সোমবার, ৮ জুলাই, ২০১৩

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে করাচীতে আমার বাসায় আমাকে দেখতে আসেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী


Mehedy Hasan
বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে আজ সাক্ষ্য দিয়েছেন নিজাম আহমেদ নামে এক ব্যক্তি। তিনি জানান ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের করাচী যাবার পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার বাসায় তাকে দেখতে এসেছিলেন।

জবানবন্দী :
আমার নাম নিজাম আহমেদ, আমার বয়স-৬৩ বৎসর। আমার ঠিকানা-ফাট ২০১, হাউজ নম্বর এন,ই,জি ২এ, রোড ৮৪, গুলশান-২, ঢাকা।

আমার সালাউদ্দিন কাদের চৌধূরী সাহেবের সংগে প্রথম পরিচয় হয় নটরডেম কলেজে শিক্ষাবর্ষ ১৯৬৭-৬৮ সালে। আমার স্কুলের বন্ধু ছিল কাইয়ুম রেজা চৌধূরী, সে আমাকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধূরীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সেখানে সালমান ফজলুর রহমান (সালমান এফ রহমান)  ছিলেন যিনি কাইয়ুম রেজা সাহেবের কাজিন। আমরা একসাথে ঘোরাফেরা বা চলাফেরা করতাম বন্ধু হিসাবে। পরবর্তীতে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৮-৬৯ ব্যাচে ভর্তি হই।  সালাউদ্দিন কাদের ঐ সময় ধানমন্ডিতে বসবাস করতেন। ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলন শুরু হলে আমরা তাতে অংশগ্রহন করি এবং শহীদ আসাদ যখন গুলিবিদ্ধ হয় তখন তিনি আমার থেকে দুই ফিট দূরে অবস্থান করছিলেন। তখন সালমান, কাইয়ুম, সালাউদ্দিন ও আমিসহ, আমরা একত্রে ছিলাম।
১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারী আমিনুল হক বাদশার সহিত হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে যাই বিদেশী সাংবাদিকদের নিকট প্রেস রিলিজের কপি দেওয়ার জন্য। ঐদিন রাত্রি সাড়ে দশটার দিকে পাকিস্তানী সৈন্যরা বলল যে, ঐ হোটেল থেকে কেউ বের হতে পারবেনা। আমরা ২৫শে মার্চ রাত্রি থেকে ২৭শে মার্চ সকালে কারফিউ ভাঙ্গার পূর্ব পর্যন্ত আমরা ঐ হোটেলেই ছিলাম। সেখানে ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ, সাইমন ড্রিং এবং ফরাসী ফটোগ্রাফার যার নাম মিশেল ছিলেন। এই দুইজন সাংবাদিক লুকিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্দেশ অমান্য করেও গণহত্যার বিভিন্ন ছবি তুলেছিলেন। ২৭শে মার্চ কারফিউ ভাঙ্গার পরে আমি এবং আমার ছোট ভাই হাটতে হাটতে ধানমন্ডি চলে যাই, কাইয়ুম তার মগবাজারের বাসায় চলে যান এবং বাদশা ভাই আতœগোপনে চলে যান। এরপর আমরা আমাদের পরিবারের সদস্য সহ ইস্কাটনে আমার খালার বাড়িতে চলে যাই। ২৮শে মার্চে আমি এবং কাইয়ুম সাহেব ধানমন্ডির ৮ নম্বর রোডে (পুরাতন) অবস্থিত সুইডিস পরিবারের বাসায় উঠি যাহা সালাউদ্দিন কাদের চৌধূরী সাহেবের বাসার দুই রাস্তা পরে অবস্থিত। ঐ বাসায় আমরা ৪/৫ দিন ছিলাম। ঐ সময় কাইয়ুম সাহেব উর্দু ভাষা জানতো বলে তিনি গাড়ি নিয়ে বের হতেন এবং ঐ সময় শেখ কামালের সংগে কাইয়ুমের দেখা হয়। শেখ কামালও আমাদের সংগে ঐ সুইডিস বাসায় থাকা আরম্ভ করল। ঐ বাসায় থাকাকালীন সময়ে কাইয়ুম আমাকে বলেছিল যে, তিনি সালাউদ্দিন কাদের চৌধূরীকে বিমান বন্দরে রেখে এসেছেন এবং শেখ কামালকে টেকি্রার ব্যবস্থা করে আরিচা ফেরিঘাটের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন, তবে শেখ কামাল যেতে নাপেরে ফিরে এসেছিলেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার ঐ সুইডিস পরিবারকে ঢাকা ছাড়ার জন্য নির্দেশ দেন। এরপর ঐ সুইডিস পরিবার আমাদের খাবার দাবার দিয়ে গাড়ি করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে কাইউমের বোনের ভাড়া বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। ঐ বাসায় আমরা শেখ কামাল সহ আনুমানিক ৩/৪ দিন ছিলাম। তারপর আমি আমার নিউস্কাটনস্থ খালার বাসায় চলে যাই। তখন শুনলাম আমার অনেক বন্ধুরা করাচিতে চলে যাচ্ছে। আমিও চিন্তা করলাম যে, করাচি হয়ে খাইবার পাস হয়ে জার্মানীতে যাবো। কারণ উদ্দেশ্য ছিল আমাদের কয়েকজন বন্ধু জার্মানীতে ছিল এবং কয়েকজন ইতোমধ্যে সেখানে চলে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের ৭/৮ তারিখ কাইউম, সালমান এবং আমি একই বিমানে করে করাচিতে গিয়ে সালমানের বাসায় উঠি। সেখানে ২/১ দিন পরে সালাউদ্দিন কাদের চৌধূরী সাহেবও সেই বাসায় আমাদের দেখতে আসেন। ঐ সময় কাইউম সাহেব বাসায় ছিলেননা, আমি এবং সালমান ছিলাম। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালের এপ্রিল কিংবা মে মাসে ঢাকার হোটেল পূর্বানীতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধূরী সাহেবের সংগে আমার দেখা হয়। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে করাচিতে সালমানের বাড়িতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধূরী সাহেবের সংগে আমার দেখা হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের এপ্রিল/মে ঢাকার হোটেল পূর্বানীতে দেখা হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে আমার সহিত তার আর দেখা হয়নাই। করাচি থেকে ইসলামাবাদ যাওয়ার পরে কাইউম ইসলামাবাদে তার বোনের বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন। ইহার ১৫/২০ দিন পর আমি ঢাকায় ফিরে আসি এবং জুন মাসের শুরুর দিকে আমি ভারতের আগড়তলা চলে যাই। এই আমার জবানবন্দী।

জেরা
অদ্য ট্রাইব্যুনালে আমি আমার পেশার বিবরণ প্রদান করিনাই। আমি নিজাম আহমেদ তৎমর্মে আমার নিকট জাতীয় পরিচয়পত্র নাই, তবে পাসপোর্ট আছে। পাসপোর্ট এই মুহুর্তে আমার নিকট নাই। (চলবে)
৯/৭/২০১৩
জেরা
আমি  ১৯৬৬ সালে ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে মানবিক বিভাগে এস,এস,সি পাশ করেছি। ১৯৬৮ সালে নটরডেম কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইস,এস,সি পাশ করেছি। আমরা দুই ভাই, দুই বোন এবং দুইজন বৈমাত্রেয় ভাই আছে। আমার অপর ভাইয়ের নাম নেওয়াজ আহমেদ এবং আমার দুই বোনের নাম নাছরিন আহমেদ এবং নাতাশা আহমেদ। আমার আম্মা ১৯৭৪ সালে এবং আমার আব্বা ২০১০ সালে মারা যান। আমার দাদার বাড়ি ছিল কুষ্টিয়া শহরে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৮-৬৯ ব্যাচে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হই। মুক্তিযুদ্ধের কারণে অর্থনীতি সম্মান কোর্স সম্পন্ন করিতে পারিনাই। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে বি.এ.পাশ কোর্সে পাশ করেছি। আমি অনার্সে পরীক্ষা দিইনাই। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবের পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেবকে আমি অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের মত মুসলিম লীগের নেতা হিসাবে চিনতাম। জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব আইয়ুব সরকারের আমলে স্পিকার ছিলেন এবং শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে ঐ সময় আমাদের স্কুল পরিদর্শন করেছিলেন। আমার বন্ধু সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবের পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের অনুপস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট পদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমার জবানবন্দীতে যে ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনের কথা বলেছি সেই আন্দোলনটি ছিল ৬ দফা এবং ১১ দফার ভিত্তিতে গণ-আন্দোলন। সেই গণ-আন্দোলন ছিল আইয়ুব খানের একনায়কতন্ত্রের বিরূদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল। উক্ত আন্দোলন বাংলাদেশের জনগণের আতœনিয়ন্ত্রণ আধিকার প্রতিষ্টার জন্য ছিল কিনা তাহা আমি জানিনা। আমার বন্ধু সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবের পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পরে আমি খুব একটা পত্রপত্রিকা পড়িনাই। ঐ সময়ের পর আমি ঢাকা শহরে খুব একটা ঘোরাফেরা করতামনা।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে গণহত্যার পর এপ্রিল মাসের পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এবং মুসলিম লীগের নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব সহ অন্যান্য নেতারা লেঃ জেনারেল টিক্কা খানের সংগে সাক্ষাৎ করিয়া সমর্থন জানান কিনা তাহা আমি জানিনা। ১৯৭৪ সালে হোটেল পূর্বানীতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবের সংগে আমার দেখা হওয়ার পূর্বে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে করাচিতে দেখা হওয়ার কথা অসত্য, ইহা সত্য নহে। ঐ সময় বিমান যোগে ঢাকা থেকে পাকিস্তান যাওয়ার পথে শ্রীলংকার উপর দিয়ে যেতে হতো বিধায় ৬ঘন্টা সময় লাগতো। পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আসতে একই সময় লাগতো। ঢাকা-করাচি এবং করাচি-ঢাকা বিমান ভ্রমণ সংক্রান্ত কোন ডকুমেন্ট আমি ট্রাইব্যুনালে দাখিল করিনাই, তবে ট্রাইব্যুনাল চাইলে দাখিল করতে পারবো। ‘‘১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলন শুরু হলে আমরা তাতে অংশগ্রহন করি এবং শহীদ আসাদ যখন গুলিবিদ্ধ হয় তখন তিনি আমার থেকে দুই ফিট দূরে অবস্থান করছিলেন। তখন সালমান, কাইয়ুম, সালাউদ্দিন ও আমি সহ, আমরা একত্রে ছিলাম”-কথাগুলি অসত্য, ইহা সত্য নহে। ‘‘২৮শে মার্চে আমি এবং কাইয়ুম সাহেব ধানমন্ডির ৮ নম্বর রোডে (পুরাতন) অবস্থিত সুইডিস পরিবারের বাসায় উঠি”-কথাগুলি অসত্য, ইহা সত্য নহে। ‘‘ ঐ বাসায় আমরা ৪/৫ দিন ছিলাম। ঐ সময় কাইয়ুম সাহেব উর্দু ভাষা জানতো বলে তিনি গাড়ি নিয়ে বের হতেন এবং ঐ সময় শেখ কামালের সংগে কাইয়ুমের দেখা হয়। শেখ কামালও আমাদের সংগে ঐ সুইডিস বাসায় থাকা আরম্ভ করল। ঐ বাসায় থাকাকালীন সময়ে কাইয়ুম আমাকে বলেছিল যে, তিনি সালাউদ্দিন কাদের চৌধূরীকে বিমান বন্দরে রেখে এসেছেন এবং শেখ কামালকে টেকি্রার ব্যবস্থা করে আরিচা ফেরিঘাটের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন, তবে শেখ কামাল যেতে না পেরে ফিরে এসেছিলেন ” বা,  ‘‘ ঐ বাসায় আমরা শেখ কামাল সহ আনুমানিক ৩/৪ দিন ছিলাম। তারপর আমি আমার নিউস্কাটনস্থ খালার বাসায় চলে যাই। তখন শুনলাম আমার অনেক বন্ধুরা করাচিতে চলে যাচ্ছে। আমিও চিন্তা করলাম যে, করাচি হয়ে খাইবার পাস হয়ে জার্মানীতে যাবো। কারণ উদ্দেশ্য ছিল আমাদের কয়েকজন বন্ধু জার্মানীতে ছিল এবং কয়েকজন ইতোমধ্যে সেখানে চলে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের ৭/৮ তারিখ কাইউম, সালমান এবং আমি একই বিমানে করে করাচিতে গিয়ে সালমানের বাসায় উঠি। সেখানে ২/১ দিন পরে সালাউদ্দিন কাদের চৌধূরী সাহেবও সেই বাসায় আমাদের দেখতে আসেন। ঐ সময় কাইউম সাহেব বাসায় ছিলেননা, আমি এবং সালমান ছিলাম।”- একথাগুলি অসত্য, ইহা সত্য নহে।
১৯৬৯ সালে শহীদ আসাদ গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থান ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুরাতন ইমার্জেন্সির বিপরীতে রাস্তার উপর।
আমার কোন পেশা নাই, আমার কোন রোজগার নাই, আমি একজন ভবগুরে ব্যক্তি হওয়ায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেবের পরিবারের লোকজনের নিকট হতে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে আর্থিক লাভবান হয়ে, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক সত্য গোপন ও অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের অসম্মান করে, শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী করে শিখানো মতে অসত্য ও বানোয়াট সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালে প্রদান করেছি, ইহা সত্য নহে। (সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন