মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৩

ঘন্টাব্যাপী ভিডিওচিত্রে একবারও দেখা গেলনা গোলাম আযমকে

মেহেদী হাসান, ২৭/২/১২
ট্রাইব্যুনালে আজ  বেশ কিছু ডকুমেন্টারি (প্রামান্য চিত্র) প্রদর্শন করেন রাষ্ট্রপক্ষের  আইনজীবীরা। প্রায় ঘন্টাব্যাপী এসব ভিডিও চিত্রে  একবারও অধ্যাপক গোলাম আযমকে দেখা যায়নি কোথাও।  অথচ জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ফরমাল চার্জ উপস্থাপনের অংশ হিসেবে  এসব   ডকুমেন্টারি ট্রাইব্যুনালের বড় পদায়   প্রদর্শন করা হল।

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে  ট্রাইব্যুনালে দীর্ঘ  অভিযোগপত্র পড়ে শোনানোর   পর তার বিরুদ্ধে ডকুমেন্ট প্রদর্শনের জন্য ধার্য্য করা ছিল গতকাল। ডকুমেন্ট প্রদর্শন উপলক্ষে  আজ তাকে আদালতে হাজির করতে নির্দেশও দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু প্রদর্শিত ভিডিও চিত্রে  তিনি বা তার দল জামায়াতে ইসলাম  সম্পর্কেও কিছু দেখনো হলনা।  কিছু বলতেও শোনা গেলনা।  

যেসব ভিডিওচিত্র দেখানো হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবিসি, এনবিসি, সিবিএস নিউজ প্রভৃতি  টেলিভিশন চ্যানেলে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং  মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কিছু খবরের ফুটেজ। এছাড়া বাংলাদেশের এটিএন বাংলায় প্রচারিত  ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ শীর্ষক এক্সকুসিভ নিউজের কয়েকটি ফুটেজ। এটিএন বাংলার রিপোর্টার রাহুল রাহার ধারাভাষ্যে প্রচারিত এসব খবরের ফুটেজ এদেশের অনেক  দর্শকরা মার্চ ও ডিসেম্বর মাসে    বহুবার দেখেছেন। এছাড়া চ্যানেল ফোরে প্রচারিত  একটি সাক্ষাতকারের ভিডিও  ফুটেজও প্রদর্শন করা হয়।

১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত  এসব ভিডিও ফুটেজে ২৫ মার্চ কালোরাত্রির ঢাকায় গহত্যার কিছু প্রামান্য চিত্র, মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে শরনার্থী শিবির, পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ,  ১৯৭১ সালে ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় বিজয়োল্লাস এবং  পাক বাহিনীর আত্মসমপর্নের ভিডিও ফুটেজ  পদায় দেখানো হয়। এছাড়া পাক আর্মি কর্তৃক ধর্ষনের শিকার কিশোরী,  শিশু কোলে কিশোরী মাকে নিয়ে  এনবিসি চ্যানেলে প্রচারিত রিপোর্টের ভিডিও ফুটেজ, জহির রায়হানের সাক্ষাতকার, গনকবর, ঢাকায় বৃটিশ সাংবাদিক মার্ক টালির  সাক্ষাৎকার দেখানো  হয়। দেখানো হয় ঐতিহাসিক বিভিন্ন পটভূমিতে    পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, সামরিক শাসক আইউব খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো  এবং বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাক্ষাতকার এবং বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভিডিও ফুটেজ। কোথাও দেখা গেলনা গোলাম আযমের কোন দৃশ্য।

ঢাকার আলবদর ইনচার্জ মইনুদ্দীন নামে এক লোকের ওপর একটি সাক্ষাতকার ভিত্তিক প্রতিবেদন দেখানো হল। এতে মইনুদ্দীনের  স্থির ছবি দেখানো  হয়   এবং তিনি যে আলবদরের কোন অপরাধের সাথে জড়িত নন সে মর্মে  চ্যানেল ফোরে  প্রচারিত তার কয়েকটি মন্তব্য শোনানো হল।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে চার্জ পড়ে শোনানো শুরু করে  রাষ্ট্রপক্ষের  আইনজীবীরা। ২২ ফেব্রুয়ারী দীর্ঘ অভিযোগ পড়ে শোনানো শেষ করেন। ঐদিন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আদালতে জানান অভিযোগ পড়ে শোনানোর প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় পর্বে  অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তারা কিছু ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করবেন আদালতে।  ডকুমেন্টারি

প্রদর্শনের জন্য ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্ধারন  করেন আদালত। এ উপলক্ষে  ২৭ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক গোলাম আযমকে আদালতে হাজির  করতে বলা হয়েছে।  নির্দেশ অনুযায়ী আজ তাকে কোর্টে হাজির করা হয়।

ভিডিও ফুটেজ দেখানো উপলক্ষে কোর্টে সাংবাদিকদেরও লক্ষ্যনীয় উপস্থিতি ছিল।  অধ্যাপক গোলাম আযমের আত্মীয় স্বজনও আসেন। সাত থেকে আটটি সিডির মাধ্যমে এসব ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়। ভিডিও ফুটেজ দেখানোর সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানান, প্রতিটি সিডিতে আরো ফুটেজ রয়েছে।    ফুটেজগুলো সংক্ষেপে দেখানো হল। ভিডিও ফুটেজ দেখানো রসময় বেশ কয়েকবার গররিমল দেখা যায়। ভারতের শরনার্থী শিবিরের দৃশ্য দেখানোর সময় চলে আসে অন্য বিষয়। আবার জাতিসংঘে জুলফিকার আলীর ভাষন দেখানোর সময়  তাতেও ছেদ পড়ে।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বক্তব্য এবং মুন সিনেমা হল প্রসঙ্গ
আজ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ট্রাইব্যুনালের অনুমিত নিয়ে  প্রায় ২০ মিনিট কথা বলেন। কাঠগড়ায় দাড়িয় স্বভাবসুলভ হাস্যরাসত্মক ভঙ্গিতে  তিনি বলেন, আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি উকিল হই। কিন্তু  হয়েছি আইন প্রণেতা (এমপি)।  এটা আমার নিয়ন্ত্রনে ছিলনা।
ট্রাইব্যুনালকে উদ্দেশ্য করে সালাউদ্দিন  কাদের চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা যে প্রশ্নগুলো করত আমার  আবেদনের  শুনানীর সময় তার  ৯৯ ভাগ আপনারা করেছেন। এজন্য আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
১৯৭৩ সালে প্রনীত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল এ্যক্ট (আইসিটিএ) এবং দালাল আইনের মধ্যে পার্থক্য কি এ প্রশ্ন উত্থাপন করে খুব ভাল করেছেন। আমার আইনজীবী এর জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আমি এখানে আরেকটু পরিষ্কার করতে চাই এবং কিছু যোগ করতে চাই।
১৯৭৩ সালে আসিটিএ প্রনয়ন করা হয় কমব্যাটান্টদের ( সৈনিক) বিচারের জন্য। আর দালাল আইন করা হয় এদেশে  পাকিস্তানীদের  সহযোগী দালালদের জন্য। দুটি আইন স¤পূর্ণরুপে ভিন্ন। কিন্তু  ২০০৯ সালে ১৯৭৩ সালের আইনের সংশোধনী এনে গোলমাল লাগিয়ে দেয়া হল। যে আইনটি সেনাদের বিচারের জন্য করা হল সেটিতে সংশোধনী এনে দেশী লোকদের বিচারের ব্যবস্থা রাখা হল। এটি সংবিধানের লঙ্ঘন।

ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হককে উদ্দেশ্য করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আপনি আমার আইনজীবীর শুনানীর সময় তাকে বলেছেন, আপনাদের ২০০৯ সালের যে আইন দেয়া হয়েছে সে অনুযায়ী আপনারা বিচার করবেন। আপনি যে প্রশ্ন করেছেন তার উত্তর দিতে পারবেন আপনার ডান পাশে যিনি বসা আছেন তিনি (ট্রাইব্যুনালের অপর বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির)। কারণ তিনি মুন সিনেমা হল মামলার কো অথার ছিলেন। মুন সিনেমা হল মামলায় তারা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দিলেন। একটি সিনেমা হলের মামলায় যদি  সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা যায় তাহলে আপনারা কেন আমার আবেদন বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারবেননা যেখানে সংবিধানের এত বড় লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটল।
সালাউদ্দিন  কাদের চৌধুরী বলেন, এখানে জাস্টিস ফজলে কবির না থাকলে আমি একথাগুলো বলতামনা।
এ পর্যায়ে জাস্টিস এটিএম ফজলে কবির  মুন সিনেমা হল মামলা প্রসঙ্গে বলেন, মুন সিনেমা হল ফিরে পাবার জন্যই ঐ লোক আসলে মামলাটি করেছিলেন এটি সত্য। কিন্তু মামলার পরিচালনার পর দেখা গেল মার্শাল লয়ের কারনে তিনি সিনেমা হলটির মালিকানা  ফেরত পাচ্ছেননা। তখন তার আইনজীবী তাকে পরামর্শ দিলেন, যেহেতু মার্শাল লয়ের কারনে  তিনি সিনেমা হলের মালিকানা  ফিরে পাবেননা তাই পঞ্চম সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে আরেকটি মামলা করার জন্য। সে অনুযায়ী তিনি মামলা করেন এবং এর কারনে এ রায়  প্রদান করা হয়।


সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী  এরপর বলেন, আমার বিরুদ্ধে চার হাজার পৃষ্ঠার অভিযোগ  জমা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি আজ পর্যন্ত তা চোখে দেখার সুযোগ পাইনি। এই এখানে কোর্টে এসে আইনজীবীদের শুনানীর মাধ্যমে যতটুকু যা জানতে পারলাম ।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হিন্দু সম্প্রদায় হত্যা  এবং হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা একটি ব্যবসা আছে। সেই ব্যবসায় ঢাকার যিনি জেনারেল ম্যানেজার তার নাম হল রতন কুমার রয় আর চট্টগ্রামের যিনি জেনারেল ম্যানেজার তার নাম হল স্বপন কমুার ঘোষ। আর আমার একটি বাড়ির কয়েক যগ ধরে কেয়ারটেকারের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন মানিক সাহা।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আকাশে উল্কা দেখা গেছে। একই দিন রাজারও মৃত্যু হয়েছে। অতএব উল্কার কারনে রাজার মৃত্যু হয়েছে ধরে নেয়া  হল। আমার ক্ষেত্রেও আজ এমন ঘটনার অবতারন হয়েছে। ছাত্রজীবনে কোনদিন রাজনীতি করিনি। বাবায় পাঠিয়েছিলেন বোর্ডি স্কুলে।
তিনি বলেন ইংরেজি একটি প্রবাদ ‘লেজ কুকুরকে নাড়ায়’ মন্তব্য করার কারনে আমাকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে  বিএনপি থেকে বরখাস্ত করা হল। একতরফা নির্বাচন করার ঘোষনা দেয়ায় এরশাদকে লাকুম দিনুকুম বলে চলে এলাম তার দল থেকে। আপনারা যারা বিচারপতি, আইনজীবী সব পেশাজীবীদের একটি সংগঠন আছে নিজ নিজ স্বার্থ দেখার জন্য। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদদের স্বার্থ দেখার কোন সংগঠন নেই।

এর  আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী আহসানুল হক হেনা জামিন আবেদনের শুনানীর সময় বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে হ্যাস্ত ন্যাস্ত করার জন্য কিছু মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আছে। অনেকে প্রো ইন্ডিয়ান, কেউ প্রো রাশিয়ান, কেউ প্রো চায়না। কিন্তু আমার  মক্কেল এসব কোন ‘প্রো’র মধ্যে নেই। তিনি প্রো মুসলিম। তাকে ওআইসি সেক্রেটারি জেনারেল পদে মনোনয়ন  দেয়া হয়েছিল। মুসিলম দেশগুলো তাকে ভাল বাসে।
আহসানুল হক বলেন, মুসলিম আইন যেমন উত্তরাধিকারের ওপর বর্তায় তেমনি পিতার সূত্রে  আজ আমার মক্কেলকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছে।  স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র  ২১ বছর। চার্জশিটে দেখা যায় মাত্র  ২১ বছর বয়সে তার পিতা বেঁচে থাকতেই তার পিতার স্থলে তাকে  তার বাবার ওপর কর্তৃত্বকারী বানিয়ে দিল। মনে হয় সবকিছু তখন তিনিই পরিচালনা করতেন তার পিতা নন।

মুলতবি  আবেদন নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়
সকালে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে গোলাম আযমের আইনজীবী তাজুল ইসলাম মুলতবির আবেদন জানান। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, প্রসিকিউশনের চার্জ  উপস্থাপন শেষ হলে আপনারা অবশ্যই সময় পাবেন। তাজুল ইসলাম বলেন, এটাতো পুরোপুরি মুলতবি  হলনা। বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, প্রসিকিউশনতো মুলতবি চায়নি। আমরা কেন তাদের থামিয়ে দেব। তাজুল ইসলাম বলেন, তারা চার্জ উপস্থাপন করার সময় আমাদের কোর্টে থাকতে হয়। এর মধ্যে আমাদের প্রস্তুতির কাজে  সমস্যা হয়। কাজেই পূর্ণ মুলতিব দরকার।  এ পর্যায়ে বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, আগে প্রসিকিউশনকে চার্জ উপস্থাপন শেষ করতে দিন। তারপর যদি আপনারা বলেন, আপনারা তৈরি নন তখন আপনাদের সময় দেয়া হবে।  মুলতবি আবেদন নিয়ে সকালে ট্রাইব্যুনাল  এবং তাজুল ইসলামের মধ্যে বিতর্কের পর আগামী ৬ মার্চ প্রসিকিউশনকে  চার্জশিটের ওপর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন এবং ১২ মার্চ আসামী পক্ষকে যুক্তি পেশের জন্য ধার্য্য করেন আদালত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন