স্কাইপ কেলেঙ্কারি
৬/১২/২০১২ বৃহষ্পতিবার
মেহেদী হাসান
আজ মাওলানা সাঈদীর মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষ হবার কথা। সমস্ত বিচার কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ ঘোষনা করা হবে। সে ঘোষনার খবর সংগ্রহের জন্য দৈনিক পত্রিকা, টিভি, রেডিও, অনলাইনসহ অনেক গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা উপস্থিত হয়েছেন ট্রাইব্যুনাল কক্ষে।
সকাল সাড়ে দশটায় যথারীতি ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে মিজানুল ইসলাম অসমাপ্ত যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন। অল্প কিছুক্ষন চলার পর ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বললেন, মিজান সাহেব, আমরা আপনার কাছ থেকে দশ মিনিট সময় নিতে চাই একটি অর্ডার পাসের জন্য। এরপর তিনি বেঞ্চ অফিসারকে ডেকে অর্ডার ডিকটেট নেয়ার নির্দেশ দেন। বিষয়টি কি কেউই কিছু আমরা বুঝতে পারিনি শুরুতে। সবাই মনোযোগ দিয়ে ইংরেজিতে অর্ডার পাস শুনছি। একটু পরেই আস্তে আস্তে সব পরিস্কার হতে শুরু করল। আমাদের কান আরো খাড়া হয়ে গেল। সবাই একদম চুপ। পিনপত নিরবতার মধ্যে চেয়ারম্যানের প্রতিটি শব্দ যেন এক একটি বোমা আকারে বিষ্ফোরিত হতে লাগল বিচার কক্ষে। আমরা বিস্ময়ে হতবাক। একি শুনছি এসব!
বিচারপতি নিজামুল হক ইংরেজিতে টানা যে আদেশ পাশ করলেন তার বাংলা অর্থ নিম্নরুপ :
এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এবং অপর দুই সদস্য বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর চেয়ারম্যান এবং অপর দুই সদস্য নিয়োগের পর তারা ওপেন কোর্টে বলেছেন যে, ইন্ট্রারন্যানশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ তাদের কাছে একটি নতুন আইন। আইনটি বোঝার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, আসামী পক্ষের আইনজীবী এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহনের পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রকৃয়া, আদেশ এবং সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে। দেশে এবং বিদেশে গবেষকদের কাছ থেকে তারা সহায়তা নিতে পারেন এবং এভাবে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রকৃয়া চলছিল।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের সুযোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন এবং আরো কয়েকজন বাংলাদেশী যারা ব্রাসেলসহ অন্যান্য জায়গায় বাস করেন তাদের সহায়তা গ্রহনের । বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের উন্নয়ন বিষয়ে ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে চেয়ারম্যানের প্রায়ই আলোচনা হত এবং তার কাছ থেকে চেয়ারম্যান এ বিষয়ে সহায়তা গ্রহণ করেছেন। এই বিচার প্রকৃয়া চলাকালে এবং বিভিন্ন আদেশের সময় চেয়ারম্যান তার কাছ থেকে সহায়তা নিয়েছেন। এ উপলক্ষে তাদের দুজনের মধ্যে স্কাইপির মাধ্যমে কথপোকথন হয়েছে।
দুই বা তিনদিন আগে চেয়ারম্যানের ইমেইল, স্কাইপি একাউন্টস এবং কম্পিউটার হ্যাক হয়। গতকাল (বুধবার) রাত দশটায় ৯১৯৮১০০১৬৬২ নম্বর থেকে চেয়ারম্যানের কাছে ফোন আসে। ফোন নম্বরটি লন্ডনভিত্তিক ইকনোমিস্ট ম্যাগাজিনের। ফোন করে চেয়ারম্যানকে বলা হয়- ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বেলজিয়ামের ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে যেসব কথাবার্তা বলেছেন তা তাদের কাছে আছে। এবং এ বিষয়ে চেয়ারম্যানকে কিছু প্রশ্ন করা হয়। ফোনে তিনি আরো জানান যে, চেয়ারম্যান নিয়মতি ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের সাথে কথা বলেন এবং তার কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করেন। তিনি জানান, চেয়ারম্যান ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের কাছ থেকে ইমেইলের মাধ্যমে যেসব জিনিস গ্রহণ করেছেন তার সবকিছুই তাদের কাছে রয়েছে। এভাবে চেয়ারম্যান এ উদ্বেগজনক বিষয়টি জানতে পারেন।
ইমেইল, স্কাইপি, কম্পিউটার হ্যাক করা, চেয়ারম্যানের কাছ থেকে অবৈধভাবে ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন এবং বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতিকে প্রভাবিত করার শামিল। টেলিফোনে চেয়ারম্যানের সাথে যিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি নিজেকে চেয়ারম্যানের সাথে কথপোকথনে লিপ্ত করেছেন এবং আইন অনুযায়ী তিনি এটি পারেননা। চেয়্যাারম্যান আরো জানতে পেরেছেন যে, ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের ইমেইল, স্কাইপি এবং কম্পিউটারও হ্যাক হয়েছে। এতে এটি পরিষ্কার যে, যারা এ ট্রাইব্যুনালের চলমান বিচার কার্যক্রমকে ব্যহত করার কাজে লিপ্ত তারা এর সাথে জড়িত । এটা কোনমতেই মেনে নেয়া যায়না। কাজেই ইকনোমিস্টের সাউথ এশিয়া ব্যুরো চিফ এ্যাডাম রবার্টস এবং ইকনোমিস্টের চিফ এডিটর রব গিফর্ডের প্রতি আমরা নোটিশ জারি করছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ১১(৪) ধারা মোতাবেক কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রকৃয়া শুরু করা হবেনা সে মর্মে তিন সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে হবে। তারা ইমেইল, স্কাইপি একাউন্টস এবং চেয়ারম্যানের কম্পিউটর থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাও গোপন রাখার নির্দেশ দেয়া হল। এটি প্রকাশ করলে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হবে এবং চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত পোগনীয়তা রক্ষা করা দরকার। তারা যদি এটি ভঙ্গ এসব প্রকাশ করে তাহলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য আদেশের কপি ইনেসপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এবং বিটিআরসির চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানোর নিদের্শ দেয়া হয় হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক আদেশ পাশের সময় ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এবং বিচারপতি আনোয়ারুল হক উপস্থিত ছিলেন।
(স্কাইপি : ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে কম্পিউটার বা ল্যাপটপের মাধ্যমে দুজনের কথপোকথন যেখানে পরস্পরের ছবি দেখারও ব্যবস্থা থাকে। )
আদেশ পাশের সাথে সাথে উপস্থিত সাংবাদিকরা হুডমুড করে বাইরে বের হতে লাগল কে কার আগে খবরটি ব্রেক করবেন সে প্রতিযোগিতায়। ট্রাইব্যুনালের সামনে সব সাংবাদিকদের মোবাইল ফোন কানে উঠে গেল। কেউ কেউ টিভিতে লাইভ প্রচার শুরু করল। সাঈদীর বিচার শেষ হচ্ছে এবং এবং রায়ের তারিখ বিষয়ে আদেশ দেবেন এটি আর কোন খবর নয় এখন। খবর হল বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ কথাবার্ত এবং ইমেইল ডকুমেন্ট হ্যাক হয়েছে। তা চলে গেছে লন্ডনের ইকনোমিস্ট ম্যাগাজিনের কাছে। বিষয়টি একেক সাংবাদিক একেকভাবে ব্রেক করতে লাগল। মূল বিষয় হল বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বিচার নিয়ে বাইরের এক ব্যক্তির সাথে বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন, ইমেইল আদান প্রদান করেছেন। সেসব রেকর্ড অন্যের কাছে চলে গেছে। বিচারপতি নিজেই আজ এ ঘটনা ফাঁস করেছেন।
গনামধ্যমে নিউজ আসার সাথেথ সাথে সারা দেশে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। অভিযোগ আসতে লাগল বিভিন্ন মহল থেকে-এই তাহলে বিচার? বিচারের নামে এই প্রহসনের নাটক চলছিল এতদিন? এর সাথে সাথে ঘটতে লাগল একের পর এক অভিনব ঘটনা।
৬ ডিসেম্বর তিনি ট্রাইব্যুানালে স্কাইপ কেলেঙ্কারির কথা নিজেই ফাঁস করলেন। আর ৯ ডিসেম্বর থেকে দৈনিক আমার দেশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে শুরু করল বিচারপতি নিজামুল হক ও বেলজিয়ামের ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যকার স্কাইপ কথোপকথনের রেকর্ড। বড় বড় হেডলাইনে আসতে লাগল ভয়ঙ্কর সব খবর। বিচার নিয়ে তাদের পরিকল্পনা, এর সাথে কোন মন্ত্রী কিভাবে জড়িত, কোন মন্ত্রী কখন কার বাসায় গেছে, বিচার বিষয়ে কি বলেছে, বিচার নিয়ে সরকারের চাপ, আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির উদ্ধৃতিসহ নানা গেপান বিষয় বের হয়ে আসতে লাগল আমার দেশের খবরে। দৈনিক আমার দেশ নিযে মহাকাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেল সারা দেশে। পাঁচশ টাকা পর্যন্ত দিয়ে একটি পত্রিকা কেনার রেকর্ড হয়েছে। একটি পত্রিকা কিনে ভাড়ায় তা অন্যরা পড়েছে এবং একজন পড়িয়ে ভাড়ার বিনিময়ে অন্যরা জড়ো হয়ে শোনার ঘটনা ঘটেছে। সারা দেশে মাঠে ঘাটে শুধু একই আলোচনা। আগামীকাল আবার কোন বোমা ফাটানো খবর বের হবে এ বিষয়ে তা নিয়ে।
শুধু বাংলাদেশ নয় গোট বিশ্বে ঢ়িঢ়ি পড়ে গেল বাংলাদেশের বিচার বিভাগের এ ন্যাক্কারজনক ঘটনায়। ট্রাইব্যুনালে যাওয়া বন্ধ করে দেন আসামী পক্ষের আইনজীবীরা। ১১ তারিখ বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। আমার দেশে ধারাবাহিকভাবে স্কাইপ ডকুমেন্ট প্রকাশের পঞ্চম দিনের মাথায় তা বন্ধ করে দেয়া হল ট্রাইব্যুনাল-২ এর এক আদেশে।
ট্রাইব্যুনালের বিচার বিষয়ে বিচারপতি নিজামুল হক বেলজিয়ামে অবস্থানরত ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের সাথে স্কাইপি সংলাপ বা ভিডিও কথোপকথন করেছেন বিভিন্ন সময়ে। ইমেইলেও বিচারের বিভিন্ন বিষয় আদান প্রদান করেছেন। তার সকল ভিডিও কথোপকথনের রেকর্ড এবং ইমেইল ডকুমেন্ট বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকনোমিস্টের কাছে চলে যায়। দৈনিক আমার দেশও একটি বিদেশী সূত্র থেকে এ সংলাপ ও ডকুমেন্ট পাওয়ার কথা জানায়। এরপর বিচারপতি নিজামুল হকের দীর্ঘ স্কাইপি সংলাপ গত রোববার থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা শুরু করে আমার দেশ। এ নিয়ে দেশে বিদেশে তুমুল ঝড় ওঠে। বিচারপতি নিজামুল হকের কথোপোকথনের বিষয়বস্তু পড়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে গোটা জাতি। বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা একে দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করেন। একজন বিচারপতির জন্য এর চেয়ে খারাপ কোন অসদাচরন আর হতে পারেনা বলেও মন্তব্য করেন তারা।
স্কাইপ সংলাপের বিষয়বস্তু :
বিচারপতি নিজামুল হক ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের সাথে যেসব কথাবর্তা বলেছেন তার মধ্যে রয়েছে অভিযুক্তদের মামলার শুনানী কখন হবে, কোন মামলার রায় আগে হবে, কোনটার রায় পরে হবে, কোন ট্রাইব্যুনালে কোন মামলায় কতজন সাক্ষী আসামী পক্ষকে আনতে দেয়া হবে, রায়ের কাঠামো কি হবে, অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলায় সাক্ষী সুলতানা কামাল, মুনতাসির মামুন এবং জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে দিয়ে কোন কোন বিষয় কিভাবে বলানো হবে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিচারের রায়ের কাঠামো কি হবে সে বিষয়ে বেলজিয়াম থেকে আহমেদ জিয়া উদ্দিনের মাধ্যমে লিখিয়ে আনা বিষয়ে তথ্য আদান প্রদান হয়। পুরো বিচার প্রকৃয়া নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সাথে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের গোপন যোগসাজস, আইনমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রীর সাথে যোগসাজসসহ বিচার কার্যক্রমের সাথে যে বাইরের আরো বিভিন্ন মহলের প্রভাবে এবং ইশারা ইঙ্গিতে চলেছে তা জানা যায় এ সংলাপ ফাঁস হওয়ার মাধ্যমে। বিশেষ করে সুদুর বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থানরত ড, আহমেদ জিয়াউদ্দিনই যে এ বিচারের বিভিন্ন গতি প্রকৃতি নির্ধারন করে দিচ্ছিলেন তা স্পষ্ট হয়েছে। ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন এ বিচার প্রকৃয়ার গতি প্রকৃতি নির্ধারনের জন্য কোন কোন ব্যক্তি এবং মহলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন তাও স্পষ্ট হয়ে যায়। এ কারনে দেশের আইনজ্ঞ মহল থেকে বলা হয়েছে এ বিচার যে একটি সাজানো নাটক এবং প্রহসন ছিল তা প্রমানিত হয়েছে।
বিচারপতি নিজামুল হকের সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে ড. জিয়াউদ্দিন কোন ট্রাইব্যুনালের কোন মামলা এগিয়ে আনতে হবে, কোনটি পিছিয়ে দিতে হবে সেজন্য দুই ট্রাইব্যুনালের সব বিচারপতিদের আইনমন্ত্রীর বাসায় তিনি বসার ব্যবস্থা করবেন বলে স্কাইপির মাধ্যমে আলাপকালে জানান বিচারপতি নিজামুল হককে।
বিচারপতি নিজামুল হক আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন, “গভর্নমেন্ট রায়ের জন্য পাগল হইয়া গেছে। সাঈদীরটা হলে ডিসেম্বরের মধ্যে রায় দেতে পারবো। গভর্নমেন্ট গেছে পাগল হইয়া। তারা একটা রায় চায়। সাঈদীর রায়ডা হইয়া গেলে গভর্নমেন্ট ঠাণ্ডা হইত।..আমাদের তো স্টেট মিনিস্টার (কামরুল ইসলাম) যাচ্ছে হজে। আজকে আসছিল আমার লগে দেখা করতে সন্ধ্যায়। ওনি বললেন যে রায়টা তাড়াতাড়ি দেবেন। ”
৬ সেপ্টেম্বরের কথোপকথনে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেন, ‘সিনহা বাবু কইছে-ডিসম্বরের মধ্যে তিনডা দিয়া লন, তারপর আমরা আপনারে এহানে নিয়া আসি।’
চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর ড. আহমদ জিয়াউদ্দিনের কাছে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম জানতে চান, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চার্জের কপিটা আছে কি না। তিনি এ-ও বলেন, ‘থাকতেই হবে, থাকতেই হবে। তো, এই জিনিসগুলোর রিপলাইডা আপনি যদি একটু ইয়ে করে দেন আমাকে। তাইলে আমি জাজমেন্টর জন্য একটু রেডি হইতে পারি।’
একই দিনের স্কাইপি কথোপকথনে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেন, ‘জাজমেন্টের কাজ তো শুরু করছি আমি, অন্য কাজ ফেলাইয়া টাইপ শুরু করছি আমি।’ তখন তাকে আহমদ জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘আপনি ওই জায়গাটাকে, আপনি করেন কি যে... এ জায়গাটিতে একটু গ্যাপ রাখেন। কারণ এখনও লিগ্যাল আরগুমেন্ট কিন্তু তারা প্লেস করে নাই।’ এ থেকে বোঝা যায় আরগুমেন্ট শুরুর আগেই বিচারপতি নিজামুল হক রায় লেখার কাজ শুরু করে দেন এবং রায়ের কিছু বিষয় লিখে পাঠানোর জন্য ড. আহমদ জিয়াউদ্দিনের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন।
নিজামুল হক নাসিম নাসিম সংলাপের সময় বলেন, “এই গোলাম আযম হইলো টিম লিডার। সাঈদী সাইড ট্র্যাক। সাঈদীর লগে আপনার লিডার-টিডারশিপের কোনো প্রশ্ন আসতেছে না। গোলম আযমের রায়ের পরে আপনার নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান—সবগুলা রায় হইতে পারে, এর পরে। কিন্তু গোলাম আযম ফাস্টে। ওই গ্রুপের থেকে একমাত্র সাঈদী, সাকা এরা বায়রায় (বাইরে)। সাকারে তো আমি থামাইয়াই দিছি। সাঈদীরে থামাচ্ছি না। কারণ, সাঈদী প্রায় শেষ। এইটা যদি উনাদেরকে বইল্লা... এইডা ওনাদেরকে (ট্রাইব্যুনাল-২) হায়ার লেভেল থেইকা বইল্লা, থামায়া দিতে হবে যে, আপনি কাদের মোল্লারে ঢিল দেন। ঢিল দিয়া বাকিগুলারে সামনে আগান। কেননা, ওই যে অ্যাবসেন্ট যে আছে, ওর নাম জানি কী...? ও বাচ্চু, হ্যারে দিয়া শুরু করেন। আরেকজনরে নিয়া আগান সামনে। এরপর আপনার, পর পর ৩-৪টা রায় দিয়া দেন, অসুবিধা নাই কোনো। বাট আফটার গোলাম আযম। নট বিফোর দ্যাট।”
বিচারপতি জহির আহমেদকে পদত্যাগে বাধ্য করার পর নতুন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয় ট্রাইব্যুনালে। এ বিষয়ে বিচারপতি নিজামুল হক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন ড. জিয়াউদ্দিনের সাথে। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বিষয়ে তিনি বলেন, “তাকে বলে দেয়া হয়েছে চেয়ারম্যান যা বলবে তুমি তাতে শুধু ইয়স বলবা। তুমি যা বলবা রুমে বলবা, কোর্টে চেয়ারম্যান যা বলবে তাতে ওকে বলবা”
এছাড়া বিচারপতি নিজামুল হক ট্রাইব্যুনালের নতুন সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে সোনা জাহাঙ্গীর, দুর্নীতি পরায়ন বলেছেন। আইনপ্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামকে কামরুল টামরুল, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনকে খাতুন টাতুন সহ আরো বিভিন্ন ব্যক্তিকে চোরসহ বিভিন্নভাবে ব্যাঙ্গ করে কথা বলেছেন। তাদেরকে আওয়ামী বলে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করেছেন। (বিচারপতি নিজামুল হক ছাত্র জীবনে জাসদ ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন)।
এছাড়া ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হকের বিষয়ে বিচারপতি নিজামুল হক বলেন আমরা দুইজন শক্ত আছি।
এসব আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে ট্রাইব্যুনালে তিনজন সদস্য থাকলেও মূলত বিচারপতি নিজামুল হকের একক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন হত। এবং তার সিদ্ধান্ত গ্রহনের পেছনে বাইরের বিভিন্ন ব্যক্তি, মহলের প্রভাব ছিল।
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুমকে শুধু লাফায়। আমি তাকে বসিয়ে দিয়েছি। পরে তাকে রুমে ডাকাই। মালুম বলে এটাই ঠিক আছে। আমি শুধু দাড়িয়ে যাব আপনি আমাকে বসিয়ে দেবেন। লোকে দেখবে আমাদের মধ্যে কোন খাতির নেই।
ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি জহির আহমেদকে সচিবালয়ে ডেকে আইনমন্ত্রলয় পদত্যাগে বাধ্য করেছিল সে বিষয়টিও উল্লেখ আছে বিচারপতি নিজামুল হকের সংলাপে। এ সংলাপ থেকে জানা যায় বিচারক জহির আহমেদকে আইনমন্ত্রীর বাসায় ডেকে প্রথমে পদত্যাগ করতে বলা হয়। এরপর সচিবালয়ে ডেকে পদত্যাগে স্বাক্ষর রাখা হয়।
৬/১২/২০১২ বৃহষ্পতিবার
মেহেদী হাসান
আজ মাওলানা সাঈদীর মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষ হবার কথা। সমস্ত বিচার কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ ঘোষনা করা হবে। সে ঘোষনার খবর সংগ্রহের জন্য দৈনিক পত্রিকা, টিভি, রেডিও, অনলাইনসহ অনেক গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা উপস্থিত হয়েছেন ট্রাইব্যুনাল কক্ষে।
সকাল সাড়ে দশটায় যথারীতি ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে মিজানুল ইসলাম অসমাপ্ত যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন। অল্প কিছুক্ষন চলার পর ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বললেন, মিজান সাহেব, আমরা আপনার কাছ থেকে দশ মিনিট সময় নিতে চাই একটি অর্ডার পাসের জন্য। এরপর তিনি বেঞ্চ অফিসারকে ডেকে অর্ডার ডিকটেট নেয়ার নির্দেশ দেন। বিষয়টি কি কেউই কিছু আমরা বুঝতে পারিনি শুরুতে। সবাই মনোযোগ দিয়ে ইংরেজিতে অর্ডার পাস শুনছি। একটু পরেই আস্তে আস্তে সব পরিস্কার হতে শুরু করল। আমাদের কান আরো খাড়া হয়ে গেল। সবাই একদম চুপ। পিনপত নিরবতার মধ্যে চেয়ারম্যানের প্রতিটি শব্দ যেন এক একটি বোমা আকারে বিষ্ফোরিত হতে লাগল বিচার কক্ষে। আমরা বিস্ময়ে হতবাক। একি শুনছি এসব!
বিচারপতি নিজামুল হক ইংরেজিতে টানা যে আদেশ পাশ করলেন তার বাংলা অর্থ নিম্নরুপ :
এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এবং অপর দুই সদস্য বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর চেয়ারম্যান এবং অপর দুই সদস্য নিয়োগের পর তারা ওপেন কোর্টে বলেছেন যে, ইন্ট্রারন্যানশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ তাদের কাছে একটি নতুন আইন। আইনটি বোঝার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, আসামী পক্ষের আইনজীবী এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহনের পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রকৃয়া, আদেশ এবং সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে। দেশে এবং বিদেশে গবেষকদের কাছ থেকে তারা সহায়তা নিতে পারেন এবং এভাবে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রকৃয়া চলছিল।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের সুযোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন এবং আরো কয়েকজন বাংলাদেশী যারা ব্রাসেলসহ অন্যান্য জায়গায় বাস করেন তাদের সহায়তা গ্রহনের । বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের উন্নয়ন বিষয়ে ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে চেয়ারম্যানের প্রায়ই আলোচনা হত এবং তার কাছ থেকে চেয়ারম্যান এ বিষয়ে সহায়তা গ্রহণ করেছেন। এই বিচার প্রকৃয়া চলাকালে এবং বিভিন্ন আদেশের সময় চেয়ারম্যান তার কাছ থেকে সহায়তা নিয়েছেন। এ উপলক্ষে তাদের দুজনের মধ্যে স্কাইপির মাধ্যমে কথপোকথন হয়েছে।
দুই বা তিনদিন আগে চেয়ারম্যানের ইমেইল, স্কাইপি একাউন্টস এবং কম্পিউটার হ্যাক হয়। গতকাল (বুধবার) রাত দশটায় ৯১৯৮১০০১৬৬২ নম্বর থেকে চেয়ারম্যানের কাছে ফোন আসে। ফোন নম্বরটি লন্ডনভিত্তিক ইকনোমিস্ট ম্যাগাজিনের। ফোন করে চেয়ারম্যানকে বলা হয়- ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বেলজিয়ামের ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে যেসব কথাবার্তা বলেছেন তা তাদের কাছে আছে। এবং এ বিষয়ে চেয়ারম্যানকে কিছু প্রশ্ন করা হয়। ফোনে তিনি আরো জানান যে, চেয়ারম্যান নিয়মতি ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের সাথে কথা বলেন এবং তার কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করেন। তিনি জানান, চেয়ারম্যান ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের কাছ থেকে ইমেইলের মাধ্যমে যেসব জিনিস গ্রহণ করেছেন তার সবকিছুই তাদের কাছে রয়েছে। এভাবে চেয়ারম্যান এ উদ্বেগজনক বিষয়টি জানতে পারেন।
ইমেইল, স্কাইপি, কম্পিউটার হ্যাক করা, চেয়ারম্যানের কাছ থেকে অবৈধভাবে ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন এবং বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতিকে প্রভাবিত করার শামিল। টেলিফোনে চেয়ারম্যানের সাথে যিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি নিজেকে চেয়ারম্যানের সাথে কথপোকথনে লিপ্ত করেছেন এবং আইন অনুযায়ী তিনি এটি পারেননা। চেয়্যাারম্যান আরো জানতে পেরেছেন যে, ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের ইমেইল, স্কাইপি এবং কম্পিউটারও হ্যাক হয়েছে। এতে এটি পরিষ্কার যে, যারা এ ট্রাইব্যুনালের চলমান বিচার কার্যক্রমকে ব্যহত করার কাজে লিপ্ত তারা এর সাথে জড়িত । এটা কোনমতেই মেনে নেয়া যায়না। কাজেই ইকনোমিস্টের সাউথ এশিয়া ব্যুরো চিফ এ্যাডাম রবার্টস এবং ইকনোমিস্টের চিফ এডিটর রব গিফর্ডের প্রতি আমরা নোটিশ জারি করছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ১১(৪) ধারা মোতাবেক কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রকৃয়া শুরু করা হবেনা সে মর্মে তিন সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে হবে। তারা ইমেইল, স্কাইপি একাউন্টস এবং চেয়ারম্যানের কম্পিউটর থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাও গোপন রাখার নির্দেশ দেয়া হল। এটি প্রকাশ করলে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হবে এবং চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত পোগনীয়তা রক্ষা করা দরকার। তারা যদি এটি ভঙ্গ এসব প্রকাশ করে তাহলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য আদেশের কপি ইনেসপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এবং বিটিআরসির চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানোর নিদের্শ দেয়া হয় হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক আদেশ পাশের সময় ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এবং বিচারপতি আনোয়ারুল হক উপস্থিত ছিলেন।
(স্কাইপি : ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে কম্পিউটার বা ল্যাপটপের মাধ্যমে দুজনের কথপোকথন যেখানে পরস্পরের ছবি দেখারও ব্যবস্থা থাকে। )
আদেশ পাশের সাথে সাথে উপস্থিত সাংবাদিকরা হুডমুড করে বাইরে বের হতে লাগল কে কার আগে খবরটি ব্রেক করবেন সে প্রতিযোগিতায়। ট্রাইব্যুনালের সামনে সব সাংবাদিকদের মোবাইল ফোন কানে উঠে গেল। কেউ কেউ টিভিতে লাইভ প্রচার শুরু করল। সাঈদীর বিচার শেষ হচ্ছে এবং এবং রায়ের তারিখ বিষয়ে আদেশ দেবেন এটি আর কোন খবর নয় এখন। খবর হল বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ কথাবার্ত এবং ইমেইল ডকুমেন্ট হ্যাক হয়েছে। তা চলে গেছে লন্ডনের ইকনোমিস্ট ম্যাগাজিনের কাছে। বিষয়টি একেক সাংবাদিক একেকভাবে ব্রেক করতে লাগল। মূল বিষয় হল বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বিচার নিয়ে বাইরের এক ব্যক্তির সাথে বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন, ইমেইল আদান প্রদান করেছেন। সেসব রেকর্ড অন্যের কাছে চলে গেছে। বিচারপতি নিজেই আজ এ ঘটনা ফাঁস করেছেন।
গনামধ্যমে নিউজ আসার সাথেথ সাথে সারা দেশে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। অভিযোগ আসতে লাগল বিভিন্ন মহল থেকে-এই তাহলে বিচার? বিচারের নামে এই প্রহসনের নাটক চলছিল এতদিন? এর সাথে সাথে ঘটতে লাগল একের পর এক অভিনব ঘটনা।
৬ ডিসেম্বর তিনি ট্রাইব্যুানালে স্কাইপ কেলেঙ্কারির কথা নিজেই ফাঁস করলেন। আর ৯ ডিসেম্বর থেকে দৈনিক আমার দেশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে শুরু করল বিচারপতি নিজামুল হক ও বেলজিয়ামের ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যকার স্কাইপ কথোপকথনের রেকর্ড। বড় বড় হেডলাইনে আসতে লাগল ভয়ঙ্কর সব খবর। বিচার নিয়ে তাদের পরিকল্পনা, এর সাথে কোন মন্ত্রী কিভাবে জড়িত, কোন মন্ত্রী কখন কার বাসায় গেছে, বিচার বিষয়ে কি বলেছে, বিচার নিয়ে সরকারের চাপ, আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির উদ্ধৃতিসহ নানা গেপান বিষয় বের হয়ে আসতে লাগল আমার দেশের খবরে। দৈনিক আমার দেশ নিযে মহাকাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেল সারা দেশে। পাঁচশ টাকা পর্যন্ত দিয়ে একটি পত্রিকা কেনার রেকর্ড হয়েছে। একটি পত্রিকা কিনে ভাড়ায় তা অন্যরা পড়েছে এবং একজন পড়িয়ে ভাড়ার বিনিময়ে অন্যরা জড়ো হয়ে শোনার ঘটনা ঘটেছে। সারা দেশে মাঠে ঘাটে শুধু একই আলোচনা। আগামীকাল আবার কোন বোমা ফাটানো খবর বের হবে এ বিষয়ে তা নিয়ে।
শুধু বাংলাদেশ নয় গোট বিশ্বে ঢ়িঢ়ি পড়ে গেল বাংলাদেশের বিচার বিভাগের এ ন্যাক্কারজনক ঘটনায়। ট্রাইব্যুনালে যাওয়া বন্ধ করে দেন আসামী পক্ষের আইনজীবীরা। ১১ তারিখ বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। আমার দেশে ধারাবাহিকভাবে স্কাইপ ডকুমেন্ট প্রকাশের পঞ্চম দিনের মাথায় তা বন্ধ করে দেয়া হল ট্রাইব্যুনাল-২ এর এক আদেশে।
ট্রাইব্যুনালের বিচার বিষয়ে বিচারপতি নিজামুল হক বেলজিয়ামে অবস্থানরত ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের সাথে স্কাইপি সংলাপ বা ভিডিও কথোপকথন করেছেন বিভিন্ন সময়ে। ইমেইলেও বিচারের বিভিন্ন বিষয় আদান প্রদান করেছেন। তার সকল ভিডিও কথোপকথনের রেকর্ড এবং ইমেইল ডকুমেন্ট বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকনোমিস্টের কাছে চলে যায়। দৈনিক আমার দেশও একটি বিদেশী সূত্র থেকে এ সংলাপ ও ডকুমেন্ট পাওয়ার কথা জানায়। এরপর বিচারপতি নিজামুল হকের দীর্ঘ স্কাইপি সংলাপ গত রোববার থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা শুরু করে আমার দেশ। এ নিয়ে দেশে বিদেশে তুমুল ঝড় ওঠে। বিচারপতি নিজামুল হকের কথোপোকথনের বিষয়বস্তু পড়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে গোটা জাতি। বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা একে দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করেন। একজন বিচারপতির জন্য এর চেয়ে খারাপ কোন অসদাচরন আর হতে পারেনা বলেও মন্তব্য করেন তারা।
স্কাইপ সংলাপের বিষয়বস্তু :
বিচারপতি নিজামুল হক ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের সাথে যেসব কথাবর্তা বলেছেন তার মধ্যে রয়েছে অভিযুক্তদের মামলার শুনানী কখন হবে, কোন মামলার রায় আগে হবে, কোনটার রায় পরে হবে, কোন ট্রাইব্যুনালে কোন মামলায় কতজন সাক্ষী আসামী পক্ষকে আনতে দেয়া হবে, রায়ের কাঠামো কি হবে, অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলায় সাক্ষী সুলতানা কামাল, মুনতাসির মামুন এবং জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে দিয়ে কোন কোন বিষয় কিভাবে বলানো হবে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিচারের রায়ের কাঠামো কি হবে সে বিষয়ে বেলজিয়াম থেকে আহমেদ জিয়া উদ্দিনের মাধ্যমে লিখিয়ে আনা বিষয়ে তথ্য আদান প্রদান হয়। পুরো বিচার প্রকৃয়া নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সাথে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের গোপন যোগসাজস, আইনমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রীর সাথে যোগসাজসসহ বিচার কার্যক্রমের সাথে যে বাইরের আরো বিভিন্ন মহলের প্রভাবে এবং ইশারা ইঙ্গিতে চলেছে তা জানা যায় এ সংলাপ ফাঁস হওয়ার মাধ্যমে। বিশেষ করে সুদুর বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থানরত ড, আহমেদ জিয়াউদ্দিনই যে এ বিচারের বিভিন্ন গতি প্রকৃতি নির্ধারন করে দিচ্ছিলেন তা স্পষ্ট হয়েছে। ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন এ বিচার প্রকৃয়ার গতি প্রকৃতি নির্ধারনের জন্য কোন কোন ব্যক্তি এবং মহলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন তাও স্পষ্ট হয়ে যায়। এ কারনে দেশের আইনজ্ঞ মহল থেকে বলা হয়েছে এ বিচার যে একটি সাজানো নাটক এবং প্রহসন ছিল তা প্রমানিত হয়েছে।
বিচারপতি নিজামুল হকের সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে ড. জিয়াউদ্দিন কোন ট্রাইব্যুনালের কোন মামলা এগিয়ে আনতে হবে, কোনটি পিছিয়ে দিতে হবে সেজন্য দুই ট্রাইব্যুনালের সব বিচারপতিদের আইনমন্ত্রীর বাসায় তিনি বসার ব্যবস্থা করবেন বলে স্কাইপির মাধ্যমে আলাপকালে জানান বিচারপতি নিজামুল হককে।
বিচারপতি নিজামুল হক আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন, “গভর্নমেন্ট রায়ের জন্য পাগল হইয়া গেছে। সাঈদীরটা হলে ডিসেম্বরের মধ্যে রায় দেতে পারবো। গভর্নমেন্ট গেছে পাগল হইয়া। তারা একটা রায় চায়। সাঈদীর রায়ডা হইয়া গেলে গভর্নমেন্ট ঠাণ্ডা হইত।..আমাদের তো স্টেট মিনিস্টার (কামরুল ইসলাম) যাচ্ছে হজে। আজকে আসছিল আমার লগে দেখা করতে সন্ধ্যায়। ওনি বললেন যে রায়টা তাড়াতাড়ি দেবেন। ”
৬ সেপ্টেম্বরের কথোপকথনে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেন, ‘সিনহা বাবু কইছে-ডিসম্বরের মধ্যে তিনডা দিয়া লন, তারপর আমরা আপনারে এহানে নিয়া আসি।’
চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর ড. আহমদ জিয়াউদ্দিনের কাছে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম জানতে চান, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চার্জের কপিটা আছে কি না। তিনি এ-ও বলেন, ‘থাকতেই হবে, থাকতেই হবে। তো, এই জিনিসগুলোর রিপলাইডা আপনি যদি একটু ইয়ে করে দেন আমাকে। তাইলে আমি জাজমেন্টর জন্য একটু রেডি হইতে পারি।’
একই দিনের স্কাইপি কথোপকথনে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেন, ‘জাজমেন্টের কাজ তো শুরু করছি আমি, অন্য কাজ ফেলাইয়া টাইপ শুরু করছি আমি।’ তখন তাকে আহমদ জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘আপনি ওই জায়গাটাকে, আপনি করেন কি যে... এ জায়গাটিতে একটু গ্যাপ রাখেন। কারণ এখনও লিগ্যাল আরগুমেন্ট কিন্তু তারা প্লেস করে নাই।’ এ থেকে বোঝা যায় আরগুমেন্ট শুরুর আগেই বিচারপতি নিজামুল হক রায় লেখার কাজ শুরু করে দেন এবং রায়ের কিছু বিষয় লিখে পাঠানোর জন্য ড. আহমদ জিয়াউদ্দিনের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন।
নিজামুল হক নাসিম নাসিম সংলাপের সময় বলেন, “এই গোলাম আযম হইলো টিম লিডার। সাঈদী সাইড ট্র্যাক। সাঈদীর লগে আপনার লিডার-টিডারশিপের কোনো প্রশ্ন আসতেছে না। গোলম আযমের রায়ের পরে আপনার নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান—সবগুলা রায় হইতে পারে, এর পরে। কিন্তু গোলাম আযম ফাস্টে। ওই গ্রুপের থেকে একমাত্র সাঈদী, সাকা এরা বায়রায় (বাইরে)। সাকারে তো আমি থামাইয়াই দিছি। সাঈদীরে থামাচ্ছি না। কারণ, সাঈদী প্রায় শেষ। এইটা যদি উনাদেরকে বইল্লা... এইডা ওনাদেরকে (ট্রাইব্যুনাল-২) হায়ার লেভেল থেইকা বইল্লা, থামায়া দিতে হবে যে, আপনি কাদের মোল্লারে ঢিল দেন। ঢিল দিয়া বাকিগুলারে সামনে আগান। কেননা, ওই যে অ্যাবসেন্ট যে আছে, ওর নাম জানি কী...? ও বাচ্চু, হ্যারে দিয়া শুরু করেন। আরেকজনরে নিয়া আগান সামনে। এরপর আপনার, পর পর ৩-৪টা রায় দিয়া দেন, অসুবিধা নাই কোনো। বাট আফটার গোলাম আযম। নট বিফোর দ্যাট।”
বিচারপতি জহির আহমেদকে পদত্যাগে বাধ্য করার পর নতুন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয় ট্রাইব্যুনালে। এ বিষয়ে বিচারপতি নিজামুল হক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন ড. জিয়াউদ্দিনের সাথে। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বিষয়ে তিনি বলেন, “তাকে বলে দেয়া হয়েছে চেয়ারম্যান যা বলবে তুমি তাতে শুধু ইয়স বলবা। তুমি যা বলবা রুমে বলবা, কোর্টে চেয়ারম্যান যা বলবে তাতে ওকে বলবা”
এছাড়া বিচারপতি নিজামুল হক ট্রাইব্যুনালের নতুন সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে সোনা জাহাঙ্গীর, দুর্নীতি পরায়ন বলেছেন। আইনপ্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামকে কামরুল টামরুল, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনকে খাতুন টাতুন সহ আরো বিভিন্ন ব্যক্তিকে চোরসহ বিভিন্নভাবে ব্যাঙ্গ করে কথা বলেছেন। তাদেরকে আওয়ামী বলে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করেছেন। (বিচারপতি নিজামুল হক ছাত্র জীবনে জাসদ ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন)।
এছাড়া ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হকের বিষয়ে বিচারপতি নিজামুল হক বলেন আমরা দুইজন শক্ত আছি।
এসব আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে ট্রাইব্যুনালে তিনজন সদস্য থাকলেও মূলত বিচারপতি নিজামুল হকের একক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন হত। এবং তার সিদ্ধান্ত গ্রহনের পেছনে বাইরের বিভিন্ন ব্যক্তি, মহলের প্রভাব ছিল।
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুমকে শুধু লাফায়। আমি তাকে বসিয়ে দিয়েছি। পরে তাকে রুমে ডাকাই। মালুম বলে এটাই ঠিক আছে। আমি শুধু দাড়িয়ে যাব আপনি আমাকে বসিয়ে দেবেন। লোকে দেখবে আমাদের মধ্যে কোন খাতির নেই।
ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি জহির আহমেদকে সচিবালয়ে ডেকে আইনমন্ত্রলয় পদত্যাগে বাধ্য করেছিল সে বিষয়টিও উল্লেখ আছে বিচারপতি নিজামুল হকের সংলাপে। এ সংলাপ থেকে জানা যায় বিচারক জহির আহমেদকে আইনমন্ত্রীর বাসায় ডেকে প্রথমে পদত্যাগ করতে বলা হয়। এরপর সচিবালয়ে ডেকে পদত্যাগে স্বাক্ষর রাখা হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন