১১/১২/১২ মঙ্গলবার
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন এবং ১৮ দলীয় জোট সমর্থক আইনজীবী নেতৃবৃন্দ আজ এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষনা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সব মামলা তামাদি হয়ে গেছে। সরকার যদি এ বিচার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চায় তাহলে ট্রাইব্যুনালে চলমান সব মামলার বিচার কার্যক্রম নতুন করে শুরু করতে হবে। যদি তা না করে মাঝখান থেকে মামলা পরিচালনা করা হয় তাহলে তা হবে বেআইনি, নৈতিকতা বিরোধী এবং সংবিধান পরিপন্থী। এ বিচার দেশবাসী এবং দেশের আইনজীবী সমাজ কারে কাছে গ্রহণযোগ্য হবেনা।
স্কাইপ সংলাপ কেলেঙ্কারি বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোশিয়েশন অডিটোরিয়ামে আজ সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহববু হোসেন, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞা, ট্রাইব্যুনালে আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার খন্দকার মাহবুব উদ্দিন খোকন এমপি, অ্যাডভোকেট খসরুজ্জামান, অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামসহ বিপুল সংখ্যক তরুন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।
সকল আইনজীবীদের পক্ষ থেকে প্রথমে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য পেশ করেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তিনি বলেন, ইকনোমিস্ট এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের যে স্কাইপি সংলাপ ফাস হয়েছে এবং এর মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে যে বেআইনী, অনৈতিক অভিযাগ উঠেছে তা সত্য প্রমানিত হয়েছে । সেই কারনেই তিনি পদত্যাগ করেছেন। আমার দেশ পত্রিকা যে সত্য কথা বলেছে তাও প্রমানিত হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালের অপর একজন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন আর্মা দেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এ সংলাপ ছাপানোর জন্য।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, এ ঘটনার পর এই ট্রাইব্যুনালে প্রথম দিন থেকে চেয়ারম্যানের পদত্যাগের আগ পর্যন্ত যত কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে তার সব কিছু তামাদি হয়ে গেছে। বাতিল হয়ে গেছে। এখন যদি সরকার তাদের বিচার করতে চায় তাহলে সব মামলার বিচার কার্যক্রম আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। যদি নতুন করে শুরু না করে মাঝখান দিয়ে আবার বিচার প্রকৃয়া এগিয়ে নেয়া হয় তা হবে সংবিধান পরিপন্থী, আইন বিরোধী এবং ন্যায় বিচার পরিপন্থী।
তিনি বলেন, অনেকে বলতে চাইবেন এবং বলছেন যেখান থেকে বিচার থেমে গেছে আবার সেখান থেকে শুরু করা যাবে। হ্যা এটা ঠিক যে স্বাভাবিক অবস্থায় যখন একজন বিচারপতি কোন বিচারের মাঝখানে বদলী হন তখন ওই বিচার কার্যক্রম চলমান থাকে। নতুন বিচারপতি নিয়োগ হলেও মাঝখান থেকেই বিচার চলে। এটা আইনে আছে। কিন্তু সেটা তো স্বাভাবিক অবস্থায়। কিন্তু এখানে তো কোন স্বাভাবিক অবস্থায় বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করেননি। তিনি চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি এমন কিছু করেছিলেন যাতে তিনি আর জাতির সামনে মুখ দেখাতে পারিছলেননা। তাই এখানে এই অস্বাভাবিক অবস্থায় এবং তার যে অসদাচরন এবং অনৈতিক কর্মকান্ডের তথ্য বের হয়ে আসছে তাতে এ বিচার মাঝখান থেকে শুরু হতে পারেনা। স্বাভাবিক আইন এখানে কার্যকর হতে পারেনা। নতুন করে সব কিছু শুরু করতে হবে। কারণ বিচারপতি নিজামুল হক এ বিচারকে রাজনীতিকরন করেছেন। বিচার প্রকৃয়াকে কলুষিত করেছেন।
কাজইে শুরু থেকে আবার শুরু করা এটাই ন্যায় বিচারের দাবি। যদি নতুন করে বিচার শুরু না করে মাঝপথে আবার বিচার এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হয় তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
তিনি বলেন, এটা আমাদের সকল আইনজীবীদের বক্তব্য।
ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন বিচারপতি নিজামুল হককে শুধু পদত্যাগ করলেই চলবেনা। তার বিচার করতে হবে। বিচারপতি হিসেবে শপথ বঙ্গ করে তিনি যে অসদাচরন করেছেন, নৈতিকতা বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়েছেন সেজন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি নিজামুল হকের বিরুদ্ধে সুপ্রীম জুড়িশিয়াল গঠন করে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য রাষ্ট্রপতি বরাবর দাবি জানান তিনি।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আমার দেশে প্রকাশিত কিছু স্কাইপি সংলাপ পড়ে শোনান । তিনি বলেন এ সংলাপগুলো পড়লে বোঝা যায় প্রথম দিন থেকেই এ বিচারে এসব অনৈতিক কাজ হয়ে আসছে। বিভিন্ন মহলের যোগসাজসে একটি সাজানো নাটক ছিল এ বিচার তার প্রমান পাওয়া যায়। বেলজিয়ামে অবস্থানরত ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে বিচারপতি নিজামুল হকের একটি সংলাপ পড়ে শুনিয়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন বাইরে থেকে বিচারের রায় কি হবে, কিভাবে রায় লেখা হবে সে বিষয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। ড. আহমদ জিয়াউদ্দিন বিচারপতি নিজামুল হককে বলছেন, ‘আমি আর রায়হান আলোচনায় বসছি। রায়হান সেপ্টেম্বর থেকে বেশি সময় দিবে। আপনাকে রায়ের একটা স্কেচ তৈরি করে দেয়ার কথা চিন্তা করছি। আমরা নিজেরা করব। আমরা যেভাবে দেখি আরকি, একটা আউটলাইন ইয়ে করে দেয়া আরকি আপনাকে । স্ট্রাকচারটা তৈরি করে দেয়া আরকি। এটা নিয়ে একটা গবেষনা করা দরকার।’ সংলাপের সময় বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলছেন , ‘তো ওই জিনিসগুলার রিপলাইডা আপনি যদি একটু ইয়ে করে দেন আমাকে তাহলে আমি জাজমেন্টের জন্য একটু রেডি হতে পারি।’
এ সংলাপ পড়ে শোনানোর পর ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এট্রোসাস, এট্রোসাস। যারা এ বিচারের সাথে জড়িত নন, যারা আদালতের সাথে স্পৃক্ত নন, যারা বাইরের লোক তারা ঠিক করে দেবেন রায়ের কাঠামো, রায়ের আউটলাইন। এরপর আর তার কাছ থেকে নিরপেক্ষ বিচার আশা করা যায়না । আমরা আশা করেছিলাম সুষ্ঠু এবং ন্যায় বিচারের। আমরা তো সবসময় বলেছি আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই। যারা অপরাধ করেছে তাদের শাস্তি হোক। কিন্তু আমরা সবসময় বলেছি বিচার হতে হবে সম্বচ্ছ নিরপেক্ষ। আমরা বলেছি ন্যায় বিচার করতে হবে। কিন্তু ন্যায় বিচার, সুষ্ঠু বিচার তো হয়নি। তাতো প্রমানিত।
এরপর খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞা, ব্যারিস্টার আব্দুৃর রাজ্জাক বক্তব্য রাখেন এ বিষয়ে । ট্রাইব্যুনাল বিষয়ে ব্যারিস্টার মওদুদু আহমদ যে বক্তব্য রেখেছেন তার সবকিছুই তারা সমর্থন করেন বলে তাদের বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এখন এ বিচার কিভাবে চলবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। আইনে বলা আছে একজন বিচারপতি চলে গেলে তার স্থলে নতুন আরেকজন আসতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তার সাথে কিন্তু আইনের ওই ধারা এখন আর সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি ট্রাইব্যুনালের বিচার ব্যবস্থাটাকে বিচারপতি নিজামুল হক সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিককরন করেছেন। কিভাবে রায় হবে বা হবেনা তার সবকিছু তিনি বিদেশী একটি চক্রের সাথে আলোচনার মাধ্যমে করেছেন। এ বিচার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটাই বিষিয়ে ফেলেছেন তিনি। আইনের ছয় ধারায় যে বিধান রয়েছে তা আর এখন প্রযোজ্য নয়। এটা কোন স্বচ্ছ বিচার নয়। এরপরও যদি এ বিচার এভাবে চালিয়ে নেয়া হয় দেশবাসী , আইনজীবী সমাজ কারো কাছে তা গ্রহনযোগ্য হবেনা। এটা কোন স্বচ্ছ বিচার হবেনা। সরকারকে ভেবে চিন্তে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। বিচারের নামে প্রহসন করা হলে দেশবাসী তা গ্রহণ করা হবেনা।
অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, এই ট্রাইব্যুনালকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিল । যার চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি নিজামুল হক। তার যে কেলেঙ্কারীর খবর ফাঁস হয়েছে এবং এ কারনে তার পদত্যাগের মাধ্যমে ট্রাইব্রুনালের সমস্ত বিচার অর্থহীন হয়ে গেছে। বাতিল হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, আরো একটি ট্রাইব্যুনাল আছে। এরপরও যদি সরকার তড়িঘড়ি করে বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাহলে আমরা ইতোপূর্বে যে আল্টিমেটাম দিয়েছিলাম তা বহাল রয়েছে। এরপরও যদি বিচারপতিগন দলের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করেন তাহলে নিজামুল হক নাসিম তো পদত্যাগ করেছেন। বাকীরা কোথায় যাবেন তা আল্লাহই ভাল জানেন।
জয়নুল আবেদিন বলেন, আমরা আইনজীবী সমিতির মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি এসকে সিনহা এবং শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিকের অপসারন দাবি করেছিলাম। । আল্টিমেটাম দিয়েছিলাম। বিচারপতি নিজামুল হক চলে গেছেন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সম্পর্কে তিনি বলেন তিনি বিচারপতির আসনে বসে রাজনীতি করছেন। আমার দেশের সম্পাদক তার বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ দিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের আবেদন করেছেন।
ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞা অবশ্য অন্য বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ কর্তৃক বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের হুমকি বিষয়ে তিনি বলেন সে যদি ক্ষমা না চায় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন বিএনপির অন্যান্য সিনিয়র লিডারদেরও গ্রেফতার করা হবে। তারা কেউ জজ নন। অথচ তারা গ্রেফতারের হুমকি দিচ্ছে। এ থেকে প্রমানিত হয় তাদের নির্দেশে চলে বিচরাঙ্গন।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ বিচার নিয়ে যা কিছু হয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে তার কোন নজির নাই। ১৭ ঘন্টা আলোচনা করেছেন তারা । ২৩০টি ইমেইল আদান প্রদান করেছেন। এটা নিয়ে বিচার বিভাগঅয় তদন্ত হওয়া দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে বিচার বিভগীয় তদন্ত নিয়ে ইতোপূবে যা হয়েছে তা আপনারা দেখেছেন। এজন্য আমি একটাই দাবি করছি। আন্তর্জাতিক বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি। অনেক আলোচনা হয়েছে। তার সবকিছূ এখনো আমরাও পড়ে শেষ করতে পারিনি। আন্তর্জাতিক বিচার বিভগীয় তদন্ত কমিশন হলে এবং তদন্ত হলে অনেক বিষয় বের হয়ে আসবে। এ জন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলন পরিচালনা করেন অ্যডভোকেট তাজুল ইসলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন