বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়-হাসান আরিফ///সাজা দেয়া হলে এটি দেশের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে-আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী

২২/৭/২০১৩
মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেয়া যাবজ্জীবন সাজার বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানি আজ শেষ করেছে আসামিপ। আগামীকাল মঙ্গলবার রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এ আপিলের শুনানি শেষ হবে।

শুনানি শেষে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, সরকারপক্ষ যে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করেছে, সে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেয়া অসম্ভব। এসব দুর্বল সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে যদি কাদের মোল্লাকে সাজা দেয়া হয়, তাহলে এটি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।

এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সর্বশেষ সংশোধনী জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বলে মত দিয়েছেন আরেক অ্যামিকাস কিউরি এ এফ হাসান আরিফ। তিনি বলেন, ৫ ফেব্রুয়ারিতে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লার মামলার রায় ঘোষণা করেছেন। ওই দিন তার শাস্তি চূড়ান্ত হয়। এরপর আনা সংশোধনী তার েেত্র প্রযোজ্য নয়। তবে আদালতে আপিল বিচারাধীন, দণ্ডসহ সব বিষয় পর্যালোচনা করার এখতিয়ার আদালতের রয়েছে। আজ  সোমবার আদালতের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ মত দেন সাবেক এই অ্যাটর্নি জেনারেল। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ এই শুনানি গ্রহণ করেন। তার আগে সিনিয়র আইনজীবী ও রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক টি এইচ খানও বলেছেন, আইনের সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

হাসান আরিফ বলেন, অপর্যাপ্ত সাজার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপকে আপিলের সুযোগ দিয়ে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে আনা সংশোধনী বৈধ। তবে তা কাদের মোল্লার েেত্র প্রযোজ্য নয়। তাছাড়া প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের রীতি দেশীয় আইনের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য তা অনুসরণ করা যেতে পারে।

সোমবার আসামিপে শেষ দিনের মতো শুনানি করেন ট্রাইব্যুনালে আসামীপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। এরপর মঙ্গলবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের সমন্বয়ক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান সাংবাদিকদের জানান, মঙ্গলবারই শুনানি শেষ করবেন রাষ্ট্রপ। আধা ঘণ্টার মতো শুনানি করবেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এরপরই আদালত আপিল মামলাটির রায়ের দিন ধার্য করতে পারেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

আজ  শুনানি শেষে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘৫ ফেব্রুয়ারি আবদুল কাদের মোল্লার রায় হয়ে যাওয়ার পর ১৮ ফেব্রুয়ারি আইনে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা আবদুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সুতরাং সরকার পক্ষ যে আপিল করেছে সে আপিল বাতিলযোগ্য এবং এটা বাতিল হওয়া উচিত। কিন্তু আদালতের ক্ষমতা আছে, আদালত ইচ্ছা করলে আবদুল কাদের মোল্লার শাস্তি বাড়াতে পারেন। সরকারের যে আপিল সে আপিল অকার্যকর, এটা চলতে পারে না। দ্বিতীয়ত আমরা বলেছি- আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে, যদি না বাংলাদেশের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। ১৯৭৩ সালের আইনের কোনো বিধান আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে। তৃতীয়ত- আদালতে সরকারপক্ষ যে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করেছে, সে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেয়া অসম্ভব। আমি আপনাদের বলছি, আদালতেও বলেছি, রাষ্ট্রপক্ষ যে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করেছে, তার ভিত্তিতে আবদুল কাদের মোল্লাকে সাজা দেয়া অসম্ভব এবং তার বেকসুর খালাস পাওয়া উচিত। আমাদের আপিল গৃহীত হওয়া উচিত এবং সরকারের আপিল বাতিল হওয়া উচিত। তিনি বলেন, এসব দুর্বল সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে যদি কাদের মোল্লাকে সাজা দেয়া হয়, তাহলে এটি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের আপিলের ভিত্তিতে কাদের মোল্লার শাস্তি বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সাজা বাড়াতে পারেন, সে ক্ষমতা আদালতের আছে, কিন্তু কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে নয়। সাত জন অ্যামিকাস কিউরির পাঁচ জনই সংশোধিত আপিল আইন আবদুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ বলে মত দিয়েছেন- এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, সংখ্যা বড় বিষয় নয়, এখানে ন্যায্যতা দেখা হবে। আমাদের বক্তব্য সঠিক কিনা, আইনিভাবে গ্রহণযোগ্য কিনা, তা দেখার পর আদালত বিচার করবেন। এটা তাদের এখতিয়ার।

মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে দুটিতে তাকে যাবজ্জীবন, তিনটিতে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড এবং একটিতে খালাস দেয়া হয়। এ রায়ের প্রতিবাদে শাহবাগে শুরু হয় আন্দোলন। মূল আইনে সাজা বাড়াতে সরকার পক্ষের আপিলের বিধান না থাকলেও আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আইন সংশোধন করে সরকারকে আপিলের সুযোগ দেয়া হয়। পরে সরকার ও আসামি দু-পক্ষই আপিল দায়ের করে। এ আপিলের শুনানিকালে উত্থাপিত আইনি প্রশ্নের মিমাংসায় গত ২০ জুন সাত জন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ এর ক্ষেত্রে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে কি না? দ্বিতীয়ত, ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধন করে ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে যে ভূতাপে কার্যকারিতা দেয়া হয়েছে, তা কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না?

শুনানিতে অংশ নিয়ে আইনের সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলে মত দেন সংখ্যাগরিষ্ঠ অ্যামিকাস কিউরি। অ্যামিকাস কিউরিদের মধ্যে ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ এবং ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি মত দেন যে, আইনের সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অন্যদিকে, সিনিয়র অ্যাডভোকেট টি এইচ খান ও এ এফ হাসান আরিফের মতে সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ প্রশ্নে শুধুমাত্র ব্যারিস্টার রফিক-উল হক মত দেন তা প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের পক্ষে মত দেন। ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ১৯৭৩ সালের ট্রাইব্যুনালস আইনে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিফলন রয়েছে। মাহমুদুল ইসলাম বলেন, এ প্রশ্নে হ্যাঁ না উত্তর দেয়া কঠিন। সাধারণভাবে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে না। তবে দেশীয় আইনে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা থাকলে, শূন্যতা থাকলে অথবা ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজন হলে আন্তর্জাতিক আইনের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। আজমালুল হোসেন কিউসি মত দেন, সাংঘর্ষিক না হলে আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইন প্রযোজ্য হবে। টি এইচ খানের মত, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে। তবে দেশীয় আইনের সাথে আন্তর্জাতিক আইন সাংঘর্ষিক হলে সেেেত্র দেশীয় আইন প্রাধাণ্য পাবে। এ এফ হাসান আরিফের মতে আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইন প্রযোজ্য হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন