বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৪

সন্দেহাতীত অবস্থানে পৌছার সুযোগ কেন হাতছাড়া করা হল বোধগম্য নয়

মেহেদী হাসান,17/4/2014
ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগমের মামলার নথি পিরোজপুর থেকে তলবের আবেদন  করেছিল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আইনজীবী। আদালত গতকাল বুধবার আবেদনটি খারিজ করে দেয়। একই সাথে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের দায়ের করা বরিশাল থেকে ১৯৭২ সালে গঠিত স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের নথি তলবের আবেদনও খারিজ করে দেয়া হয়েছে।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আলোচিত একটি অভিযোগ হল ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা। এ অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের দাবি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর উপস্থিতিতে এবং নির্দেশে ১৯৭১ সালের ৮ মে পাড়েরহাট বাজারে তাকে পাকিস্তান আর্মি গুলি করে হত্যা করে। আর আসামি পক্ষের দাবি ইব্রাহিম কুট্টি ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর নলবুনিয়ায় তার শশুরবাড়ি থাকা অবস্থায় রাজাকারদের হাতে নিহত হয়। এ হত্যাকান্ডের সাথে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর কোন সম্পর্ক নেই। আসামি পক্ষ এ দাবির পক্ষে ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে পিরোজপুর আদালতে স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে যে মামলা করেন সেই মামলার এফআইআর বা মামলার প্রাথমিক অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। মমতাজ বেগমের সেই মামলায় তিনি পাকিস্তান আর্মিসহ মোট১৩ জনকে আসামি করেন । কিন্তু আসামির তালিকায় সাঈদীর নাম নেই। আসামি পক্ষের যুক্তি সাঈদী যদি এ ঘটনায় জড়িত থাকত তাহলে অন্তত মমতাজ বেগমের ওই মামলায় আসামির তালিকায় তার নাম থাকত।  শুধু তাই নয় মমতাজ বেগমের সেই মামলার বিবরনে ইব্রাহিম কুট্টি নিহত হবার ঘটনাস্থল  নলবুনিয়া এবং ঘটনার তারিখ ১ অক্টোবর ১৯৭১ সাল উল্লেখ আছে। আর রাষ্ট্রপক্ষের দাবি ইব্রাহিম কুট্টি ১৯৭১ সালের ৮ মে পাড়েরহাট বাজারে নিহত হয়। মমতাজ বেগমের মামলায় ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার ঘটনাস্থল এবং তারিখের সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য রয়েছে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগে।

২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে আসামি পক্ষ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মমতাজ বেগমের মামলার এ ডকুমেন্ট জমা দেয় এবং ট্রাইব্যুনালে তা প্রদশীনী ‘এ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ তখন আসামি পক্ষের এ ডকুমেন্টকে জাল এবং মামলার প্রয়োজনে সৃজনকৃত বলে আখ্যায়িত করে। একে জাল আখ্যায়িত করার আগে তারা পিরোজপুর  গিয়ে এ মামলা বিষয়ে কোন খোঁজখবর নিয়েছিল কিনা এমন কোন দাবিও তারা করেনি। রাষ্ট্রপক্ষ এ ডকুমেন্টকে জাল আখ্যায়িত করার পর আসামি পক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার জিআর বইয়ের একটি ফটোকপি ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে এবং পিরোজপুর থেকে জিআর বই তলবের আবেদন করে। ট্রাইব্যুনাল তাদের সে আবেদন খারিজ করে দেয়।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয় এবং তার মধ্যে একটি হল আলোচিত এ ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগ। ট্রাইব্যুনালের রায়ে আসামি পক্ষের দায়ের করা মমতাজ বেগমের মামলার ডকুমেন্ট বিষয়ে কোন আলোচনা করা হয়নি। 

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল শুনানীতেও অন্যতম আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয় ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা এবং মমতাজ বেগমের মামলা।
গত ৩ মার্চ প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নতেৃত্বে আপিল শুনানীর  সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মমতাজ বেগমের মামলার ডকুমেন্ট বিষয়ে একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়েন।
আদালত তাকে প্রশ্ন করেন, আসামী পক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার ডকমেন্ট সংগ্রহ করতে পারল আর আপনারা পারলেননা কেন? ১৯৭২ সালে আদৌ এ ধরনের কোন এফআইআর হয়েছিল কি-না? পিরোজপুরে অবশ্যই জিআর রেজিস্ট্রেশন বই আছে। আপনারা এটা চাইতে পারতেননা? আপনাদের অনেক বড় মেশিনারীজ আছে। তার মাধ্যমে এগুলো সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন? আমরা যদি আসামী পক্ষের দায়ের করা এ ডকুমেন্ট গ্রহণ করি তাহলে অ্যাটলিস্ট আমরা বলতে পারি সাঈদী এ ঘটনায় জড়িত নয়।
আদালত আরো বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ মামলার শুনানী চলছে। আসামী পক্ষ অনেক আগে এ বিষয়ে যুক্তি পেশ করেছে। আপনারা অনেক সময় পেয়েছেন। এ দীর্ঘ সময়ে আপনারা চাইলে এ ডকুমেন্ট বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারতেন।

এরপর গত ১ এপ্রিল শুনানীর পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ মামলার বিচার ৮ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি চান। এরপর খবর বের হল মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগমের মামলার নথির খোঁজে অ্যাটর্নি জেনারেল বরিশাল সফর করছেন। ৯ এপ্রিল অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম  দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে দাবি করলেন পিরোজপুর এবং বরিশালে এ মামলার কোন কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছেনা। কাজেই আসামি পক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার যে এফআইআর জমা দিয়েছে তা জাল, মিথ্যা এবং মামলার প্রয়োজনে সৃজনকৃত।  তিনি লিখিত আবেদন করে বলেন, আসামি পক্ষের দায়ের করা মমতাজ বেগমের মামলার এফআইআর যেন  বিবেচনায় না নেয়া হয়।
মমতাজ বেগমের মামলাকে জাল, মিথ্যা, সৃজনকৃত আখ্যায়িত করা এবং একে বিবেচনায় না নেয়ার আবেদনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান যুক্তি ছিল পিরোজপুর এবং বরিশালে এ মামলার কোন কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছেনা। এরপর দ্বিতীয় প্রধান যুক্তি ছিল একটি মামলায় এফআইআরে সব আসামি বা মূল আসামির নাম নাও থাকতে পারে। মামলার তদন্ত শেষে যে চার্জশিট তৈরি হয় সেখানে মূল আসামির নাম থাকতে পারে। আসামি পক্ষ দাবি করেছে এ মামলার চার্জশিট হয়েছিল কিন্তু তারা সে চার্জশিট তুলতে পারেনি এবং জমাও দিতে পারেনি। তারা এফআইআর তুলতে পারল চার্জশিট কেন তুলতে পারলনা? তাছাড়া চার্জশিট হলে এফআইআর নির্ভরযোগ্য থাকেনা।

অবশেষে  গত ১৩ এপ্রিল মমতাজ বেগমের মামলার চার্জশিটের সার্টিফাইড কপি জমা দেয় আসামি পক্ষ। সেখানেও আসামির তালিকায় সাঈদীর নাম নেই। আসামি পক্ষ ১৩ এপ্রিল আবেদন চার্জশিট যেন বিবেচনায় নেয়া হয় সে মর্মে আবেদন করে। একই আবেদনে তারা পিরোজপুর থেকে মমতাজ বেগমের  মামলার জিআর বই তলবেরও আবেদন করে। গতকাল  ১৬ এপ্রিল আদালত র আবেদনটি খারিজ করে দেয়।

আমি মনে করি সকল  প্রশ্নের মীমাংসার জন্য আদালতের পিরোজপুর থেকে মমতাজ বেগমের মামলার নথি তলব করা উচিত ছিল। এটা তলব করলেই প্রমান হয়ে যেত আসামি পক্ষের  দাবি সত্য নাকি মিথ্যা। মমতাজ বেগমের মামলার যে এফআইআর তারা জমা দিয়েছে  জাল কিনা।  নথি তলব করলেই বোঝা যেত ১৯৭২ সালে মমতাজ বেগম নামে কোন মহিলা পিরোজপুর আদালতে এ ধরনের কোন মামলা করেছিলনা কিনা, এ ধরনের কোন মামলার অস্তিত্ব সেখানে আছে কি-না। আসামি পক্ষ জাল জালিয়াতি করেছে কি-না তাও প্রমানিত হত।  কিন্তু আবেদনটি খারিজ করে দেয়ায় বিষয়টি অমিমীমাংসিত থেকে গেল । সাঈদী সত্যিই ইব্রাহিম কুট্টি হত্যায় জড়িত কি-না এ বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমানের একটি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন আদালত সে সুযোগ  কাজে না লাগিয়ে আবেদন খারিজ করে দিল  এ জিজ্ঞাসা সবসময়ই মানুষের মনে থেকে যাবে বলেই মনে হচ্ছে।

আরেকটি মজার বিষয় হল  ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম এখনো জীবিত। তিনি ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের এক নম্বর সাক্ষী হতে পারতেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ তাকে এ মামলায় সাক্ষী করেনি। মমতাজ বেগম জীবিত সেটা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও জানেন বলে জেরায় স্বীকার করেছেন। কিন্তু তাকে তিনি সাক্ষী করেননি। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তকালে কখনো মমতাজ বেগমের কাছে যানওনি।

ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগ এবং এ বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগমের মামলার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত এত আলোচিত একটি বিষয়ে পরিণত হলেও কোন পক্ষ থেকেই তাকে আদালতে হাজির করার কোন আবেদন কেউ করেনি। ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার সাথে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী জড়িত কিনা এবং তিনি ১৯৭২ সালে এ বিষয়ে কোন মামলা করেছিলেন কি-না তা সবই পানির মত পরিষ্কার হয়ে যেত তাকে হাজির করা গেলে। কারণ তিনি তার স্বামী হত্যার ঘটনায় একজন চাুস সাক্ষী। ঘটনার সময় তিনি তার স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন এবং তার হাতেও গুলি লেগেছে মর্মে মামলার বিবরনে বর্নিত আছে।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন