বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৩

কে এই রাজাকার দেলোয়ার শিকদার?

মেহেদী হাসান, ৩/২/২০১২- শুক্রবার
পিরোজপুরে দেলোয়ার শিকদার পিতা রসুল শিকদার নামে কুখ্যাত একজন রাজাকার ছিল।  স্বাধীনতার পর সে গণরোষের শিকার হয়ে মারা যায়।  মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বর্তমানে যে বিচার চলছে তাতে একটি আলোচিত নাম দেলোয়ার শিকদার। মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের অভিযোগ- কুখ্যাত রাজাকার দেলোয়ার শিকদারের  অপকর্মের  দায়ভার চাপানোর চেষ্টা চলছে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওপর।  মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা সাক্ষীদের জেরার সময় প্রশ্নের মাধ্যমে আদালতে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন যে, দেলোয়ার শিকদার নামে  ভিন্ন একজন রাজাকার ছিল। তার পিতার নাম  এবং মাওলানা সাঈদীর পিতার নামও আলাদা।

পিরোজপুরের স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকেও রাজাকার দেলোয়ার শিকদারের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে  অনেক চাঞ্চল্যকর   অপকর্মের তথ্য পাওয়া গেছে।

গত ১ ফেব্রুয়ারি  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে   প্রবীন সাক্ষী মধুসূদন ঘরামী সাক্ষ্য দেয়ার পর মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, দেলোয়ার শিকদার নামে একজন কুখ্যাত রাজাকার  থাকার কথা সাক্ষী মধুসূদন স্বীকার করেছেন।  আজকে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে  যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে সেগুলো মূলত ১৯৭১ সালে এ দেলোয়ার  শিকদার নামে রাজাকারই করেছে এবং সে মারা গেছে।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে  গত ১ ফেব্রুয়ারি   আদালতে সাক্ষ্য দেন  ৮১ বছর বয়স্ক আলোচিত সাক্ষী  মধুসূদন ঘরামী। দেলোয়ার শিকদার, পিতা রসুল শিকদার নামে পিরোজপুরে  ত একজন রাজাকার থাকার কথা স্বীকার করেছেন সাক্ষী  মধুসূদন ঘরামী। সে গনরোষে পিরোজপুর নিহত হয়ে থাকতে পারে বলেও স্বীকার করেছেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের জেরার সময়।

এর আগে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে  সাক্ষ্য দিতে আসা   বেশ কয়েকজন সাক্ষীকে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা রাজাকার দেলোয়ার শিকদার, পিতা রসুল শিকদার  প্রসঙ্গে প্রশ্ন  করলে কেউ বলেছেন এই নামে কোন রাজাকারের নাম তারা শোনেননি।  কেউ জানিয়েছেন এই নামে  কোন রাজাকারের নাম তার জানা নেই বা চেনেননা। আবার  কেউ বলেছেন  পিরোজপুরে  এই নামে কোন রাজাকার ছিলনা।
পূর্বের কয়েকজন সাক্ষী বলেছেন ,  দেলোয়ার শিকদার নামে তারা যে রাজাকারকে চেনেন তিনিই বর্তমানে  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নামে পরিচিতি।  তবে ১ জানুয়ারি   মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা রাজাকার দেলোয়ার শিকদারের  পিতৃ পরিচয় (রসুল শিকদার ) সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে প্রশ্ন  করলে  প্রবীণ সাক্ষী মধুসূদন ঘরামী স্বীকার করেন,  এই নামে একজন  রাজাকার ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার অপকর্মের কারনে মুক্তিযোদ্ধা  এবং এলাকাবাসীর গণরোষের শিকার হয়ে পিরোজপুরে নিহত হয়ে থাকতে পারেন তিনি।

মুধসূদন ঘরামী আদালতে জবানবন্দীতে জানান, দানেস মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, মোসলেম মাওলানা, আতাহার, দেলোয়ার  পিস কমিটি গঠন করে।  তিনি জানান দেলোয়ার শিকদার আমাদেরকে মুসলমান বানায় । তার জবানবন্দী শেষে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম  প্রশ্ন করেন  সেকেন্দার শিকদার, দানেস মোল্লা, সৈয়দ মো: আফজাল, দেলোয়ার শিকদার পিতা রসুল  শিকদার এরা রাজাকার বাহিনী গঠন করে? মধুসূদন “হ্যা” বলে জবাব দেন। 

দেলোয়ার শিকদার সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য:
মুক্তিযোদ্ধা  সংসদ পিরোজপুর জেলা কমান্ড কাউন্সিলের  প্রস্তুতকৃত পিরোজপুরের  রাজাকারদের  তালিকায় রাজাকার দেলোয়ার শিকদারের নাম রয়েছে । সেখানে দেলোয়ার শিকদারের পিতার নাম রসুল শিকদার  উল্লেখ রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের  আইনজীবীরা মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের যে ডকুমেন্ট সরবরাহ করেছেন  তার ভলিউম-৩, পৃষ্ঠা ২১৩ তেও রাজাকার তালিকায় দেলোয়ার শিকদার পিতা রসুল শিকদারের নাম উল্লেখ আছে।
পিরোজপুর এবং পারেরহাটের প্রবীণ স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপ করে রাজাকার দেলোয়ার শিকদার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। রাজাকার দেলোয়ার শিকদারকে স্থানীয় লোকজন  ‘দেউল্লা’ ‘দেইল্লা’  বা দেলু রাজাকার নামে চেনেন। তবে দেউল্লা রাজাকার নামে বেশি  পরিচিত সে। তার পিতার নাম  রসুল শিকদার (মৃত)।  তাদের বাড়ি পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী কলেজ রোড দিয়ে এগিয়ে গেলে চিলাগ্রামের শিকদার বাড়ি। ১৯৭১ সালে  মুক্তিযুদ্ধের  সময় নাজিরপুর থেকে পারেরহাট পর্যন্ত এলাকার দায়িত্ব ছিল রাজাকার দেলোয়ার শিকদার ওরফে দেউল্লার। তবে পারেরহাট বন্দরেই সে  অত্যাচার নির্যাতন বেশি পরিচালনা করে।

স্থানীয় সূত্র জানায় পাক আর্মিদের  ক্যাম্পে মেয়েদের তুলে দেয়া, হিন্দুদের ধরিয়ে দেয়া, হিন্দু  সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি দোকানপাট দেখিয়ে দেয়া,  হিন্দু পাড়ায় হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের যেসব অভিযোগ রয়েছে তার  অনেক ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল এই দেলোয়ার  শিকদার ওরফে দেউল্লা রাজাকার। অনেক হিন্দুদের বাড়িতে রাজাকার এবং  পাক আর্মি নিয়ে যাবার  বিষয়ে সে নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।  স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়     তার ব্যক্তিগত অনেক অপকর্ম যা ভুক্তভোগী এবং স্থানীয়রা জানত কিন্তু তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়নি। অনেকে মুখবুজে সহ্য করেছে কোথাও প্রকাশও করেনি মান  সম্মানের কারনে।

পিরোজপুর পারেরহাট, উমেদপুর, মাছিমপুর, শঙ্করপাশা প্রভৃতি এলাকায় হিন্দু পাড়া জ্বালিয়ে দেয়া, লুটাপাট, হিন্দুদের হত্যা  বিষয়ে  রাজাকার দেলোয়ার শিকদার পিতা রসুল শিকদার, রাজ্জাক রাজাকার, মবিন রাজাকার, মোসলেম মাওলানা, দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার  সরাসরি জড়িত বলে স্থানীয় প্রবীনদের কাছে তথ্য পাওয়া গেছে।

মাছিমপুরে ১৩  জন হিন্দুকে হত্যা, উমেদপুরে চিত্তরঞ্জন তালুকদার, জহর তালুকদার, হরেন ঠাকুর, অনিল মন্ডল, সতিষ বালাদের বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনায় দেলোয়ার, রাজ্জাক এবং  মবিন রাজাকারের জড়িত থাকার বিষয়ে অভিযোগ করেছে  স্থানীয় লোকজন। পারেরহাট বাজারে হিন্দু  পাড়ায় হরলাল মালাকার, অরুন কুমার, তরনী কান্ত, নন্দ কুমারসহ মোট ১৩ জন হিন্দুকে এক  দড়িতে বেঁেধ নিয়ে পাক আর্মিদের হাতে তুলে দেয়া এবং হত্যার ঘটনার সাথেও  রাজাকার দেলোয়ার শিকদারের  জড়িত থাকা বিষয়ে জানিয়ছেন এলাকাবাসী।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তার এসব অপকর্মের  বিষয়ে এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের  কাছে অভিযোগ করেন। । রাজাকার দেলোয়ার শিকদার  পালিয়ে যাবার সময় কদমতলায় সে ধরা পড়ে  এবং মুক্তিযোদ্ধা আবেদ আলীর গুলিতে সে নিহত হয় বলে জানিয়েছে সূত্র ।

১৯৭১ সালে  সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর (অব) জিয়াউদ্দিনের কাছে দেলোয়ার শিকদার পিতা রসুল শিকদার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে দৈনিক নয়া দিগন্তকে  তিনি বলেন, ৪০ বছর আগের কথা। ঠিক মেমোরিতে নেই বিষয়টি। অনুসন্ধান করলে হয়ত বলতে পারব। তাই এ মুহুর্তে  কমেন্ট করা যাচ্ছেনা।

মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম জানান, মাওলানা সাঈদীর পিতার নাম ছিল ইউসুফ সাঈদী  এবং মাওলানা সাঈদীর দাখিলের সার্টিফিকেটে তার প্রমান রয়েছে।

পিরোজপুর জেলার  ইতিহাস বইয়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকা:
পিরোজপুর জেলা পরিষদের  উদ্যোগে  পিরোজপুর জেলার ইতিহাস নামে একটি বই প্রকাশ করা হয়। এখানে রাজাকার, শান্তি কমিটি এবং স্বাধীনতা বিরোধী পিরোজপুরের উল্লেখযোগ্য ৪৬ জনের নামের একটি তালিকা প্রদান করা হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ   শুরুর পর পিরোজপুর অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলার আসামী  জামালুল  হক মনু (যিনি জেলা কমান্ডার ছিলেন),  পিরোজপুর মহিলা পরিষদের নেত্রী  মনিকা মন্ডল, দর্পন পত্রিকার সম্পাদক গৌতম রায় চৌধুরীসহ পিরোজপুর জেলার নামকরা স্থানীয় সাংবাদিক লেখকরা জড়িত ছিল এ  বই প্রকাশ  এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকা তৈরির সাথে।

বইয়ে উল্লেখিত  পিরোজপুরের স্বাধীনতা বিরোধীরা হল সৈয়দ মো আফজাল, আব্দুস সাত্তার মিয়া, সরদার  সুলতান মাহমুদ, আব্দুল আজিজ মল্লিক, আশরাফ আলী চেয়ারম্যান, আজিজুল হক মোক্তার, ডা. মোজাফ্ফর হোসেন, দেলোয়ার হোসেন মল্লিক, সৈয়দ সালেহ আহমদ, মানিক খন্দকার, আতাহার চাপরাশি, সেকান্দার কমান্ডার, নুরু কমান্ডার , হারুনুর রশিদ, দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, মোসলেম মাওলানা, আমির আলী, সিরাজুল হক, মইনুদ্দীন চেয়ারম্যান, সবদুল খান, মাওলানা ফজলুর রহমান মো: সালেহ, আবু জাফর চেয়ারম্যান, আব্দুল খালেক মাওলানা, আনছার আলী আকন,  হালিম চেয়ারম্যান, মতিউর রহমান শিকদার, আব্দুল আলী মিয়া, ওসি নুরুল ইসলাম, ডা. সাইজুদ্দীন, আব্দুল আজিজ, মাওলানা আব্দুর রহিম, আব্দুল হামেদ জমাদ্দার, আশরাফ আলী তালুকদার, মজিদ সরদার, খান সাহেব মো: আব্দুল মজিদ জমাদ্দার, আজাহার আলী, নুরুল ইসলাম, আজিজ মল্লিক, ইস্কান্দার মৃধা, মোস্তাফিজুর রহমান, আরশাদ আলী মিয়া এবং  এ্যাডভোকেট শমশের আলী ।  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন