মেহেদী হাসান, ২৪/৯/২০১২ , সোমবার
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আজ সোমবার যশোরের রওশন আলী ৬ষ্ঠ সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী প্রদান করেন। রওশন আলী বলেন, ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাঈদী সাহেব যশোরের বাঘারপাড়ায় তাদের বাড়ি ছিলেন । এরপর তিনি তার পিরোজপুর গ্রামের বাড়ি চলে যান।
জবানবন্দী :
আমার নাম রওশন আলী। পিতা সুফী দাউদ আলী বিশ্বাস। মাতা সালেহা খাতুন। আমার বয়স ৬১/৬২ বছর। গ্রাম দোহাকোলা, থানা বাঘারপাড়া, যশোর। আমি আমার বাগান পরিচর্যা করি, ক্ষেত খামার যা আছে তা দেখাশুনা করি। ১৯৭১ সালেও আমি তাই করতাম। আমি আজ এখানে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য এসেছি।
১৯৬৯/৭০ সালে আমাদের এলাকায় সাঈদী সাহেব অনেক ধর্মসভা করেছেন। সে ধর্মসভার মাধ্যমে ওনার সাথে আমার পরিচয় হয়। উনি তখন যশোর নিউটাউনে ভাড়া থাকতেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে যখন পাকিস্তানী সেনারা গুলিগোলা মারতে শুরু করল তখন শহরের লোকজন গ্রামে আশ্রয় নেয়। সাঈদী সাহেব তার পরিবারসহ বাঘারপাড়ার মহিরন গ্রামের পীর সদরুদ্দীন সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ওখানে সাঈদী সাহেব দুই সপ্তাহ থাকার পর হুজুর আমাকে খবর দেন। সেই খবরে আমি পীর সাহেবের বাড়িতে যাই। পীর সাহেব হুজুর আমাকে বললেন তাদের বাড়িতে সদস্য সংখ্যা অনেক। তারও কিছু আত্মীয় স্বজন ঢাকা থেকে এসেছেন তাদের বাড়িতে। তিনি আমাকে অনুরোধ করেন আমি যেন সাঈদী সাহেবকে স্বপরিবারে আমাদের বাড়িতে নিয়ে রাখার ব্যবস্থা করি। তিনিও (সাঈদী সাহেব) এখানে কষ্ট পাচ্ছেন। মে মাসের প্রথম দিকে তাকে স্বপরিবারে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। আড়াই মাসের মত সাঈদী সাহেব আমার বাড়িতে থাকেন। জুলাই মাসের মাঝামাঝি তিনি তার গ্রামের বাড়ি চলে যান।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পূর্বে সাক্ষীরা যা বলেছেন : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরের পাড়েরহাট বাজার, উমেদপুর, নলবুনিয়া, চিথলিয়া, মাছিমপুর, ধোপাপাড়সহ বিভিন্ন হিন্দু এলাকায় যেসব হত্যা, গনহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে তা মূলত ১৯৭১ সালের মে মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। এ সময়ের মধ্যেই হুমায়ুন আহমেদের পিতা ফয়জুর রহমানসহ তিনজন সরকারি কর্মকর্তাকে বলেশ্বর নদীর ঘাটে নিয়ে হত্যা, ইব্রাহিম কুট্টি, বিশাবালী হত্যাসহ বিভিন্ন হিন্দু এলাকায় গনহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, অথচ আজকের (সোমবার) সাক্ষী রওশন আলীর জবানবন্দী অনুযায়ী সাঈদী সাহেব তখন পিরোজপুরেই ছিলেননা।
মামলার বাদী এবং প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার, দ্বিতীয় সাক্ষী রুহুল আমিন নবীন বলেছিলেন, ৭ মে পারেরহাট পাকিস্তান আর্মি আসে । মাওলানা সাঈদী সাহেবসহ অন্যান্য শান্তি কমিটির লোকজন তাদের অভ্যর্থনা জানায় পারেরহাট রিক্সাস্ট্যান্ডে। এরপর পারেরহাটে হিন্দু এবং আওযামী লীগের দোকানপাট লুটপাট করে। অন্য আরো অনেক সাক্ষী বলেছেন, মাওলানা সাঈদী অংশ নেন সে লুটপাটে।
ষষ্ঠ সাক্ষী মানিক পসারী বলেছেন ৮ মে সাঈদী সাহেবসহ অন্যান্য লোকজন তাদের বাড়িতে লুটপাট করে আগুন দেয়। তাদের বাড়ির লোক ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে পাড়েরহাটে ঐদিন হত্যা করা হয়। এছাড়া ৪ মে মাছিমপুর বাস স্ট্যান্ডের পেছনে ২০ জনকে হত্যা, হিন্দু পাড়ায় ১৩ জনকে হত্যা, কালিবাড়ি, শিকারপাড়া, ডুমুর তলা, কদমতলা, নবাবপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় লুটপাট আগুন দেয়া, ২রা জুন উমেদপুর হিন্দুপাড়ায় ২৫/৩০টি বাড়িতে লুটপাটের পর আগুন দেয়া, বিশাবালীকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা, মামলার বাদী মাহবুবুল আলমের বাড়ি লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে ।
আজ জবানবন্দী শেষে সাক্ষী রওশন আলীকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী ।
জেরা :
জেরা : সাঈদী সাহেব যকন আপনাদের বাড়িতে ছিলেন তখন তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা কত ছিল?
উত্তর : ২ ছেলে, স্ত্রী এবং একজন কাজের লোক।
প্রশ্ন : কাজের লোকের নাম?
উত্তর : মাছি।
প্রশ্ন : তার বাড়ি?
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : তার বয়স?
উত্তর : আট নয় হবে।
প্রশ্ন : আপনি আপনার বাড়িতে তখন কত লোক আশ্রয় দিয়েছিলেন?
উত্তর : আগে আমার মামা, খালা ছিলেন। সাঈদী সাহেব যখন ছিলেন তখন আমার খালা ছিলেন।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের ছোট ছেলের বয়স তখন কত ছিল?
উত্তর : বুকের দুধ খেত।
প্রশ্ন : আজ ছাড়া আর কয় মামলায় আপনি সাক্ষ্য দিয়েছেন?
উত্তর : আজ ছাড়া জীবনে আর কোন দিন কোন মামলায় সাক্ষী দেইনি।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব আপনার কোন আত্মীয় হয়?
উত্তর : না। ধর্মসভার মাধ্যমে পরিচয়।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের বাড়ি গেছেন?
উত্তর : বরিশাল বাড়ি যাইনি। ১৯৭৩ সালে খুলনার বাড়ি গেছি।
প্রশ্ন : মাঝে মাঝে সেখানে গেছেন?
উত্তর : ১৯৮০ সাল পর্যন্ত গেছি।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত সাঈদী সাহেব গ্রেফতার হয়েছে একথা শুনেছেন?
উত্তর : শুনেছি একবার গ্রেফতার হয়েছেন।
প্রশ্ন : কারণ জানেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের মোট ছেলে মেয়ে কয়জন?
উত্তর : চার ছেলে।
প্রশ্ন : গ্রামের বাড়িতে তার কি পরিমান বিষয় সম্পত্তি আছে জানেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব কি পরিমান লেখাপড়া করেছেন জানা আছে?
উত্তর : না। উনি যখন আমাদের বাড়ি ছিলেন তখন আমিও জিজ্ঞাসা করিনি তিনিও বলেননি।
প্রশ্ন : সদরুদ্দীন পীর সাহেব জীবিত?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তার ছেলেরা জীবিত?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : তার বড় ছেলের বয়স কতদ হবে?
উত্তর : ৪৫ অনুমান।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের বয়স কত ছিল তখন?
উত্তর : আমার অনেক বড় ছিলেন।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের আশপাশের বাড়ির দুচারজনের নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : মোখলেছুর, কোবাত আলী, গোলাম মওলা, আশরাফ আলী, মৌলভী এমরান।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের বাড়ি আপনার বাড়ি থেকে কতদূর?
উত্তর : অনুমান ২ কিলোমিটার।
প্রশ্ন : পীর সাহেব আপনার আত্মীয়?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনারা কয় ভাই?
উত্তর : ৫ ভাই।
প্রশ্ন : বয়সসহ ভাইদের নাম বলেন।
উত্তর : বড় ভাই গোলাম রব্বানী। সে আমার ২/৩ বছরের বড়। তারপর আমি। এরপর আমার ছোট তিনভাই হলেন, হাফিজুর রহমান, খলিলুর রহমান এবং আব্দুল জলিল। তাদের প্রত্যেকের বয়সের ব্যবধান ২/৩ বছরের হবে।
প্রশ্ন : এ মামলা সম্পর্কে কবে জানলেন?
উত্তর : এক বছর আগে।
প্রশ্ন : কার কাছ থেকে জানলেন?
উত্তর : রাফিক সাঈদী।
প্রশ্ন : রাফিক সাহেবের কাছ থেকে জানার আগে অন্য কেউ আপনাদের বাড়িতে গিয়েছিল?
উত্তর : ট্রাইব্যুনাল থেকে গিয়েছিল জানার জন্য।
প্রশ্ন : কতদিন আগে?
উত্তর : রাফিক সাহেবের কাছ থেকে জানার ২/৩ মাস আগে।
প্রশ্ন : কতজন লোক ছিল?
উত্তর : বাঘারপাড়ার থানার ওসি, এলাকার গণ্যমান্য লোকজনসহ ৪০ জনের মত হবে।
প্রশ্ন : তারা গিয়ে কি করল?
উত্তর : সাঈদী সাহেবের সাথে আমার পরিচয় কিভাবে, তিনি কখন এখানে ছিলেন, কখন গেলেন এসব জানতে চান।
প্রশ্ন : গণ্যমান্য দুয়েকজনের নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ, বাঘারপাড়া থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খন্দকার শহীদুল্লাহ, বাঘারপাড়া মহিলা কলেজের প্রফেসর আব্দুর রউফ।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ সে বিষয়ে তারা কিছু বলেছেন?
উত্তর : তা বলেনি।
প্রশ্ন : আপনি লেখাপড়া কতদূর করেছেন?
উত্তর : ফোর ফাইভ।
প্রশ্ন : বাংলা পত্রিকা পড়েন?
উত্তর : পড়ি।
প্রশ্ন : পত্রিকা পড়ে অভিযোগ সম্পর্কে কি জেনেছেন?
উত্তর : যুদ্ধাপরাধের কথা শুনেছি, ঘরবাড়ি জ্বালানো, নারী ধর্ষণ, মানুষ হত্যা ইত্যাদি অভিযোগের কথা জেনেছি।
প্রশ্ন : ২০০১, ২০০৪, ২০১১ এসময় পত্রিকা পড়তেন?
উত্তর : নিয়মিত পত্রিকা পড়িনি।
প্রশ্ন : এ মামলার আগেও তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বিষয় পেপারে আসত।
উত্তর : আসতে পারে। আমি পড়িনি।
প্রশ্ন : এ ধরনের অভিযোগ সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে আছে এবং লোকজন তা বলাবলি করত তা শুনেছেন?
উত্তর : শুনেছি।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব যখন নির্বাচন করেন তখন পিরোজপুর গিয়েছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তদন্ত কমকর্তা কোন মাসে গিয়েছিল তা মনে আছে?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তারা কোন অফিস থেকে গিয়েছিল তা পরে খোঁজ নিয়েছেন?
উত্তর : না। তানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার পরে বলেছেন তারা ট্রাইব্যুনাল থেকে এসেছেন।
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালে ভোটার ছিলেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : তখন মিটিংয়ে যেতেন?
উত্তর : বাঘারপাড়া প্রপারে মিটিং হলে যেতাম।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের শেষে পীর সাহেব কোথায় ছিলেন?
উত্তর : বাড়িতে।
প্রশ্ন : যারা আপনার এলাকায় ধর্মসভা করতে যেত তাদের সবাইকে আপনি চিনতেন?
উত্তর : প্রায় সবাইকে চিনতাম।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের যশোরের বাসায় গেছেন?.
উত্তর : ২ বার দাওয়াত দিতে গিয়েছি।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার এলাকায় রাজাকার, শান্তি কমিটির লোকজন ছিল?
উত্তর : ছিল।
প্রশ্ন : ২/৪ জনের নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : জবেদ আলী, খালেক মোল্লা, ইউসুফ আলী।
প্রশ্ন : আপনার পরের ভাই হাফিজুর রহমান কবে বিয়ে করেন?
উত্তর : সে বিয়ে করেনি। চিরকুমার।
প্রশ্ন : অন্য ভাইরা কবে বিয়ে করেন বলতে পারবেন?
উত্তর : লেখা আছে। না দেখে বলতে পারবনা।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের বাড়ি এবং আপনার বাড়ির মাঝে তখন আর কোন বড় বাড়ি ছিলনা।
উত্তর : ছিলননা।
প্রশ্ন : আপনার বাবা কি করতেন?
উত্তর : সাব পোস্ট মাস্টার ছিলেন।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি বিপক্ষে কাজ করেছেন।
উত্তর : জি না। পক্ষে কাজ করেছি।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের আগেও আপনি স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষে কাজ করেছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি বাড়ি ছেড়ে কোথাও গিয়েছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : বর্তমানে আপনি জামায়াতের সাথে জড়িত?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেব কখনো আপনাদের বাড়িতে আশ্রয় নেননি।
প্রশ্ন : সত্য নয়।
প্রশ্ন : তিনি মুক্তিযুদ্ধ শেষে পিরোজপুর থেকে পালিয়ে গিয়ে আপনার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি জামায়াত করেন। সে কারনে জামায়াত নেতা সাঈদী সাহেবের পক্ষে সত্য গোপন করে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলেন।
উত্তর : সত্য নয়।
তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে গতকাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক, সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক উপস্থিত ছিলেন।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মনজুর আহমদ আনসারী, আবু বকর সিদ্দিক, হাসানুল বান্না সোহাগ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আজ সোমবার যশোরের রওশন আলী ৬ষ্ঠ সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী প্রদান করেন। রওশন আলী বলেন, ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাঈদী সাহেব যশোরের বাঘারপাড়ায় তাদের বাড়ি ছিলেন । এরপর তিনি তার পিরোজপুর গ্রামের বাড়ি চলে যান।
জবানবন্দী :
আমার নাম রওশন আলী। পিতা সুফী দাউদ আলী বিশ্বাস। মাতা সালেহা খাতুন। আমার বয়স ৬১/৬২ বছর। গ্রাম দোহাকোলা, থানা বাঘারপাড়া, যশোর। আমি আমার বাগান পরিচর্যা করি, ক্ষেত খামার যা আছে তা দেখাশুনা করি। ১৯৭১ সালেও আমি তাই করতাম। আমি আজ এখানে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য এসেছি।
১৯৬৯/৭০ সালে আমাদের এলাকায় সাঈদী সাহেব অনেক ধর্মসভা করেছেন। সে ধর্মসভার মাধ্যমে ওনার সাথে আমার পরিচয় হয়। উনি তখন যশোর নিউটাউনে ভাড়া থাকতেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে যখন পাকিস্তানী সেনারা গুলিগোলা মারতে শুরু করল তখন শহরের লোকজন গ্রামে আশ্রয় নেয়। সাঈদী সাহেব তার পরিবারসহ বাঘারপাড়ার মহিরন গ্রামের পীর সদরুদ্দীন সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ওখানে সাঈদী সাহেব দুই সপ্তাহ থাকার পর হুজুর আমাকে খবর দেন। সেই খবরে আমি পীর সাহেবের বাড়িতে যাই। পীর সাহেব হুজুর আমাকে বললেন তাদের বাড়িতে সদস্য সংখ্যা অনেক। তারও কিছু আত্মীয় স্বজন ঢাকা থেকে এসেছেন তাদের বাড়িতে। তিনি আমাকে অনুরোধ করেন আমি যেন সাঈদী সাহেবকে স্বপরিবারে আমাদের বাড়িতে নিয়ে রাখার ব্যবস্থা করি। তিনিও (সাঈদী সাহেব) এখানে কষ্ট পাচ্ছেন। মে মাসের প্রথম দিকে তাকে স্বপরিবারে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। আড়াই মাসের মত সাঈদী সাহেব আমার বাড়িতে থাকেন। জুলাই মাসের মাঝামাঝি তিনি তার গ্রামের বাড়ি চলে যান।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পূর্বে সাক্ষীরা যা বলেছেন : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরের পাড়েরহাট বাজার, উমেদপুর, নলবুনিয়া, চিথলিয়া, মাছিমপুর, ধোপাপাড়সহ বিভিন্ন হিন্দু এলাকায় যেসব হত্যা, গনহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে তা মূলত ১৯৭১ সালের মে মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। এ সময়ের মধ্যেই হুমায়ুন আহমেদের পিতা ফয়জুর রহমানসহ তিনজন সরকারি কর্মকর্তাকে বলেশ্বর নদীর ঘাটে নিয়ে হত্যা, ইব্রাহিম কুট্টি, বিশাবালী হত্যাসহ বিভিন্ন হিন্দু এলাকায় গনহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, অথচ আজকের (সোমবার) সাক্ষী রওশন আলীর জবানবন্দী অনুযায়ী সাঈদী সাহেব তখন পিরোজপুরেই ছিলেননা।
মামলার বাদী এবং প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার, দ্বিতীয় সাক্ষী রুহুল আমিন নবীন বলেছিলেন, ৭ মে পারেরহাট পাকিস্তান আর্মি আসে । মাওলানা সাঈদী সাহেবসহ অন্যান্য শান্তি কমিটির লোকজন তাদের অভ্যর্থনা জানায় পারেরহাট রিক্সাস্ট্যান্ডে। এরপর পারেরহাটে হিন্দু এবং আওযামী লীগের দোকানপাট লুটপাট করে। অন্য আরো অনেক সাক্ষী বলেছেন, মাওলানা সাঈদী অংশ নেন সে লুটপাটে।
ষষ্ঠ সাক্ষী মানিক পসারী বলেছেন ৮ মে সাঈদী সাহেবসহ অন্যান্য লোকজন তাদের বাড়িতে লুটপাট করে আগুন দেয়। তাদের বাড়ির লোক ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে পাড়েরহাটে ঐদিন হত্যা করা হয়। এছাড়া ৪ মে মাছিমপুর বাস স্ট্যান্ডের পেছনে ২০ জনকে হত্যা, হিন্দু পাড়ায় ১৩ জনকে হত্যা, কালিবাড়ি, শিকারপাড়া, ডুমুর তলা, কদমতলা, নবাবপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় লুটপাট আগুন দেয়া, ২রা জুন উমেদপুর হিন্দুপাড়ায় ২৫/৩০টি বাড়িতে লুটপাটের পর আগুন দেয়া, বিশাবালীকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা, মামলার বাদী মাহবুবুল আলমের বাড়ি লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে ।
আজ জবানবন্দী শেষে সাক্ষী রওশন আলীকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী ।
জেরা :
জেরা : সাঈদী সাহেব যকন আপনাদের বাড়িতে ছিলেন তখন তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা কত ছিল?
উত্তর : ২ ছেলে, স্ত্রী এবং একজন কাজের লোক।
প্রশ্ন : কাজের লোকের নাম?
উত্তর : মাছি।
প্রশ্ন : তার বাড়ি?
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : তার বয়স?
উত্তর : আট নয় হবে।
প্রশ্ন : আপনি আপনার বাড়িতে তখন কত লোক আশ্রয় দিয়েছিলেন?
উত্তর : আগে আমার মামা, খালা ছিলেন। সাঈদী সাহেব যখন ছিলেন তখন আমার খালা ছিলেন।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের ছোট ছেলের বয়স তখন কত ছিল?
উত্তর : বুকের দুধ খেত।
প্রশ্ন : আজ ছাড়া আর কয় মামলায় আপনি সাক্ষ্য দিয়েছেন?
উত্তর : আজ ছাড়া জীবনে আর কোন দিন কোন মামলায় সাক্ষী দেইনি।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব আপনার কোন আত্মীয় হয়?
উত্তর : না। ধর্মসভার মাধ্যমে পরিচয়।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের বাড়ি গেছেন?
উত্তর : বরিশাল বাড়ি যাইনি। ১৯৭৩ সালে খুলনার বাড়ি গেছি।
প্রশ্ন : মাঝে মাঝে সেখানে গেছেন?
উত্তর : ১৯৮০ সাল পর্যন্ত গেছি।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত সাঈদী সাহেব গ্রেফতার হয়েছে একথা শুনেছেন?
উত্তর : শুনেছি একবার গ্রেফতার হয়েছেন।
প্রশ্ন : কারণ জানেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের মোট ছেলে মেয়ে কয়জন?
উত্তর : চার ছেলে।
প্রশ্ন : গ্রামের বাড়িতে তার কি পরিমান বিষয় সম্পত্তি আছে জানেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব কি পরিমান লেখাপড়া করেছেন জানা আছে?
উত্তর : না। উনি যখন আমাদের বাড়ি ছিলেন তখন আমিও জিজ্ঞাসা করিনি তিনিও বলেননি।
প্রশ্ন : সদরুদ্দীন পীর সাহেব জীবিত?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তার ছেলেরা জীবিত?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : তার বড় ছেলের বয়স কতদ হবে?
উত্তর : ৪৫ অনুমান।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের বয়স কত ছিল তখন?
উত্তর : আমার অনেক বড় ছিলেন।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের আশপাশের বাড়ির দুচারজনের নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : মোখলেছুর, কোবাত আলী, গোলাম মওলা, আশরাফ আলী, মৌলভী এমরান।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের বাড়ি আপনার বাড়ি থেকে কতদূর?
উত্তর : অনুমান ২ কিলোমিটার।
প্রশ্ন : পীর সাহেব আপনার আত্মীয়?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনারা কয় ভাই?
উত্তর : ৫ ভাই।
প্রশ্ন : বয়সসহ ভাইদের নাম বলেন।
উত্তর : বড় ভাই গোলাম রব্বানী। সে আমার ২/৩ বছরের বড়। তারপর আমি। এরপর আমার ছোট তিনভাই হলেন, হাফিজুর রহমান, খলিলুর রহমান এবং আব্দুল জলিল। তাদের প্রত্যেকের বয়সের ব্যবধান ২/৩ বছরের হবে।
প্রশ্ন : এ মামলা সম্পর্কে কবে জানলেন?
উত্তর : এক বছর আগে।
প্রশ্ন : কার কাছ থেকে জানলেন?
উত্তর : রাফিক সাঈদী।
প্রশ্ন : রাফিক সাহেবের কাছ থেকে জানার আগে অন্য কেউ আপনাদের বাড়িতে গিয়েছিল?
উত্তর : ট্রাইব্যুনাল থেকে গিয়েছিল জানার জন্য।
প্রশ্ন : কতদিন আগে?
উত্তর : রাফিক সাহেবের কাছ থেকে জানার ২/৩ মাস আগে।
প্রশ্ন : কতজন লোক ছিল?
উত্তর : বাঘারপাড়ার থানার ওসি, এলাকার গণ্যমান্য লোকজনসহ ৪০ জনের মত হবে।
প্রশ্ন : তারা গিয়ে কি করল?
উত্তর : সাঈদী সাহেবের সাথে আমার পরিচয় কিভাবে, তিনি কখন এখানে ছিলেন, কখন গেলেন এসব জানতে চান।
প্রশ্ন : গণ্যমান্য দুয়েকজনের নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ, বাঘারপাড়া থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খন্দকার শহীদুল্লাহ, বাঘারপাড়া মহিলা কলেজের প্রফেসর আব্দুর রউফ।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ সে বিষয়ে তারা কিছু বলেছেন?
উত্তর : তা বলেনি।
প্রশ্ন : আপনি লেখাপড়া কতদূর করেছেন?
উত্তর : ফোর ফাইভ।
প্রশ্ন : বাংলা পত্রিকা পড়েন?
উত্তর : পড়ি।
প্রশ্ন : পত্রিকা পড়ে অভিযোগ সম্পর্কে কি জেনেছেন?
উত্তর : যুদ্ধাপরাধের কথা শুনেছি, ঘরবাড়ি জ্বালানো, নারী ধর্ষণ, মানুষ হত্যা ইত্যাদি অভিযোগের কথা জেনেছি।
প্রশ্ন : ২০০১, ২০০৪, ২০১১ এসময় পত্রিকা পড়তেন?
উত্তর : নিয়মিত পত্রিকা পড়িনি।
প্রশ্ন : এ মামলার আগেও তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বিষয় পেপারে আসত।
উত্তর : আসতে পারে। আমি পড়িনি।
প্রশ্ন : এ ধরনের অভিযোগ সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে আছে এবং লোকজন তা বলাবলি করত তা শুনেছেন?
উত্তর : শুনেছি।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব যখন নির্বাচন করেন তখন পিরোজপুর গিয়েছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তদন্ত কমকর্তা কোন মাসে গিয়েছিল তা মনে আছে?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তারা কোন অফিস থেকে গিয়েছিল তা পরে খোঁজ নিয়েছেন?
উত্তর : না। তানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার পরে বলেছেন তারা ট্রাইব্যুনাল থেকে এসেছেন।
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালে ভোটার ছিলেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : তখন মিটিংয়ে যেতেন?
উত্তর : বাঘারপাড়া প্রপারে মিটিং হলে যেতাম।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের শেষে পীর সাহেব কোথায় ছিলেন?
উত্তর : বাড়িতে।
প্রশ্ন : যারা আপনার এলাকায় ধর্মসভা করতে যেত তাদের সবাইকে আপনি চিনতেন?
উত্তর : প্রায় সবাইকে চিনতাম।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের যশোরের বাসায় গেছেন?.
উত্তর : ২ বার দাওয়াত দিতে গিয়েছি।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার এলাকায় রাজাকার, শান্তি কমিটির লোকজন ছিল?
উত্তর : ছিল।
প্রশ্ন : ২/৪ জনের নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : জবেদ আলী, খালেক মোল্লা, ইউসুফ আলী।
প্রশ্ন : আপনার পরের ভাই হাফিজুর রহমান কবে বিয়ে করেন?
উত্তর : সে বিয়ে করেনি। চিরকুমার।
প্রশ্ন : অন্য ভাইরা কবে বিয়ে করেন বলতে পারবেন?
উত্তর : লেখা আছে। না দেখে বলতে পারবনা।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের বাড়ি এবং আপনার বাড়ির মাঝে তখন আর কোন বড় বাড়ি ছিলনা।
উত্তর : ছিলননা।
প্রশ্ন : আপনার বাবা কি করতেন?
উত্তর : সাব পোস্ট মাস্টার ছিলেন।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি বিপক্ষে কাজ করেছেন।
উত্তর : জি না। পক্ষে কাজ করেছি।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের আগেও আপনি স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষে কাজ করেছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি বাড়ি ছেড়ে কোথাও গিয়েছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : বর্তমানে আপনি জামায়াতের সাথে জড়িত?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেব কখনো আপনাদের বাড়িতে আশ্রয় নেননি।
প্রশ্ন : সত্য নয়।
প্রশ্ন : তিনি মুক্তিযুদ্ধ শেষে পিরোজপুর থেকে পালিয়ে গিয়ে আপনার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি জামায়াত করেন। সে কারনে জামায়াত নেতা সাঈদী সাহেবের পক্ষে সত্য গোপন করে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলেন।
উত্তর : সত্য নয়।
তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে গতকাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক, সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক উপস্থিত ছিলেন।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মনজুর আহমদ আনসারী, আবু বকর সিদ্দিক, হাসানুল বান্না সোহাগ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন