৩/১/২০১৩
মেহেদী হাসানপুনরায় বিচার শুরু করা বিষয়ক আসামী পক্ষের তিনটি আবেদনই খারিজ করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তবে ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান বদল হবার কারনে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় পাঁচদিন পুনরায় আর্গুমেন্ট শুনানী হবে।
আজ আবেদন খারিজ করার পক্ষে ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলেছেন, সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ কথোপকথন অবৈধভাবে রেকর্ড করা হয়েছে। তার ই-মেইল ডকুমেন্টও হ্যাকিং করে সংগ্রহ করা হয়েছে। এসবই অপরাধ এবং অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এ অপরাধ করা হয়েছে। অবৈধভাবে সংগৃহীত এসব ডকুমেন্ট প্রমান হিসেবে গ্রহণ করা যাবে কি-না সে বিষয়ে আসামী পক্ষ কোন ব্যাখ্যা দেয়নি। আদেশে আরো বলা হয়েছে কে, কখন, কোন দেশ থেকে অবৈধভাবে এসব বিষয় সংগ্রহ করেছে সে প্রশ্নের সুরাহা করতে হবে এসব আমলে নেয়ার পূর্বে।
আবেদন খারিজ করে আদেশ প্রদানের পর আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, এটি একটি ভুল আদেশ। আমরা হতাশ হয়েছি। বিচারপতি নিজামুল হক এবং ড. আহেমদ জিয়া উদ্দিনের ব্যক্তিগত বোঝা কেন তারা নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন তা তারাই ভাল জানেন।
ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার পুনরায় শুরুর আবেদন করা হয়েছিল।
আদেশ : তিনটি আবেদনই খারিজ করে দিয়ে ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলেন, ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক এবং ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যকার স্কইপ কথোপকথন অবৈধভাবে রেকর্ড করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে যে ই-মেইল আদান প্রদান করা হয়েছে তাও হ্যাক করে সংগ্রহ করা হয়েছে।
ব্যক্তিগত কথোপকথন অবৈধভাবে রেকর্ড করা এবং হ্যাকিং করে ইমেইল ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা নি:সন্দেহে একটি অপরাধ এবং গুরুতর অনৈতিক কাজ। কে, কখন, কোন দেশ থেকে এসব তথ্য অবৈধভাবে রেকর্ড এবং হ্যাক করেছে? এসব প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার এসব ডকুমেন্ট আমলে নেয়ার পূর্বে । কিন্তু দরখাস্তে এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। অবৈধভাবে রেকর্ড করা স্কাইপ কথোপকথন যা দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে এ দরখাস্ত করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলেন, অবৈধভাবে ব্যক্তিগত কথোপকথন রেকর্ড করা হয়েছে এবং হ্যকিং করে ই-মেইল-থেকে ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে । এটি একটি অপরাধ এবং অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এ অপরাধ করা হয়েছে।
আদেশে বলা হয় ট্রাইব্যুনালের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে ‘ইকোনমিস্ট’ সাময়িকী এখনো পুরো স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশ করেনি। সামান্য কিছু বিষয় তারা তাদের প্রতিবেদনে এনেছে । কিন্তু আশচর্যজনকভবে স্থানীয় একটি পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ ন্যূনতম নীতিমালাও না মেনে চেয়ারম্যানের এ ব্যক্তিবগ কথোপকথন প্রকাশ করা শুরু করে, যা অবৈধ উপায়ে ফাঁস করা হয়েছে।
আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ পর্যন্ত যেসব তথ্য প্রমান সংগ্রহ করা হয়েছে তা প্রকাশ্য এবং স্বচ্ছ প্রকৃয়ার মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে। সাক্ষীকে জেরার জন্য উভয় পক্ষ পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে। প্রকাশ্য কোর্টে সাক্ষীদের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে। শুধুমাত্র চার্জ গঠনের ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বা রায় দেয়া হবেনা। আনীত অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ কতখানি প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে সেটাই বিবেচনা করা হবে। আমাদের সামনে উপস্থাপিত ডকুমেন্ট মূল্যায়ন প্রকৃয়ায় অবৈধভাবে রেকর্ড করা এবং সংগৃহীত স্কাইপ কথোপকথন এবং ইমেইল কোন পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ব্যাপারে কোন প্রভাব ফেলবেনা। উভয় পক্ষ থেকে যেসব তথ্য প্রমান ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে সে অনুযায়ী কাজ করাই আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।
আদেশে বলা হয় ট্রাইব্যুনালের আইনে পুনরায় বিচার শুরুর কোন সুযোগ নেই। আসামী পক্ষ পুনরায় বিচার শুরুর পক্ষে ট্রাইব্যুনালের সহজাত ক্ষমতা ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি পেশ করেছে। কিন্তু আইনের প্রতিষ্ঠিত মূলনীতি হল যেখানে কোন কিছু প্রতিকার বিষয়ে আইনে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা আছে সেখানে সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ নেই। আইনের ৬ (৬) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের কোন সদস্য পরিবর্তন হলে বিচার যে অবস্থায় ছিল সেখান থেকে আবার শুরু করা যাবে। সুতরাং আইনী বিষয়ে আমরা কোন সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করার কোন সুযোগ দেখছিনা। তাই আইনে বর্নিত দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার স্বার্থে আমরা কোন আদেশ পুনরায় বিবেচনা বা সাক্ষীকে পুনরায় তলব করার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করছিনা। আমরা আরো মনে করি শুধুমাত্র সাবেক চেয়ারম্যানকে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়নি। চার্জ গঠন বিষয়ক সব আদেশ তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে প্রদান করা হয়েছে। সাবেক চেয়ারম্যান ছাড়া আরো যে দুজন বিচারপতি আছেন যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা আগের কোন আদেশ বিষয়ে দ্বিমত পোষন করেননি।
এখন আমাদের প্রশ্ন হল আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এই কোর্ট এমন কোন বিচারিক আদেশ দিতে পারে কি-না ওইসব হ্যাক করা ডকুমেন্টের ওপর ভিত্তি করে যা নি:সন্দেহে অবৈধ উপায়ে সংগ্রহ করা হয়েছে এবং যে কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হ্যাক করা এসব ডকুমেন্ট গ্রহণ করা যাবে কি-না সে মর্মে আসামী পক্ষ কোন প্রমান হাজির করতে পারেনি। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সর্ব পর্যায়ে হ্যাকিং একটি অপরাধ। এছাড়া তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রাপ্ত মতামতে জানা গেছে স্কাইপ কথোপকথন পরিবর্তন করা যায় । হ্যাকার তার স্বার্থে ভিন্ন অর্থ বোঝাানোর জন্য কোন অংশ বাদ দিয়ে পরিবর্তন করতে পারে।
সুতরাং আমাদের অভিমত হল এসব হ্যাক করা ডকুমেন্টকে এবিডেন্স হিসেবে গ্রহণ করার মত কোন নির্ভরযোগ্য প্রমান নেই। তাই অভিযোগ আমলে নেয়া এবং চার্জ গঠনের আদেশ পুনবিবেচনার আবেদন খারিজ করা হল।
আজ সকালে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে প্রথমে আবেদন বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির আদেশ পড়ে শোনন। আদেশের শুরুতে পুনরায় বিচার শুরু বিষয় আসামী পক্ষ এবং রাষ্ট্রপক্ষ যেসব যুক্তি তর্ক পেশ করেছে তার সারমর্ম বর্ননা করা হয়। আদেশে উল্লেখ করা হয় এ আবেদনের শুনানীর সময় বিচারাতি নিজামুল হক এবং ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন রেকর্ড এবং ই-মেইল হ্যাক করার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে । স্কাইপ কথোপকথন এবং হ্যাক করা ই-মেইল ফাঁস হবার জের ধরে বিতর্কের এক পর্যায়ে বিচারপতি নিজামুল হক গত ১১ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। এরপর ১৩ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়।
আসামী পক্ষের প্রতিক্রিয়া : আদেশের পর ট্রাইব্যুনালের সামনে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ট্রাইব্যুনাল আমাদের তিনটি আবেদনই খারিজ করে দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি এটি একটি ভুল আদেশ।
আমাদের প্রত্যাশা ছিল পুনরায় বিচারের আদেশ প্রদান করে ট্রাইব্যুনাল প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং বেলজিয়াম প্রবাসী একজন আইনজীবীর অসদাচরন থেকে একটা দুরত্ব বজায় রাখবেন। আমরা সম্পূর্ণ হতাশ হয়েছি।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মাননীয় বিচারকগনই ভাল জানেন তারা কেন এই দুজন ব্যক্তির বোঝা নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন। আমরা শুধু এটুকু বলার মধ্যে আমাদের বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখতে চাই যে, এর মাধ্যমে না অভিযুক্তদের প্রতি সুবিচার করা হবে, না ১৯৭১ সালের ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি। এটা হবে একটা তাড়াহুড়োর বিচার।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা দিনের আলোর মত স্বচ্ছ পরিস্কার ডকুমেন্ট জমা দিয়েছি আমাদের আবেদনের পক্ষে। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় স্কাইপ সংলাপ প্রকাশিত হয়েছে। তারা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বেলজিয়াম থেকে এসব তারা পেয়েছে। আমরা আমাদের তথ্যের সোর্স হিসেবে একটি ওয়েব সাইটের নাম উল্লেখ করেছি। লন্ডনের ইকোনমিস্টের কাছে সব ডকুমেন্ট আছে তাও বলেছি আমরা। সূত্র হিসেবে আমরা আর কি উল্লেখ করতে পারি?
এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রতিকৃয়া ব্যক্ত করে বলেন, ই-মেইল আর স্কাইপ দিয়ে বিচার হবেনা। বিচার হবে ১৯৭১ সালে তারা কি কি করেছে তার ওপর ভিত্তি করে।
আদেশের সময় বিপুল সংখ্যক আইনজীবী, সাংবাদিক ও আসামীদের আত্মীয় স্বজন উপস্থিত হন ট্রাইব্যুনালে। জনাকীর্ণ ট্রাইব্যুনাল কক্ষে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির আদেশ পড়ে শোনানোর সময় অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এবং বিচারপতি আনোয়ারুল হক উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান আইনকর্মকর্তা বা এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
ট্রাইব্যুনালের বিচার বিষয়ে সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বিভিন্ন সময় বেলজিয়ামের ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে স্কাইপে কথা বলেছেন। এছাড়া বিচারের বিভিন্ন আদেশ বিষয়ে ২৩০টি ই-মেইল এসেছে বেলজিয়াম থেকে। বিচারপতি নিজামুল হকের এসব স্কাইপ সংলাপ এর রেকর্ড এবং সমস্ত ইমেইল ডকুমেন্ট হ্যাক করে জব্দ করা হয়। লন্ডনের বিখ্যাত সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট ৫ ডিসেম্বর রাতে বিচারাতি নিজামুল হকের কাছে ফোন করে জানান তাদের কাছে তার স্কাইপ সংলাপ এবং ই-মেইল ডকুমেন্ট রয়েছে। ৯ ডিসেম্বর থেকে দৈনিক আমার দেশ ধারাবাহিকভাবে বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করতে শুরু করে। গোটা জাতি হতভম্ব হয়ে যায় এ সংলাপ পাঠ করে। সারা বিশ্বে খবর ছড়িয়ে পড়ে স্কাইপ কেলেঙ্কারি বিষয়ে। তীব্র বিতর্ক এবং সমালোচনার মুখে ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর আসামী পক্ষ তিনজন আসামীর বিচার পুনরায় শুরুর আবেদন করেন। আবেদনের সাথে তারা স্কাইপ সংলাপ এবং ই-মেইল বিষয়ে প্রায় দুই হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট দাখিল করে। ২৪ ডিসেম্বর থেকে এ বিষয়ে শুনানী শুরু হয়। গত মঙ্গলবার শুনানী শেষে আদেশের তারিখ ধার্য্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
এদিকে পুনরায় বিচার শুরুর আবেদন খারিজ করে দেয়ার পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কর্তৃক দায়ের করা তিনটি আবেদন প্রত্যাহার করে নেয়ার আবেদন করেন আজ। এগুলো হল বিচারপতি নিজামুল হককে সাক্ষী হিসেবে হাজিরের জন্য সমন প্রদান, আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্কাইপ সংলাপ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের বর্তমান তিন বিচারপতির অবস্থান ব্যাখ্যা করে আদেশ প্রদান।
এর মধ্যে প্রথম দুটি বাতিলের আবেদন গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। তৃতীয়টি বিষয়ে আগামী ১০ জানুয়ারি আদেশ। অন্যদিকে আগামী ৭ জানুয়ারি অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য্য করা হয়েছে।
মেহেদী হাসানপুনরায় বিচার শুরু করা বিষয়ক আসামী পক্ষের তিনটি আবেদনই খারিজ করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তবে ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান বদল হবার কারনে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় পাঁচদিন পুনরায় আর্গুমেন্ট শুনানী হবে।
আজ আবেদন খারিজ করার পক্ষে ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলেছেন, সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ কথোপকথন অবৈধভাবে রেকর্ড করা হয়েছে। তার ই-মেইল ডকুমেন্টও হ্যাকিং করে সংগ্রহ করা হয়েছে। এসবই অপরাধ এবং অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এ অপরাধ করা হয়েছে। অবৈধভাবে সংগৃহীত এসব ডকুমেন্ট প্রমান হিসেবে গ্রহণ করা যাবে কি-না সে বিষয়ে আসামী পক্ষ কোন ব্যাখ্যা দেয়নি। আদেশে আরো বলা হয়েছে কে, কখন, কোন দেশ থেকে অবৈধভাবে এসব বিষয় সংগ্রহ করেছে সে প্রশ্নের সুরাহা করতে হবে এসব আমলে নেয়ার পূর্বে।
আবেদন খারিজ করে আদেশ প্রদানের পর আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, এটি একটি ভুল আদেশ। আমরা হতাশ হয়েছি। বিচারপতি নিজামুল হক এবং ড. আহেমদ জিয়া উদ্দিনের ব্যক্তিগত বোঝা কেন তারা নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন তা তারাই ভাল জানেন।
ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার পুনরায় শুরুর আবেদন করা হয়েছিল।
আদেশ : তিনটি আবেদনই খারিজ করে দিয়ে ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলেন, ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক এবং ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যকার স্কইপ কথোপকথন অবৈধভাবে রেকর্ড করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে যে ই-মেইল আদান প্রদান করা হয়েছে তাও হ্যাক করে সংগ্রহ করা হয়েছে।
ব্যক্তিগত কথোপকথন অবৈধভাবে রেকর্ড করা এবং হ্যাকিং করে ইমেইল ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা নি:সন্দেহে একটি অপরাধ এবং গুরুতর অনৈতিক কাজ। কে, কখন, কোন দেশ থেকে এসব তথ্য অবৈধভাবে রেকর্ড এবং হ্যাক করেছে? এসব প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার এসব ডকুমেন্ট আমলে নেয়ার পূর্বে । কিন্তু দরখাস্তে এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। অবৈধভাবে রেকর্ড করা স্কাইপ কথোপকথন যা দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে এ দরখাস্ত করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলেন, অবৈধভাবে ব্যক্তিগত কথোপকথন রেকর্ড করা হয়েছে এবং হ্যকিং করে ই-মেইল-থেকে ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে । এটি একটি অপরাধ এবং অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এ অপরাধ করা হয়েছে।
আদেশে বলা হয় ট্রাইব্যুনালের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে ‘ইকোনমিস্ট’ সাময়িকী এখনো পুরো স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশ করেনি। সামান্য কিছু বিষয় তারা তাদের প্রতিবেদনে এনেছে । কিন্তু আশচর্যজনকভবে স্থানীয় একটি পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ ন্যূনতম নীতিমালাও না মেনে চেয়ারম্যানের এ ব্যক্তিবগ কথোপকথন প্রকাশ করা শুরু করে, যা অবৈধ উপায়ে ফাঁস করা হয়েছে।
আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ পর্যন্ত যেসব তথ্য প্রমান সংগ্রহ করা হয়েছে তা প্রকাশ্য এবং স্বচ্ছ প্রকৃয়ার মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে। সাক্ষীকে জেরার জন্য উভয় পক্ষ পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে। প্রকাশ্য কোর্টে সাক্ষীদের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে। শুধুমাত্র চার্জ গঠনের ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বা রায় দেয়া হবেনা। আনীত অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ কতখানি প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে সেটাই বিবেচনা করা হবে। আমাদের সামনে উপস্থাপিত ডকুমেন্ট মূল্যায়ন প্রকৃয়ায় অবৈধভাবে রেকর্ড করা এবং সংগৃহীত স্কাইপ কথোপকথন এবং ইমেইল কোন পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ব্যাপারে কোন প্রভাব ফেলবেনা। উভয় পক্ষ থেকে যেসব তথ্য প্রমান ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে সে অনুযায়ী কাজ করাই আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।
আদেশে বলা হয় ট্রাইব্যুনালের আইনে পুনরায় বিচার শুরুর কোন সুযোগ নেই। আসামী পক্ষ পুনরায় বিচার শুরুর পক্ষে ট্রাইব্যুনালের সহজাত ক্ষমতা ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি পেশ করেছে। কিন্তু আইনের প্রতিষ্ঠিত মূলনীতি হল যেখানে কোন কিছু প্রতিকার বিষয়ে আইনে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা আছে সেখানে সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ নেই। আইনের ৬ (৬) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের কোন সদস্য পরিবর্তন হলে বিচার যে অবস্থায় ছিল সেখান থেকে আবার শুরু করা যাবে। সুতরাং আইনী বিষয়ে আমরা কোন সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করার কোন সুযোগ দেখছিনা। তাই আইনে বর্নিত দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার স্বার্থে আমরা কোন আদেশ পুনরায় বিবেচনা বা সাক্ষীকে পুনরায় তলব করার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করছিনা। আমরা আরো মনে করি শুধুমাত্র সাবেক চেয়ারম্যানকে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়নি। চার্জ গঠন বিষয়ক সব আদেশ তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে প্রদান করা হয়েছে। সাবেক চেয়ারম্যান ছাড়া আরো যে দুজন বিচারপতি আছেন যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা আগের কোন আদেশ বিষয়ে দ্বিমত পোষন করেননি।
এখন আমাদের প্রশ্ন হল আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এই কোর্ট এমন কোন বিচারিক আদেশ দিতে পারে কি-না ওইসব হ্যাক করা ডকুমেন্টের ওপর ভিত্তি করে যা নি:সন্দেহে অবৈধ উপায়ে সংগ্রহ করা হয়েছে এবং যে কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হ্যাক করা এসব ডকুমেন্ট গ্রহণ করা যাবে কি-না সে মর্মে আসামী পক্ষ কোন প্রমান হাজির করতে পারেনি। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সর্ব পর্যায়ে হ্যাকিং একটি অপরাধ। এছাড়া তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রাপ্ত মতামতে জানা গেছে স্কাইপ কথোপকথন পরিবর্তন করা যায় । হ্যাকার তার স্বার্থে ভিন্ন অর্থ বোঝাানোর জন্য কোন অংশ বাদ দিয়ে পরিবর্তন করতে পারে।
সুতরাং আমাদের অভিমত হল এসব হ্যাক করা ডকুমেন্টকে এবিডেন্স হিসেবে গ্রহণ করার মত কোন নির্ভরযোগ্য প্রমান নেই। তাই অভিযোগ আমলে নেয়া এবং চার্জ গঠনের আদেশ পুনবিবেচনার আবেদন খারিজ করা হল।
আজ সকালে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে প্রথমে আবেদন বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির আদেশ পড়ে শোনন। আদেশের শুরুতে পুনরায় বিচার শুরু বিষয় আসামী পক্ষ এবং রাষ্ট্রপক্ষ যেসব যুক্তি তর্ক পেশ করেছে তার সারমর্ম বর্ননা করা হয়। আদেশে উল্লেখ করা হয় এ আবেদনের শুনানীর সময় বিচারাতি নিজামুল হক এবং ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন রেকর্ড এবং ই-মেইল হ্যাক করার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে । স্কাইপ কথোপকথন এবং হ্যাক করা ই-মেইল ফাঁস হবার জের ধরে বিতর্কের এক পর্যায়ে বিচারপতি নিজামুল হক গত ১১ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। এরপর ১৩ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়।
আসামী পক্ষের প্রতিক্রিয়া : আদেশের পর ট্রাইব্যুনালের সামনে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ট্রাইব্যুনাল আমাদের তিনটি আবেদনই খারিজ করে দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি এটি একটি ভুল আদেশ।
আমাদের প্রত্যাশা ছিল পুনরায় বিচারের আদেশ প্রদান করে ট্রাইব্যুনাল প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং বেলজিয়াম প্রবাসী একজন আইনজীবীর অসদাচরন থেকে একটা দুরত্ব বজায় রাখবেন। আমরা সম্পূর্ণ হতাশ হয়েছি।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মাননীয় বিচারকগনই ভাল জানেন তারা কেন এই দুজন ব্যক্তির বোঝা নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন। আমরা শুধু এটুকু বলার মধ্যে আমাদের বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখতে চাই যে, এর মাধ্যমে না অভিযুক্তদের প্রতি সুবিচার করা হবে, না ১৯৭১ সালের ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি। এটা হবে একটা তাড়াহুড়োর বিচার।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা দিনের আলোর মত স্বচ্ছ পরিস্কার ডকুমেন্ট জমা দিয়েছি আমাদের আবেদনের পক্ষে। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় স্কাইপ সংলাপ প্রকাশিত হয়েছে। তারা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বেলজিয়াম থেকে এসব তারা পেয়েছে। আমরা আমাদের তথ্যের সোর্স হিসেবে একটি ওয়েব সাইটের নাম উল্লেখ করেছি। লন্ডনের ইকোনমিস্টের কাছে সব ডকুমেন্ট আছে তাও বলেছি আমরা। সূত্র হিসেবে আমরা আর কি উল্লেখ করতে পারি?
এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রতিকৃয়া ব্যক্ত করে বলেন, ই-মেইল আর স্কাইপ দিয়ে বিচার হবেনা। বিচার হবে ১৯৭১ সালে তারা কি কি করেছে তার ওপর ভিত্তি করে।
আদেশের সময় বিপুল সংখ্যক আইনজীবী, সাংবাদিক ও আসামীদের আত্মীয় স্বজন উপস্থিত হন ট্রাইব্যুনালে। জনাকীর্ণ ট্রাইব্যুনাল কক্ষে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির আদেশ পড়ে শোনানোর সময় অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এবং বিচারপতি আনোয়ারুল হক উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান আইনকর্মকর্তা বা এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
ট্রাইব্যুনালের বিচার বিষয়ে সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বিভিন্ন সময় বেলজিয়ামের ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে স্কাইপে কথা বলেছেন। এছাড়া বিচারের বিভিন্ন আদেশ বিষয়ে ২৩০টি ই-মেইল এসেছে বেলজিয়াম থেকে। বিচারপতি নিজামুল হকের এসব স্কাইপ সংলাপ এর রেকর্ড এবং সমস্ত ইমেইল ডকুমেন্ট হ্যাক করে জব্দ করা হয়। লন্ডনের বিখ্যাত সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট ৫ ডিসেম্বর রাতে বিচারাতি নিজামুল হকের কাছে ফোন করে জানান তাদের কাছে তার স্কাইপ সংলাপ এবং ই-মেইল ডকুমেন্ট রয়েছে। ৯ ডিসেম্বর থেকে দৈনিক আমার দেশ ধারাবাহিকভাবে বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করতে শুরু করে। গোটা জাতি হতভম্ব হয়ে যায় এ সংলাপ পাঠ করে। সারা বিশ্বে খবর ছড়িয়ে পড়ে স্কাইপ কেলেঙ্কারি বিষয়ে। তীব্র বিতর্ক এবং সমালোচনার মুখে ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর আসামী পক্ষ তিনজন আসামীর বিচার পুনরায় শুরুর আবেদন করেন। আবেদনের সাথে তারা স্কাইপ সংলাপ এবং ই-মেইল বিষয়ে প্রায় দুই হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট দাখিল করে। ২৪ ডিসেম্বর থেকে এ বিষয়ে শুনানী শুরু হয়। গত মঙ্গলবার শুনানী শেষে আদেশের তারিখ ধার্য্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
এদিকে পুনরায় বিচার শুরুর আবেদন খারিজ করে দেয়ার পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কর্তৃক দায়ের করা তিনটি আবেদন প্রত্যাহার করে নেয়ার আবেদন করেন আজ। এগুলো হল বিচারপতি নিজামুল হককে সাক্ষী হিসেবে হাজিরের জন্য সমন প্রদান, আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্কাইপ সংলাপ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের বর্তমান তিন বিচারপতির অবস্থান ব্যাখ্যা করে আদেশ প্রদান।
এর মধ্যে প্রথম দুটি বাতিলের আবেদন গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। তৃতীয়টি বিষয়ে আগামী ১০ জানুয়ারি আদেশ। অন্যদিকে আগামী ৭ জানুয়ারি অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য্য করা হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন