মেহেদী হাসান, ২২/৫/২০১২, মঙ্গলবার
ডিফেন্স টিমের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন তদন্ত কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালের সাথে প্রতারনা করেছেন। সম্পূর্ণ অসত্য এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোর্টকে তিনি প্রতারিত করেছেন এবং আদেশ পাস করিয়েছেন। আমি পুরো আস্থা নিয়ে বলছি তিনি কোটের সাথে প্রতারনা করেছেন।
গত ২৯ মার্চ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনাল-১। এ আদেশ বিষয়ে ডিফেন্স টিমের পক্ষ থেকে রিভিউি পিটিশন দায়ের করা হয়। আজ মঙ্গলবার এ বিষয়ে শুনানী অনুষ্ঠিত হবার সময় ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক কোর্টে উপরোক্ত কথা বলেন।
গত ২০ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে তালিকাভুক্ত ৪৬ জন সাক্ষীর একটি তালিকা দিয়ে আদালতে দরখাস্ত করে বলা হয় এদের হাজির করা আদৌ সম্ভব নয়। কেন হাজির করা সম্ভব নয় সে বিষয়ে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আবেদনে বলা হয় তারা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হোক। এদের মধ্যে ১৫ জনের জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন আদালত।
যে ১৫ জনের সাক্ষ্য তাদের অনুপস্থিতিতে গ্রহণ করা হয়েছে তাদের মধ্যে তিনজন সাক্ষীর ভিডিও দেখানো হয় আদালতে ডিফেন্স টিমের (আসামী পক্ষের আইনজীবী) পক্ষ থেকে।
এছাড়া বাকী ১২ জন সাক্ষী বিষয়ে ডিফেন্স টিমের পক্ষ থেকে আদালতে তথ্য প্রমান দাখিল করে সাক্ষীদের নাম ধরে ধরে বলা হয় তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রসিকিউশনের হেফাজতে দীর্ঘদিন ঢাকায় সেফ হাউজে ছিল। ৩ জন সাক্ষী ৪৭ দিন পর্যন্ত সেফ হাউজে ছিল। কোন কোন সাক্ষী বাড়িতে আছেন, স্বাভাবিক কাজ কর্ম করছেন।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, এসব সাক্ষীরা মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজী না হওয়ায় তাদেরকে আদালতে হাজির করেনি প্রসিকিউশন। সাক্ষীদের অনেকে তাদেরই হেফাজতে ছিল এবং তারা পলাতক, নিখোঁজ বলে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে ট্রাইব্যুনালকে প্রতারিত করেছন তদন্ত কর্মকর্তা। তারা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কোন জবানবন্দী দেননি। তাদের নামে তদন্ত কর্মকর্তা মিথ্যা মনগড়া গল্প বানিয়ে লিখে জমা দিয়েছেন । ভিডিওসহ এসব তথ্য প্রমান দেখানোর পরও বলা হবে সাক্ষীরা মাওলানা সাঈদীর সন্ত্রাসীরা ভয়ে বাড়িছাড়া হয়েছেন?
বিশিষ্ট আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালে:
আজ ১৫ সাক্ষীর রিভিউ পিটিশন উপলক্ষে ট্রাইব্যুনাল-১ এ হাজির হন ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ব্যারিস্টার রফিকউল ইসলাম মিঞা, সুপ্রীম কোর্ট বারের সভাপতি
জয়নুল আবেদিন, বারের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, নজরুল ইসলাম প্রমুখ আইনজীবী। এদের মধ্যে ব্যারিস্টার মওদূদ আহমেদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নুল আবেদীন ট্রাইব্যুনালে বক্তব্য রাখেন।
ব্যারিস্টার মওদূদ আহমেদ : ট্রাইব্যুনালে বক্তব্য শেষে ব্যারিস্টার মওদূদ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, জেরা ছাড়া এ ১৫ জন সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে যদি কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তা অন্যায় এবং বেআইনী হবে। ১৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দী এভাবে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হলে ন্যায় বিচার বাঁধাগ্রস্ত হবে বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধাপরাধ বিচার চাই। তবে সে বিচার হতে হবে স্বচ্ছ এবং নিরপক্ষে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী। আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন।
ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীদের যে সাক্ষাৎকার দেখানো হল তাতে বোঝা গেল তদন্ত কর্মকর্তা নিজে সাক্ষীদের নামে জবানবন্দী লিখেছেন। সাক্ষীকে জেরা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জেরায় যদি আমি প্রমান করতে পারি এ সাক্ষীকে কিনে আনা হয়েছে তখন তো তার সাক্ষ্যের গুরুত্ব থাকেনা।
ব্যারিস্টার মওদূদ আহমেদ ট্রাইব্যুালে বলেন, সাক্ষী আনা সম্ভব নয় বলে যে কারণ দেখানো হল তা সত্য নয় প্রমান হল। এখানে সাক্ষীদের সাক্ষাৎকার দেখানো হল টিভিতে। তারা বলছেন, তারা কোন জবানবন্দী দেননি। তাদের নামে যে জবানবন্দী জমা দেয়া হয়েছে তাতে তাদের কোন সাক্ষর নেই। তিনি বলেন বিচারে তাড়াহুড়া করা উচিত নয়। সাক্ষীর জেরা করা একটি মৌলিক অধিকার। জেরা ছাড়া জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ সংবিধানের লঙ্ঘন।
জয়নুল আবেদনী: ট্রাইব্যুনালে জয়নুল আবেদীন বলেন, ১৫ সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছেন তারা প্রসিকিউশনের বর্ণিত কারনে ইতোমধ্যে সন্তুষ্ট। এসময় বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, আইনের ১৯ (২) ধারা মোতাবেক সন্তুষ্ট। তা নাহলে তো আদাশেই দেয়া যেতনা। জয়নুল আবেদন বলেন, কিন্তু আমরা এখানে সাক্ষীদের যে সাক্ষাৎকার দেখলাম তাতে যা দেখানো হল তাতে তো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
খন্দকার মাহবুব হোসেন: তিনি ট্রাইব্যুনারে বলেন, সরকার কি গরিব হয়ে গেছে যে টাকা খরচ করে সাক্ষী আনা যাবেনা? জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কোন আইনেই জেরা ছাড়া সাক্ষ্য গ্রহন করা হয়না। অনেক সময় সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া বক্তব্য অস্বীকার করে।
রিভিউ পিটিশন বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের যুক্তি:
৪৬ সাক্ষী হাজির না করা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের দরখাস্তে যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছিল প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে তাতে কারো কারো ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল গুরুতর অসুস্থ, কেউ পলাতক, কেউ নিখোঁজ, কেউ ভারতে পালিয়ে গেছে, কেউবা মাওলানা সাঈদীর সন্ত্রাসীদের ভয়ে বাড়িছাড়া।
উষারানী মালাকার সম্পর্কে বলা হয়েছিল তিনি অসুস্থ, স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে এবং ভ্রমনে মৃত্যু ঝুকি রয়েছে। গতকাল উষারানাী মালাকারের সাক্ষাৎকার দেখানো হয় ট্রাইব্যুনালের পর্দায়। দিগন্ত টেলিভিশন এবং ইসলামিক টেলিভিশনে একটি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক প্রতিবেদন দেখানো হয়। ডিফেন্স টিম এর সিডি ট্রাইব্যুানলে জমা দিয়েছেন। এতে দেখানো হয় উষারানী মালাকার সুস্থ এবং টিভিতে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। তিনি বলছেন তিনি মাওলানা সাঈদীকে চেনননা। সাঈদীর বিরুদ্ধে তিনি কিছু বলেছিলেন কিনা এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বারবার না না বলছেন তিনি। এছাড়া গণেষ চন্দ্র নামে আরেক সাক্ষী বলেন তিনিও মাওলানা সাঈদীকে চেনননা। তার মাকে সাঈদী নন পাক আর্মিরা নির্যাতন
করেছেন। তার মায়ের নাম বেইচ্চা কেউ কেউ খাচ্ছে। আর তারা পথে পথে ভিক্ষা করছেন। সুখরাঞ্জন বালী নামে ১৫ সাক্ষীর আরেকজন জানান তিনি মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে কোন কিছু মিথ্যা বলেননি।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, সাক্ষী হাজির করতে না পারা বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা যেসব কারণ উল্লেখ করেছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ বিষয়ে আমরা প্রমান সংগ্রহ করেছি। তিনি বলেন, আশিষ কুমার, সুমতি রানী, সমর মিস্ত্রি এ তিন জন সাক্ষী নিখোঁজ এবং ভারতে পালিয়ে গেছে বলে বলা হয়েছে । কিন্তু আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছি তারা দুই দফায় ৪৭ দিন পর্যন্ত সেফ হাউজে প্রসিকিউশনেরই হেফাজতে ছিল।
মাওলানা সাঈদীর ভয়ে বাড়িছাড়া বলা হয়েছে যাদের সম্পর্কে তাদের মধ্যে ৫ জনের নাম উল্লেখ করে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন তারা বাড়িতে আছেন এবং কেউ কেউ ঢাকায় সেফ হাউজে ছিল প্রসিকিউশনের হেফাজতে। এমনকি তাদেরকে ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের রুমে পর্যন্ত আনা হয়েছিল।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, আপনার এ অভিযোগের ভিত্তি কি। ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন একজন সাংবাদিক অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছেন। তিনি সেফ হাউজে গেছেন এবং রেজিষ্ট্রেশন খাতায় বর্ণিত তথ্য উল্লেখ করেছেন। কোন সাক্ষী কত তারিখে সেফ হাউজে আনা হয়েছে, কবে তারা বাড়ি গেছে তার সব রেকর্ড রেজিস্ট্রার খাতায় আছে। গত ১২ এপ্রিল দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পত্রিকা থেকে রিপোর্টের হেডলাইন পড়ে শোনান ।
বিচারপতি জহির আহমেদ বলেন উষারানী মালাকার সম্পর্কে প্রসিকিউশন থেকে বলা হয়েছিল তিনি সয্যাশায়ী । অথচ আপনারা দেখালেন তিনি কথা বলছেন। টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তাছাড়া তিনজন সাক্ষী সম্পর্কে প্রসিকিউশন ফেব্রুয়ারি মাসে বলেছিলেন তারা নিখোজ। তাদের কোন খোঁজ তারা পাচ্ছেননা। অথচ আপনি বললেন তারা ১৬ মার্চ সেফ হাউজে তাদেরই হেফাজতে ছিলেন। এটা তো অবিশ্বাস্য। মারাত্মক অভিযোগ। প্রসিকিউশন এ দুটি অভিযোগ বিষয়ে জবাব দিক।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আইনের ১৯ (২) ধারায় দুট অংশ আছে। প্রথম অংশ বলা হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সাক্ষী জবানবন্দী দিলে তা আদালত গ্রহণ করতে পারবে। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে সাক্ষী হাজির করা যদি দূরুহ, সময় সাপেক্ষ এবং ব্যায়বহুল হয় এবং এভাবে সাক্ষী হাজির করা যদি অযৌক্তিক মনে করে কোর্ট তাহলে তাদের জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায় তাদের অনুপস্থিতিতে। কিন্তু আমি প্রমান দেব ঐসব সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কোন জবানবন্দীই দেননি। সুতরাং ১৯ (২) আইনের প্রথম অংশ চলে গেল। ং ১৯ (২) ধারার যাত্রাই শুরু হতে পারেনা যদি সাক্ষীরা তার কাছে কোন জবানবন্দী না দেন। । সুতরাং আইনের প্রথম অংশের প্রয়োগ অকার্যকর হয়ে গেলে দ্বিতীয় অংশও অবান্তর হয়ে যায়।
আমাদের কাছে প্রমান আছে সাক্ষী হাজির করতে না পারা বিষয়ে যে কারণ দেখিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা এবং প্রসিকিউশন তা মিথ্যা।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, আপনারা ধরে নিয়েছেন এ ১৫ জন সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী দিয়েছেন। এটি ধরে নিতে হলে তদন্ত কর্মকর্তাকে ডকে এসে বলতে হবে তিনি তাদের কাছে গিয়েছিলেন। তাতো হয়নি।
এসময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক কোন ডাক্তারি পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট যখন আদালত গ্রহণ করে তখন কিন্তু ডাক্তার আসেনা। ধরে নেয়া হয় এটি ডাক্তারের রিপোর্ট। পরে যদি
প্রমান হয় তারা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী দেননি তা বাতিল হবে পরে। এখানেও যদি প্রমান হয় তাদের জবানবন্দী মিথ্যা তা বাতিল হবে। কিন্তু তারা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী দিয়েছেন এটি ধরে নিয়ে তা গ্রহণ করা যাবেনা তা ঠিক নয়। এটি বেআইনী হয়নি।
এরপর ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, আমি আপনাদের দেখাব কিভাবে তদন্ত কর্মকর্তা আপনাদের প্রতারিত করেছেন। তিনি বলেন আপনারা তো চাননা আমরা আপনাদের প্রতারিত করি। দি ইনভেস্টিগেশন অফিসার হ্যাজ কমিটেড ফ্রড ইন দিজ কোর্ট।
কয়েকজন সাক্ষীর জবানবন্দী বিষয়ে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন হুবহু কপি পেস্ট করে একজনের বক্তব্য আরেক জনের নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রতরানার অভিযোগ এনে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, তিনি একজন সম্মানিত লোক। সেক্স পিয়ারের জুলিয়ান সিজার নাটকে যে অর্থে এন্টনি জুলিয়াস সিজারের হত্যাকারীদের সম্মানিত বলে আখ্যায়িত করেছিলেন আমি সেই অর্থে তাকে সম্মানিত বলেছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন