মেহেদী হাসান, ৬/৪/২০১৫
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে।
আজ আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়া । এর ফলে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগ এর আগে যে রায় দিয়েছিল তা বহাল রইল।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ সকালে রিভিউ আবেদন খারিজ করে রায় দেন।
রিভিউ আবেদনের খারিজের মধ্য দিয়ে এ মামলার সমস্ত বিচার কার্যক্রম শেষ হয়ে গেল এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে আইনগত আর কোন বাঁধা নেই। আসামীর জন্য এখন সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদনের একটি সুযোগ রয়েছে। তিনি যদি এ আবেদন না করেন বা আবেদন করলেও রাষ্ট্রপতি যদি তা নামঞ্জুর করেন তাহলে ফাঁসি কার্যকর করার ক্ষেত্রে আর কোন বাঁধা থাকবেনা।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেছেন, কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার আবেদনের জন্য সময় পাবেন। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে তাকে আবেদন করতে হবে। তিনি আবেদন করলে তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি কার্যকর করা যাবেনা। তবে আবেদন না করলে বা আবেদন নাকচ করা হলে সেক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল আইনের ধারা মোতাবেক সরকার ফাঁসি কার্যকর করার সময় নির্ধারণ করবে। তিনি বলেন, ফাঁসি কার্যকরের জন্য সাত দিনের আগে নয় এবং ২১ দিনের পরে নয় জেলকোডের এ নিয়ম তার জন্য প্রযোজ্য হবেনা। সরকার যখন চাইবে তখন তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফাঁসির দিনক্ষন ঠিক করে তা জেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেবে এবং সে অনুযায়ী জেল কর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকরের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
প্রাণভিক্ষার আবেদন বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজের বিষয়টি কারাকর্তপক্ষ বরাবর পাঠাবে। কারা কর্তৃপক্ষ রিভিউ আবেদনের রায় আসামীকে পড়ে শোনানোর পর তার কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন বিষয়ে জানতে চাইবে। সেটা বিবেচনার জন্য তিনি কিছু সময় পেতে পারেন। তবে খুব বেশি দেরি করার সুযোগ নেই।
মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়। গত বছর ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের একটি অভিযোগ বহাল রাখেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। মৃত্যুদণ্ডের আরেকটি সাজা বাতিল করে যাবজ্জীবন করেন।
আজ রিভিউ আবেদন খারিজের মাধ্যমে আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ৩ নভেম্বর যে রায় দিয়েছিলেন তা বহাল রইল। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের অপর তিনটি অভিযোগের বিষয়ে আপিল বিভাগ পূর্বে যে রায় দেন তাও বহাল রইল গতকালের রায়ে।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা ট্রাইব্যুনাল থেকে কারাগারে পাঠানো হয়।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও রায় :
ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনে।
এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রায়ে মোট পাঁচটিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয়া য় হয়।
নিম্নে এ পাঁচটি অভিযোগে ট্রাইবুন্যাল এবং আপিল বিভাগের রায় উল্লেখ করা হল।
১ নম্বর অভিযোগ : বদিউজ্জামানকে অপহরন করে আহমেদনগর আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা। এ হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে সর্বসম্মতভাবে।
২ নম্বর অভিযোগ : শেরপর কলেজের অধ্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় উলঙ্গ করে শহরে প্রদণি করানো এবং পেটানো হয়। এ অভিযোগে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগে এ সাজা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে বহাল রাখা হয়েছে।
৩ নম্বর অভিযোগ : ১৯৭১ সালে কামারুজ্জামানের পরামর্শে পাকিস্তান আর্মি দেশীয় রাজাকার এবং আলবদর সদস্যদের সাথে নিয়ে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে অভিযান চালায়। অভিযানে ওই গ্রামে দেড়শতাধিক মানুষ নিহত হয় এবং অসংখ্য নারী ধর্ষনের শিকার হয়। এ গণহত্যার অভিযোগে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ সাজা বহাল রাখে।
৪ নম্বর অভিযোগ : শেরপর মোস্তফাবাগ থেকে গোলাম মোস্তফাকে ধরে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। এরপর তাকে কামারুজ্জামানসহ অন্যান্যরা মিলে একটি ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ অভিযোগে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে যাবজ্জীবন দিয়েছে।
৭ নম্বর অভিযোগ : মুক্তিযুদ্ধচলাকালে ময়মনসিংহ গোলাপজান রোডে টেপা মিয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে টেপা মিয়া এবং তার ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলাপরিষদ ডাকবাংলায় অবস্থিত আলবদর ক্যাম্পে আনা হয়। পরেরদিন সকালে তারা দুজনসহ সাতজনকে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর তীরে আনা হয়। এসময় টেপা মিয়া নদীতে ঝাপ দিয়ে রক্ষা পায় এবং বাকীদের হত্যা করা হয়। এ অভিযোগের সাথে সংশ্লিষ্টতার ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় । আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে এ দণ্ড বহাল রাখা হয়।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
গত বছরের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখে আদেশ দেন।
এরপর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
নিয়ম অনুযায়ী আসামীপক্ষ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে গত ৫ মার্চ আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন দায়ের করে।
৫ মাচ রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল রিভিউ আবেদন খারিজ করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছর ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
কামারুজ্জামানের আপিল শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী।
কামারুজ্জামানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালে শেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি জিকে স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। এরপর জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে আইএসসি’তে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালে নাসিরাবাদ কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৭৬ সালে কামারুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে এমএ পাস করেন।
১৯৭৯ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং ১৯৯২ সালে এ দলের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। জামায়াতে যোগ দেয়ার আগে তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রেীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
মুহম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৮০ সাল থেকে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। তিনি দৈনিক সংগ্রমের নির্বাহিী সম্পাদক ছিলেন। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তিনি সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কামারুজ্জামান এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলনে লিয়াজো কমিটির একজন সদস্য ছিলেন।
একজন লেখক এবং সুবক্তা হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। তার পাঁচ ছেলে রয়েছে।
রায়ের কপিতে স্বাক্ষর করেননি বিচারপতিরা
এদিকে আজ সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার সৈয়দ আমিনুল ইসলাম জানান, বিচারাপতিরা রিভিউ’র রায়ে স্বাক্ষর করেননি। আজ মঙ্গলবার তারা স্বাক্ষর করতে পারেন।
সিনিয়র জেল সুপার বিকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের জানান, তারা এখনো রায়ের কপি পাননি। কপি পেলে আসামীকে তা পড়ে শোনানো হবে এবং তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি-না সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে। এরপর পরবর্তী করনীয় বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রিভিউ আবেদন সকালে খারিজ করে দেয়ার পর কারাকর্তৃপক্ষ দুপুরের পর কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের খবর দেয় বিকাল পাঁচটার মধ্যে কারাগারে আসার জন্য আসামীর সাথে সাক্ষাতের জন্য। কারা কর্তৃপক্ষও ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় প্রস্ততি সম্পন্ন করে রাখে। এসব কারনে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় রাতেই কার্যকর হতে পারে মর্মে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে।
আজ আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়া । এর ফলে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগ এর আগে যে রায় দিয়েছিল তা বহাল রইল।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ সকালে রিভিউ আবেদন খারিজ করে রায় দেন।
রিভিউ আবেদনের খারিজের মধ্য দিয়ে এ মামলার সমস্ত বিচার কার্যক্রম শেষ হয়ে গেল এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে আইনগত আর কোন বাঁধা নেই। আসামীর জন্য এখন সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদনের একটি সুযোগ রয়েছে। তিনি যদি এ আবেদন না করেন বা আবেদন করলেও রাষ্ট্রপতি যদি তা নামঞ্জুর করেন তাহলে ফাঁসি কার্যকর করার ক্ষেত্রে আর কোন বাঁধা থাকবেনা।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেছেন, কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার আবেদনের জন্য সময় পাবেন। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে তাকে আবেদন করতে হবে। তিনি আবেদন করলে তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি কার্যকর করা যাবেনা। তবে আবেদন না করলে বা আবেদন নাকচ করা হলে সেক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল আইনের ধারা মোতাবেক সরকার ফাঁসি কার্যকর করার সময় নির্ধারণ করবে। তিনি বলেন, ফাঁসি কার্যকরের জন্য সাত দিনের আগে নয় এবং ২১ দিনের পরে নয় জেলকোডের এ নিয়ম তার জন্য প্রযোজ্য হবেনা। সরকার যখন চাইবে তখন তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফাঁসির দিনক্ষন ঠিক করে তা জেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেবে এবং সে অনুযায়ী জেল কর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকরের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
প্রাণভিক্ষার আবেদন বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজের বিষয়টি কারাকর্তপক্ষ বরাবর পাঠাবে। কারা কর্তৃপক্ষ রিভিউ আবেদনের রায় আসামীকে পড়ে শোনানোর পর তার কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন বিষয়ে জানতে চাইবে। সেটা বিবেচনার জন্য তিনি কিছু সময় পেতে পারেন। তবে খুব বেশি দেরি করার সুযোগ নেই।
মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়। গত বছর ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের একটি অভিযোগ বহাল রাখেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। মৃত্যুদণ্ডের আরেকটি সাজা বাতিল করে যাবজ্জীবন করেন।
আজ রিভিউ আবেদন খারিজের মাধ্যমে আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ৩ নভেম্বর যে রায় দিয়েছিলেন তা বহাল রইল। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের অপর তিনটি অভিযোগের বিষয়ে আপিল বিভাগ পূর্বে যে রায় দেন তাও বহাল রইল গতকালের রায়ে।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা ট্রাইব্যুনাল থেকে কারাগারে পাঠানো হয়।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও রায় :
ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনে।
এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রায়ে মোট পাঁচটিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয়া য় হয়।
নিম্নে এ পাঁচটি অভিযোগে ট্রাইবুন্যাল এবং আপিল বিভাগের রায় উল্লেখ করা হল।
১ নম্বর অভিযোগ : বদিউজ্জামানকে অপহরন করে আহমেদনগর আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা। এ হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে সর্বসম্মতভাবে।
২ নম্বর অভিযোগ : শেরপর কলেজের অধ্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় উলঙ্গ করে শহরে প্রদণি করানো এবং পেটানো হয়। এ অভিযোগে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগে এ সাজা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে বহাল রাখা হয়েছে।
৩ নম্বর অভিযোগ : ১৯৭১ সালে কামারুজ্জামানের পরামর্শে পাকিস্তান আর্মি দেশীয় রাজাকার এবং আলবদর সদস্যদের সাথে নিয়ে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে অভিযান চালায়। অভিযানে ওই গ্রামে দেড়শতাধিক মানুষ নিহত হয় এবং অসংখ্য নারী ধর্ষনের শিকার হয়। এ গণহত্যার অভিযোগে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ সাজা বহাল রাখে।
৪ নম্বর অভিযোগ : শেরপর মোস্তফাবাগ থেকে গোলাম মোস্তফাকে ধরে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। এরপর তাকে কামারুজ্জামানসহ অন্যান্যরা মিলে একটি ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ অভিযোগে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে যাবজ্জীবন দিয়েছে।
৭ নম্বর অভিযোগ : মুক্তিযুদ্ধচলাকালে ময়মনসিংহ গোলাপজান রোডে টেপা মিয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে টেপা মিয়া এবং তার ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলাপরিষদ ডাকবাংলায় অবস্থিত আলবদর ক্যাম্পে আনা হয়। পরেরদিন সকালে তারা দুজনসহ সাতজনকে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর তীরে আনা হয়। এসময় টেপা মিয়া নদীতে ঝাপ দিয়ে রক্ষা পায় এবং বাকীদের হত্যা করা হয়। এ অভিযোগের সাথে সংশ্লিষ্টতার ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় । আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে এ দণ্ড বহাল রাখা হয়।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
গত বছরের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখে আদেশ দেন।
এরপর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
নিয়ম অনুযায়ী আসামীপক্ষ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে গত ৫ মার্চ আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন দায়ের করে।
৫ মাচ রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল রিভিউ আবেদন খারিজ করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছর ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
কামারুজ্জামানের আপিল শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী।
কামারুজ্জামানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালে শেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি জিকে স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। এরপর জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে আইএসসি’তে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালে নাসিরাবাদ কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৭৬ সালে কামারুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে এমএ পাস করেন।
১৯৭৯ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং ১৯৯২ সালে এ দলের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। জামায়াতে যোগ দেয়ার আগে তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রেীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
মুহম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৮০ সাল থেকে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। তিনি দৈনিক সংগ্রমের নির্বাহিী সম্পাদক ছিলেন। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তিনি সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কামারুজ্জামান এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলনে লিয়াজো কমিটির একজন সদস্য ছিলেন।
একজন লেখক এবং সুবক্তা হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। তার পাঁচ ছেলে রয়েছে।
রায়ের কপিতে স্বাক্ষর করেননি বিচারপতিরা
এদিকে আজ সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার সৈয়দ আমিনুল ইসলাম জানান, বিচারাপতিরা রিভিউ’র রায়ে স্বাক্ষর করেননি। আজ মঙ্গলবার তারা স্বাক্ষর করতে পারেন।
সিনিয়র জেল সুপার বিকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের জানান, তারা এখনো রায়ের কপি পাননি। কপি পেলে আসামীকে তা পড়ে শোনানো হবে এবং তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি-না সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে। এরপর পরবর্তী করনীয় বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রিভিউ আবেদন সকালে খারিজ করে দেয়ার পর কারাকর্তৃপক্ষ দুপুরের পর কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের খবর দেয় বিকাল পাঁচটার মধ্যে কারাগারে আসার জন্য আসামীর সাথে সাক্ষাতের জন্য। কারা কর্তৃপক্ষও ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় প্রস্ততি সম্পন্ন করে রাখে। এসব কারনে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় রাতেই কার্যকর হতে পারে মর্মে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন