বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৩

বিচারপতি নিজামুল হক জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন বিচারকাজে//মামলার সব কিছু এসেছে বাইরে থেকে


২৪/১২/২০১২
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচার পুনরায় শুরুর আবেদনের ওপর শুনানী শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ। আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আজ শুনানী  শুরু করেন।

শুনানীতে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক  ডকুমেন্ট উপস্থাপন করে ট্রাইব্যুনালে বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক এই ট্র্বাবি্যুনালে বিচারের নামে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।  চার্জ গঠন আদেশসহ তিনি বিভিন্ন সময়ে যেসব আদেশ দিয়েছেন তা বেলজিয়াম থেকে ড. আহেমদ জিয়াউদ্দিন পাঠিয়েছেন।  পরের জিনিসকে তিনি নিজের বলে  চালিয়ে  দিয়েছেন। তিনি যে পরিমান  প্রতারনা করেছেন তারপর আর এ বিচার চলতে পারেনা।

তিনি বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলার সব কিছইু বাইরে থেকে এসেছে।  এমনকি ফরমাল চার্জ যা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের তৈরি করে ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়ার কথা তাও বেলজিয়াম থেকে ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিন তৈরি করে পাঠিয়েছেন।

স্কাইপি কেলেঙ্কারির জের ধরে  জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, বর্তমান আমির  মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার পুনরায় শুরুর আবেদন করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। গতকাল  তিনটি আবেদনের ওপরই শুনানীর জন্য ধার্য্য ছিল। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক  অধ্যাপক গোলাম আযমের  আবেদনের ওপর শুনানী শুরু করেন প্রথমে।  বিচারপতি নিজামুল হক ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে যেসব ইমেইল আদান প্রদান করেছেন ডকুমেন্ট এবং স্কাইপি সংলাপ বিষয়ে তিনি দিনব্যাপী  শুনানী করেন। 

 আবেদনের সাথে জমা দেয়া ৬শ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট সামনে নিয়ে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক শুনানীর সময় বলেন,  অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলার সব কিছু  দেশের বাইরে থেকে তৈরি করা হয়েছে।  চার্জ গঠনসহ   বিভিন্ন ধরনের  আদেশ দেশের বাইরে থেকে তৈরি করে পাঠানো হয়েছে। আর এ কাজটি করেছেন বেলজিয়ামে বসে ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিন। এমনকি ফরমাল চার্জ যা রাষ্ট্রপক্ষের তৈরি করার কথা তাও ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিন তৈরি করে তাদের নামে ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছেন।  তদন্ত সংস্থার তদন্ত  প্রতিবেদনও পাঠানো হয়েছিল বেলজিয়ামে। প্রসিউিশন টিমের কোন সদস্য না হয়েও প্রসিকিউশনের নামে তিনি এসব কাজ করেছেন। 

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মামলার যত ডকুমেন্ট তার কোন কিছুই তদন্ত কর্মকর্তা  মতিউর রহমান কর্তৃক তৈরি হয়নি বরং এসব তৈরি করেছেন ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিন। ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন অন্যান্য লোকজনের যোগসাজজে তা তৈরি করে প্রসিকিউশনের নামে জমা দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে।
এটা একটা প্রতারনা। বিচারপতি নিজামুল হক চার্জ গঠনসহ যেসব আদেশ দিয়েছেন এই ট্রাইব্যুনালে তা তার নিজের তৈরি করা নয়। তা দেশের বাইরে থেকে ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন তৈরি করেছেন। অথচ  পরের এসব জিনিস তিনি নিজের বলে চালিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রতারনা এবং  জালিয়াতি করেছেন। তাই এ বিচার আর কোন অবস্থায়ই চলতে পারেনা।

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া ডকুমেন্ট  দেখিয়ে বলেন, চার্জ গঠনের আদেশ, ফরমাল চার্জ, বিচারপতি নিজামুল হককে অপসারন বিষয়ে রিভিউ পিটিশন খারিজ আদেশ, বিদেশী সাক্ষী আনা বিষয়ে খারিজ  আদেশ, গোলাম আযমের মামলা দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর  বিষয়ক খারিজ আদেশ সবই দেশের বাইরে থেকে এসেছে।  মামলায় সাক্ষী কারা হবে, কোন সাক্ষীকে দিয়ে  কতটুকু বলাতে হবে  সেসব বিষয় নিয়েও  বিচারপতি নিজামুল হক এবং ড. জিয়া উদ্দিন আলোচনা করেছেন।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক স্কাইপ সংলাপ থেকে উদ্ধৃতি  দিলে বলেন, আমরা দুজন  বিদেশী  সাক্ষী আনার জন্য আবেদন করেছিলাম। এ বিষয়ে কি আদেশ দেবেন তা জানার জন্য বিচারপতি নিজামুল হক স্কাইপি সংলাপের সময় ড. আহমেদ জিয়া  উদ্দিনের কাছে প্রশ্ন করেছেন কি আদেশ দেব। একজন জাজ কি আরেকজনের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন তিনি কি আদেশ দেবেন?

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন বিষয়ে  ৫টি ড্রাফট আসে বেলজিয়ামে বসবাসরত ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কাছ থেকে।

১২/৫/২০১২ তারিখ বেলজিয়াম থেকে ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন গোলাম আযমের মামলায় চার্জ গঠন বিষয়ে ইমেইল পাঠান  বিচারপতি নিজামুল হকের কাছে। বিচারপতি নিজামুল হক সেই ড্রাফটটি হুবহু কপি করে পরের দিন ১৩/৫/২০১২ তারিখ অধ্যাপক গোলাম  আযমের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন বিষয়ে আদেশ দেন।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তারিখ ছাড়া  বিশাল এ  ডকুমেন্ট দুটির মধ্যে আর কোন পার্থক্য নেই।  বিচারপতি নিজামুল হক এই কাজটির মাধ্যমে  ট্রাইব্যুনালের মর্যাদা এবং ইমেজ ধুলিস্যাত করে  দিয়েছেন। তিনি ডকুমেন্ট দুটি মিলিয়ে দেখান ট্রাইব্যুনালকে।


এরপর ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ইমেইল ডকুমেন্ট তুলে ধরে তারিখ অনুযায়ী বর্ননা করেন কোন তারিখ বিচারপতি নিজামুল হক কোন আদেশ দিয়েছেন এবং সে আদেশের খসড়া কপি কোন তারিখ বেলজিয়াম থেকে ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিন পাঠিয়েছেন ।

তিনি বলেন, ৩১/১০/২০১১ তদন্ত  সংস্থা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিল  প্রসিকিউশনের কাছে। 
চিফ প্রসিকিউটর ১২/১২/২০১১ ফরমাল চার্জ দাখিল করলেন কোর্টে। এর মাত্র দুই দিন আগে অর্থাৎ ১০/১২/২০১১ তারিখ ফরমাল চার্জের একটি খসড়া ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিন পাঠান বিচারপতি নিজামুল হকের কাছে।  এ থেকে বোঝা যায় যে, অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ রাষ্ট্রপক্ষ দাখিল করেনি  বরং করেছেন ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন।


ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা যে তদন্ত প্রতিবেদন  জমা  দিয়েছে তা আমরা বারবার ট্রাইব্যুনালের কাছে  চেয়ে আবেদন করেছিলাম। আমরা মাথা কুটেও সে তদন্ত প্রতিবেদন পাইনি। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল আমাদের জানায়  এটি আমরা পাবনা। এটি শুধু  রাষ্ট্রপক্ষ এবং ট্রাইব্যুনাল দেখতে পারবে।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, সেই তদন্ত রিপোর্ট বেলজিয়ামে ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের কাছে গেল কি করে? কেন গেল? ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক  বলেন তারা ইমেইলের মাধ্যমে  বেলজিয়াম থেকে পাঠানো যে তদন্ত রিপোটর্টি পয়েছেন সেটি ৩৫০ পৃষ্ঠার একটি ডকুমেন্ট।

তিনি বলেন, ১৯৯২ সালে গঠিত গন আদালতের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলায়   বিচারপতি নিজামুল হকের অপসারন চেয়ে  রিভিউ আবেদন  করেছিলাম। সে আবেদনও খারিজ  করে যে আদেশ দেয়া হয়েছিল তাও আসে বেলজিয়াম থেকে। 

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক   বিচারপতি নিজামুল হক এবং ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের মধ্যকার আদান প্রদানকৃত ইমেইল ডকুমেন্ট  উপস্থপন করে শুনানীর সময় এ বিষয়ে ট্রাইবু্যুনাল কিছু কিছু প্রশ্ন করলে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক গত ৬ ডিসেম্বর ইকনোমিস্টের বিরুদ্ধে রুল দিয়ে  এ বিষয়ে স্বীকার করে গেছেন। তাছাড়া দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় যে স্কাইপি সংলাপ প্রকাশ করা হয়েছে তা কেউ অস্বীকার করেননি তারা। এটি যে মিথ্যা  এমন দাবি কেউ করেননি। এসব ডকুমেন্ট  যে সত্য তা  প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন স্কাইপি সংলাপের সত্যতা নিশ্চিত করার জন্য এটা  ট্রাইব্যুনালে শোনা দরকার।

পুনরায় বিচার শুরুর আবেদন খারিজের আবেদন রাষ্ট্রপক্ষের : আজ  সকালে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানীতে অংশ নেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে আসেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বা এটর্নি জেনারেল   মাহবুবে আলম বলেন।   আসামী পক্ষের শুনানী শুরু হলে এর এক পর্যায়ে আপত্তি  উত্থাপন করে তিনি বলেন,  আমরা পুনরায় বিচার শুরুর আবেদন  খারিজ করার আবেদন করেছি । তাই  এ বিষয়ে শুনানীও চলতে পারেনা। কারণ স্কাইপি সংলাপ  প্রকাশের ওপর ট্রাইব্যুনাল -২ একটি আদেশ দিয়েছেন। তাই এ নিয়ে আলোচনা চলতে পারেনা। চললে আদেশ লঙ্ঘন হবে।

জবাবে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আবেদন খারিজ হবে কি হবেনা তা  শুনানীর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল নির্ধারন করবেন। কিন্তু শুনানী হবেনা কোন যুক্তিতে?  স্কাইপি সংলাপ বিষয়ে তারা কেউ অস্বীকার করেননি।  আপনারা দেখেন আমরা কি জমা দিয়েছি। কি আছে এর মধ্যে। 
এ পর্যয়ে ট্রাইব্যুনাল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাককে শুনানী শুরুর অনুরোধ করলে তিনি শুনানী শুরু করেন।

দুপুরের বিরতির পর শুনানীর শুরুতে আবারো এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দাড়িয়ে বলেন, আসামী পক্ষের দাবি হচ্ছে সব কিছু বেলজিয়াম থেকে এসেছে। বেলজিয়াম থেকে  করা হয়েছে। এটা মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে যাচ্ছে। ট্রাইব্যুনাল বিতর্কিত হচ্ছে।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মিডিয়া ট্রায়াল করছে তারা যারা রাস্তায় বলে বেড়াচ্ছেন ১৬ ডিসেম্বর রায় দেবেন।
এটর্নি জেনারেল বলেন চুরি করা জিনিস নিয়ে এত গলা জুরি করা যায়না। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চোরকে আগে ধরেন।

আরো ৫শ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট দাখিল : অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচার পুনরায় শুরুর আবেদনের সাথে  আসামী পক্ষ প্রথম দিন ৬শ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট দাখিল করে। গতকাল আরো ৫১০ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫০ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট হল তদন্ত সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনটি ঢাকা থেকে বেলজিয়ামে পাঠানো হয়েছিল ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কাছে। সেটি আবার তিনি পাঠিয়েছেন বিচারপতি নিজামুল হকের কাছে। বিচারপতি নিজামুল হকের যেসব ইমেইল হ্যাকড হয়েছে তার মধ্যে অন্যান্য ডকুমেন্টের সাথে এটিও রয়েছে।

আজ  শুনানী উপলক্ষে অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। এছাড়া মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকেও ট্রাইব্যুনালে  আনা হয়।  হাজতখানায় বেশ কিছু সময় এ তিন নেতাসহ অন্য আরো দুয়েকজন বন্দী নেতা  একত্রে সময় কাটান। এদের মধ্যে  একজন ছিলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি আনোয়রুল হক শুনানী গ্রহণ করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে অন্যান্যের মধ্যে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, রানা দাস গুপ্ত, জেয়াদ আল মালুম উপস্থিত ছিলেন।
আসামী পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, অ্যাডভোকেট  জসিম উদ্দিন সরকার, তাজুল ইসলাম, মিজানুল ইসলাম, মনজুর আহমদ আনাসারী, ব্যারিস্টার  এহসান সিদ্দিক, ব্যারিস্টার এমরান সিদ্দিক, মতিউর রহমান আকন্দ, শিশির মো: মনির প্রমুখ। আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত শুনানী মুলতবি করা হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন