মেহেদী হাসান, ১৫/৫/২০১৭
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। আপিল বিভাগ গতকাল শুনানী শেষে উভয় পক্ষের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন । ফলে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল চূড়ান্ত রায় হলো । আর এরই সাথে শেষ হলো দেশ বিদেশজুড়ে বহুল আলোচিত ঘটনাবহুল এ মামলার কার্যক্রম দীর্ঘ সাত বছর শেষে।
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মাওলানা সাঈদীকে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদন্ড দেয় ।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে আমৃত্যৃ কারাদণ্ড দেন মাওলানা সাঈদীকে। একজন বিচারপতি ভিন্ন রায়ে মাওলানা সাঈদীকে সমস্ত অভিযোগ থেকে খালাস দিয়ে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করেন। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড বহাল চেয়ে এবং মাওলানা সাঈদী সব অভিযোগ থেকে খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন করেণ। গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী শেষে উভয় পক্ষের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়ে মামলার সমাপ্তি টানলেন । ২০১০ সালের ২৯ জুলাই গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে।
গত রোববার রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানী শুরু হয়। গতকাল সরকার পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তি পেশ করেন। এসময় আদালত তাকে প্রশ্ন করেন যাবজ্জীবন রায় দেয়ার পর তা পরিবর্তন করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে এরকম অন্তত একটি কেসের উদহারণ দেখান। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি এই মামলায় সেটা চাচ্ছি।
বিশাবালি হত্যা বিষয়ে একজন বিচারপতি বলেন, বিশাবালীকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। সাঈদীর নির্দেশে একজন রাজাকার তাকে গুলি করল। জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে এ ঘটনা দেখেছে বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষের ৫ এবং ৯ নং সাক্ষী। সাঈদী বিশাবালিকে গুলির নির্দেশ দিয়েছে তাও তারা শুনেছে । কিন্তু প্রশ্ন হলো পাকিস্তান আর্মি দেখলে মানুষ যেখানে পালিয়ে যেত সেখানে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে গুলি করতে দেখা সম্ভব কি না। আর গুলি করতে দেখা এবং গুলির নির্দেশ দিয়েছেন সাঈদী এ কথা শুনতে হলে ঘটনার খুবই কাছে থাকতে হয়। এটা সম্ভব কিনা।
শুনানী শেষে ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের (প্রসিকিউটর) উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, কিছু প্রসিকিউটর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মিটিংয়ে যোগ দেয়। কিছু নন-প্রাকটিসিং লইয়ার প্রসিকিউটর হয়েছে। একজন পাবলিক প্রসিকিউটরের যে অবস্থান তা তারা বুঝতে পারছে না। তাদের অবস্থানের কথা তারা জানে না।
রায়ে সন্তুষ্ট নন সাঈদীর ছেলে
আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি মাওলানা সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী। রায়ের পর আদালত চত্বরে সাংবাদিকরা তার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। একদিনের সাজাও কাম্য ছিল না। একমাত্র খালাসই ছিল আমার পিতার জন্য ন্যায়বিচার। আমরা তার মুক্তি আশা করেছিলাম।
তিনি বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির জন্য এ মামলায় আমরা যেসব দলিল প্রমান দাখিল করেছি তাতে তার একমিনিটেরও দণ্ড হওয়ার কথা নয়। তারপরও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে, মানতে হবে আমাদের।
মাসুদ সাঈদী এসময় জানান, চার দিন আগে তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর বাবার সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি সুস্থ আছেন, স্বাভাবিক আছেন। তিনি দেশবাসীকে সালাম জানিয়েছেন।
এদিকে অ্যটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড না হওয়ায় আমি ব্যথিত। মূলত প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার ব্যর্থতার কারণে রিভিউ খারিজ করে দিয়েছেন আদালত।
ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায়
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল১। মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২০টি অভিযোগ আনে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে মোট আটটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টি এবং বিশাবালী হত্যার অভিযোগে মুত্যুদন্ড দেয়া হয়। অপর ছয়টি অভিযোগে কোন সাজা উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল।
আসামী পক্ষ মাওলানা সাঈদীকে বেকসুর খালাস চেয়ে আপিল করে সুপ্রিম কোর্টে। অপর দিকে ট্রাইব্যুনাল যে ছয়টি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করে কিন্তু সাজা উল্লেখ করেনি সে ছয়টি অভিযোগে সাজা উল্লেখের দাবি জানিয়ে আপিল আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
শুনানী শেষে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন।
আপিল বিভাগের রায়ে তিনটি পৃথক অভিযোগে প্রত্যেকটিতে আমৃত্যু জেল, অপর দুটি অভিযোগের একটিতে ১২ বছর এবং আরেকটিতে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাকান্ডে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগ এটিতে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে ১২ বছর জেল দেন। বিশাবালী হত্যাকান্ডে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেয়। এ অভিযোগে আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন।
অপর যে দুটি অভিযোগে আপিল বিভাগ মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন সে দুটি হলো গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোনকে ধর্ষণ এবং এক থেকে দেড়শজনকে ধর্মান্তরকরনের অভিযোগ।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা উল্লেখ করা হয়নি এমন ছয়টি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে আপিল বিভাগের রায়ে । অপর তিনটি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন গ্রহণ করে যে তিনটি অভিযোগে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল সাত, ১৬ এবং ১৯ নং অভিযোগ। ১৬ নং অভিযোগ হল গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোন মহামায়া, অন্নরানী এবং কমলা রানী নামে তিন বোনকে অপহরন করে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়ার অভিযোগ। তাদেরকে পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্পে আটকে রেখে তিন দিন ধর্ষণ করে মর্মে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
অপরদিকে ১৯ নং অভিযোগ হল মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরকরন।
সাত নং অভিযোগ ছিল শহিদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে আগুন দেয়া। এ অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
সাঈদীকে সব অভিযোগ থেকে খালাস দেন বচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা
আপিল বিভাগের সংখ্যগরিষ্ঠ রায়ের প্রতি সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোশন করে ভিন্ন রায় দেন বিচারপতি মো : আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা তার রায়ে মাওলানা সাঈদীকে সমস্ত অভিযোগ থেকে খালাস দিয়ে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করেন। লিখিত রায়ে তিনি বলেছেন রাষ্ট্রপক্ষ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আনীত কোন অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি। আসামী পক্ষ সফলভাবে প্রমান করতে পেরেছে তিনি পিরোজপুর রাজাকার বাহিনী এবং শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেননা এবং কোন অপরাধ করেননি। আসামী পক্ষ আরো প্রমান করতে পেরেছে যে, ঘটনার সময় তিনি পিরোজপুর ছিলেননা; যশোর ছিলেন।
মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় তখন। বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞ, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি শাসসুদ্দীন চৌধুরী অবসরে গেছেন।
রিভিউ শুনানীর জন্য পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে নতুন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মির্জা হুসেইন হায়দার ।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে আপিল এবং রিভিউ শুনানীতে অংশ নেন খন্দকার মাহবুব হোসেন ও অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান। তাদের সহায়তা করেণ ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিনসহ অনেকে।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে স্কাইপ কেলেঙ্করির কারনে পিছিয়ে যায় এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি।
মানিক পসারী নামে এক লোক পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এর কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আরেকটি নালিশ দায়ের করেন পিরোজপুর নালিশী আদালতে।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবী করেন। এভাবে মাওলানা সাঈদীর বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে এবং বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।
এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।
২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন ১১ ডিসেম্বর। এরপর মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য মামলার পুনরায় বিচার দাবি করে দরখাস্ত করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তবে মাওলানা সাঈদীর মামলায় পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ১৩ জানুয়ারি পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ২৯ জানুয়ারি উভয় পক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে সেদিন পুনরায় রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনার এক মাসের মাথায় নির্দিষ্ট করে তারিখ ঘোষনা করলেন ট্রাইব্যুনাল।
আলোচিত এবং ঘটনাবহুল একটি মামলা :
১৯৭১ সালে সংঘটিত মাবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এবং ২ এ যে কয়টি মামলা হয়েছে তার মধ্যে নানা কারনে সবচেয়ে আলোচিত এবং ঘটনাবহুল মামলা ছিল মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা। গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ মামলা।
এই মামলার শুরুতেই প্রশ্ন ওঠে ট্রাইব্যুনালের পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নিরপেক্ষতা নিয়ে। এরপর সর্বশেষ স্কাইপ কেলেঙ্কারি এবং ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে মাওলানা সাঈদীর পক্ষের একজন হিন্দু সাক্ষী অপহরনের ঘটনা, রাষ্ট্রপক্ষের হিন্দু সাক্ষী গণেশ চন্দ্র মাওলানা সাঈদীর পক্ষে এসে সাক্ষ্য দেয়ার ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বিদেশী গনমাধ্যমেও স্থান পায় স্কাইপ কেলেঙ্কারি এবং সাক্ষী অপহরনের ঘটনা। স্কাইপ কেলেঙ্কারির কারনে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুলক হককে। মাওলানা সাঈদীর মামলার বিচারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল হক থাকলেও তিনি এ মামলার রায় ঘোষনা করতে পারনেনি। স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে তার পদত্যাগ করতে হয় এবং ট্রাইব্যুনালে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এটিএম ফজলে কবিরকে। নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের কারনে মাওলানা সাঈদীর বিচার কার্যক্রম শেষ হবার পরও আবার নতুন করে শুরু করতে হয় যুক্তি তর্ক উপস্থাপন। এছাড়া বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালের আরেক সদস্য বিচারক জহির আহমেদ পদতাগ করেন। তাকে সরকারের চাপের কারনে পদত্যাগ করতে হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া আসামী পক্ষ কর্তৃক সেফ হাউজের ডকুমেন্ট উদ্ধারের ঘটনাও এ মামলার একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ছিল। ১৫ জন সাক্ষীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির না করে তাদের জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার ঘটনাও বেশ সমালোচনার জন্ম দেয় এ মামলার ক্ষেত্রে।
মাওলানা সাঈদীর মামলায় উভয় পক্ষের হাজির করা সাক্ষীদের জেরা বছরজুড়ে পাঠকের কাছে ছিল আকর্ষনীয় বিষয় । পিরোজপুরের এমপি একেএমএ আউয়াল মাওলানা সাঈদীর বিপক্ষে সাক্ষ্য দেন। মাওলান সাঈদীর পক্ষেও সাক্ষ্য দিয়েছেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের শুরুতে আইন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। তবে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে শুরু হওয়া সব বিতর্ক ছাপিয়ে যায় বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ কেলেঙ্কারির ঘটনা। বিচারের বিভিন্ন বিষয় বেলজিয়াম থেকে লিখে পাঠানোর ঘটনার চিত্র বের হয়ে পড়ে এতে। বিচার কাজে সরকার এবং বাইরের বিভিন্ন ব্যক্তি এবং মহলের যোগসাজস এবং নিয়ন্ত্রনের ঘটনায় দেশ এবং বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিচার বিভাগের ইতিহাসে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা অতীতে আর কখনো ঘটেনি বলে মন্তব্য করেন আইনজ্ঞরা।
এ বিচার চলাকালে এবং বন্দী থাকা অবস্থায় মাওলানা সাঈদী প্রথমে তার মাকে হারান। এরপর বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালে বসে অসুস্থ হয়ে মুত্যৃর কোলে ঢলে পড়েন তার বড় ছেলে রাফিক বিন সাঈদী।
মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা ইউসুফ সাঈদী দেশের দণিাঞ্চলের সুপরিচিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন।
মাওলানা সাঈদী নিজ পিতার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিা লাভ করার পর তিনি ১৯৬২ সালে মাদরাসা শিক্ষা শেষ করে গবেষণা কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯৬৭ থেকে মাওলানা সাঈদী বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং বিশ্বের বহু দেশে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর করেছেন। তার ওয়াজ শুনে অনেক হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কোরআন, হাদিস এবং ইসলামের ওপর রচনা করেছেন অনেক পুস্তক। পেয়েছেন নানা উপাধি, খ্যাতি ও সম্মান। তার তাফসিরের অডিও ভিডিও পাওয়া যায় দেশে বিদেশে সর্বত্র। দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছে তার অগনিত ভক্ত অনুরাগী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশ থেকে নামকরা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রনে তিনি সেসব দেশ সফর করেছেন এবং কোরআনের তাফসির করেছেন।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। আপিল বিভাগ গতকাল শুনানী শেষে উভয় পক্ষের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন । ফলে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল চূড়ান্ত রায় হলো । আর এরই সাথে শেষ হলো দেশ বিদেশজুড়ে বহুল আলোচিত ঘটনাবহুল এ মামলার কার্যক্রম দীর্ঘ সাত বছর শেষে।
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মাওলানা সাঈদীকে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদন্ড দেয় ।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে আমৃত্যৃ কারাদণ্ড দেন মাওলানা সাঈদীকে। একজন বিচারপতি ভিন্ন রায়ে মাওলানা সাঈদীকে সমস্ত অভিযোগ থেকে খালাস দিয়ে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করেন। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড বহাল চেয়ে এবং মাওলানা সাঈদী সব অভিযোগ থেকে খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন করেণ। গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী শেষে উভয় পক্ষের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়ে মামলার সমাপ্তি টানলেন । ২০১০ সালের ২৯ জুলাই গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে।
গত রোববার রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানী শুরু হয়। গতকাল সরকার পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তি পেশ করেন। এসময় আদালত তাকে প্রশ্ন করেন যাবজ্জীবন রায় দেয়ার পর তা পরিবর্তন করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে এরকম অন্তত একটি কেসের উদহারণ দেখান। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি এই মামলায় সেটা চাচ্ছি।
বিশাবালি হত্যা বিষয়ে একজন বিচারপতি বলেন, বিশাবালীকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। সাঈদীর নির্দেশে একজন রাজাকার তাকে গুলি করল। জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে এ ঘটনা দেখেছে বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষের ৫ এবং ৯ নং সাক্ষী। সাঈদী বিশাবালিকে গুলির নির্দেশ দিয়েছে তাও তারা শুনেছে । কিন্তু প্রশ্ন হলো পাকিস্তান আর্মি দেখলে মানুষ যেখানে পালিয়ে যেত সেখানে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে গুলি করতে দেখা সম্ভব কি না। আর গুলি করতে দেখা এবং গুলির নির্দেশ দিয়েছেন সাঈদী এ কথা শুনতে হলে ঘটনার খুবই কাছে থাকতে হয়। এটা সম্ভব কিনা।
শুনানী শেষে ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের (প্রসিকিউটর) উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, কিছু প্রসিকিউটর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মিটিংয়ে যোগ দেয়। কিছু নন-প্রাকটিসিং লইয়ার প্রসিকিউটর হয়েছে। একজন পাবলিক প্রসিকিউটরের যে অবস্থান তা তারা বুঝতে পারছে না। তাদের অবস্থানের কথা তারা জানে না।
রায়ে সন্তুষ্ট নন সাঈদীর ছেলে
আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি মাওলানা সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী। রায়ের পর আদালত চত্বরে সাংবাদিকরা তার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। একদিনের সাজাও কাম্য ছিল না। একমাত্র খালাসই ছিল আমার পিতার জন্য ন্যায়বিচার। আমরা তার মুক্তি আশা করেছিলাম।
তিনি বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির জন্য এ মামলায় আমরা যেসব দলিল প্রমান দাখিল করেছি তাতে তার একমিনিটেরও দণ্ড হওয়ার কথা নয়। তারপরও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে, মানতে হবে আমাদের।
মাসুদ সাঈদী এসময় জানান, চার দিন আগে তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর বাবার সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি সুস্থ আছেন, স্বাভাবিক আছেন। তিনি দেশবাসীকে সালাম জানিয়েছেন।
এদিকে অ্যটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড না হওয়ায় আমি ব্যথিত। মূলত প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার ব্যর্থতার কারণে রিভিউ খারিজ করে দিয়েছেন আদালত।
ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায়
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল১। মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২০টি অভিযোগ আনে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে মোট আটটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টি এবং বিশাবালী হত্যার অভিযোগে মুত্যুদন্ড দেয়া হয়। অপর ছয়টি অভিযোগে কোন সাজা উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল।
আসামী পক্ষ মাওলানা সাঈদীকে বেকসুর খালাস চেয়ে আপিল করে সুপ্রিম কোর্টে। অপর দিকে ট্রাইব্যুনাল যে ছয়টি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করে কিন্তু সাজা উল্লেখ করেনি সে ছয়টি অভিযোগে সাজা উল্লেখের দাবি জানিয়ে আপিল আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
শুনানী শেষে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন।
আপিল বিভাগের রায়ে তিনটি পৃথক অভিযোগে প্রত্যেকটিতে আমৃত্যু জেল, অপর দুটি অভিযোগের একটিতে ১২ বছর এবং আরেকটিতে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাকান্ডে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগ এটিতে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে ১২ বছর জেল দেন। বিশাবালী হত্যাকান্ডে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেয়। এ অভিযোগে আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন।
অপর যে দুটি অভিযোগে আপিল বিভাগ মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন সে দুটি হলো গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোনকে ধর্ষণ এবং এক থেকে দেড়শজনকে ধর্মান্তরকরনের অভিযোগ।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা উল্লেখ করা হয়নি এমন ছয়টি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে আপিল বিভাগের রায়ে । অপর তিনটি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন গ্রহণ করে যে তিনটি অভিযোগে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল সাত, ১৬ এবং ১৯ নং অভিযোগ। ১৬ নং অভিযোগ হল গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোন মহামায়া, অন্নরানী এবং কমলা রানী নামে তিন বোনকে অপহরন করে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়ার অভিযোগ। তাদেরকে পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্পে আটকে রেখে তিন দিন ধর্ষণ করে মর্মে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
অপরদিকে ১৯ নং অভিযোগ হল মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরকরন।
সাত নং অভিযোগ ছিল শহিদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে আগুন দেয়া। এ অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
সাঈদীকে সব অভিযোগ থেকে খালাস দেন বচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা
আপিল বিভাগের সংখ্যগরিষ্ঠ রায়ের প্রতি সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোশন করে ভিন্ন রায় দেন বিচারপতি মো : আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা তার রায়ে মাওলানা সাঈদীকে সমস্ত অভিযোগ থেকে খালাস দিয়ে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করেন। লিখিত রায়ে তিনি বলেছেন রাষ্ট্রপক্ষ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আনীত কোন অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি। আসামী পক্ষ সফলভাবে প্রমান করতে পেরেছে তিনি পিরোজপুর রাজাকার বাহিনী এবং শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেননা এবং কোন অপরাধ করেননি। আসামী পক্ষ আরো প্রমান করতে পেরেছে যে, ঘটনার সময় তিনি পিরোজপুর ছিলেননা; যশোর ছিলেন।
মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় তখন। বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞ, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি শাসসুদ্দীন চৌধুরী অবসরে গেছেন।
রিভিউ শুনানীর জন্য পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে নতুন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মির্জা হুসেইন হায়দার ।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে আপিল এবং রিভিউ শুনানীতে অংশ নেন খন্দকার মাহবুব হোসেন ও অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান। তাদের সহায়তা করেণ ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিনসহ অনেকে।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে স্কাইপ কেলেঙ্করির কারনে পিছিয়ে যায় এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি।
মানিক পসারী নামে এক লোক পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এর কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আরেকটি নালিশ দায়ের করেন পিরোজপুর নালিশী আদালতে।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবী করেন। এভাবে মাওলানা সাঈদীর বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে এবং বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।
এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।
২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন ১১ ডিসেম্বর। এরপর মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য মামলার পুনরায় বিচার দাবি করে দরখাস্ত করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তবে মাওলানা সাঈদীর মামলায় পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ১৩ জানুয়ারি পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ২৯ জানুয়ারি উভয় পক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে সেদিন পুনরায় রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনার এক মাসের মাথায় নির্দিষ্ট করে তারিখ ঘোষনা করলেন ট্রাইব্যুনাল।
আলোচিত এবং ঘটনাবহুল একটি মামলা :
১৯৭১ সালে সংঘটিত মাবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এবং ২ এ যে কয়টি মামলা হয়েছে তার মধ্যে নানা কারনে সবচেয়ে আলোচিত এবং ঘটনাবহুল মামলা ছিল মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা। গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ মামলা।
এই মামলার শুরুতেই প্রশ্ন ওঠে ট্রাইব্যুনালের পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নিরপেক্ষতা নিয়ে। এরপর সর্বশেষ স্কাইপ কেলেঙ্কারি এবং ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে মাওলানা সাঈদীর পক্ষের একজন হিন্দু সাক্ষী অপহরনের ঘটনা, রাষ্ট্রপক্ষের হিন্দু সাক্ষী গণেশ চন্দ্র মাওলানা সাঈদীর পক্ষে এসে সাক্ষ্য দেয়ার ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বিদেশী গনমাধ্যমেও স্থান পায় স্কাইপ কেলেঙ্কারি এবং সাক্ষী অপহরনের ঘটনা। স্কাইপ কেলেঙ্কারির কারনে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুলক হককে। মাওলানা সাঈদীর মামলার বিচারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল হক থাকলেও তিনি এ মামলার রায় ঘোষনা করতে পারনেনি। স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে তার পদত্যাগ করতে হয় এবং ট্রাইব্যুনালে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এটিএম ফজলে কবিরকে। নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের কারনে মাওলানা সাঈদীর বিচার কার্যক্রম শেষ হবার পরও আবার নতুন করে শুরু করতে হয় যুক্তি তর্ক উপস্থাপন। এছাড়া বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালের আরেক সদস্য বিচারক জহির আহমেদ পদতাগ করেন। তাকে সরকারের চাপের কারনে পদত্যাগ করতে হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া আসামী পক্ষ কর্তৃক সেফ হাউজের ডকুমেন্ট উদ্ধারের ঘটনাও এ মামলার একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ছিল। ১৫ জন সাক্ষীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির না করে তাদের জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার ঘটনাও বেশ সমালোচনার জন্ম দেয় এ মামলার ক্ষেত্রে।
মাওলানা সাঈদীর মামলায় উভয় পক্ষের হাজির করা সাক্ষীদের জেরা বছরজুড়ে পাঠকের কাছে ছিল আকর্ষনীয় বিষয় । পিরোজপুরের এমপি একেএমএ আউয়াল মাওলানা সাঈদীর বিপক্ষে সাক্ষ্য দেন। মাওলান সাঈদীর পক্ষেও সাক্ষ্য দিয়েছেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের শুরুতে আইন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। তবে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে শুরু হওয়া সব বিতর্ক ছাপিয়ে যায় বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ কেলেঙ্কারির ঘটনা। বিচারের বিভিন্ন বিষয় বেলজিয়াম থেকে লিখে পাঠানোর ঘটনার চিত্র বের হয়ে পড়ে এতে। বিচার কাজে সরকার এবং বাইরের বিভিন্ন ব্যক্তি এবং মহলের যোগসাজস এবং নিয়ন্ত্রনের ঘটনায় দেশ এবং বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিচার বিভাগের ইতিহাসে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা অতীতে আর কখনো ঘটেনি বলে মন্তব্য করেন আইনজ্ঞরা।
এ বিচার চলাকালে এবং বন্দী থাকা অবস্থায় মাওলানা সাঈদী প্রথমে তার মাকে হারান। এরপর বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালে বসে অসুস্থ হয়ে মুত্যৃর কোলে ঢলে পড়েন তার বড় ছেলে রাফিক বিন সাঈদী।
মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা ইউসুফ সাঈদী দেশের দণিাঞ্চলের সুপরিচিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন।
মাওলানা সাঈদী নিজ পিতার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিা লাভ করার পর তিনি ১৯৬২ সালে মাদরাসা শিক্ষা শেষ করে গবেষণা কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯৬৭ থেকে মাওলানা সাঈদী বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং বিশ্বের বহু দেশে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর করেছেন। তার ওয়াজ শুনে অনেক হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কোরআন, হাদিস এবং ইসলামের ওপর রচনা করেছেন অনেক পুস্তক। পেয়েছেন নানা উপাধি, খ্যাতি ও সম্মান। তার তাফসিরের অডিও ভিডিও পাওয়া যায় দেশে বিদেশে সর্বত্র। দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছে তার অগনিত ভক্ত অনুরাগী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশ থেকে নামকরা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রনে তিনি সেসব দেশ সফর করেছেন এবং কোরআনের তাফসির করেছেন।