বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১২

‘গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের প্রমান প্রধানমন্ত্রীর কাছেই আছে’ প্রতিবেদন বিষয়ে জেরা ///প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে প্রশ্নে আপত্তি ট্রাইব্যুনালের


মেহেদী হাসান, ১১/১০/২০১২
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে  বিরোধী দলীয়  নেতা থাকাকালে ১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল গণআদালতের ন্যায্যতা এবং  অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে  যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের প্রমান তুলে ধরে একটি ভাষন দেন। ভাষনে তিনি বলেন, গোলাম আযম যে একজন হত্যাকারী ছিলেন তার একটি প্রমান আমি এখানে এনেছি। কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর  গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিরু মিয়া দারোগা ও তার কিশোর পুত্র আনোয়ার কামালকে গোলাম আযমের লিখিত নির্দেশে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৭  অক্টোরব সিরু মিয়া এবং তার কিশোর পুত্র আনোয়ার কামাল ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার সময় অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাসহ রাজাকারদের  হাতে ধরা পড়েন। সিরু মিয়া মুক্তিযুদ্ধে অনেক দু:সাহসিক কাজ করেছেন। তিনি আমাদের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী বেগম তাজউদ্দিনকে সপরিবারে কুমিল্লা সীমান্ত থেকে পার করে দিয়েছিলেন। সেই সিরু মিয়াকেও গোলাম আযমের নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিল। তার নজির  ও প্রমান (কাগজ দেখিয়ে) এই কাগজে আছে। আপনি (মাননীয় স্পিকার) চাইলে এই কাগজও আপনার কাছে দিতে পারি।

পাক্ষিক ‘একপক্ষ’ নামে একটি ম্যাগাজিনে  বাংলা ১৪১৭ (ইংরেজি ২০১০ ) সংখ্যায় ‘গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের প্রমান প্রধানমন্ত্রীর কাছেই  আছে’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে  সংসদে   প্রধানমন্ত্রী  অভিযোগ এবং প্রমান উত্থাপন   সংক্রান্ত উপরোক্ত বিষয়টি বিস্তারিত  তুলে ধরা হয়।

একপক্ষ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত  উপরোক্ত প্রতিবেদনটি  রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া হয়েছে ।  এ বিষয়ে আজ   তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা করেন অধ্যাপক গোলাম আযমের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরার সময় মিজানুল ইসলাম প্রশ্ন করেন,  প্রতিবেদনে বর্নিত  প্রধানমন্ত্রীর  কাছ থেকে ওই প্রমানপত্রটি   উদ্ধারের জন্য   যোগাযোগ করেছিলেন কি-না।  প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে করা এ পশ্নে  আপত্তি  করেন ট্রাইব্যুনাল। শেষে ট্রাইব্যুনালের পরামর্শে মিজানুল ইসলাম  প্রশ্নটি অন্যভাবে করেন।  এরপর এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন,  তিনি ওই প্রমানপত্রটি সংগ্রহ করেননি । এমনকি অধ্যাপক গোলাম আযম যে পেয়ারা মিয়ার কাছে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন বলে বলা হয় তার বাড়িতে তল্লাসী করেনি এবং তার ছেলের সাথেও যোগাযোগ করেননি বলেন জানান তদন্ত কর্মকর্তা।

১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর ঈদের  দিন রাতে  ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া জেলখানা থেকে  সিরু মিয়া, তার কিশোর পুত্র আনোয়ার কামালসহ ৩৮ জন বন্দী মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এ হত্যঅ  বিষয়ে অধ্যাপক গোলাম আযমের  বিরুদ্ধে অভিযোগ  আনা হয়েছে। গতকাল এ বিষয়ে জেরা করা হয় তদন্ত কর্মকর্তাকে।



জেরা (সংক্ষিপ্ত) :
প্রশ্ন : ‘গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের প্রমান প্রধানমন্ত্রীর কাছেই  আছে’ শিরোনামে ‘একপক্ষ’ ম্যাগাজিনে  প্রকাশিত একটি   প্রতিবেদন আপনি দাখিল করেছেন।
উত্তর : হ্যা।

প্রশ্ন :  প্রতিবেদনে  গোলাম আযমের  বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের প্রমান যেখানে আছে বলা হয়েছে তা সংগ্রহের জন্য সেখানে যোগাযোগ করেছিলেন?
উত্তর : না। কারণ তদন্তের জন্য তা প্রয়োজন মনে হয়নি।
প্রশ্ন : ওই  প্রতিবেদনে  বর্নিত সিরু মিয়ার মুক্তির জন্য গোলাম আযমের যে চিঠির কথা বলা হয়েছে তা উদ্ধারের জন্য সচিবালয় বা কোন মন্ত্রণালয়ে  আপনি কোন পত্র পাঠিয়েছিলেন?

উত্তর : না।
প্রশ্ন : অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের লিখিত সিরু মিয়ার মুক্তি সংক্রান্ত চিঠিটি আপনি সিরু মিয়ার স্ত্রী শহীদ জননী আনোয়ারা বেগম আপনাকে প্রদান করেননি।
উত্তর :  না, তিনি  প্রদান করেননি।
প্রশ্ন : চিঠি উদ্ধারের জন্য আপনি পেয়ারা মিয়ার বাড়ি  তল্লাসী করেছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : পেয়ারা মিয়া জীবিত?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তার ছেলে মেয়ে জীবিত আছে কেউ?
উত্তর : আছে।
প্রশ্ন : বড় ছেলের নাম কি?
উত্তর :  সানাউল হক  চৌধুরী নামে এক ছেলের নাম আছে।
প্রশ্ন : তার সাথে যোগাযোগ করেছেন চিঠি উদ্ধারের জন্য?
উত্তর : না কারণ আমার ধারণা থাকলেও সে দেবেনা।
প্রশ্ন :  আনোয়ারা বেগম অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে গেছেন এ মর্মে আপনার তদন্তে কোন তথ্য নাই।
উত্তর : নাই।
প্রশ্ন : ১৯৭৫ সালে মার্চ মাসে আল হামরা প্রসাদে সৌদি বাদশার সাথে অধ্যাপক গোলাম আযম সাক্ষাৎ করেছেন এ মর্মে আপনার কাছে তথ্য আছে।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : এ তথ্য কোন ব্যক্তির কাছ থেকে পেয়েছেন না কোন ডকুমেন্ট আকারে পেয়েছেন?
উত্তর : ব্যক্তির কাছ থেকে।
প্রশ্ন : যার কাছ থেকে পেয়েছেন তিনিও সেদিন সৌদি বাদশার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : অধ্যাপক গোলাম আযম কবে দেশে আসলেন?
উত্তর : ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই  পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে লন্ডন থেকে ঢাকায় আসেন।
প্রশ্ন : দেশে আসার পরপর  গোলাম আযম  সাহেব তার পাসপোর্ট জমা দিয়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ফেরত পাবার জন্য আবেদন করেছিলেন।
উত্তর : আমার তদন্তে নাই। তবে ১৯৯৩ সালে তার নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ বেআইন ঘোষনা করে হাইকোর্টের প্রদত্ত রায় বহাল রাখেন আপীল বিভাগ।

প্রশ্ন :  তদন্তকালে অধ্যাপক গোলাম আযমের বক্তব্য জানার জন্য তার কাছে গিয়েছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তার বক্তব্য জানার জন্য তাকে কোন চিঠি দিয়েছিলেন?


উত্তর : না।
প্রশ্ন : সিরু মিয়া এবং তার ছেলে আনোয়ার কামাল  ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া জেলখানায় আটক ছিলেন এ মর্মে কোন দালিলিক প্রমান আছে আপনার কাছে?
উত্তর : সরকারি রেকর্ড নেই। তবে জেলখানা থেকে আনোয়ার কামাল তার মায়ের কাছে যে চিঠি লিখেছেন তা আছে এবং এ মর্মে সাক্ষীও আছে।

প্রশ্ন : জেলখানা থেকে আত্মীয়দের কাছে চিঠি লিখতে হলে তা জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে লিখতে হয় তা জানা আছে?
উত্তর : ১৯৭১ সালে ওই জেলখানায় সেরকম কোন পরিস্থিতি ছিলনা।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে ওই জেলখানার প্রধান কেউ  ছিলেন ?
উত্তর : থাকতে পারে।
প্রশ্ন : আনোয়ার কামাল কর্তৃক তার মায়ের কাছে যে চিঠি লেখার কথা জানিয়েছেন তা তা জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠানো হয়নি ঠিক কি-না?
উত্তর : জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠানো  নয় তবে সাক্ষী আনোয়ারা বেগমের ভাই ফজলুর রহমানের মাধ্যমে  তা আনোয়ারা বেগমের  হাতে আসে।
প্রশ্ন :  ১৯৭১ সালে ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার  সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসর  (এসডিপিও)  কে ছিলেন?
উত্তর : ইসমাইল হোসেন সিএসপি।
প্রশ্ন : ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া  জেল সুপার কে ছিলেন সে বিষয়ে কোন  খোঁজ খবর নেননি?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে  ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া জেলখানায় কয়েদী/বন্দী সংক্রান্ত কোন নথিপত্র সংগ্রহ করেননি।
উত্তর : পাইনি।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে ২১ নভেম্বর ওই জেলখানায় কারারক্ষী হিসেবে কারা ছিল তাদের নামও সংগ্রহ করেননি।
উত্তর : না।
প্রশ্ন : এ বিষয়ে তথ্য চেয়ে কারা বিভাগের প্রধানের কাছে কোন চিঠি লিখেছেন ?
উত্তর : না করন ওই সময় স্বাভাবিক অবস্থা ছিলনা।
প্রশ্ন : তদন্তকালে চিনু মিয়া নামে কারো অস্তিত্ব পেয়েছেন?
উত্তর : পেয়েছি।
প্রশ্ন : তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন?
উত্তর : না। কারণ খুঁজে পাইনি।
প্রশ্ন : তার ঠিকানা পেয়েছিলেন?
উত্তর : পেয়েছি।
প্রশ্ন : তার বাড়ি কোথায়?
উত্তর : এ মুহূর্তে  বলতে পারছিনা।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর শহীদ সিরু মিয়া, শহীদ আনোয়ার কামাল ছাড়া বাকী যে ৩৬ জনকে জেল থেকে বের করে  শহীদ  করা হয় তাদের কারো  খোঁজ পেয়েছেন?
উত্তর : শহীদ নজরুলসহ আরো কয়েকজনের খোঁজ পেয়েছি তবে এ মুহুর্তে তাদের নাম বলতে পারবনা।
প্রশ্ন : ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া শহর থেকে নিখোঁজ হয়েছেন এ মর্মে কোন তথ্য পেয়েছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া শহরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বা প্রখ্যাত যারা মুক্তিযোদ্ধা  আছেন তাদের  পরিচিত কেউ ১৯৭১ সালে নিখোঁজ হয়েছেন কি-না   সে বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন?

উত্তর : আমার ডায়েরিতে উল্লেখ নেই।




আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার  কার্যক্রম পরিচালনা করেন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি আনোয়ারুল হক।

তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরায় মিজানুল ইসলামকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট মনজুর আহমদ আনসারী,  অ্যাডভোকেট শিশির মনির প্রমুখ।
চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম,  প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন