শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০১৩

রায় পর্যালোচনা//সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে মুক্তির সুপারিশ ছিল গোলাম আযমের চিঠিতে!


মেহেদী হাসান, ১৬/৭/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমকে  সিরু মিয়া, তার কিশোর ছেলে আনোয়ার কামালসহ ৩৮ জন বন্দী মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার দায়ে ৩০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। সিরু মিয়া হত্যাকান্ড বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ছিল- অধ্যাপক গোলাম আযমের  চিঠির নির্দেশে ব্রাèনবাড়িয়া জেলখানা থেকে বের করে  সিরু মিয়অসহ ৩৮ জনকে হত্যা করা হয়।

তবে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী শহীদ সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম জেরায় জানিয়েছেন অধ্যাপক গোলাম আযমের লেখা চিঠিটি তার ভাই ফজলুর রহমান ব্রাèবাড়িয়া নিয়ে গিয়েছিলেন এবং চিঠিটি  তার ভাই  পড়েছিলেন। সে চিঠিতে লেখা ছিল তার স্বামী সিরু মিয়া এবং ছেলে আনোয়ার কামালকে মুক্তির বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ করেছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম।  চিঠিটি ছিল ছোট্ট দুই লাইনের।

তবে  যে চিঠির ওপর ভিত্তি করে সিরু মিয়া হত্যাকান্ডের জন্য অধ্যাপক গোলাম আযমকে অভিযুক্ত  করা হয়েছে এবং ৩০ বছর জেল দেয়া হয়েছে আলোচিত সেই  চিঠি রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে পারেনি।  চিঠি যে বহন করেছিল এবং চিঠি যাকে পৌছানো হয়েছিল  এবং যিনি পাঠ করেছেন তাদের কাউকেই হাজির করা হয়নি সাক্ষী হিসেবে।

সিরু মিয়াসহ ৩৮ জন হত্যাকান্ডের ঘটনা :  অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রায়ে সিরু মিয়া এবং ব্রাèনবাড়িয়া জেলখানায় বন্দী ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধা হত্যার বিবরন সাক্ষীদের বরাত দিয়ে বিস্তারিতভাবে  তুলে ধরা হয়েছে । রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা চার্জ থেকে রায়ে ঘটনাটি নিম্নরুপ আকারে উল্লেখ করা হয়েছে।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সিরু মিয়া ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মোহাম্মদপুর থানায় দারোগা ছিলেন। ২৭ বা ২৮ মার্চ তিনি সপরিবারে কুমিল্লা জেলার হোমনা থানায় নিজ গ্রাম রামকৃষ্ণপুর চলে যান।  গ্রামে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। তিনি তার নিজ বাড়িতে ক্যাম্প গড়ে তোলেন এবং এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করতে থাকেন। প্রশিক্ষনের জন্য অনেককে ভারতে পাঠান এবং নিজেও ভারতে গিয়ে আবার ফিরে আসেন। এর এক পর্যায়ে  তিনি তার  ১৪ বছরের কিশোর ছেলে আনোয়ার কামাল, নজরুল ইসলামসহ আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা  মিলে কসবা থানার তন্তর চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে যাবার পথে অস্ত্রসহ রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন ২৭ অক্টোবর। এরপর তাদেরকে ব্রাèবাড়িয়া কোর্টে চালান দেয়া হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে ব্রাèনবাড়িয়া জেলাখানায় হস্তান্তর করা হয়। কোর্টে চালান  দেয়া এবং জেলখানায় হস্তান্তরের পূর্বে তাদেরকে দানা মেয়ার বাড়িতে আর্মি ক্যাম্প রেখে দফায় দফায় নির্যাতন করা হয়।
সিরু মিয়ার স্ত্রীর নাম আনোয়ারা বেগম। আনোয়ারা বেগমের ছোট বোনের নাম মনোয়ারা বেগম। মনোয়া বেগমের স্বামীর নাম মহসিন আলী খান। অর্থাৎ মহসিন আলী খান সিরু মিয়ার ভায়রা। এই মহসিন আলী খান  ১৯৭১ সালে খিলগাও সরকারী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। সেই স্কুলে পড়তেন অধ্যাপক গোলাম আযমের দুই ছেলে আযমী ও আমীন। অধ্যাপক গোলাম আযমের দুই ছেলে মহসিন আলীরও ছাত্র ছিল। সেই সূত্র ধরে সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম তার বোনের স্বামী মহসিন আলীকে অনুরোধ করেন অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে যাওয়ার জন্য। তার স্বামী এবং ছেলেকে জেলখানা থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছ থেকে একটি সুপারিশপত্র সংগ্রহের জন্য।

মহিসন আলী খান অধ্যাপক  গোলাম আযমের কাছে তার মগবাজার বাসায় যান। দুই দিন পর তিনি জামায়াতের নাখালপাড়া পার্টি অফিসে যেতে বলেন। সেখানে গেলে অধ্যাপক গোলাম আযম মহসিন আলী খানকে খামে আটকানো একটি চিঠি দেন। চিঠিখানা তিনি ব্রাèনবাড়িয়া শান্তি কমিটির নেতা পেয়ার মিয়ার কাছে পৌছানোর জন্য বলেন। মহসিন আলী সে চিঠি এনে সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়রা বেগম এর কাছে দেন। আনোয়ারা বেগম তার ভাই ফজলুর রহমানকে সে চিঠিসহ পাঠান ব্রাèবাড়িয়া শান্তি কমিটির নেতা পেয়ারা মিয়ার কাছে।

পেয়ারা মিয়ার কাছে চিঠি হস্তান্তরের পর পেয়ারা মিয়অ  ফজলুর রহমানকে অধ্যাপক গোলাম আযম লিখিত আরেকটি অফিসিয়াল চিঠি দেখান যেখানে সিরু মিয়াকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে মর্মে উল্লেখ আছে। কারণ তারা মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সিরু মিয়ার স্ত্রীকে বাড়ি ফিরে আল্লারহ কাছে প্রার্থনা করতে বলেন। শেষ পর্যন্ত সিরু মিয়াসহ ৪০ জনকে জেলখানা থেকে বের করে আনা হয়। এদের মধ্যে একজন শফিউদ্দিন আহমেদ উর্দু ভাষা জানার কারনে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাকী ৩৯ জনকে পৈরতলায় নিয়ে রাজাকার আল বদররা গুলি করে হত্যা করে। হত্যাকান্ড থেকে চিনু মিয়া নামে একজন ঘটনাক্রমে বেঁচে যায়। এভাবে অধ্যাপক গোলাম আযমের সরাসরি নির্দেশে সিরু মিয়া, আনোয়ার কামাল, নজরুল ইসলাম, আবুল কাসেমসহ ৩৮ জনকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে মর্মে অভিযোগ করা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।

সাক্ষী : অভিযোগটির পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মোট আট জন সাক্ষী হাজির করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। ট্রাইব্যুাল রুদ্ধদ্বার কক্ষে তার জবানবন্দী গ্রহণ করায় তখন তা সাংবাদিকদের জানানো হয়নি এবং গনমাধ্যমে  প্রকাশও নিষিদ্ধ ছিল। তবে তার জবানবন্দী  রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে পর্যালোচনা আকারে এবং অভিযোগের  স্বপক্ষে ভিত্তি আকারে। এছাড়া অপর গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন  শফিউদ্দিন আহমদ। তিনিও ২৭ অক্টোবার সিরু মিয়ার সাথে ভারত যাবার পথে ধরা পড়েছিলেন এবং তাকেও হত্যার জন্য ৪০ জনের সাথে জেলখানা থেকে বের করে আনা হয়েছিল।  তবে তিনি ১৯৭০ সালে করাচির একটি কলেজে লেখাপড়া করতেন এবং উর্দু জানার কারনে পাকিস্তানের সাদ উল্ল্যাহ নামে এক বিগ্রেডিয়ার তাকে ছেড়ে দেন বলে তিনি জানান ট্রাইব্যুনালে।
এ ঘটনায় রাষ্ট্রপক্ষের আরেকজন  উল্লেখযোগ্য সাক্ষী  হলেন বিশিষ্ট সুরকার গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তিনিও সিরু মিয়া, আনোয়ার কামালদের  সাথে ব্রাèনবাড়িয়া জেলাখানায় বন্দী ছিলেন।

সাক্ষীদের বরাতে ঘটনার বিবরন : রাষ্ট্রপক্ষের এসব সাক্ষীদের বরাত দিয়ে সিরু মিয়া হত্যাকান্ডের ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে রায়ে। সাক্ষীদের বিবরন অনুযায়ী পাকিস্তান আর্মি ৪০ জনকে জেলখানা থেকে বরে নিয়ে নিয়ে এসেছিল। পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন ২১ নভেম্বর রাতে এ হত্যাকান্ড ঘটানো হয়। সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ট্রাইব্যুনালে জানান তার  ভাই ফজলুর রহমান ব্রাèনবাড়িয়া পেয়ারা মিয়ার বাড়ি থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার দুই দিন তিনি তার স্বামী এবং ছেলর হত্যাকান্ডের  খবর জানতে পারেন। তার স্বামী এবং ছেলের কাপড় পোচড় ফেরত পাঠানো হয় তার কাছে। স্বাধীনতার পর শফিউদ্দিন জেল থেকে ছাড়া পাবার পর তার সাথে দেখা করেন এবং শফিউদ্দিন তার কাছে হত্যাকান্ডের বিবরন দেন। ৩৮ জনের সাথে তার স্বামী এবং ছেলেকেও হত্যা করা হয়েছে বলে শফিউদ্দিন জানান তাকে।

সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ট্রাইব্যুনালে তার স্বামী এবং ছেলে হত্যা বিষয়ে ঘটনার যে বিবরন দিয়েছেন তা তুলে ধরা হয়েছে রায়ে। তিনি তার  জবানবন্দীতে বলেন, ‘আমার ভাই পেয়ারা মিয়াকে চিঠি দেয়ার পর পেয়ারা মিয়া আমার ভাইকে আরেকটি চিঠি খুলে দেখান এবং তা পড়তে বলেন। ঔ চিঠিতে নির্দেশ ছিল এরা মুক্তি বাহিনী , এদের খতম করে দেয়া হউক। তিনি আমার ভাইকে আরো বলেন, আপনি যে চিঠি নিয়ে এসেছেন তাতে অনেক কিছু লেখা থাকলেও এটা সাদা কাগজ । এ লেখার কোন গুরুত্ব নেই। পেয়ারা মিয়া আমার ভাইকে বড়ি ফিরে আল্লাহর নাম নিতে বলেন।...পেয়ারা মিয়া আমার ভাইকে যে চিঠিটি দেখিয়েছিলেন সে চিঠির নির্দেশ ছিল গোলাম আযমের। ’

সিরু মিয়া এবং তার ছেলেকে মুক্তির সুপারিশ ছিল চিঠিতে?
সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগমকে জেরায় প্রশ্ন করা হয় তিনি তার ভাইকে দিয়ে অধ্যাপক গোলাম আযমের লেখা যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তা তিনি নিজে পড়েছিলেন কি-না। তিনি জবাবে জানান তিনি পড়েননি। কারণ সেটি খামবদ্ধ ছিল। তবে আনোয়ারা বেগম জানান, তার ভাই সে চিঠি পেয়ারা মিয়ার কাছে নিয়ে যাবার পরে পড়েছিলেন এবং চিঠির বিষয সম্পর্কে পরে তাকে বলেছিলেন। দুই লাইনের ছোট্ট সে চিঠিতে অধ্যাপক গোলাম আযম   সিরু মিয়া এবং তার ছেলের মুক্তির বিষয়ে বিবেচনার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।

রায়ে আনোয়রা বেগমের জবানবন্দী বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলেও জেরার এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।
অধ্যাপক গোলা আযমের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, যে চিঠিতে মুক্তির জন্য সুপারিশ করা হয়েছে তা কি করে মানবতা বিরোধী অপরাধ হতে পারে?
আনোয়ারা বেগমের ভাই ফজলুর রহমান যিনি চিঠি বহন করেছিলেন তিনি এখন মৃত।  যার কাছে চিঠি পৌছানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে সেই পেয়ারা মিয়াও  বর্তমানে মৃত। তবে যে মহসিন আলী সরাসরি অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছ থেকে চিঠিটি এনেছিলেন  তিনি বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। রাষ্ট্রপক্ষ তাকেও হাজির করতে পারেনি। তবে তার জবানবন্দী  তার অনুপস্থিতিতে  আদালতে দাখিল করা হয়েছে এবং ১৯ (২) ধারায় আদালত তা গ্রহণ করেছেন। রায়ে মহসিন আলীকে মৃত উল্লেখ করা হয়েছে। অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম বলেন, এটি ভুলে হতে পারে। তিনি জীবিত আছেন।

তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান জেরায় স্বীকার করেছেন গোলাম আযমের লেখা চিঠি উদ্ধারের জন্য পেয়ারা মিয়ার বাড়িতে যাননি। সে বাড়ি তল্লাসি করেননি এবং পেয়ারা মিয়ার জীবিত ছেলে সানাউল হকের সাথেও যোগাযোগ করেননি।

সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম স্বীকার করেছেন তাদের  যে চিঠি গোলাম আযম লিখেছিলেন তাতে তার স্বামী এবং সন্তানকে মুক্তির জন্য সুপারিশ ছিল। কিন্তু রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে অধ্যাপক গোলাম আযম ইচ্ছা করলে তার অধীনস্ত পেয়রা মিয়াকে নির্দেশ দিয়ে সিরু মিয়াসহ অপর তিনজনের জীবন বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তার অধীনস্ত পেয়রা মিয়াকে নিগেটিব সিগনাল দিয়ে সিরু মিয়া এবং অপর তিনজনকে হত্যায় সহযোগিতা করেছেন।

রায়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে উল্লেখ করা হয়েছে শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক গোলাম আযমের নির্দেশে সিরু মিয়া, তার ছেলে, নজরুলইসলামসহ ৩৮ জন বন্দী মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে।

সাক্ষী আনোয়ারা বেগম বলেছেন তার বোনের স্বামী মহসিন আলী ১৯৭১ সালে মতিঝিল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। অপর দিকে মহসিন আলী তার জমা দেয়া জবানবন্দীতে দাবি  উল্লেখ করেছেন তিনি ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত খিলগাও গভ: স্কুলে শিক্ষক ছিলেন। ১৯৯৫ সালে মতিঝিল বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অবসর নেন।

আনোয়রা বেগম বলেছেন ৯১৭১ সালে তার ছেলে মতিঝিল সরকারী স্কুলে পড়ত এবং গোলাম আযমের দুই ছেলেও সেই স্কুলে পড়ত। অন্য দিকে মহসিন আলীর দাবি অনুযায়ী তারা তখন খিলগাও সরকারী স্কুলে পড়ত।
অধ্যাপক গোলাম আযমের পক্ষে আইনজীবী মিজানুল ইসলাম আনোয়ারা বেগমেকে জেরার সময় সাজেশন দিয়ে বলেন, মহসিন আলী খন্দকারকে অধ্যাপক গোলাম আযম কর্তৃক চিঠি দেয়া, সে চিঠি নিয়ে পেয়ারা মিয়ার কাছে যাওয়া, পেয়ারা মিয়া কর্তৃক গোলাম আযমের আরেকটি অফিসিয়াল চিঠি দেখানো, গোলাম আযমের দুই ছেলের মহসিন আলীর ছাত্র থাকার তথ্য সব মিথ্যা। তবে আনোয়ারা বেগম এ সাজেশন অস্বাীকার করেন।

সাক্ষ্য : রায়ে আনোয়রা বেগমের সাক্ষ্য থেকে যে বিবরন তুলে ধরা হয়েছে তা এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হল। আনোয়ারা বেগম বলেছেন সিরু মিয়া তার স্বামী। আনোয়ার কামাল তার ছেলে। ১৯৭১ সালে তার স্বামী মোহাম্মদপুর থানায় পোস্টিংয়ে ছিল। তার ১৪ বছরের ছেলে মতিঝিল সরকারি   উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে পড়ত। ১৯১৭১ সালের ২৮ অথবা ২৯ মার্চ তিনি তার বোনের পরিবারসহ হোমনার রামকৃষ্ণপুরে চলে যান। এরপর  সিরু মিয়া ভারতে চলে যান এবং ১৫/২০ দিন থাকার পরে চলে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদেন। তিনি পাঁচটি থানার দায়িত্ব পালন করেন। ২৫ অক্টোবর সিরু মিয়া, আনোয়ার কামাল, নজরুল, কাসেম, জাহাঙ্গীর, সেলিম, শফিউদ্দিন ভারতের উদ্দেশে বাড়ি ছেড়ে যায়। ২ দিন পর তার স্বামীল চাচাত ভাই জাহারু  এসে জানায় তার স্বামী ছেলে এবং অন্যরা ধরা পড়েছে। তাদেরকে ব্রাèনবাড়িয়া নেয়া হয়েছে। এরপর তিনি তার ভাই ফজলুর রহমানকে ব্রাèবাড়িয়া পাঠান এবং তার ছেলে সিগারেটের সাদা কাগজে তাকে একটি চিঠি লিখেন। এরপর তিনি তার পিতার সাথে ঢাকায় তার বোন মনোয়ারা বেগমের বাসায় আসেন। তার বোনের স্বামী মহসিন আলী খান মতিঝিল সরকার স্কুলের শিক্ষক ছিলেন তখন এবং পরে খিলগাও সরকারি স্কুল থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি আগেই জানতেন গোলাম আযমের দুই ছেলে মহসিন আলীর ছাত্র ছিল। তাই সেই সূত্রে তিনি মহসিন আলীকে গোলাম আযমের কাছে পাঠানা তার স্বামী এবং ছেলের মুািক্তর বিষয়ে সুপারিশ সংগ্রহের জন্য। দুই দিন পর মহসিন আলী অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছ থেকে চিঠি সংগ্রহ করে দেন। চিঠিখানা গোলাম আযম ব্রèনবাড়িয়া শান্তি কমিটির সভাপতি পেয়ারা মিয়ার কাছে পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক তিনি সে  চিঠি নিয়ে তিনি তার ভাই ফজলুর রহমানকে ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া পাঠান । সে চিঠি পেয়ারা মিয়াকে দেয়ার পর পেয়ারা মিয়া তাকে গোলাম আযমের আরেকটি অফিসিয়াল চিঠি দেখান যেখানে বলা আছে তারা মুক্তিযোদ্ধা। তাদের হত্যা করা হোক। নতুন যে চিঠি নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার কোন মূল্য নেই। কারণ সেটি সাদা কাগজে লেখা। তার ভাই বাড়ি ফিরে আসল। এর দুই দিন পর তিনি তার স্বামী এবং ছেলের জামা কাপড় ফেরত পেলেন এবং তাদের মৃত্যুর খবর জানতে পারলেন।
স্বাধীনতার পর তার স্বামীর সাথে ধরা পড়া শফিউদ্দিন তার সাথে দেখা করেন । তার স্বামীসহ ৩৮ জনকে হত্যার বিবরন দেন। এছাড়া একদিন টিভিতে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে এ ঘটনা বলতে দেখে তিনি তাকে ফোন দেন । এর আগে তার সাথে তার পরিচয় ছিলনা বলে সাক্ষী জানান।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সাক্ষ্য তুলে ধরে রায়ে বলা হয়েছে তিনিও ভারত যাবার পথে তন্তর চেকোপোস্টে ধরা পড়েন এবং ব্রাèনবাড়িয়া কারাগারে রাখা হয়। সেখানে আনোয়ার কামালের সাথে পরিচয় হয় এবং তাদের ঘটনা জানতে পারেন। এরপর ঈদুল ফিতরের দিন রাতে পাকিস্তান আর্মি সিরু মিযা আনোয়ার কামালসহ ৪০ জনকে বের করে নেয়ার ঘটনার রিববনর দেন তিনি।
সাক্ষী শফিউদ্দিন আহমেদের বাড়ি হোমনার রামনগর। তিনিও সিরু মিয়ার সাথে ভারতে যাবার জন্য ২৫ অক্টোবার রওয়ানা হন। এরপর সিরু মিয়াসহ তিনি ধরা পড়া থেকে শুরু করে ব্রান্নবাড়িয়া জেল খানায় বন্দী হওয়া, ৩৮ জনকে ২১ নভেম্বর ঈদুল ফিতরের দিন পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক বের করে নিয়ে যাওয়া এবং তার রক্ষা পাওয়ার ঘটনার বিস্তারিত বিবরন দেন।

মূল্যায়ন :
ইভালুয়েশন অব এভিড্যান্স এন্ড ফাইন্ডিংস শিরোনামে রায়ে বলা হয়েছে-পাঁচ নং অভিযোগ সিরু মিয়া, আনোয়ার কামাল, নজরুল ইসলামসহ ৩৮ জনকে গোলাম আযমের সরাসরি নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি, রাজাকার আলবদর কর্তৃক হত্যার অভিযোগ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ মোট আট জন সাক্ষী হাজির করেছে।  রায়ে বলা হয়েছে শফিউদ্দিন আহমেদ এ অভিযোগের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন সাক্ষী। কারণ তার দাবি অনুযায়ী সেও সিরু মিয়া আনোয়ার কামালসহ একসাথে ধরা পড়েন এবং তাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একসাথে বন্দী ছিলেন জেলখানা।

আনোয়ার কামাল ১/১১/১৯৭১ সালে সিগারেটের কাগজে তার মাকে যে চিঠি লিখেছিলেন সে চিঠি আদালতে হাজির করা হয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে-আম্মা, সালাম নিবেন। আমরা  জেলে আছি। জানিনা কবে ছুটব। ভয় করবেননা। আমাদের ওপর তারা অকথ্য অত্যাচার করেছে। দোয়া করবেন। আমাদের জেলে অনেক দিন থাকতে হবে। ঈদ মোবারক। কামাল।

মহসিন আলী তার লিখিত জবানবন্দীতে জানিয়েছেন তিনি সিরু মিয়ার আপন ভায়রা। তিনি ১৯৬৮  থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত খিলগাও সরকারি স্কুলে শিক্ষক ছিলেন। অধ্যাপক গোলাম আযমের দুই ছেলে ওই সময় তার ছাত্র ছিল। ১৫ রমজানের পর সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম তার চৌধুরী পাড়া বাসায় আসেন এবং তাকে অনুরোধ করেন অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছ থেকে তার স্বামী ও ছেলের মুক্তির বিষয়ে একটি সুপারিশ সংগ্রহের জন্য। তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছ থেকে চিঠি এনে আনোয়ারা বেগমের কাছে দিয়েছেন। এরপর জানতে পারেন ২১ নভেম্বর সিরু মিয়া, আনোয়ার কামালসহ অন্যদের হত্যা করা হয়েছে।  মহসিন আলীর অনুপস্থিতিতে তার জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে ১৯ (২) ধারায়।

রায়ে উল্লেখ করা হয় সাক্ষ্য প্রমান বিশ্লেষনে এটি প্রতিষ্ঠিত যে, ১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর সিরু মিয়া, আনোয়ার কামাল, নজরুল এবং অন্যরা ভারতে যাবার জন্য বাড়ি থেকে রওয়ানা হন। এরপর তারা তন্তর চেকপোস্টে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন এবং পরে তাদের  ব্রাèনবাড়িয়া কারাগারে রাখা হয়। শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক গোলাম আযমের নির্দেশে ২১ নভেম্বর ঈদুল ফিতরের দিন সিরু মিয়া, আনোয়ার কামাল, নজরুল, কাসেমসহ ৩৮ জনকে পাকিস্তান আর্মি, রাজাকার এবং আল বদর বাহিনীর লোকজন হত্যা করে। এটা প্রমানিত যে, অধ্যাপক গোলাম আযম ইচ্ছা করলে তার অধীনন্ত ব্রাèনবাড়িয়া শান্তি কিমিটির নেতা পেয়ারা মিয়াকে নির্দেশনা দিয়ে সিরু মিয়া, আনোয়ার কামাল, নজরুল এবং কাসেমের জীবন রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তাদেরকে হত্যায় সহযোগিতা করেছেন এবং ভূমিকা পালন করেছেন। কাজেই সিরু মিয়া এবং অপর তিনজনকে হত্যার জন্য অধ্যাপক গোলাম আযম মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ।

আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন,  চিঠি নেই, চিঠির বাহক নেই, চিঠির পাঠকও নেই। তারপরও মাননীয় ট্রাইব্যুনাল তাদের ‘প্রজ্ঞা‘য় গোলাম ্আযমকে মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য সাজা প্রদান করেছেন। আমাদের দেশের ফৌজদারী আইনের দু‘শো বছরের ইতিহাসে এরকম সাক্ষ্য প্রমাণের উপর ভিত্তি করে কাউকে সাজা দেওয়ার কোন নজির নেই।
অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম বলেন, পেয়ারা মিয়ার কাছে গোলাম আযমের আরেকটি অফিসিয়াল  চিঠির কথা বলা হয়েছে । কিন্তু গোলাম আযম কি করে পেয়ারা মিয়ার কাছে অফিসিয়াল চিঠি লিখবেন? সে চিঠি কাকে সম্বোধন করা হয়েছিল তাও কোন সাক্ষী বলতে পারেননি। গোলাম আযমের কোন হাতের লেখার সাথেও তারা আগে থেকে পরিচিত ছিলনা বলে জানিয়েছেন।
অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম বলেন, এ রায়ে আমরা একটি বিষয়ে সন্তুষ্ট যে আসামী পক্ষ কোন অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি। ট্রাইব্যুনাল  আসামী পক্ষের সাক্ষীদের বিশ্বাস না করে দালিলিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করেছেন। তবে আদালতের প্রতি সম্মান রেখেই আমরা বলছি আদালত যেসব দালিলিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করেছে সে বিষয়ে আমরা কোন জবাব দেয়ার সুযোগ পাইনি।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে  বিরোধী দলীয়  নেতা থাকাকালে ১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল গণআদালতের ন্যায্যতা এবং  অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে  যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের প্রমান তুলে ধরে একটি ভাষন দেন। ভাষনে তিনি বলেন, গোলাম আযম যে একজন হত্যাকারী ছিলেন তার একটি প্রমান আমি এখানে এনেছি। কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর  গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিরু মিয়া দারোগা ও তার কিশোর পুত্র আনোয়ার কামালকে গোলাম আযমের লিখিত নির্দেশে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৭  অক্টোরব সিরু মিয়া এবং তার কিশোর পুত্র আনোয়ার কামাল ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার সময় অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাসহ রাজাকারদের  হাতে ধরা পড়েন। সিরু মিয়া মুক্তিযুদ্ধে অনেক দু:সাহসিক কাজ করেছেন। তিনি আমাদের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী বেগম তাজউদ্দিনকে সপরিবারে কুমিল্লা সীমান্ত থেকে পার করে দিয়েছিলেন। সেই সিরু মিয়াকেও গোলাম আযমের নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিল। তার নজির  ও প্রমান (কাগজ দেখিয়ে) এই কাগজে আছে। আপনি (মাননীয় স্পিকার) চাইলে এই কাগজও আপনার কাছে দিতে পারি।

পাক্ষিক ‘একপক্ষ’ নামে একটি ম্যাগাজিনে  বাংলা ১৪১৭ (ইংরেজি ২০১০ ) সংখ্যায় ‘গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের প্রমান প্রধানমন্ত্রীর কাছেই  আছে’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। পাক্ষিক এক পক্ষের ওই প্রতিবেদনে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে  সংসদে  তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা কর্তৃক উত্থাপিত   অভিযোগ এর বিষয়টি বিস্তারিত  তুলে ধরা হয়।

একপক্ষ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত  উপরোক্ত প্রতিবেদনটি  রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া হয়েছে ।  এ বিষয়ে গত বছর ১১ অক্টোবর   তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা করেন অধ্যাপক গোলাম আযমের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। জেরায় তদন্ত কর্মকর্তা জানান তিনি ওই  প্রমানপত্রটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সংগ্রহ করেননি  এবং যোগাযোগও করেননি কোথাও।
 এ বিষয়ে রায়ে কোন কিছু উল্লেখ করা হয়নি।







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন