বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৩

আব্দুল আলিমের আমৃত্যু জেল


মেহেদী হাসান ও হাবিবুর রহমান, ৯/১০/২০১৩
প্রবীণ বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলিমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। চারটি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড ছাড়াও অপর চারটি অভিযোগে মোট ২০  বছর এবং আরো একটি অভিযোগে ১০ বছর করাদণ্ড দেয়া হয়েছে তাকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আজ  তার বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষনা করে।
আব্দুল আলিমের বিরুদ্ধে ১৭টি অভিযোগের মধ্যে নয়টিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আটটি অভিযোগে খালাস দেয়া হয়েছে। দোষী প্রমানিত চারটি অভিযোগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করেছে আব্দুল আলিমের  অপরাধ মত্যৃদন্ডের সমতুল্য। তবে তার বয়স এবং শারিরীক অসুস্থতা বিবেচনায় তাকে আমৃত্যু জেল দেয়া হল।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আব্দুল আলিমের বয়স ৮৩ বছর। তিনি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। শারিরীক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ কোন ব্যক্তিকে ফাঁসির কাষ্ঠে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। আমরা তার শারিরীক অসুস্থতার বিষয়ে অন্ধ থাকতে পারিনা।
এ নিয়ে বিএনপির দ্বিতীয় কোন নেতার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডিত করে রায় দিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর আগে বিএনপি জাতীয়  স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল-১।
দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের এটি পঞ্চম রায়। দুই ট্রাইব্যুনাল মিলিয়ে এ পর্যন্ত আটি মামলার রায় ঘোষনা করল।
জনাকীর্ন আদালত কক্ষে  ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সদস্য বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম রায় পড়ে শোনান।
রায়ে বলা হয়েছে, আব্দুল আলিমের বিরুদ্ধে নয়টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়েছে। যে চারটি অভিযোগে  তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে  এসব অভিযোগে আসামীর অপরাধ সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের সমতুল্য। কিন্তু আবদুল আলীম ৮৩ বছরের বয়োবৃদ্ধ একজন মানুষ। তিনি  শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী । হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন।  যদিও আবদুল আলীম শতাধিক মানুষ হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন, তথাপি আইন আসামীর শারীরিক অক্ষমতা অগ্রায্য করে শান্তি দেয়ার ক্ষেত্রে নির্দয় হতে পারে না।

দোষী প্রমানিত নয়টি অভিযোগ :
১. ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানার দমদমা গ্রামের মেহের উদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে হামলা এবং তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা।
২. ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল কাঁদিপুর এলাকার হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামের বাড়িঘরে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের পর ৩৭০ জনকে হত্যা।
৬. ’৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে আক্কেলপুরের ১০জন নিরস্ত্র ব্যক্তিকে ভারত যাওয়ার পথে আটক করে কোকতারা গ্রামের বকুলতলা এলাকায় নয়জনকে হত্যা করা হয়।
৭. ’৭১ সালের ২৬ মে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানার নওদা গ্রামের চারজন নিরস্ত্র মানুষকে কালী পুকুরের পাশে নিয়ে হত্যা করা হয়।
৮. ’৭১ সালের মে মাসে তেলাল থানার উত্তরহাট শহরে হারুনজাহাট এলাকায় হিন্দু জনগণের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হয় এবং ১০ জনকে হত্যা করা হয়।
৯. ’৭১ সালের ১৪ জুন ১৫ যুবককে পশ্চিম আমাত্রা গ্রামে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা।
১০. ’৭১ সালের জুন মাসে ২৬ জন ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটক করা ছবি তোলার। পরে জয়পুরহাট কলেজে নিয়ে হত্যা করা হয়।
১২. ’৭১ সালের ২৬ জুলাই দেবীপুর কাজীপাড়া থানা থেকে ডা. আবুল কাশেমকে হত্যা।
১৪. পাহাড়পুরে আহত মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল করিমসহ আরো দুজনকে হত্যা।

দণ্ড :
উপরোক্ত নয়টি অভিযোগের মধ্যে ১ নং অভিযোগে ১০ বছর; ৬, ৭. ৯ ও  ১২ নং অভিযোগে মোট ২০ বছর এবং ২, ৮, ১০, ও ১৪ নং অভিযোগে আমৃত্যু জেলা দেয়া হয়েছে।
তবে চারটি অভিযোগের ২০ বছর এবং একটি অভিযোগের ১০ বছর কারাদণ্ডও স্বাভাবিকভাবে আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাথে একিভূত হবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

রায় ঘোষনা :
আব্দুল আলিমের বিরুদ্ধে রায় ঘোষনা উপলক্ষে গতকাল সকাল থেকে দেশি বিদেশি  বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক, আইনজীবী, পর্যবেক্ষক,  মুক্তিযোদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধ বিচারের পক্ষে সোচ্চার বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী, ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির নেতাকর্মীরা ট্রাইব্যুনালের সামনে জড়ো হতে থাকে।
এছাড়া অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুম প্রসিকিউশনের সমন্বয়ক এম কে রহমান প্রসিকিউশন টিমের  অন্যান্য  সদস্যদের নিয়ে হাজির হন ট্রাইব্যুনালে। 

১০টা ৫০ মিনিটের সময় রায় ঘোষনা শরু হয়।  রায় ঘোষণার শুরুতে ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, এখন চিফ প্রসিকিউটর বনাম আবদুল আলীম মামলার রায় ঘোষণা করা হচ্ছে। রায়টি মোট  ১৯১ পৃষ্ঠার । তবে রায় সংক্ষিপ্ত আকারে পড়া হবে। শুরুতে বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম, তারপর বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া রায় পাঠ করেন। সব শেষে রায়ের মূল অংশ পাঠ করেন ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
এদিকে রায় ঘোষনা উপলক্ষে ট্রাইব্যুনাল এবং পুরো সুপ্রিম কোর্ট এলাকাজুড়ে ব্যাপক নিরাপত্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার অতিরিক্ত সদস্য মোতায়নের পাশাপাশি আইনশঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন যানবাহন প্রস্তুত রাখা হয়।  ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ প্রার্থীদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে এবং তল্লাশি করে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করানোর ব্যবস্থা করা হয়।
আব্দুল আলিমের ফাঁসির দাবিতে সকাল থেকে ট্রাইব্যুালের সামনে বিভিন্ন সঙ্গঠনের নেতাকর্মীরা ব্যানার নিয়ে মানববন্ধন ও স্লোগান দিতে থাকে।
সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে আবদুল আলীমকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানা থেকে আসামির কাঠগড়ায় আনা হয়। আবদুল আলীমের ছেলে সাজ্জাদ বিন আলীম ও খালিদ বিন আলীম ট্রাইব্যুনালে তাদের বাবার পাশে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া তার আইনজীবী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলে আহসানুল হক হেনা ও মো: তারিকুল ইসলাম। সকাল পৌনে ১০টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেল থেকে আবদুল আলীমকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়।
আব্দুল আলীম জানতে চান কি সাজা হয়েছে:
৮৩ বছরের বয়োবৃদ্ধ আবুল আলিম কানে ঠিকমত  শুনতে পান না। রায় ঘোষণা শুরু হলে আলীম তার ছেলে সাজ্জাদ বিন আলিমকে বলেন, শুনতে পাই না কি বলছে। ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর আদালতের আসামীর কাঠগড়ায় বসা আব্দুল আলীম তার সামনের বেঞ্চে বসা মেজ ছেলে সাজ্জাদ বিন আলিম ও সেজ ছলে খালেদ বিন আলিমের কাছে জানতে চান কি সাজা ঘোষণা করা হয়েছে। ছেলে সাজ্জাদ বিন আলিম বলেন, তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়নি, লাইফ সাজা দিয়েছে।

পরিচিতি:
আবদুল আলীম ১৯৩০ সালের ১ নভেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি থানাধীন পাঁদুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫০-৫১ সালে আলীমের পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জয়পুরহাটে এসে বসবাস শুরু করেন। তিনি ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  ইতিহাস বিষয়ে এম এ পাশ করেন  এবং ১৯৫৩ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাশ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে তিনি কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। ১৯৭৫ ও ১৯৭৭ সালে তিনি জয়পুরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৯, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে জয়পুরহাট পাঁচবিবি আসন থেকে আবদুল আলীম এমপি নির্বাচিত হন। আবদুল আলীম ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রী সভায় প্রথমে  বস্ত্রমন্ত্রী ও পরে যোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। 
আব্দুল আলিমের চার ছেলে ও ১ মেয়ে। তার স্ত্রী ১৯৭১ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

মামলার বিবরণ:
 গত ১৯ সেপ্টেম্বর আবদুল আলীমের পক্ষে মামলার যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়। গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে আসামিপে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন  অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আহসানুল হক হেনা ও অ্যাডভোকেট আবু ইউসুফ মোঃ খলিলুর রহমান। গত ৪ সেপ্টেম্বর আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ১১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন। রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ ও রানা দাসগুপ্ত যুক্তি উপস্থাপন করেন। গত বছরের ১১ জুন আলীমের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে জয়পুরহাটের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, দেশত্যাগে বাধ্য করা এবং এসব অপরাধে উস্কানি ও সহযোগিতার করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ১৭টি ঘটনার অভিযোগ গঠন করা হয়।
আব্দুল আলিমের বিরুদ্ধে ৩৫ জন এবং  পে তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১১ সালের ২৭ মার্চ জয়পুরহাটের বাড়ি থেকে আবদুল আলীমকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ৩১ মার্চ তাকে ১ লাখ টাকায় মুচলেকা এবং ছেলে ফয়সাল আলীম ও আইনজীবী তাজুল ইসলামের জিম্মায় তাকে জামিন দেন ট্রইব্যুনাল-২। ২২ সেপ্টেম্বর মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে আব্দুল আলিমের জামিন বাতিল করে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয় এবং তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে আব্দুল আলিমের মামলটি ছিল প্রথম মামলা।


খালাস পাওয়া আট অভিযোগ :
৩. ’৭১ সালের ১৮ জুন আলীমের দেয়া একটি তালিকা অনুসারে ২৮ জনকে চিহ্নিত করা হয়। তাঁদের মধ্যে ২২জন নিহত হন, বাকিরা পালিয়ে যান।
৪. ’৭১ সালের মে মাসে কোকতারা, বাগজানা, কোটাহারা, ঘোড়াপা গ্রামের ১৯ জন মুক্তিযুদ্ধে পরে লোককে হত্যা।
৫. ’৭১ সালের মে মাসে ৬৭ জন নিরস্ত্র লোককে হত্যা করেকবর দেওয়া হয়।
১১. ’৭১ সালের জুন মাসে ১৯ ব্যক্তিকে খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি সেতুর কাছে নিয়ে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
১৩. আলীমের পরামর্শে পাকিস্তানি সেনারা ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে।
১৫. জয়পুরহাট চিনিকলে স্থাপিত সেনাক্যাম্পে ২৫ জন ব্যক্তিকে আটকে রাখার পর হত্যা করা হয়।
১৬. পাঁচবিবি থানার সুলাইমান আলী ফকির, আফজাল হোসেন, আব্দুল খালেক ও আব্দুস সামাদকে দেশান্তরিত করতে বাধ্য করা।
১৭. ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টের ১৭ উইংয়ের সুবেদার মেজর জব্বল হোসেনকে হত্যা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন