বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৩

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ

মেহেদী হাসান, ১৫/৭/২০১২
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গতকাল ট্রাইব্যুনালে  (১)  সাক্ষ্য দিয়েছেন মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম। দীর্ঘ দুই ঘন্টার জবানবন্দীতে তিনি দেড়ঘন্টা পর্যন্ত  ১৯৭১  সালে  ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া যশোর অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা এবং  পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন  অপারেশন পরিচালনার  বিবরন দেন। এরপর তিনি অধ্যাপক গোলাম আযম, রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী প্রসঙ্গে জবানবন্দী প্রদান করেন ।

মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৯৬৭ সালে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের মাধ্যমে পুলিশ বিভাগে যোগদান করেন। এরপর ১৯৭১ সালে তিনি ঝিনাইদহ মহকুমার সাবডিভিশনাল  পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) থাকা অবস্থায় ঐ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করেন।  যুদ্ধ  শুরু হবার আগে থেকেই তিনি আরো কয়েকটি জেলার এসডিওদের সাথে আলোচনা  করে সিদ্ধান্ত নেন দেশ এবং জনগনের পক্ষে অবস্থান নেয়ার। ১৮ মার্চ থেকে তিনি ঝিনাইদহের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করেন এবং স্থানীয় আনছার, মুজাহিদ বাহিনীর লোকদের প্রশিক্ষনে সম্পৃক্ত  করেন। ২৫  মার্চ  রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রান্ত হবার খবর পাবার পরপরই তিনি  ঝিনাইদহ অস্ত্রাগারে থাকা ৪০০ থ্রিনট থ্রি রাইফেল যুদ্ধে যোগদানে উৎসাহী যুবকদের মাঝে বিতরন করেন।    তাদের নিয়ে তিনি মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি ঝিনাইদহে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার নেতৃত্ব পান।   যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার জন্য তাকে ক্যাপ্টেন র‌্যাংক প্রদান করা হয় । তিনি নিজে ঝিনাইদহ এলাকায়  এবং আশপাশ যথা কুষ্টিয়া, যাশোর এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে নিয়োজিতদের সাথে মিলিত হয়ে কিভাবে  পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরারেশন পরিচালনা করেন তার বেশ কয়েকটি বিবরন প্রদান করেন  ।

তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা  এবং পরবর্তীতে  বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী  তাজউদ্দিন আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে তিনি ভারতে পাস করেন বলে জানান।  তার নেতৃত্বেই  মুজিব নগর সরকারকে প্রথম গার্ড অব অনার প্রদান করা হয় বলে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে উল্লেখ করেন সাক্ষী। 

সাক্ষী মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম সকাল ১১টায় সাক্ষ্য জবানবন্দী প্রদান   শুরু করেন।  ঝিনাইদহ এবং আশপাশের এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং ঐ অঞ্চলকে মুক্ত করার ঘটনা বর্ননা করতে সাড়ে  ১২টা বেজে যায়।  সাক্ষী বলেন, ৮ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা অঞ্চল হানাদার মুক্ত  হয়। আমি আমার দলবল নিয়ে মনিরামপুর প্রাইমারি স্কুলে অবস্থান নেই। ১৬ ডিসেম্বর খবর পাই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তান বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমপর্ন করেছে।  এ পর্যন্ত গোলাম আযমের কোন প্রসঙ্গ আসেনি।

এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুম সাক্ষীকে প্রশ্ন করেন- প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতৃত্বদানকালে কি জানলেন, কি দেখলেন?



সাক্ষী বলেন, এ যুদ্ধ চলা অবস্থায় আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে অনেক রাজাকার, আল বদর, আল শামস সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। তাদের কাছ থেকে, পত্রপত্রিকা পড়ে, রেডিওর খবর শুনে জেনেছি ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। তখন যে দলগুলি আওয়ামী লীগের বিরোধীতা করে তাদের মধ্যে জামায়াত, মুসলিম লীগ এবং পিডিবি ছিল। এই পরাজিত দলগুলো এপ্রিলের প্রথম দিকে টিক্কা খানের সাথে দেখা করে ২৫ মার্চ  থেকে পরিচালিত অপারেশন সার্চলাইট সমর্থন করে। পাকিস্তান আর্মির সহায়তা করার জন্য দেশব্যাপী শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
এ পর্যন্ত বলার পর জেয়াদ আল মালুম প্রশ্ন করেন কারা টিক্কা খানের সাথে দেখা করেছিল?
সাক্ষী বলেন, আমি শুনেছি টিক্কা খানের সাথে যারা দেখা করছেন তাদের মধ্যে গোলাম আযম, খাজা খয়েরউদ্দিন এবং নুরুল আমিন ছিলেন। স্বাধীনতার পর তাদের সে সাক্ষাতের ছবি পত্রিকায় দেখেছি।
সাক্ষী বলেন, জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ রেজাকার বাহিনী গঠন করল। তার সাথে তারা আল বদর বাহিনীও গঠন করে। শান্তি কমিটি, আল বদর , রেজাকার বাহিনীর সদস্যদের সশস্ত্র করার জন্য গোলাম আযম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করেছে শুনেছি। ফলে এই বাহিনীকে আইনী রূপ দেয়ার জন্য আনছার বাহিনী বিলুপ্ত করে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়।
এরপর জেয়াদ  আল মালুম প্রশ্ন করেন ৯ মাস পাকিস্তান বাহিনীর সাথে মিলে কি করেছে?
সাক্ষী বলেন, সশস্ত্র অবস্থায় তারা পাকিস্তান বাহিনীর সাথে চলত। আর্মিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত বিভিন্ন অঞ্চলে।  স্বাধীনতাকামী জনতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দেখিয়ে দিত। তাদের হত্যা, গুম করত। এলাকার সুন্দরী যুবতীদের   ধরে নিয়ে পাকিস্তান ক্যাম্পে পৌছে দিত। আমার এলাকায় চুপনগরে কয়েক হাজার মানুষকে গণহত্যা করেছে তারা। এরকম গণহত্যা দেশের সর্বত্র হয়েছে বলে শুনেছি।
এরপর জেয়াদ আল মালুম বলেন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ। এ পর্যন্ত প্রশ্ন করার পর ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক আপত্তি জানিয়ে বলেন, কোন লিডিং প্রশ্ন করা যাবেনা।
সাক্ষী এরপর বলেন এই গণহত্যা, নারী নির্যাতনের সাথে  লুটপাট চালায় তারা। গ্রামের পর গ্রাম  জ্বালিয়ে দেয়ার কাজ করেছে এই রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী। যারা পাকিস্তান আর্মির সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। ১৪ ডিসেম্বর মিরপুরে তারা বুদ্ধিজীবীদের গণহারে হত্যা করেছে।  বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টা করেছে। এই যে স্বাধীনতাবিরোধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এই অপরাধের নেতৃত্ব দিয়েছে সবচেয়ে বড় যে দল তা হল জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রসংঘ। বড় দল হিসেবে, বড়  দলের নেতা হিসেবে  অধ্যাপক গোলাম আযম এবং তার সাথীরা  যারা এই সহযোগী বাহিনী সম্পূর্ণ নিজেদের কমান্ডে নিয়েছে তারা এই মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। তাদের মুল নেতা প্রফেসর গোলাম আযম এর নেতৃত্ব দিয়েছে।

আগামীকাল  দ্বিতীয় সাক্ষীর জেরা শুরু হবার কথা রয়েছে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন