বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩

আইনের দৃষ্টিতে এ রায় কোন রায়ই নয়-আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবীর প্রতিক্রিয়া

আলী আহসান মো: মুজাহিদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষনার পর আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, আইনের দৃষ্টিতে এ রায় কোন রায়ই নয়। এ রায় সম্পূর্ণ ভুল। তারা আন্তর্জাতিক আইন অনুধাবন করতে এবং এর সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলস্বরূপ তারা যে রায় দিয়েছেন তা আইনের শাসন এবং ন্যায় বিচারের পরিপন্থী হয়েছে।

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আজ  বিকালে ধানমন্ডিতে তার নিজ বাসভবনে আসামী পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ বক্তব্য তুলে ধরেন। আলী আহসান মো : মুজাহিদকে যেসব অভিযোগে সাজা দেয়া হয়েছে তার প্রতিটি অভিযোগ খন্ডন করে তিনি লিখিত বক্তব্য পেশ করেন।

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। মাননীয় বিচারপতিদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলছি তাদের এই রায় সম্পূর্ণ ভূল । তারা আন্তর্জাতিক আইন অনুধাবন করতে এবং এর সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। ফল স্বরুপ তারা যে রায় দিয়েছেন তা আইনরে শাসন এবং ন্যায় বিচারের পরিপন্থি। আমরা দ্বার্থহীন ভাষায় বলতে চাই রাষ্ট্রপক্ষ মুজাহিদের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রথম অভিযোগে আলী আহসান  মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন অপহরন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। অথচ এই অভিযোগের স্বাক্ষী সিরাজুদ্দিন হোসেনের ছেলে জেরায় নিজেই স্বীকার করেছেন, তার পিতাকে অপহরনের পরপর তিনি ১৯৭২ সালে রমনা থানায় দালাল আইনে একটি মামলা করেছিলেন। ঐ মামলায় তিনি সাক্ষ্যও দিয়েছিলেন। এই মামলায় আসামী জনৈক খলিল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছিল এবং বিচারে তাদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। স্বাক্ষী তার জেরায় স্বীকার করেন যে, তার পরিবারের পক্ষ থেকে সিরাজুদ্দিন হোসেনের হত্যাকান্ডের ব্যপারে যে সব স্মৃতিচারনমূলক লেখা হয়েছে তার কোথাও আলী আহসান মুজাহিদকে জড়িয়ে কোন কথা লেখা হয়নি। তারপরও সিরাজুদ্দিন হোসেনের মামলায় মুজাহিদকে দোষী সাব্যস্তকরা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি।


৩য় অভিযোগে জনাব মুজাহিদের বিরুদ্ধে ফরিদপুরের জনৈক মুক্তিযোদ্ধা রঞ্জিত কুমার নাথকে আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়। অথচ এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা স্পষ্ট করেই তার জেরায় স্বীকার করেছেন যে, রঞ্জিত নাথকে নিগৃহিত করার ঘটনা তার জব্দকৃত কোন বইয়ে উল্লেখ ছিল না। ফরিদপুর জেলা প্রশাসন থেকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং বধ্যভূমির তালিকাসহ নিহত ব্যক্তিদের যে তালিকাটি সংগ্রহ করেছিলেন সেই তালিকায়ও রঞ্জিত নাথের নাম নেই।
 ৫ম অভিযোগে নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলে বেশ কয়েকজন বন্দীকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এই অভিযোগের প্রসিকিউশন স্বাক্ষী তার জেরায় বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৯ আগষ্ট সকালে পত্রিকায় কিছু ব্যক্তিদের আটকের খবর পেয়ে ঐ দিনই বিকেলে তিনি তার চাচার সাথে রমনা থানায় গিয়েছিলেন এবং সেখানে গিয়ে বদি, রুমি, জুয়েল, আজাদ, আলতাফ মাহমুদ সহ আরো ২০/২৫ জনকে দেখেছিলেন। অথচ প্রসিকিউশন কর্তৃক সরবরাহকৃত জাহানারা ইমামের নিজের লেখা বই ’একাত্তরের দিনগুলি’ থেকে জানা যায় উপরোক্তদের কেউই ৩০ আগষ্ট মধ্যরাতের আগে গ্রেফতার হয়নি। উল্লেখ্য যে, নিহতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জাহানার ইমামের ছেলে রুমী। এইভাবে মিথ্যা তথ্য প্রদানকারী একজন ব্যক্তির স্বাক্ষ্যের ভিত্তিতে জনাব মুজাহিদকে দোষী সাব্যস্ত করা অন্যায্য এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।  

 ৬ষ্ঠ অভিযোগে জনাব মুজাহিদের বিরুদ্ধে ঢাকার মোহাম্মাদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এই পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষ জনাব মুজাহিদের বিরু্েদ্ধ সুস্পষ্ট কোন অভিযোগআনতে ব্যর্থ হয়েছে। জনাব মুজাহিদ কতজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছেন তাদের কোন সংখ্যা নেই। সেই সব বুদ্ধিজীবীদের   নামও নেই। কোনদিন এবং কোথায় তাদেরকে হত্যা করেছে তারও কোন বিবরণ নেই। বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের কোন লোক সাক্ষী দিতে আসেননি। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ন যে, প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরালিয়েন সহ অন্যান্য ট্রাইব্যুনালে মানবতা বিরোধী অপরাধে যত বিচার হয়েছে সেখানে অধিকাংশ সাক্ষী ছিলেন নিহতদের পরিবারবর্গের সদস্যবৃন্দ।  বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালে আমরা আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্য করলাম জনাব মুজিাহিদকে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো অথচ সেই বুদ্ধিজীবী একজনেরও নাম প্রকাশ করা হলো না এবং তাদের পরিবারের কাউকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা হলো না। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জনাব সিরাজুদ্দিন হোসেনের হত্যাকান্ডকে রাষ্ট্রপক্ষ একটি আলাদা হত্যাকান্ড হিসেবে অভিযোগ এনেছে। ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে বুদ্ধিজীবী হত্যার সাথে সিরাজুদ্দিন সাহেবের হত্যাকে জড়িত করা হয়নি।

৭ম অভিযোগে ফরিদপুরের বাকচরে হত্যাযজ্ঞ চালানোর অভিযোগ আনা হয়। এই মামলার একজন স্বাক্ষী শোনা স্বাক্ষী। আর আরেকজন বর্তমানে ভারতে থাকলেও ট্রাইবুনালে এসে বাংলাদেশে থাকার দাবী করেন। সাক্ষী শক্তি সাহা তার পিতার হত্যার বিচার চেয়ে ট্রাইবুনালে স্বাক্ষী দিলেও জেরার এক পর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশে তার সুদির্ঘকাল অবস্থান কালে তিনি তার বাবার হত্যার ব্যাপারে কোন থানায় বা আদালতে কোন অভিযোগ দায়ের  করেনি। তার বড় ভাই ফরিদপুরেই আছেন । সেই ভাই তার বাবার মৃত্যু সংক্রান্তে কোন মামলা করেছেন কি না তার জানা নেই বা এ মর্মে তিনি কিছু শোনেনওনি, কারন তার আগ্রহ ছিল না। ঐ স্বাক্ষী গাব গাছের উপরে বসে তার পিতার হত্যাকান্ড দেখার বর্ননা করেছেন যা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। অথচ এই ধরনের অগ্রহনযোগ্য স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে জনাব মুজাহিদকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। শুধু তাকে দোষী সাব্যস্ত করাই হয়নি মৃত্যুদন্ডও দেয়া হয়েছে এতে আমরা বিস্মিত। এটা ন্যায় বিচারের পরিপন্থি।

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন,  সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তার জেরায় পরিস্কারভাবে স্বীকার করেছেন যে, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত জনাব মুজাহিদের বিরুদ্ধে ফরিদপুর জেলাধীন কোন থানায় বা বাংলাদেশের ৬৫টি জেলার অন্য কোন থানায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত কোন অপরাধের জন্য কোন মামলা হয়েছে, এমন তথ্য তিনি তার তদন্তে পাননি। তদন্তকারী কর্মকর্তা এটাও স্বীকার করেছেন যে, জনাব মুজাহিদ আল বদর, শান্তি কমিটি, রাজাকার,আশ শামস বা এই ধরনের কোন সহযোগী বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, এমন কোন তথ্য তিনি তার তদন্তকালে পাননি। তারপরও মাননীয় ট্রাইব্যুনাল তাকে আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এটা সত্য কথা যে জনাব মুজাহিদ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল এবং পরবর্তীকালে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তিনি আলবদরের সদস্য ছিলেন বা আলবদরের কমান্ডার ছিলেন এমন কোন সাক্ষ্য প্রমান রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন।

তিনি বলেন, আলী আহসান মো :  মুজাহিদ মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন ছাত্র ছিলেন। সরকারের কোন দায়িত্বশীল পদে তিনি ছিলেন না। তার সাথে সামরিক-বেসামরিক কোন ব্যক্তির কোন বৈঠক হয়েছে, বা কোন কমিটিতে তার নাম আছে, এমন একটি তথ্যও রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করতে পারেনি।  আমরা মনে করি, আলী আহসান মো: মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে মানবতা বিরোধী অপরাধের কোন উপাদান নেই। আইনের দৃষ্টিতে এই রায় কোন রায়ই নয়। এই রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ এবং এর বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপীল করবো।”

সংবাদ সম্মেলনে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মুন্সি আহসান কবির সাইফুর রহমান, মতিউর রহমান আকন্দ, ব্যারিষ্টার এহসান-এ-সিদ্দিকী ও ব্যারিষ্টার এমরান-এ-সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন