বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০১৩

রায় কে লিখেছে জানতে চায় জাতি

মেহেদী হাসান, ২/১০/২০১৩
সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়শনের এক সভায় আইনজীবী নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ট্রাইব্যুনালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায় কে লিখেছে তা জাতি জানতে চায়। তারা বলেন, রায় আগেই প্রকাশিত হওয়ায় এ নিয়ে জনমনে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে বিচার ব্যবস্থায় অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা আরো বলেন, ট্রাইব্যুনালকে অনুরোধ করবো রায় কে লিখেছে তা আপনারা বলেন।  যদি আপনারা সেটা না বলেন, তাহলে এই দোটানার জাজমেন্টের ক্রেডিবিলিটি নিয়ে সমগ্র বিশ্বে যেমন প্রশ্ন দেখা দেবে, তেমনি বাংলাদেশের মানুষের কাছেও প্রশ্ন দেখা দেবে।

আজ সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক বিশেষ সভায় আইনজীবীরা এসব কথা বলেন।

গত মঙ্গলবার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসির আদেশ দেয়  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। রায়ের পর জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরমের সংবাদ সম্মেলনে বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এই বিচারটি প্রহসনের বিচার। এই বিচার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিচার। ইনশাআল্লাহ যদি জাতীয়তাবাদী শক্তি ক্ষমতায় আসে, তাহলে সত্যিকার অর্থে যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের বিচার হবে এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে নির্দোষ ব্যক্তিদের যে বিচার করা হয়েছে, কাল্পনিক গল্প দিয়ে যে মামলা তৈরি করা হয়েছে, অবশ্যই সেটা চলে যাবে।  যারা এই প্রহসনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো, ইনশাআল্লাহ বাংলার মাটিতে তাদেরও বিচার হবে।’

তার এ কথার রেশ ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সাথে জড়িত বিচারপতিরদেরও বিচার করা হবে বলে মন্তব্য করেছেন খন্দকার মাহবুব হোসেন।

আজ সকালে  অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন  এর বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যথা সুপ্রীম কোর্টের  আপিল বিভাগে নালিশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে আপিল বিভাগের কার্যক্রম শুরু হলে তিনি  খন্দকার মাহবুব হোসেন এর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

সাড়ে নয়টার দিকে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল আবেদন শুনানী শুরুর আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, গতকাল মঙ্গলবার সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক রায় ঘোষনার পর  বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, এ বিচারের সাথে যারা জড়িত তাদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে। মাই লর্ড এ বিচারের সাথে আপনারাও জড়িত। ফলে  এর এ বক্তব্যের মাধ্যমে আপনাদেরও বোঝানো হয়েছে। তিনি এই কোর্টের একজন অফিসার হয়ে এ ধরনের কথা বলতে পারেন কি-না।

তার এ কথার পর প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন বলেন, সিরিয়াস কথা। তো আমরা কি করতে পারি?
এসময় অপর বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, আমরা কিছু দেখিনাই, শুনিনাই। আমাদের সামনে ঘটনা ঘটেনি। আমাদের সামনে আছে শুধু পেপার বুক। তা দেখে আমরা বিচার করি। আপনারা প্রপার জায়গায় যান।
এরপর আর কিছু বলেননি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এসময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান উপস্থিত ছিলেন।

এরপর ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু খন্দকার মাহবুব হোসেন এর বিষয়ে উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানান। ট্রাইব্যুনাল তাকে বলেন লিখিত আবেদন নিয়ে আসার জন্য।

এর জের ধরে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন এর  নেতৃবৃন্দ তাৎক্ষনিকভাবে বার ভবনেরদণি হলে প্রতিবাদ সভা আয়োজন করে। 


বারের সিনিয়র সদস্য ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বারের পরপর দুইবার নির্বাচিত সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের একটি বক্তব্যের ব্যাপারে প্রসিকিউশন টিম আজ ট্রাইব্যুনালে উনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার আবেদন করার উদ্যোগ নিয়েছে। খন্দকার মাহবুব হোসেনকে কলাবোরেটর অ্যাক্টসে বাংলাদেশে যে বিচার হচ্ছিলো সেই বিচারের চিফ প্রসিকিউটরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সুতরাং তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অত্যন্ত বিজ্ঞ একজন সিনিয়র আইনজীবী। তিনি আদালত অবমাননার বিষয়ে কি বলেছেন, তা আমাদের বোধগম্যের বাইরে।’

তিনি আরো বলেন, ট্রাইব্যুনালে যাদের বিচার হচ্ছে- আইন প্রতিমন্ত্রী বিচার চলাকালীন তাদের ফাঁসি দাবি করেছেন। বহুবার দাবি করেছেন। সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া যায়নি, এমন কথা আইন প্রতিমন্ত্রী দাবি করতে পারেননি। তিনি বলেছেন- বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। এর অর্থ আইন প্রতিমন্ত্রী স্বীকার করে নিয়েছেন যে, আইন মন্ত্রণালয় থেকে এ কাজটা করা হয়েছে। বিচারকালীন তারা বলছেন, ফাঁসি চাই। বিচার সুষ্টু হোক তারা তা চায়নি, ন্যায়বিচার তারা চায়নি। যারা বিচার চলাকালীন ফাঁসি চেয়েছেন তারা তাদের এই দাবির মাধ্যমে বিচারপতিদের প্রভাবান্বিত করার চেষ্টা করেছেন। রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, এ সমস্ত আচরণ যারা করেছেন, আইন অনুসারে তারা আদালত অবমাননা করেছেন। কিন্তু আজ একটি সঠিক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে কেন এমন আচরণ করা হলো জনগণ তা জানতে চায়। পত্রিকায় বলা হয়েছে রায়টা মন্ত্রণালয় থেকে টাইপ হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি। সরকারও এ বিষয়ে কিছু বলেনি। আমার প্রশ্ন- আসলে রায়টা কে লেখছে। ওই আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটারের ভেতরে রায়টা গেলো কি করে, ঢুকলো কি করে? জাতি জানতে চায় আপনাদের কাছ থেকে, আসলে এ রায়টা কে লেখছে। ট্রাইব্যুনালকে অনুরোধ করবো- যদি আপনারা সেটা না বলেন, তাহলে এই দোটানার জাজমেন্টের ক্রেডিবিলিটি নিয়ে সমগ্র বিশ্বে যেমন প্রশ্ন দেখা দেবে তেমনি বাংলাদেশের মানুষের কাছেও প্রশ্ন দেখা দেবে।

সিনিয়রা আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, খন্দকার মাহবুব হোসেন যে কথা বলেছেন তা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে দেয়া অধিকারের ভিত্তিতে বলেছেন। দুঃখজনক হচ্ছে তার বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। যারা এই কাজটা করছেন, তাদেরকে আমরা বলবো যে- আপনারা সংবিধান পড়–ন এবং আপনারা বার এবং বেঞ্চের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করবেন না। আমরা চাই- বার এবং বেঞ্চের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকুক। ইতিহাসে যখনই কোনো সঙ্কট দেখা দিয়েছে তখই সুপ্রিম কোর্ট বার সে সঙ্কট সমাধানে নেতৃত্ব দিয়েছে। আমরা এখন সেই দায়িত্বই পালন করছি। যারা তাদের অবস্থানকে ব্যবহার করে বারের অত্যন্ত সিনিয়র আইনজীবীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার আবেদন করারা পাঁয়তারা করছেন, এটা কারো জন্যই কোনো কল্যাণ বহণ করে আনবে না।

সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, খন্দকার মাহবুব হোসেনের মন্তব্যকে নিয়ে যারা বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছেন, তারা বিচার বিভাগের সুহৃদ হতে পারেন না। তারা বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। যারা এর পেছনে ইন্ধন দিচ্ছেন তারা যেন এটা থেকে বিরত থাকেন।

বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বারের পরপর দুইবার নির্বাচিত সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, বিচারকার্য স্বচ্ছ করতে হবে। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন- রায় ঘোষণার আগে রায় কিভাবে বাজারে চলে আসলো, ইন্টারনেটে চলে আসলো। এই প্রশ্ন আজ সারা জাতির। কিভাবে এই রায় আগে প্রচারিত হলো। পত্রিকায় এসেছে- বেলজিয়াম থেকে নাকি ইন্টারনেটে প্রকাশ হয়েছে এ রায়। মে মাসে আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটারে কিভাবে এসেছে? তাই বলতে চাই- খন্দকার মাহবুব হোসেনের যে বক্তব্য সে বক্তব্য সকল আইনজীবীর।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করি। এই বিচার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আইনজীবী হিসাবে এবং আইনজীবী নেতা হিসাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বক্তব্য রেখেছেন। এই মন্তব্যকে তারা এখন রাজনৈতিকভাবে ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করছে।’ অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, কিভাবে সরকারের মন্ত্রীরা বলেন- ট্রাইব্যুনালে যাদের বিচার হচ্ছে তাদের ফাঁসি হবে? আইন প্রতিমন্ত্রী কিভাবে বললো যে- ওদের ফাঁসি হবে? প্রধানমন্ত্রী কিভাবে বলে- ওদের রায় কার্যকর হবে, ফাঁসি হবে। গণজাগরণ মঞ্চের ডা. ইমরান এইচ সরকার কেন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে আসলো?

তিনি আরো বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস সম্পূর্ণ কলুষিত করেছে বিচার প্রক্রিয়ায়কে। শুধু তাই নয়, আগের দিন গণজাগরণ মঞ্চ শাহবাগ থেকে বললো- সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি চাই। আগে তারা বললো- কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই, গোলাম আযমের ফাঁসি চাই, পরের দিন ট্রাইব্যুনাল থেকে ফাঁসি দেয়। মাহবুব উদ্দিন বলেন, বিচারপতি নাসিম (নিজামুল হক নাসিম) স্কাইপিতে কথা বলেছেন রায়ের আগে। তারপরও তিনি কিভাবে বিচারকের আসনে বসেন- এ প্রশ্ন রাখেন তিনি প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতি। সমস্ত বিচার ব্যবস্থাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে স্কাইপ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম ইউ আহমেদকে হত্যার সাথে জড়িত। তার কারণেই এম ইউ আহমেদকে হত্যা করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে প্রমোশন দেয়া হয়েছে। এ অসহিষ্ণু অবস্থা সুপ্রিম কোর্টে বা বাংলাদেশের আইননাঙ্গনে চলবে না। যদি ট্রাইব্যুনালও কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত কোনো দরখাস্ত গ্রহণ করেন তাহলে বার কাউন্সিল ও সুপ্রিম কোর্ট থেকে আমরা সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য হবো- সকল আইনজীবী যেন এই ট্রাইব্যুনাল বর্জন করে।

আইনজীবীদের বক্তব্যের পর সর্বসম্মতিক্রমে সেখানে একটি রেজুলেশন পাস হয়। রেজুলেশনে বলা হয়, ইন্টারনেটে আগেই রায় প্রকাশ হওয়ায় বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনমনে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করতে ১৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠনে প্রধান বিচারপতি বরাবর দাবি জানানো হয়।

সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বারের সহসভাপতি এ বি এম ওয়ালিউর রহমান খান ও মো. শাহজাদা মিয়া, সহসম্পাদক এ বি এম রফিকুল হক তালুকদার রাজা ও মো. সাইফুর রহমান, ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট রবিউল ইসলাম রবি, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট শরিফুল ইসলাম প্রমুখ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন