রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৩

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলার রায় আগামীকাল

মেহেদী হাসান, ১৪/৭/২০১৩, রোববার, ঢাকা :
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় ঘোষনা করা হবে আগামীকাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ  রায়ের এ তারিখ ঘোষনা করেন।

সকালে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে সাড়ে বারটার দিকে চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলার রায় প্রস্তুত হয়েছে। আগামীকাল সোমবার রায় ঘোষনা করা হবে।
রায়ের দিন ঘোষনার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুম ট্রাইব্যুনালের সামনে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আসামীর সর্বোচ্চ শাস্তির প্রত্যাশা করছি। আমরা আশা করি ট্রাইব্যুনাল অধ্যাপক গোলাম আযমকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করবে।

অপর দিকে আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এসময় সাংবাদিকদের বলেন, এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৬২টি অভিযোগ এনেছিল। যার মধ্যে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ কোন অপরাধের সাথে গোলাম আযম সাহেবের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ ওইসব অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টতা প্রমানে কোন এভিডেন্স আনতেও ব্যর্থ হয়েছে। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের একাত্তর সালের কোন বক্তব্য বিবৃতির পর কেউ অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েছে এটাও রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আশা করি গোলাম আযম সাহেব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাবেন।

গত বছর ১৩ মে চার্জ গঠনের মাধ্যমে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। চলতি বছর ১৭ এপ্রিল অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সমস্ত বিচার প্রক্রিয়া শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়। প্রায় তিন মাস পরে ট্রাইব্যুনালের অন্যতম আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষনা করা হচ্ছে আজ।
এর আগে একই ট্রাইব্যুনাল থেকে অপর আলোচিত মামলায় মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়। অপর দিকে  ট্রাইব্যুনাল- থেকে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার রায় দিয়েছে এর আগে।
অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রায়ের দিন ঘোষনার পর আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ট্রাইব্যুনালকে বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযম অসুস্থ। তাকে রায়ের সময়  ট্রাইব্যুনালে হাজির  না করলে ভাল হয়।
বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির বলেন, রায় শোনা আসামীর অধিকার। আমরা তো ইতোমধ্যে তাকে হাজির করার আদেশ দিয়েছি। তার অসুস্থতার বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ : অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকান্ড পরিচালনা এবং বিভিন্ন অপরাধ সংগঠন বিষয়ে চারটি শিরোনামে ৬০টি অভিযোগসহ মোট ৬১টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়।  এগুলো হল স্বাধীনতা বিরোধী ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি এবং সংশ্লিষ্টতা বিষয়ক অভিযোগ। এছাড়া গোলাম আযমের নির্দেশে ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া কারাগারে ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে  আলাদা একটি অভিযোগ আনা হয়েছে। এটিই তার বিরুদ্ধে একমাত্র ব্যক্তিগতভাবে অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টতা বিষয়ক অভিযোগ। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৬২টি অভিযোগ আনা হয়েছিল।
 
পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, এবং উসকানি বিষয়ে অভিযোগের মূলে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির হিসেবে অধ্যাপক গোলাম আযম ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খানসহ পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষের সাথে নিয়মিত বৈঠক করেছেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বনকারী এদেশীয় অন্যান্য দল এবং সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে নিয়মিত বৈঠক করে স্বাধীনতা বিরোধী পরিকল্পনা এবং ষড়যন্ত্র করেছেন। স্বাধীনতাবিরোধী বক্তব্য বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে উসকানি দিয়েছেন তার অনুগতদের।  এ অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ১৯৭১ সালের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবর কাটিং আকারেদাখিল করা হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।

এক কথায়  নেতৃত্বের দায় হিসেবে ১৯৭১ সালের ৩০ লাখ মানুষ হত্যা, ৪ লাখ নারী ধর্ষণসহ সমস্ত অপরাধ এবং  ধ্বংসযজ্ঞের দায়ভার চাপানো হয়েছে অধ্যাপক গোলাম আযমের ওপর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন, পরিকল্পনা এবং  এসব বাহিনী গোলাম আযমের নির্দেশে, পরামর্শে ও পরিকল্পনায় কার্যক্রম  কার্যক্রম পরিচালনা করত মর্মে অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ তিনি তখন জামায়াতে ইসলামীর আমির ছিলেন এবং জামায়াত ও তৎকালীন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসংঘের লোকজন এসব বাহিনীতে যোগ দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী অপরাধ সংঘঠনে পাকিস্তান বাহিনীকে তারা সরাসরি সহায়তা করেছে। 
সে কারনে ১৯৭১ সালের যাবতীয় অপরাধের দায় আনা হয়েছে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে।

অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র  এবং পরিকল্পনা বিষয়ে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে   ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল নুরুল আমীন, মৌলভী ফরিদ আহমেদ, খাজা খয়ের রউদ্দিন, এ কে এম শফিকুল ইসলাম, মাওলান নুরুজ্জামান, হামিদুল হক চৌধুরী, মোহসিন উদ্দিন আহমেদ, এ টি সাদীসহ ১২ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের ষড়যন্ত্র করেন।
৬ এপ্রিল গোলাম আযম আবারও টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং  ষডযন্ত্রে অংশ নেন। ৪ ও ৬ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে গোলাম আযমসহ অন্যরা সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ৪ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে সারা দেশে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ এপ্রিল গোলাম আযম ও অন্যরা ঢাকায ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করেন। ১৫ এপ্রিল এর নাম পরিবর্তন করে কেন্দ্রীয শান্তি কমিটি করা হয।  ৪ মে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে এ কিউ এম শফিকুল ইসলামের বাসভবনে খাজা  খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির সভা হয, যেখানে গোলাম আযম উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিযনে শান্তি কমিটি গঠনের বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয।

১৯ জুন এই ষডযন্ত্রের ধারাবাহিকতায  গোলাম আযম রাওযালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইযাহিযা খানের সঙ্গে উচ্চপর্যাযরে একটি বৈঠক করেন। বৈঠকে  সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবিলার জন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান জানান।

১ ডিসেম্বর রাওযালপিন্ডিতে আবারও ইযাহিযা খানের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে মোকাবিলার জন্য রাজাকার বাহিনীর শক্তি বাডানোর পরামর্শ দেন মর্মে অভিযোগ আনা হয়েছে।
এভাবে সামরিক নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করে নাগরিক শান্তি কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন গঠনের নেতৃত্বদানের অভিযোগ আনা হয়েছে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ।
১৯৭১ সালে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য, বিবৃতি উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকান্ডের উসকানী এবং মানবতাবিরোধী  অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব বক্তব্য বিবৃতিতে তিনি স্বাধীনতাকামী, মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয়  অনুপ্রবেশকারী, দৃস্কৃতকারী, বিশ্বাসঘাতক প্রভৃতি অভিধায় আখ্যায়িত করে তাদের ধ্বংস করার আহবান জানিয়েছেন মর্মে অভিযোগ করা আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে । 

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :

২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি অধ্যাপক গোলাম আযম ট্রাইব্যুনালে হাজির হন ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে। সেদিন ট্রাইব্যুনাল তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তখন থেকে  নব্বয়োর্ধ অধ্যাপক গোলাম আযম বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিজন সেলে বন্দী রয়েছেন।

অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরদ্ধে ২০১২ সালেল ১৩ মে চার্জ গঠন করা হয়। ১ জুলাই সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষ্য গ্রহন শেষে চলতি বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তি উপস্থান শুরু হয়।

রাষ্ট্রপক্ষে ১৬ জন সাক্ষী  অধ্যাপক গোলাম আযমের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর মধ্যে সাতজন সাক্ষী ছিলেন জব্দ তালিকার। বাকীরা ১৯৭১ সালের ঘটনা বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ঘটনা বিষয়ক সাতজন সাক্ষী হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর  ড. মুনতাসীর মামুন, মাহবুব উদ্দিন আহমদ  বীরবিক্রম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা  ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি) এর চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দিন আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা দণিপাড়া গ্রামের সোনা মিয়া,  গীতিকার ও সুরকার মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, রাজধানীর নাখালপাড়ার ফরিদ আলম । এছাড়া একজন নারী সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে।
অপর দিকে অধ্যাপক গোলাম আযমের পক্ষে একমাত্র সাক্ষী ছিলেন তার ছেলে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।
স্কাইপ  কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর  পদত্যাগ করেন। স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ধরে আসামী পক্ষ ১৯ ডিসেম্বর অধ্যাপক গোলাম আযমসহ অন্য দুজনের পুনরায় বিচার দাবি করে আবেদন করে। আসামী পক্ষের  অভিযোগ- অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনসহ মামলার যাবতীয় আদেশ এবং সিদ্ধান্ত বেলজিয়ামে বসবাসরত ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কাছ থেকে এসেছে। প্রমান হিসেবে তারা আদালতে বলেন, ১৩ মে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের আদেশ দেয়া হয়েছে। আগের দিন ১২ ডিসেম্বর বেলজিয়াম থেকে একটি ড্রাফট আসে। চার্জ গঠন বিষয়ক সে ড্রাফটে  শুধু তারিখ পরিবর্তন করে তা ট্রাইব্যুনালে পাঠ করে শোনানো হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। এর স্বপক্ষে তারা ট্রাইব্যুনালে ডকুমেন্ট হাজির করে। তবে শুনানী শেষে চলতি বছর ৩ জানুয়ারি পুনরায় বিচারের তিনটি আবেদনই খারিজ করে দেয়া হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ সালে লন্ডন থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন অধ্যাপক গোলাম আযম। আমির হিসেবে আবার দায়িত্ব পান জামায়াতে ইসলামীর। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলমীর আমির পদ থেকে পদত্যাগ করে তিনি রাজনীতি থেকে অবসরে যান । 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন