি নিজামুল হক বললেন তিনি যদি এসে রাষ্ট্রপক্ষের বিপক্ষে বলে যান? সেজন্য জিয়াউদ্দিন সাহেব বললেন তার সাথে একটা গেপান পরামর্শ করেন। এর মানে হল বিচারপতি নিজামুল হক আসামীর বিপক্ষে মতামত চাওয়ার জন্য এমিকাস কিউরি নিয়োগ দিতে চেয়েছেন। তিনি আসামীকে ফাঁসিয়ে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তিনি এমন একজনকে নিয়োগ দিতে চেয়েছেন যার কাছ থেকে এ নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। যিনি আসামীর বিপক্ষে বলবেন। রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে কিছু বলবেননা।
মিজানুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ জমা দিয়েছে এমন ২০০টিরও বেশি প্রদর্শনীর ওপর আমাদের জেরা করতে দেয়া হয়নি। আমাদের ওপর গিলোটিন প্রয়োগ করা হয়েছে। আর এটিও তিনি করেছেন ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের নির্দেশে।
স্কাইপ সংলাপ তুলে ধরে মিজানুল ইসলাম বলেন, আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি নিজামুল হককে বলেছেন তিনডা রায় দিয়া দেন আপনাকে তারপর এখানে নিয়া আসব। সত্যি তাকে নিয়ে যাওয়া হবে কি-না এবং প্রমোশন নিশ্চিত হবে কিনা এসব নিয়ে আলোচনা করেছেন বিচারপতি নিজামুল হক। তিনি আসামীদের ফাঁসিয়ে দেয়ার বিনিময়ে প্রমোশন পাওয়ার জন্য লালায়িত ছিলেন। তিনি ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনকে বলেছেন যা করার করেন আমার প্রমোশন পেলেই হল। যখন কোন বিচারপতি প্রলোভনে পড়ে, অন্যের নিদেশে বিচার কাজ পরিচালনা করেন তখন আর সেখানে ন্যায় বিচার হতে পারেনা। যে বিচারপতি শপথ ভঙ্গ করে বিচার কাজ পরিচালনা করেছেন তার রেখে যাওয়া জিনিসের ওপর ভিত্তি করে বিচার কাজ চালিয়ে নেয়া যায়না। তার যদি আদেশ এবং রায় লেখার যোগ্যতা নাই থাকে তাহলে কেন জজ হলেন তিনি।
মিজানুল ইসলাম বলেন, বিচারপতি নিজামুল হককে একটি ছুরি ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে জবাই করার করার জন্য। কিন্তু তিনি ছুরিটি চালাতে পারেননি।
তিনি বলেন, ১৭ ঘন্টার কথোপকথন পাওয়া গেছে। কিন্তু যা পাওয়া যায়নি তার মধ্যে তিনি কি কথাবার্তা বলেছেন তাই আল্লাহই ভাল জানেন।
মিজানুল ইসলাম বলেন বিদেশে পলাতক দুজনকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার বিষয়ে নিজামুল হক বলেছেন অসুবিধা নেই আমি তাদের ৬০ বছর করে জেল দিয়ে দেব । এর মাধ্যমে তিনি মামলা হওয়ার আগেই জাজমেন্ট দিয়ে দিয়েছেন। বিচারের নামে অবিচার আর কাকে বলে।
মিজানুল ইসলাম বলেন, সারা বিশ্বে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় আসামীর কথা বলার সুযোগ থাকে। আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের সময় তিনি দুয়েক মিনিট কথা বলেছিলেন। তখন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলা হয়েছিল আপনি পরে আইন অনুযায়ী কথা বলার সময় পাবেন। কিন্তু তাকে আর পরে কথা বলতে দেয়া হয়নি। আমরা যখন কথা বলার সুযোগ চাইলাম তখন বলা হল তিনি কথা বলে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। মিজানুল ইসলাম বলেন, এর মাধ্যমে তিনি শুধু আইনই ভঙ্গ করলেনা বরং প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করলেন। তিনি যদি বলতেন আপনি কথা বলার সুযোগই পাবেননা সেটা ভিন্ন কথা ছিল। কিন্তু আগে বলা হল পরে কথা বলতে পারবেন। আর পরে বলা হল কথা বলে ফেলেছেন।
স্কাইপ নিয়ে উত্তেজনা : মিজানুল ইসলাম বলেন ন্যায় বিচারের স্বার্থে আপনাদের আধাঘন্টা হলেও এটি ট্রাইব্যুনালে শোনা দরকার। তাহলে বুঝতে পারবেন কিভাবে বিচারের নামে জালিয়াতি হয়েছে। প্রয়োজনে সাংবাদিকদের বাইরে বের করে দিয়ে আপনারা এখানে শুনুন আমাদের সামনে। এটি আমাদের আপনাদের এবং ন্যায় বিচারের সবার স্বার্থে শোনা দরকার।
তখন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, হ্যা সবার স্বার্থ আছে আর ৩০ লাখ মানুষের কোন স্বার্থ নাই।
মিজানুল ইসলাম তখন ক্ষোভের সাথে বলেন, এটি বলবেননা। মুক্তিযুদ্ধ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের একচ্ছত্র বিষয় নয়। এটি এদেশের গনমানুষের বিষয়। আমার পরিবারের লোক শহীদ হয়েছে। শোক কি তা আমরা জানি। মুক্তিযুদ্ধ কি স্কাইপ সংলাপের জন্য, ন্যায় বিচারের কবর রচনার জন্য, দুনীতির জন্য হয়েছিল? মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাার জন্য, ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য। বিচারের নামে অবিচার আর সাজানো নাটক মঞ্চস্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। নিজের স্বার্থে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের সম্মানের জন্য, মুক্তিযুদ্ধকে সম্মানের জন্য ন্যায় বিচার করা উচিত।
এসময় প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, কারা নাটক করে তা আমরা দেখাব। আপনারা নাটক করেছেন। স্কাইপ সংলাপ আপনারা বানিয়েছেন।
একথা বলার সাথে সাথে আসামী পক্ষের আইনজীবীরা উচ্চস্বরে এর প্রতিবাদ করতে থাকেন। এসময় কোর্টে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েন। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির মিজানুল ইসলামকে বলেন, আপনি যুক্তি পেশ অব্যাহত রাখেন। তখন পরিস্থিতি শান্ত হয়।
যুক্তি উপস্থাপনের সময় আসামী পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাবেক সহকারি এটর্নি জেনারেল গিয়সউদ্দিন আহমেদ মিঠূ, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিক, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক, অ্যাডভোকেট শিশির মো: মনির ।
রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু প্রমুখ।
ট্রাইব্যুনাল -১ চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি আনোয়ারুল হক শুনানী গ্রহণ করেন।
নতুন করে বিচার শুরুর আবেদনের ওপর আসামী পক্ষের যুক্তি উপস্থান অব্যাহত রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ । আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আজ শুনানীর সময় বলেন বিচারপতি নিজামুল হক এবং ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিন তাদের ১৭ ঘন্টার স্কাইপ সংলাপের সময় ২২ জন ব্যাক্তির নাম বলেছেন। এর মধ্যে সাতজন বিচার বিভাগের, ছয়জন প্রসিকিউটর (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী), চারজন জন নির্বাহী বিভাগের যথা মন্ত্রী এবং পাঁচজন অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে স্কাইপ সংলাপ ফাঁস হয়েছে কিন্তু এ সংলাপে তাদের জড়িয়ে যেসব কথাবার্তা উল্লেখ করা হয়েছে তার কোন কিছুই তাদের কেউই অস্বীকার করেনননি। কেউ কোন প্রশ্ন তোলেননি এ নিয়ে। কাজেই এটা যে সত্য তার প্রমান এটি।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক নতুন করে বিচার শুরুর দাবি জানিয়ে বলেন, এই কোর্ট চার্জ গঠনের আদেশ দিয়েছেন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। কাজেই সে আদেশ বাদ দেয়ার ক্ষমতাও তাদের রয়েছে। কারণ অভিযোগ আমলে নেয়া এবং চার্জ গঠন আদেশ দুটির ক্ষেত্রেই প্রতারনা ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, পুনরায় বিচার শুরুর পূর্ণ এখতিয়ার এ কোর্টের আছে। এটাই সোজা কথা। এটা কোর্টের সহজাত ক্ষমতা। ন্যায় বিচারের স্বার্থে তাদের শুরু থেকে এসব মামলা আবার শোনা দরকার।
আজ ১২টার দিকে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক শুনানী শেষ করেন। এরপর মিজানুল ইসলাম মাওলানা সাঈদীর বিচার পুনরায় দাবি করে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন। মিজানুল ইসলাম শুনানীর সময় স্কাইপ সংলাপ নিয়ে ট্রাইব্যুনালে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়।
স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পুনরায় বিচার শুরুর আবেদন করা হয়েছে আসামী পক্ষ থেকে। তবে তিনটি আবেদনই প্রায় এক হওয়ায় সবগুলো মিলিয়ে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক তার আইনী বক্তব্য পেশ করেছেন। এরপর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার পুনরায় শুরুর ওপর শুনানী শুরু করেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম।
মিজানুল ইসলামের যুক্তি: মিজানুল ইসলাম বলেন, গত ৬ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিচার কাজ শেষ হলে রায়ের তারিখ নির্ধারনের বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়। সেদিন বিচারপতি নিজামুল হক আল্লহর নামে শপথ করে বলেছিলেন তিনি ডানে বামে কোনদিন তাকাবেননা। তারা যেসব সাক্ষ্য প্রমান পেয়েছেন তার ওপর ভিত্তি করে রায় দেবেন।
কিন্তু তার আল্লাহর নামে এই শপথের সাথে মিল পাওয়া যায়না স্কাইপি সংলাপ এবং ইমেইল ডকুমেন্টের সাথে। আল্লার নামে শপথ নিয়ে তিনি গোপনে এসব কাজ করলেন বিচারের নামে। এছাড়া ১৯৯২ সালে জাহানা ইমামের নেতৃত্বে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত গণ তদন্ত কমিশনে জড়িত থাকার অভিযোগে বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগের দাবি করেছিলাম আমরা। সে বিষয়ক একটি আদেশে তিনি শপথ নিয়ে বলেছিলেন তিনি শপথ ভঙ্গ করবেননা। তার সেদিনের শপথও ছিল একটি প্রতারনা। এরপরেও তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন বারবার।
মিজানুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এটিএম ফজলে কবিরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মাওলানা সাঈদীর চার্জ গঠনের আদেশের সময় আপনি এখানে সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া একেএম জহির আহমেদও তখন ছিলেন। আমরা জানিনা বিচারপতি নিজামুল হক চার্জ গঠনের আদেশ বিষয়ে আপনার সাথে আলোচনা করেছিলেন কি-না। যদি না করে থাকেন তাহলে আমাদের নিবেদন আপনি এ বিষয়টি এ কে এম জহির আহমেদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারেন বিচারপতি নিজামুল হক চার্জ গঠন বিষয়ে তার সাথেও আলোচনা করেছিলেন কিনা। ইচ্ছা করলে তাকে ওপেন কোর্টে জিজ্ঞাসা করতে পারেন বা ক্যামেরা ট্রায়ালেল মাধ্যমেও করতে পারেন।
মিজানুল ইসলাম বলেন, আমাদের বিশ্বাস তিনি মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যে চার্জ গঠনের আদেশ দিয়েছেন তা অন্যের নির্দেশ মত লিখে এখানে পড়ে শুনিয়েছেন মাত্র।
মিজানুল ইসলাম বলেন, এই ট্রাইব্যুনালে বিচার চলাকলে ২টি রুল পরিবর্তন আনা হয়েছে। রুল পরিবর্তনের বিষয়টিও বেলজিয়াম থেকে এসেছে। অভিযোগ আমলে নেয়া, চার্জ গঠন আদেশ সবই তার কাছ থেকে এসেছে। তারপরও বলা হচ্ছে এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। এসময় এটর্নি জেনারেল মিজানুল ইসলামের কোন কোন বক্তব্যে আপত্তি জানালে মিজানুল ইসলাম বলেন, তাহলে তো আমাদের শুনানী করারই দরকার নেই। আমরা চলে যাই আর ওনারা বলুক সব মিথ্যা, সব আবেদন বাতিল হয়ে যাক। সেটাই তো ওনারা চান।
মিজানুল ইসলাম স্কাইপ সংলাপ তুলে ধরে বলেন, ট্রাইব্যুনালে একজন এমিকাস কিউরি নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হল। সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী শাহদিন মালিকের নাম উঠে আসে তাদের স্কাইপ আলোচনায়। বিচারপতি নিজামুল হক বললেন তিনি যদি এসে রাষ্ট্রপক্ষের বিপক্ষে বলে যান? সেজন্য জিয়াউদ্দিন সাহেব বললেন তার সাথে একটা গেপান পরামর্শ করেন। এর মানে হল বিচারপতি নিজামুল হক আসামীর বিপক্ষে মতামত চাওয়ার জন্য এমিকাস কিউরি নিয়োগ দিতে চেয়েছেন। তিনি আসামীকে ফাঁসিয়ে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তিনি এমন একজনকে নিয়োগ দিতে চেয়েছেন যার কাছ থেকে এ নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। যিনি আসামীর বিপক্ষে বলবেন। রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে কিছু বলবেননা।
মিজানুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ জমা দিয়েছে এমন ২০০টিরও বেশি প্রদর্শনীর ওপর আমাদের জেরা করতে দেয়া হয়নি। আমাদের ওপর গিলোটিন প্রয়োগ করা হয়েছে। আর এটিও তিনি করেছেন ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের নির্দেশে।
স্কাইপ সংলাপ তুলে ধরে মিজানুল ইসলাম বলেন, আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি নিজামুল হককে বলেছেন তিনডা রায় দিয়া দেন আপনাকে তারপর এখানে নিয়া আসব। সত্যি তাকে নিয়ে যাওয়া হবে কি-না এবং প্রমোশন নিশ্চিত হবে কিনা এসব নিয়ে আলোচনা করেছেন বিচারপতি নিজামুল হক। তিনি আসামীদের ফাঁসিয়ে দেয়ার বিনিময়ে প্রমোশন পাওয়ার জন্য লালায়িত ছিলেন। তিনি ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনকে বলেছেন যা করার করেন আমার প্রমোশন পেলেই হল। যখন কোন বিচারপতি প্রলোভনে পড়ে, অন্যের নিদেশে বিচার কাজ পরিচালনা করেন তখন আর সেখানে ন্যায় বিচার হতে পারেনা। যে বিচারপতি শপথ ভঙ্গ করে বিচার কাজ পরিচালনা করেছেন তার রেখে যাওয়া জিনিসের ওপর ভিত্তি করে বিচার কাজ চালিয়ে নেয়া যায়না। তার যদি আদেশ এবং রায় লেখার যোগ্যতা নাই থাকে তাহলে কেন জজ হলেন তিনি।
মিজানুল ইসলাম বলেন, বিচারপতি নিজামুল হককে একটি ছুরি ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে জবাই করার করার জন্য। কিন্তু তিনি ছুরিটি চালাতে পারেননি।
তিনি বলেন, ১৭ ঘন্টার কথোপকথন পাওয়া গেছে। কিন্তু যা পাওয়া যায়নি তার মধ্যে তিনি কি কথাবার্তা বলেছেন তাই আল্লাহই ভাল জানেন।
মিজানুল ইসলাম বলেন বিদেশে পলাতক দুজনকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার বিষয়ে নিজামুল হক বলেছেন অসুবিধা নেই আমি তাদের ৬০ বছর করে জেল দিয়ে দেব । এর মাধ্যমে তিনি মামলা হওয়ার আগেই জাজমেন্ট দিয়ে দিয়েছেন। বিচারের নামে অবিচার আর কাকে বলে।
মিজানুল ইসলাম বলেন, সারা বিশ্বে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় আসামীর কথা বলার সুযোগ থাকে। আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের সময় তিনি দুয়েক মিনিট কথা বলেছিলেন। তখন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলা হয়েছিল আপনি পরে আইন অনুযায়ী কথা বলার সময় পাবেন। কিন্তু তাকে আর পরে কথা বলতে দেয়া হয়নি। আমরা যখন কথা বলার সুযোগ চাইলাম তখন বলা হল তিনি কথা বলে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। মিজানুল ইসলাম বলেন, এর মাধ্যমে তিনি শুধু আইনই ভঙ্গ করলেনা বরং প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করলেন। তিনি যদি বলতেন আপনি কথা বলার সুযোগই পাবেননা সেটা ভিন্ন কথা ছিল। কিন্তু আগে বলা হল পরে কথা বলতে পারবেন। আর পরে বলা হল কথা বলে ফেলেছেন।
স্কাইপ নিয়ে উত্তেজনা : মিজানুল ইসলাম বলেন ন্যায় বিচারের স্বার্থে আপনাদের আধাঘন্টা হলেও এটি ট্রাইব্যুনালে শোনা দরকার। তাহলে বুঝতে পারবেন কিভাবে বিচারের নামে জালিয়াতি হয়েছে। প্রয়োজনে সাংবাদিকদের বাইরে বের করে দিয়ে আপনারা এখানে শুনুন আমাদের সামনে। এটি আমাদের আপনাদের এবং ন্যায় বিচারের সবার স্বার্থে শোনা দরকার।
তখন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, হ্যা সবার স্বার্থ আছে আর ৩০ লাখ মানুষের কোন স্বার্থ নাই।
মিজানুল ইসলাম তখন ক্ষোভের সাথে বলেন, এটি বলবেননা। মুক্তিযুদ্ধ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের একচ্ছত্র বিষয় নয়। এটি এদেশের গনমানুষের বিষয়। আমার পরিবারের লোক শহীদ হয়েছে। শোক কি তা আমরা জানি। মুক্তিযুদ্ধ কি স্কাইপ সংলাপের জন্য, ন্যায় বিচারের কবর রচনার জন্য, দুনীতির জন্য হয়েছিল? মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাার জন্য, ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য। বিচারের নামে অবিচার আর সাজানো নাটক মঞ্চস্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। নিজের স্বার্থে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের সম্মানের জন্য, মুক্তিযুদ্ধকে সম্মানের জন্য ন্যায় বিচার করা উচিত।
এসময় প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, কারা নাটক করে তা আমরা দেখাব। আপনারা নাটক করেছেন। স্কাইপ সংলাপ আপনারা বানিয়েছেন।
একথা বলার সাথে সাথে আসামী পক্ষের আইনজীবীরা উচ্চস্বরে এর প্রতিবাদ করতে থাকেন। এসময় কোর্টে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েন। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির মিজানুল ইসলামকে বলেন, আপনি যুক্তি পেশ অব্যাহত রাখেন। তখন পরিস্থিতি শান্ত হয়।
যুক্তি উপস্থাপনের সময় আসামী পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাবেক সহকারি এটর্নি জেনারেল গিয়সউদ্দিন আহমেদ মিঠূ, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিক, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক, অ্যাডভোকেট শিশির মো: মনির ।
রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু প্রমুখ।
ট্রাইব্যুনাল -১ চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি আনোয়ারুল হক শুনানী গ্রহণ করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন