মেহেদী হাসান, ১৮/৪/২০১২
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন সাক্ষ্য দেয়ার সময় ইটিভির আধাঘন্টাব্যাপী একটি প্রতিবেদন দেখানো হল আজ । একুশের চোখ নামে ঐ সচিত্র প্রতিবেদনে মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত জীবনীর বিবরনীতে বলা হল তিনি ১৯৭৩ সালে ঢাকার আরমানিটোলায় প্রথম ওয়াজ মাহফিল করেন।
কিন্তু ইটিভির ঐ রিপোটের্ই আবার হুমায়ুন আহমেদের ভগ্নিপতি আলী হায়দার খান জানালেন মাওলানা সাঈদী স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছর পলাতক ছিলেন।
আবার মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যে চার্জশিট জমা দেয়া হয়েছে তাতে উল্লেখ আছে স্বাধীনতার পর সাঈদী আত্মগোপনে চলে যায় অস্ত্রসহ। দীর্ঘদিন যশোরে পালিয়ে থাকেন। এরপর জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বপরিবারে শহীদ হবার পর সাঈদী আত্মগোপন অবস্থা হতে বের হয় এবং ১৯৮৬ সালে ভুয়া মাওলানা হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত যেসব সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদেরও অনেকে বলেছেন স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন তিনি পলাতক ছিলেন। বেশ কয়েক বছর তিনি সাঈদী নামে আত্ম প্রকাশ করেন। ইটিভির রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৩ সালে ঢাকায় ওয়াজ মাহফিল করার কথা যদি সত্য হয় তাহলে তা স্বাধীনতার মাত্র এক থেকে দেড় বছরের মাথায় হয়েছে। তাদেরই রিপোর্টে আলী হায়দার খানের সাড়ে তিন বছর পালিয়ে থাকার তথ্যের সাথে যেমন গরমিল রয়েছে তেমনি গরমিল রয়েছে চার্জশিটে বর্ণিত তথ্য এবং অন্যান্য যেসব সাক্ষী বলেছেন স্বাধীনতার পর মাওলানা সাঈদী দীর্ঘদিন পালিয়ে ছিলেন সে বক্তব্যের সাথেও।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সাক্ষী রুহুল আমিন নবীন গত বছর ৮ ডিসেম্বর সাক্ষ্য দেন। তখন তিনি বলেন ১৯৮৬ সালে পাড়েরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাঠে সাঈদী সাহেব একটি মাহফিল বা জনসভা করার প্রস্তুতি নেন তাদের কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে। আমরা বাঁধা দেব চিন্তা করে স্থানীয় জামায়াত নেতা মোকাররম হোসেন বারীসহ আরো তিন জন জামায়াত কর্মী আমার বাসায় আসেন এবং আমাকে বরেন যে, সাঈদী সাহেব কাল পাড়েরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মাহফিলে বক্তব্য দেবেন। আমি তাদের বলি মাহফিলে কোন রাজনৈতিক বক্তব্য দিলে মাহফিল করতে দেয়া হবেনা।
ইটিভির ঐ রিপোর্টে উপস্থাপিত বিভিন্ন তথ্যের সাথে ইতোপূর্বে সাক্ষীদের বর্ণিত অনেক তথ্যের সাথে আরো অনেক গরমিল ধরা পরে।
যেমন ইটিভির রিপোর্টে মানিক পসারী নামে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে এক সাক্ষীর দীর্ঘ সাক্ষাতকার রয়েছে। সাক্ষাৎকারে মানিক পসারী নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন উচ্চ কন্ঠে এবং ইটিভি রিপোর্টারও তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করেন।
কিন্তু গত বছর ২৮ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ষষ্ঠ সাক্ষী মানিক পসারী আদালতের জেরার সময় স্বীকার করেন তিনি কোন মুক্তিযোদ্ধা নন। ২০১০ সালে পিরোজপুরের বর্তমান এমপি এ কে এম এ আউয়াল তাকে মুক্তিযোদ্ধ আখ্যায়িত করে ডিও লেটার দিয়েছেন বলে জানান ।
২৮ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম জেরার সময় প্রশ্ন করেন-
আইনজীবী: আপনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন?
সাক্ষী: করিনাই। (এরপর বলেন) বাড়িতে বসে করেছি।
আইনজীবী: আপনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এ মর্মে এমপি আপনাকে ডিও লেটার দিয়েছেন আপনার তদ্বিরের কারনে।
সাক্ষী: আমি মক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছি। তাদের খাওয়াছি দাওয়াছি। সেজন্য দেছে।
পিরোজপুরে মামলা করার পর মানিক পসারীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন ইটিভিতে এবং গতকালের রিপোর্টে তা আদালতে দেখানো হয়। কিন্তু গত ২৮ ডিসেম্বর জেরার সময় মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম তাকে প্রশ্ন করেছিলেন
আইনজীবী: পিরোজপুর মামলার পর আপনি ইটিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন?
সাক্ষী: স্মরন নেই। কত লোক যায়।
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম গতকাল বলেন, মানিক পসারী ইটিভির সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন তাদের বাড়ি পোড়ার কোন চিহ্ন নেই। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা পোড়া টিন আদালতে হাজির করেছেন আলামত হিসেবে।
মাহবুবুল আলম হাওলাদার এবং মানিক পসারী ২০০৯ সালে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুর আদালতে মামলা করার পর ইটিভির ঐ রিপোর্টটি প্রস্তুত করা হয় মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে।
এদিকে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী আদালতে প্রদর্শিত ইটিভির রিপোর্টকে উদ্দেশ্যমূলক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন সাক্ষ্য দিতে আসেননি এমন অনেক লোকের সাক্ষাৎকার রয়েছে এখানে। তিনি অভিযোগ করেন এ রিপোর্ট আসামীকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টার অংশ ।
তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দী:
আজ সপ্তম দিনের মত মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে জবানবন্দী দেন তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন। এখানে সপ্তম দিনের জবানবন্দী তুলে ধরা হল।
গেপান ও প্রকাশ্যে তদন্তে প্রাথমিকভাবে প্রমানিত হয় যে, আসামী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেলু ওরফে দেইল্লা পিতা মৃত ইউসুফ শিকদার, গ্রাম সাউথখালি, ইন্দুরকানী ১ মে ১৯৪০ (দাখিল সনদ অনুযায়ী ) জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৫৭ সালে ছারছিনা দারুসসুন্নত আলীয়া মাদ্রাসা হতে দাখিল প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ঐ সময় আলীম শ্রেণী চার বছরের ছিল এবং সে কারনে দাখিলের মান ছি অষ্টম শ্রেণীর সমমানের। দাখিল পাশ করার পর তিনি উক্ত মাদ্রাসায় আলীমে ভর্তি হয়ে অধ্যয়ন করতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যে মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ আসে যে, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী জামায়াতের ছাত্র রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত। উক্ত অভিযোগের বিষয়টি তদন্তের পর সত্য প্রমানিত হলে মাদ্রাসা হতে তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে তিনি বারইপাড়া সিদ্দিকিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা হতে ১৯৬০ সালে আলী পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি আর কোথাও হতে কোন প্রকার ডিগ্রিী লাভ করেননি বলে জানা যায়।
নামের সাথে আল্লামা এবং মওলানা লেখার মত শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন প্রমান তদন্তকালে পাওয়া যায়নি। তদন্তকালে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমানে জানা যায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তি যুদ্ধের পূর্ব হতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেলু ওরফে দেইল্লা পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানী থানাধীন পারেরহাট বন্দরের পাশে তার শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই হিসেবে অবস্থান করেন।
পারেরহাট বাজারের রাস্তার ওপর বসে লবন মরিচ, তেল ও অন্যান্য সামগ্রীর ব্যবসা করতেন। আসামী দেলাওয়ার হোসাইনের নেতৃত্বে অন্যান্য শান্তি কমিটি ও সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৫ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিজেরা এককভাবে আবার কখনো পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহায়তায় পিরোজপুর এলাকায় নিরীহ নিরস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, হিন্দু সম্প্রদায়সহ সাধারন জনগনের ওপর গণহত্যা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুন্ঠন চালাতে থাকে। পাক দখলদার বাহিনী তাদের সহযোগী শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর , আল শামস বাহিনী পিরোজপুরে অন্তত ৩০ হাজার দেশপ্রেমিককে হত্যা ও কয়েকশত মহিলাকে ধর্ষণ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরের বিভিন্ন নদীতে শত শত মৃতদেহ ভাসিতে দেখা গেছে। যা পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনী তথা শান্তি কমিটি, রাজাকারম আল বদর , আল শামস বাহিনী হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। তাদের অত্যাচার নির্যাতনে পিরোজপুরের হাজার হাজার মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মরনার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, মন্ত্রী একেএম ইউসুফ, পিরোজপুর শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্ট খান বাহাদুর সৈয়দ মো: আফজালদের পরিকল্পনা ও নির্দেশ মোতাবেক জামায়াত ইসলামী নেতা সেকেন্দার শিকদার, দানেশ মোল্লা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেলু ওরফে দেইল্লা এবং আরো অনেককে নিয়ে পারেরহাট শান্তি কমিটি গঠন করে। উক্ত শান্তি কমিটির সদস্যরা পরবর্তীতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেলু ওরফে দেইল্লা বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র, স্থানীয় জামায়াতের ও স্বাধীনতা বিরোধী অন্যান্য সংগঠনের সমন্বয়ে পারেরহাটে ১৯৭১ সালের মে মাসের শুরুতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগী (অক্সিলিয়ারি ফোর্স) রাজাকার বাহিনী গঠন করে। রাজাকাররা পারেরহাটে ফকির দাসের বিল্ডিং দখল করে সেখানে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে।
৩ মে ১৯৭১ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় পিরোপজপুরে স্বাধীনতাকামী মানুষকে দাবিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কর্নেল আতিক, মেসজর নাদের পারভেজ, ক্যাপ্টেন এজাজ এবং অন্যান্য সেনাসদস্যসহ পিরোজপুর জেলার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তারা পিরোজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পিরোজপুর আসার পর শান্তিকমিপির লোকদের সাথে বৈঠক করে। শান্তি কমিটিসহ রাজাকার, আল বদর, আল শামস পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, তাদের পরিবারবর্গ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনসহ সাধারন মানুষের ওপর গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ লুন্ঠন , অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য অপরাধ করতে শুরু করে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সাথে নিয়ে তারা পিরোজপুর শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ” ট্রাইব্যুনাল ১৯৭৩ এর ৩ (২) এবং ৪ (১) ধারার অপরাধ করতে থাকে। মামলার তদন্তে সাক্ষ্য প্রমানাদিতে আসামী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেলু ওরফে দেইল্লা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষঅর নামে পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য শান্তিকমিটিতে যোগদান করেন। এবং পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামীর পরিকল্পনা মোতাবেক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী (অক্সিলিয়ারী ফোর্স) রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করে।
সাঈদীর বিরুদ্ধে ২৩ দফা অভিযোগ উত্থাপন
তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন এরপর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১৮৭৩ এর ৩(২) এবং ৪(১) ধারায় ২৩ দফা অভিযোগ উত্থাপন করেন। এসময় তিনি যেসব হত্যা, ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের অভিযোগ বর্ণনার সাথে পিরোজপুরের পারেরহট, উমেদপুর, বাদুরিয়া, চিথলিয়ার বিভিন্ন গ্রাম, মামলায় বর্ণিত ভুক্তভোগী এবং সাক্ষীদের বাড়িঘরের ও ঘটনাস্থলের স্থির ও ভিডিও চিত্রি প্রদর্শন করেন আদালতে।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন সাক্ষ্য দেয়ার সময় ইটিভির আধাঘন্টাব্যাপী একটি প্রতিবেদন দেখানো হল আজ । একুশের চোখ নামে ঐ সচিত্র প্রতিবেদনে মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত জীবনীর বিবরনীতে বলা হল তিনি ১৯৭৩ সালে ঢাকার আরমানিটোলায় প্রথম ওয়াজ মাহফিল করেন।
কিন্তু ইটিভির ঐ রিপোটের্ই আবার হুমায়ুন আহমেদের ভগ্নিপতি আলী হায়দার খান জানালেন মাওলানা সাঈদী স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছর পলাতক ছিলেন।
আবার মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যে চার্জশিট জমা দেয়া হয়েছে তাতে উল্লেখ আছে স্বাধীনতার পর সাঈদী আত্মগোপনে চলে যায় অস্ত্রসহ। দীর্ঘদিন যশোরে পালিয়ে থাকেন। এরপর জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বপরিবারে শহীদ হবার পর সাঈদী আত্মগোপন অবস্থা হতে বের হয় এবং ১৯৮৬ সালে ভুয়া মাওলানা হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত যেসব সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদেরও অনেকে বলেছেন স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন তিনি পলাতক ছিলেন। বেশ কয়েক বছর তিনি সাঈদী নামে আত্ম প্রকাশ করেন। ইটিভির রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৩ সালে ঢাকায় ওয়াজ মাহফিল করার কথা যদি সত্য হয় তাহলে তা স্বাধীনতার মাত্র এক থেকে দেড় বছরের মাথায় হয়েছে। তাদেরই রিপোর্টে আলী হায়দার খানের সাড়ে তিন বছর পালিয়ে থাকার তথ্যের সাথে যেমন গরমিল রয়েছে তেমনি গরমিল রয়েছে চার্জশিটে বর্ণিত তথ্য এবং অন্যান্য যেসব সাক্ষী বলেছেন স্বাধীনতার পর মাওলানা সাঈদী দীর্ঘদিন পালিয়ে ছিলেন সে বক্তব্যের সাথেও।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সাক্ষী রুহুল আমিন নবীন গত বছর ৮ ডিসেম্বর সাক্ষ্য দেন। তখন তিনি বলেন ১৯৮৬ সালে পাড়েরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাঠে সাঈদী সাহেব একটি মাহফিল বা জনসভা করার প্রস্তুতি নেন তাদের কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে। আমরা বাঁধা দেব চিন্তা করে স্থানীয় জামায়াত নেতা মোকাররম হোসেন বারীসহ আরো তিন জন জামায়াত কর্মী আমার বাসায় আসেন এবং আমাকে বরেন যে, সাঈদী সাহেব কাল পাড়েরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মাহফিলে বক্তব্য দেবেন। আমি তাদের বলি মাহফিলে কোন রাজনৈতিক বক্তব্য দিলে মাহফিল করতে দেয়া হবেনা।
ইটিভির ঐ রিপোর্টে উপস্থাপিত বিভিন্ন তথ্যের সাথে ইতোপূর্বে সাক্ষীদের বর্ণিত অনেক তথ্যের সাথে আরো অনেক গরমিল ধরা পরে।
যেমন ইটিভির রিপোর্টে মানিক পসারী নামে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে এক সাক্ষীর দীর্ঘ সাক্ষাতকার রয়েছে। সাক্ষাৎকারে মানিক পসারী নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন উচ্চ কন্ঠে এবং ইটিভি রিপোর্টারও তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করেন।
কিন্তু গত বছর ২৮ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ষষ্ঠ সাক্ষী মানিক পসারী আদালতের জেরার সময় স্বীকার করেন তিনি কোন মুক্তিযোদ্ধা নন। ২০১০ সালে পিরোজপুরের বর্তমান এমপি এ কে এম এ আউয়াল তাকে মুক্তিযোদ্ধ আখ্যায়িত করে ডিও লেটার দিয়েছেন বলে জানান ।
২৮ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম জেরার সময় প্রশ্ন করেন-
আইনজীবী: আপনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন?
সাক্ষী: করিনাই। (এরপর বলেন) বাড়িতে বসে করেছি।
আইনজীবী: আপনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এ মর্মে এমপি আপনাকে ডিও লেটার দিয়েছেন আপনার তদ্বিরের কারনে।
সাক্ষী: আমি মক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছি। তাদের খাওয়াছি দাওয়াছি। সেজন্য দেছে।
পিরোজপুরে মামলা করার পর মানিক পসারীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন ইটিভিতে এবং গতকালের রিপোর্টে তা আদালতে দেখানো হয়। কিন্তু গত ২৮ ডিসেম্বর জেরার সময় মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম তাকে প্রশ্ন করেছিলেন
আইনজীবী: পিরোজপুর মামলার পর আপনি ইটিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন?
সাক্ষী: স্মরন নেই। কত লোক যায়।
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম গতকাল বলেন, মানিক পসারী ইটিভির সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন তাদের বাড়ি পোড়ার কোন চিহ্ন নেই। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা পোড়া টিন আদালতে হাজির করেছেন আলামত হিসেবে।
মাহবুবুল আলম হাওলাদার এবং মানিক পসারী ২০০৯ সালে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুর আদালতে মামলা করার পর ইটিভির ঐ রিপোর্টটি প্রস্তুত করা হয় মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে।
এদিকে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী আদালতে প্রদর্শিত ইটিভির রিপোর্টকে উদ্দেশ্যমূলক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন সাক্ষ্য দিতে আসেননি এমন অনেক লোকের সাক্ষাৎকার রয়েছে এখানে। তিনি অভিযোগ করেন এ রিপোর্ট আসামীকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টার অংশ ।
তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দী:
আজ সপ্তম দিনের মত মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে জবানবন্দী দেন তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন। এখানে সপ্তম দিনের জবানবন্দী তুলে ধরা হল।
গেপান ও প্রকাশ্যে তদন্তে প্রাথমিকভাবে প্রমানিত হয় যে, আসামী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেলু ওরফে দেইল্লা পিতা মৃত ইউসুফ শিকদার, গ্রাম সাউথখালি, ইন্দুরকানী ১ মে ১৯৪০ (দাখিল সনদ অনুযায়ী ) জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৫৭ সালে ছারছিনা দারুসসুন্নত আলীয়া মাদ্রাসা হতে দাখিল প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ঐ সময় আলীম শ্রেণী চার বছরের ছিল এবং সে কারনে দাখিলের মান ছি অষ্টম শ্রেণীর সমমানের। দাখিল পাশ করার পর তিনি উক্ত মাদ্রাসায় আলীমে ভর্তি হয়ে অধ্যয়ন করতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যে মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ আসে যে, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী জামায়াতের ছাত্র রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত। উক্ত অভিযোগের বিষয়টি তদন্তের পর সত্য প্রমানিত হলে মাদ্রাসা হতে তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে তিনি বারইপাড়া সিদ্দিকিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা হতে ১৯৬০ সালে আলী পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি আর কোথাও হতে কোন প্রকার ডিগ্রিী লাভ করেননি বলে জানা যায়।
নামের সাথে আল্লামা এবং মওলানা লেখার মত শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন প্রমান তদন্তকালে পাওয়া যায়নি। তদন্তকালে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমানে জানা যায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তি যুদ্ধের পূর্ব হতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেলু ওরফে দেইল্লা পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানী থানাধীন পারেরহাট বন্দরের পাশে তার শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই হিসেবে অবস্থান করেন।
পারেরহাট বাজারের রাস্তার ওপর বসে লবন মরিচ, তেল ও অন্যান্য সামগ্রীর ব্যবসা করতেন। আসামী দেলাওয়ার হোসাইনের নেতৃত্বে অন্যান্য শান্তি কমিটি ও সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৫ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিজেরা এককভাবে আবার কখনো পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহায়তায় পিরোজপুর এলাকায় নিরীহ নিরস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, হিন্দু সম্প্রদায়সহ সাধারন জনগনের ওপর গণহত্যা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুন্ঠন চালাতে থাকে। পাক দখলদার বাহিনী তাদের সহযোগী শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর , আল শামস বাহিনী পিরোজপুরে অন্তত ৩০ হাজার দেশপ্রেমিককে হত্যা ও কয়েকশত মহিলাকে ধর্ষণ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরের বিভিন্ন নদীতে শত শত মৃতদেহ ভাসিতে দেখা গেছে। যা পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনী তথা শান্তি কমিটি, রাজাকারম আল বদর , আল শামস বাহিনী হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। তাদের অত্যাচার নির্যাতনে পিরোজপুরের হাজার হাজার মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মরনার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, মন্ত্রী একেএম ইউসুফ, পিরোজপুর শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্ট খান বাহাদুর সৈয়দ মো: আফজালদের পরিকল্পনা ও নির্দেশ মোতাবেক জামায়াত ইসলামী নেতা সেকেন্দার শিকদার, দানেশ মোল্লা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেলু ওরফে দেইল্লা এবং আরো অনেককে নিয়ে পারেরহাট শান্তি কমিটি গঠন করে। উক্ত শান্তি কমিটির সদস্যরা পরবর্তীতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেলু ওরফে দেইল্লা বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র, স্থানীয় জামায়াতের ও স্বাধীনতা বিরোধী অন্যান্য সংগঠনের সমন্বয়ে পারেরহাটে ১৯৭১ সালের মে মাসের শুরুতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগী (অক্সিলিয়ারি ফোর্স) রাজাকার বাহিনী গঠন করে। রাজাকাররা পারেরহাটে ফকির দাসের বিল্ডিং দখল করে সেখানে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে।
৩ মে ১৯৭১ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় পিরোপজপুরে স্বাধীনতাকামী মানুষকে দাবিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কর্নেল আতিক, মেসজর নাদের পারভেজ, ক্যাপ্টেন এজাজ এবং অন্যান্য সেনাসদস্যসহ পিরোজপুর জেলার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তারা পিরোজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পিরোজপুর আসার পর শান্তিকমিপির লোকদের সাথে বৈঠক করে। শান্তি কমিটিসহ রাজাকার, আল বদর, আল শামস পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, তাদের পরিবারবর্গ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনসহ সাধারন মানুষের ওপর গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ লুন্ঠন , অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য অপরাধ করতে শুরু করে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সাথে নিয়ে তারা পিরোজপুর শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ” ট্রাইব্যুনাল ১৯৭৩ এর ৩ (২) এবং ৪ (১) ধারার অপরাধ করতে থাকে। মামলার তদন্তে সাক্ষ্য প্রমানাদিতে আসামী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেলু ওরফে দেইল্লা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষঅর নামে পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য শান্তিকমিটিতে যোগদান করেন। এবং পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামীর পরিকল্পনা মোতাবেক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী (অক্সিলিয়ারী ফোর্স) রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করে।
সাঈদীর বিরুদ্ধে ২৩ দফা অভিযোগ উত্থাপন
তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন এরপর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১৮৭৩ এর ৩(২) এবং ৪(১) ধারায় ২৩ দফা অভিযোগ উত্থাপন করেন। এসময় তিনি যেসব হত্যা, ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের অভিযোগ বর্ণনার সাথে পিরোজপুরের পারেরহট, উমেদপুর, বাদুরিয়া, চিথলিয়ার বিভিন্ন গ্রাম, মামলায় বর্ণিত ভুক্তভোগী এবং সাক্ষীদের বাড়িঘরের ও ঘটনাস্থলের স্থির ও ভিডিও চিত্রি প্রদর্শন করেন আদালতে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন