বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩

মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড

মেহেদী হাসান
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আজ  তার বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষণা করেন।

আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে তাকে দোষীসাব্যস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে  দুটিতে  যথা ছয় এবং সাত নং অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। পাঁচ নং অভিযোগে  যাবজ্জীবন এবং তিন নং  অভিযোগে পাঁচ বছরের সাজা প্রদান করা হয়েছে। শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হত্যাকান্ডের অভিযোগ ছিল এক নং অভিযোগ। এ অভিযোগেও আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে তবে এ অভিযোগে আলাদা করে কোন সাজার কথা উল্লেখ করা হয়নি। এক নং এ অভিযোগটিকে ছয় নং অভিযোগের সাথে  অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এছাড়া দুটি অভিযোগ যথা দুই এবং এবং চার  নং অভিযোগ থেকে  মুজাহিদকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।   


যে অভিযোগগুলোতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সেগুলো হল শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন হত্যা, মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ ও হত্যার পৃথক তিনটি অভিযোগ ।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমি, আলতাফ মাহমুদ, বদি, জুয়েল ও আজাদকে নির্যাতন ও হত্যার একটি অভিযোগে যাবজ্জিবন সাজা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ফরিদপুরের রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে নির্যাতনের অপর অভিযোগে পাঁচ বছর সাজা দেয়া হয়েছে।

যে দুটি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হযেছে তা হল  ফরিদপুরের বৈদ্যডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালাডাঙ্গিতে হামলা ও ৫০-৬০ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক হত্যার ঘটনা এবং আবু ইউসুফ ওরফে পাখির উপর নির্যাতনের পৃথক দুটি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

গতকাল হরতালের মধ্যে  ট্রাইব্যুনাল ভবনে বিপুল সংখ্যক আইনজীবী, পর্যবেক্ষক, দেশি বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের বিপুলসংখ্যক সংবাদ কর্মীর উপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনাল ২০৯ পৃষ্ঠার মূল রায়ের ৩৭ পৃষ্টা সামারি রায় পাঠ করেন। প্রথমে রায় পাঠ করেন ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারক মো. শাহিনুর ইসলাম। তারপর অপর সদস্য বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া এবং সব শেষে চেয়ারম্যান  বিচারপতি ওবায়দুল হাসান রায়ের মূল অংশ পাঠ করেন।

উল্লাস :
রায় ঘোষনা উপলক্ষে ট্রাইব্যুনালের সামনে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ  কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত হয়। ফাঁসির রায় ঘোষনার পর তারা ট্রাইব্যুনালের সামনে উল্লাসে ফেটে পড়ে। অসংখ্য টিভিতে চলতে থাকে তাদের উল্লাস এবং আনন্দের প্রতিকৃয়ার লাইভ প্রচার এবং রিপোর্টারদের ধারাভাষ্য। ৪২ বছর পর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শহীদের আত্মা কবরে শান্তি পাবে, তারা এখন শান্তিতে ঘুমাতে পারবে, শান্তিতে ঘুমাতে পারবে শহীদ পরিবারের সদস্যরাও, জীবিত এবং আহত মুক্তিযোদ্ধারাও.........প্রভৃতি বর্ননা চলতে থাকে অবিরাম ধারায়। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরাও আনন্দ প্রকাশ করে টিভি এবং অন্যান্য মিডিয়ার সামনে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।

রায় ঘোষনার পর ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপরে আইনজীবীদের সমন্বয়ক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, ৪০ বছর জাতী স্বস্থি পেয়েছে। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। তিনি বলেন, আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে মুজাহিদ গণহত্যা চালিয়েছে। আদালত বলেছে তার অপরাধ মানবিকতায় নাড়া দিয়েছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম অভিযোগে আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।


মৃত্যুদন্ডের অভিযোগ :
মুজাহিদের বিরুদ্ধে ছয় ও সাত নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া এক নম্বর অভিযোগ ছয় নম্বর অভিযোগের সাথে সমন্বিত করে একত্রে রায় দেয়া হয়েছে। এক নম্বর অভিযোগে শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন হত্যা ও ছয় নম্বর অভিযোগে ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা বিষয়ে  সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির অভিযোগ। নেতা হিসেবে পরিকল্পনা করা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা। শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন হত্যার ঘটনায়ও তার সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির  দায় ছিল বলে উল্লেখ করা হয় রায়ে।

শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন হত্যার ঘটনা হল, একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর চামেলীবাগ বাসা থেকে ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে ৭/৮ জন যুবক মিনিবাসে তুলে নিয়ে যায়। এরপর আর তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। অভিযোগে বলা হয়, শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ’৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ঠগ বাছিতে গা উজাড়’ শিরোনামে এক প্রবন্ধ লিখেন। ওই প্রবন্ধ প্রকাশের পর দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে ‘অতএব ঠক বাছিও না’ শিরোনামে পাল্টা প্রবন্ধ ছাপা হয়। এতে তিনি আল-বদরদের লক্ষ্যে পরিণত হন।

ছয় নম্বর অভিযোগ হল বুদ্ধিজীবী হত্যা। অভিযোগে বলা হয়, মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে শারীরিক শিা কলেজ) পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে মুজাহিদ বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করতেন। ওই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ’৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুরু হয়।

আর সাত নম্বর অভিযোগ হল ফরিদপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের হত্যা। এ অভিযোগে বলা হয়েছে, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ করে। সেখানে বীরেন্দ্র সাহা, নৃপেণ সিকদার, সানু সাহা, জগবন্ধু মিত্র, জলধর মিত্র, সত্য রঞ্জন দাস, নরদ বন্ধু মিত্র প্রমুখকে হত্যা করা হয়।

এসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে মুজাহিদকে ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

যাবজ্জীবন:
মুজাহিদের বিরুদ্ধে পঞ্চম অভিযোগ হল আলতাফ মাহমুদ, বদি, রুমি, জুয়েল, আজাদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা ও নির্যাতন। এ অভিযোগে বলা হয়, ’৭১ সালের ৩০ আগস্ট আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও মতিউর রহমান নিজামী নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলের আর্মি ক্যাম্পে যান। সেখানে আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাদের গালিগালাজ করেন এবং পাকিস্তানি একজন ক্যাপ্টেনকে বলেন যে, প্রেসিডেন্টের সাধারণ মা ঘোষণার আদেশের আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। রায়ে বলা হয়েছে, অভিযুক্তকে স্বশরীরে অপরাধ সংগঠন করতে পাওয়া যায়নি। কিন্তু এটা সন্দেহাতিতভাবে প্রমান পাওয়া গেছে যে আসামী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ অপরাধে প্ররোচনা দিয়েছে এবং তার সহযোগিতায় আর্মি ক্যাম্পে আটক রাখা বহু বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণত হওয়া তাকে যাবজ্জিবন সাজা প্রদান করা হল।

পাঁচ বছরের কারাদণ্ড:
’৭১ সালের জুন মাসের ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে পুরাতন সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। সেখানে উপস্থিত মুজাহিদের ইঙ্গিতে রাজাকার ও অবাঙালিরা তাঁকে নির্যাতন করে। এই অভিযোগে অপরাধ সংগঠনের সহযোগিতার অভিযোগে মুজাহিদকে পাঁচ বছরের সাজা দেয়া হয়েছে। 

দুই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি:
মুজাহিদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ ’৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুজাহিদ ও জনৈক হাম্মাদ মাওলানা, ৮-১০ জন অবাঙালি ও পাকিস্তানি সেনারা ফরিদপুরের তিনটি হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রাম বৈদ্যডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালাডাঙ্গিতে হামলা চালায়। ওই হামলায় ৫০-৬০ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক নিহত হন।
আর চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে রাজাকাররা আটক করার পর আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এরপর মুজাহিদের পরামর্শে তাকে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। রায় বলা হয় রাষ্ট্রপক্ষ এই অভিযোগ দুটি সন্দেহাতিত ভাবে প্রমান করতে পারেনি।

সূচনা বক্তব্য:  
রায় ঘোষণার শুরুতে ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, রায় প্রদান করার আগে কিছু  কথা বলতে চাই যা বলা খুবই পয়োজন। আমরা লক্ষ্য করেছি যে দিন রায় দেয়া হবে সেদিন হরতাল আহ্বান করা হচ্ছে। আসামী পক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত থাকেননা। মামলা পরিচালনাকারী সংশ্লিষ্ট আইনজীবীও থাকেননা। তারা তাদের প্রতিনিধিদের পাঠান। সিনিয়ররা না আসতে পারেন হরতালে কিন্তু মামলা পরিচালনাকারী সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর অন্তত আসা উচিত। আমরা আরো লক্ষ্য করেছি রায় ঘোষনার পর কেউ খুশি না হলে রায় প্রত্যাখান করে বক্তব্য দেয়। ঘৃনাভরে রায় প্রত্যাখ্যান করার কথা বলেন। এটা আমাদের জন্য কষ্টের। রায় প্রত্যাখ্যানের সুযোগ নেই। এটা  আদালত অবমাননার শামিল। আশা করি ভবিষ্যতে এ ধররেনর কথা বলা থেকে সবাই বিরত থাকবেন। আপনারা রায়কে পারভার্স বা ন্যায়ভ্রষ্ট বলতে পারেন। রায়ে সংুব্ধ হলে পথ খোলা আছে। আপিল বিভাগে যেতে পারেন। আমরা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, আমরা শপথ নিয়ে এসেছি। রায়ের পর দেখা যায় গাড়ী ভাংচুর করা হচ্ছে। আবার ফাঁসির দাবি জানানো হচ্ছে। রাস্তায় ফাঁসির স্লোগান দিয়ে প্রতিকার পাওয়া যায়না।
টেলিভিশনের টকশোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, রাত যতো গভীর হয় টেলিভিশনে টকশো ততো জোরে  শোরে শুরু হয়। টকশোতে রায় না দেখেই মন্তব্য করা হয়। বলা হয় এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণদিত। আমরা কাদের মোল্লার মামলায় আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি। সুপ্রিম কোর্ট যদি আমাদের বক্তব্য সমর্থন করে তা হলে সেটা আইনে পরিণত হবে। রায় সম্পার্কে যারা কথা বলছেন তাদের মনে রাখতে হবে বিষয়টি বিচারাধীন। কাজেই বিচাররাধীন বিষয়ে মন্তব্য না করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বরেন,  মনে রাখতে হবে আদালতের হাত অনেক লম্বা। বাংলাদেশের সীমানার মধ্য থেকে কেউ যদি আদালতকে আঘাত করেন, অবমাননা করে তাহলে আদালত  কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার রাখেন।

আল্লাহর কাছে বিচার চাই: মুজাহিদ

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা হওয়ার পর  ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেন, এটা শতভাগ অবিচার হয়েছে। একাত্তর সালের নয় মাসে আমি একবারও ফরিদপুরে যায়নি। এসময় তিনি  পবিত্র আল-কুরআনের সুরা বুরুজ থেকে পাঠ করে বলেন, আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাই।

রায় ঘোষণার সময় আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ট্রাইব্যুনালের গাঠগড়ায় বসে ছিলেন। তার গায়ে ছিল সাদা পাঞ্জাবী। রায় ঘোষণার পুরো সময় তিনি শান্ত স্বাভাবিক ছিলেন। রায় ঘোষণা শেষ হওয়ার পর তিনি ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাড়িয়ে কুরআনের আয়াত তেলওয়াত করতে থাকেন। তিনি বলেন, আল্লাহ জিবন মৃত্যুর মালিক। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি রায়কে ‘অবিচার’ উল্লেখ করে বলেন, শুধু ইসলামি আন্দোলন করার কারণেই আমার বিরুদ্ধে এ রায় দেয়া হয়েছে।  আমার বিরুদ্ধে একশ’ পার্সেন্ট ইনজাস্টিস করা হয়েছে। আমার কোনো অপরাধ নেই। শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার কারণেই এ রায় দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ রায়ে ইসলামী আন্দোলন থেমে থাকবেনা। ইসলামী আন্দোলন চলবে ইনশাআল্লাহ।  ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন নয় মাসে আমি ফরিদপুরেই ছিলাম না। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মুজাহিদকে কাঠগড়া থেকে নামিয়ে নিয়ে যান। রায় ঘোষার পূর্বে সকাল পোনে ১১টায় মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় আনা হয়।
রায় ঘোষণার সময় মুজাহিদের কাঠগড়ার পাশের তার তিন সন্তান আলী আহমেদ তাজদীদ, আলী আহমেদ তাহকীক ও আলী আহমেদ মাবরুর উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণা শেষে মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনাল থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় করাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

জামায়াতের  সাথে যুক্ত থাকার কারনে আমার পিতার বিচার হয়েছে-রায়ের প্রতিকৃয়ায়  ছেলে মাবরুর

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষনার পর তার ছোট ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর বলেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খান তার সাক্ষ্যে বলেছেন তিনি তার তদন্তকালে রাজাকার,  আল-বদর, আল শামসের কোন তালিকায় আলী আহসান মো : মুজাহিদের নাম পাননি। তিনি আরো স্বীকার করেছেন বাংলাদেশের কোন থানায় আমার পিতা মুজাহিদের বিরুদ্ধে একাত্তর সালের কোন ঘটনায় আজ পর্যন্ত একটিও মামলা হয়নি। সম্পূর্ণ ধারণার উপর ভিত্তি করে তার বিরুদ্ধে এ রায় দেয়া হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল হওয়ার কারনে এবং ইসলামী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার কারনে  তার বিরুদ্ধে এই রায় দেয়া হয়েছে। তিনি ইসলামী আন্দোলনের সাথে যুক্ত না থাকলে তার বিচার হতনা। আমরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব। আশাকরি আপিলে ন্যায় বিচার পাব।


মুজাহিদের পরিচিতি:
রায়ে আলী আহসান মো : মুজাহিদের পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়-আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি ফরিদপুরের কোতয়ালি থানার পশ্চিম খাবাসপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মাওলানা আবদুল আলী। মাতার নাম নুরজাহান বেগম। তিনি রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। তার পিতা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। মুজাহিদ ১৯৬৪ সালে এসএসসি পাস করেন এবং তারপর ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তখন তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা সভাপতি ছিলেন। তিনি একাত্তর সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ছাত্রসংঘের পূর্ব পকিস্তান শাখার সেক্রেটারি হন এবং একই সালের অক্টোবর মাসে সভাপতি হন। মুজাহিদ ২০০১-২০০৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন। তিনি বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল। 


ট্রাইব্যুনালের ষষ্ঠ রায়: 
এ দিকে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মামলা রায় ঘোষণার মধ্যদিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ চতুর্থ রায় ঘোষণা করা হল। এর আগে একই ট্রাইব্যুনাল মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোলার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা করে।

অপর দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত সোমবার জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলায় রায় ঘোষণা করে। একই ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমির বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করে।

মামলার বিবরণ: গত বছরের ২৬ আগস্ট আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে শাহরিয়ার কবিরের সাক্ষ্য গ্রহনের মধ্য দিয়ে স্যাগ্রহণ শুরু হয়। এরপর এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকসহ মোট ১৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।
অপরদিকে মুজাহিদের পক্ষে আদালত তিনজন ডিফেন্স সাক্ষী সীমিত করে দেয়ার পর মুজাহিদের ছোট ছেলে আলী আহমদ মাবরুর (জব্দ তালিকার) একমাত্র ডিফেন্স স্বাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন।
গত বছরের ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাতটি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল, আজাদকে নির্যাতন, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও দেশত্যাগে বাধ্য করা এবং মুজাহিদ একক ও দলবদ্ধভাবে জড়িত থেকে ও নেতৃত্ব দিয়ে কিংবা সহযোগিতা ও নির্দেশ দানের মাধ্যমে অপরাধ সংগঠনের অভিযোগ আনা হয়।
২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার মামলায় গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
মামলার আইনজীবী:
আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হলেন চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল, তুরিন আফরোজ, আবুল কালাম, সাবিনা ইয়াসমিন খান ও তাপস কান্দি।
অপর দিকে মুজাহিদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন, ডিফেন্স টিমের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট সৈয়দ মিজানুর রহমান, ব্যারিস্টার মুন্সি আহসান কবীর, ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিকী ও অ্যাডভোকেট গাজী এমএইচ তামিম। 




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন