মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৩

মাওলানা নিজামীর পক্ষে সাক্ষ্য দিলেন পাবনা জেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শামসুল আলম

মেহেদী হাসান , 22/10/2013
পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ  এর  সাবেক কমান্ডার মো: শামসুল আলম মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা মো : শামসুল হক এর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় আজ।

জবানবন্দী :
সাক্ষী তার জবানবন্দীতে বলেন, আমার নাম মোঃ শামসুল আলম। বয়স আনুমানিক ৬২ বছর। ঠিকানা : গ্রাম- গোবিন্দা, থানা- পাবনা সদর, জেলা- পাবনা।

সাক্ষী তার পরিচয় সম্পর্কে বলেন, আমি একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আমি পাবনা জেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা জেলা কমান্ডার এবং জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের আহ্বায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের বিবরন দিয়ে সাক্ষী বলেন,  ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাত্রে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তখন আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। পরবর্তীতে ২৮শে মার্চ আমার বাড়ির নিকটবর্তী টিএন্ডটি ভবনে অবস্থানরত পাক সেনাদেরকে আক্রমণ করে তাদের নিশ্চিহ্ন করি।  সেখানে ২৯ জন পাক সেনা ছিল। পরের দিন ২৯শে মার্চ পাবনার মাধপুর নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক সেনাদের যুদ্ধ হয় এবং সেখানে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়।  এ যুদ্ধে অনেক পাক সেনা নিহত হয়। এরপর ৮ই এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা জেলা শত্রুমুক্ত ছিল। তারপর ১৯শে এপ্রিল পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ডাববাগানে (শহীদনগর) যুদ্ধ হয়।  সেখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং অনেক পাক সেনাও নিহত হয়। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় ট্রেনিং এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসার জন্য ভারতে  যাই। আমি প্রথমে ভারতের কেচুয়াডাংগা ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগদান করি। এরপর  আমাদেরকে উচ্চতর ট্রেনিং-এর জন্য জুনের শেষের দিকে অথবা জুলাইয়ের প্রথম দিকে বিহারের চাকুলিয়ায় পাঠিয়ে দেয়। সেখানে ২৮ দিনের উচ্চতর ট্রেনিং দেওয়ার পরে মুর্শিদাবাদ জেলার বাবুলতলী অপারেশন ক্যাম্পে নিয়ে আসে। বাবুলতলী অপারেশন ক্যাম্প থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ১২/১৩ই আগষ্ট বাংলাদেশের রাজশাহী এলাকায় প্রবেশ করি এবং রাজশাহী শহরের পাশে সিতলাই ব্রীজ বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে  দেই। তার দুই দিন পর সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে অভয়া ব্রীজ অপারেশনে গেলে পাক সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয়।  সেখানে আমাদের তিনজন মুক্তযোদ্ধা শহীদ হন এবং পাক সেনাদের অনেক হতাহত হয়। পরবর্তীতে ভারতের ধূলাউড়ি ক্যাম্পে যাই এবং সেখান থেকে মকবুল হোসেন সন্টুর নেতৃত্বে পাবনা এলাকায় চলে আসি। দেশে আসার পর আড়িয়া গোয়ালবাড়ি নামক স্থানে নকশাল, রাজাকার সম্মিলতি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয় আমাদের এবং সেখানে ২৩ জনকে পাকড়াও করি। পরবর্তীতে পাবনার নিকটবর্তী তিনগাছা বাবুবাড়িতে যুদ্ধ হয় নকশালদের বিরুদ্ধে। সেখানে আমাদের দুইজন শহীদ এবং শত্রুপক্ষের ১৭/১৮ জন নিহত হয়। তিনগাছা বাবুবাড়িটি নকশালদের হেডকোয়ার্টার ছিল যেটি  আমরা যুদ্ধের পরে  দখল করি। ২৭শে নভেম্বর ১৯৭১ সানিকদিয়ায় ভয়াবহ যুদ্ধ হয়।  এ  যুদ্ধে পাক সেনাদের সাথে রাজাকার, নকশাল মিলে তিন শতাধিক ছিল।  মুক্তিযোদ্ধারাও দুই শতাধিক ছিল। যুদ্ধে আমাদের পরিবারের ৯ জনসহ মোট ২০/২৫ জন শহীদ হয় এবং শত্রুপক্ষের অসংখ্য আহত ও নিহত হয়।  পাকসেনারা তাদেরকে গাড়িতে করে নিয়ে যায়। এরপর থেকে পাবনার পশ্চিম অঞ্চল মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হয়। আমি সানিকদিয়ার যুদ্ধে মর্টারের স্পিøন্টারে আহত হই।

সাক্ষী বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শত শত লোকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধ করার কারণে আমাদের নিকট অনেকে অভিযোগ করেছে কিন্তু মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে কেউ কোন সময় কোন অপরাধ করেছে মর্মে কোন অভিযোগ করে নাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমি আমাদের কমান্ডার ইকবাল হোসেন সাহেব এবং মকবুল হোসেন সন্টু সাহেবের সাথে জেলার সাথিয়া, সুজানগর, বেড়াসহ বিভিন্ন থানা এলাকায় গিয়েছি,। শত শত লোক যারা অপরাধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের নিকট অভিযোগ করেছে লোকজন। লোকজনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অনেককে শাস্তি দিয়েছি  কিন্তু কোন লোক মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে কোন অপরাধ করেছে মর্মে কোন অভিযোগ করে নাই। 
সাক্ষী বলেন, আমাদের পাবনা এলাকায় অধিকাংশ যুদ্ধ হয়েছে অতি বিপ্লবী নকশালদের সাথে তার মধ্যে ৮০/৯০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে তাদের গুলিতে। শহীদদের নিকট আত্মীয় ও পরিবারবর্গকে জিজ্ঞাসা করলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে। পাবনা এলাকায় ক্যাপ্টেন জায়েদী, নুরু খন্দকার, টিপু বিশ্বাস, মাসুদ খন্দকার মূলত আর্মিসহ রাজাকার টাজাকারদের নিয়ন্ত্রণ করতো । এখানে  নিয়ন্ত্রণ অর্থ আর্মিদের কমান্ডার ছিল না তবে তাদেরকে যে দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল সেদিকে নিয়ে যেতো।

সাক্ষী বলেন, স্থানীয় পিস কমিটির সভাপতি ছিল স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পিস কমিটির সদস্য ছিল ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বাররা। তারা নি¤œবিত্ত লোকজন নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিল। আমাদেরকে রাজাকারদের সাথে তেমন একটা যুদ্ধ করতে হয় নাই।


জেরা :
জবানবন্দী শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আলী।
প্রশ্ন : আপনার দাদার নাম কি?
উত্তর : কোরবান মালিথা।
প্রশ্ন : আপনারা কয় ভাইবোন?
উত্তর : ১২ জন।
প্রশ্ন : আপনি পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের দায়িত্ব পালন করেছেন কোন সময় থেকে কোন সময় পর্যন্ত?
উত্তর : ২০০১ সাল থেকে ২০০৯ সালের মে মাস পর্যন্ত।
প্রশ্ন : ২০০১ সালের পর কারা ক্ষমতায় ছিল জানা আছে?
উত্তর : চারদলীয় জোট।
প্রশ্ন : চারদলীয় জোটের মধ্যে অন্যতম ছিল জামায়াতে ইসলামী ।
উত্তর : ছিল।
প্রশ্ন : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী তখন মন্ত্রী ছিলেন।
উত্তর : ছিলেন।
প্রশ্ন : তিনি তখন জামায়াতের আমির ছিলেন।
উত্তর : হতে পারে।
প্রশ্ন : ২০০১ সালের নির্বাচনের আগেই আপনি নিজামী সাহেবের অনুপ্রেরনায় জামায়াতে যোগদেন  এবং আপনি তার কাছে মানুষে পরিণত হন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি ২০০১ সালের নির্বাচনে নিজামী সাহেবের পক্ষে প্রচারানয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তার প্রিয়ভাজনে পরিণত হন।
উত্তর : সঠিক নয়।
প্রশ্ন : ২০০১ সালের নির্বাচনের পর নিজামী সাহেব জোটের প্রভাবশালী মন্ত্রী হন এবং  তিনি আপনাকে পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ  করে।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের বিধি অনুযায়ী নির্বাচন হয়েছিল তখন?
উত্তর : শেষের দিকে হয়েছিল।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে এমন দলের নাম আপনার জানা আছে?
উত্তর : মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম এবং নকশালীরা।
প্রশ্ন : মুসলিম লীগ, জামায়াত এবং নেজামে ইসলাম রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : বিপ্লবী নকশাল বাহিনী কখনোই অনুমোদিত কোন রাজনৈতিক ছিলনা।
উত্তর : আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর দলের নাম ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : এ দলের ছাত্রফ্রন্টের নাম ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : এভাবে জামায়াতেরও ছাত্রফ্রন্ট ছিল এবং ১৯৭১ সালে এর নাম ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ যা বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে পরিচিত।
উত্তর : শুনেছি।
প্রশ্ন : সেসময় ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী।
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : আপনার লেখাপড়া কতদূর?
উত্তর : এইচএসসি পাশ।
প্রশ্ন : স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য মুক্তিবাহিনীর পাশপাশি মুজিব বাহিনী হয়েছিল দেশকে হানাদার মুক্ত করার লক্ষ্যে তা আপনি জানেন।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : রাজাকার বাহিনীর পাশাপাশি  আল বদর বাহিনী গঠিত হয়েছিল তাও আপনি জাননে।
উত্তর : শুনেছি।
প্রশ্ন : আল বদর বাহিনী গঠিত হয়েছিল পাকিস্তান বাহিনীকে সহায়তার জন্য।
উত্তর : হয়তোবা।
প্রশ্ন ঃ আড়িয়া গোয়ালবাড়িসহ চরতারাপুর ইউনিয়নেও দখলদার পাক বাহিনী দেশীয় রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের সহযোগীতায় একাধিকবার নিরিহ নিরস্ত্র লোকদের উপর আক্রমন     করেছিল কিনা?
উত্তর ঃ রাজাকার ও পাক বাহিনী দ্বারা আক্রমন হয়েছিল, অন্যদের সম্পর্কে আমার কোন ধারনা     নাই
প্রশ্ন : উক্ত চরতারপুর ইউনিয়নসহ পাবনা জেলার বিভিন্ন স্থানে দখলদার পাক বাহিনী ও রাজাকারদের সাথে  আলবদর বাহিনীর সদস্যরাও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটনে সম্পৃক্ত ছিল।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : সাথিয়া, সুজানগর ও বেড়া থানার আলবদর কমান্ডার ছিল রফিকুন্নবী বাবলু । তিনি সহ অন্যান্য আলবদররাও দখলদার পাক বাহিনী ও রাজাকারদের সাথে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটনে জড়িত ছিল।
উত্তর : আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : পাবনার কোন জায়াগায়  নকশালদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়নি।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : “তিনগাছা বাবু বাড়িটি নকশালদের হেড কোয়ার্টার ছিল” বা “মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে কেউ কোন সময় কোন অপরাধ করেছে মর্মে কোন অভিযোগ করে নাই।” বা “কোন লোক মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে কোন অপরাধ করেছে মর্মে কোন অভিযোগ করে নাই।” আপনার এ বক্তব্য অসত্য।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : নিজামী সাহেব আপনাকে  জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের আহ্বায়াক/কমান্ডার মনোনিত করায় এবং চার দলীয় জোট সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রী জনাব মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের দ্বারা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কারনে তাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে তার পক্ষে অসত্য সাফাই সাক্ষ্য েিদ এসেছেন।
উত্তর : সত্য নয়।

মাওলানা নিজামীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, মনজুর আহমেদ আনসারী, তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন, আসাদ উদ্দিন, তারিকুল ইসলাম প্রমুখ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন