অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আনিত অভিযোগ খন্ডন করে আসামী পক্ষ নিম্নলিখিত যুক্তি লিখিত আকারে পেশ করে ট্রাইব্যুনালে।
ষড়যন্ত্র [Conspiracy [চার্জ নং - ১]
অধ্যাপক গোলাম আজমের বিরুদ্ধে “ষড়যন্ত্রের” ছ’টি অভিযোগ আনা হয়েছে। ডিফেন্স নিবেদন করেন যে, গনহত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমান করতে হলে, রাষ্ট্রপক্ষকে আসামীর সাথে ইয়াহিয়া খান বা টিক্কা খানের গনহত্যার একটি চুক্তি হয়েছিল মর্মে সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে হবে। তবে এমামলায় তেমন কোন সাক্ষ্য প্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারেনি। কেবল মাত্র বলা হয়েছে যে গোলাম আযম টিক্কা খান এবং ইয়াহিয়া খানের সাথে বৈঠক করেছে। পাকিস্তান আর্মির কোন অফিসারের সাথে কেবলমাত্র বৈঠক করে গনহত্যার ষড়যন্ত্রে অভিযোগ প্রমানিত করা যায় না। ডিফেন্সের পক্ষ থেকে এও বলা হয় যে গনহত্যার চুক্তি
Circumstantial Evidence এর মাধ্যমে প্রমান করা সম্ভব, তবে তেমন কোন সাক্ষ্য প্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে। গোলাম আযমের সাথে টিক্কা খানের পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ছবি দিয়ে গনহত্যার ষড়যন্ত্র প্রমান করা যায় না। ডিফেন্সের পক্ষ থেকে এও নিবেদন করা হয় যে রাষ্ট্রপক্ষকেই প্রমান করতে হবে অধ্যাপক গোলাম আজম বাঙালী জাতি বা হিন্দু গোষ্ঠী নিধন করার উদ্দেশ্য নিয়ে গণহত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। তবে কোন জাতি বা গোষ্ঠী নিধনের অভিপ্রায় গোলাম আজমের ছিল মর্মে কোন সাক্ষ্যপ্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারেনি।
ফর্দিনান্দ নাহিমানার কেস উল্লেখ করে বলা হয় যে, গনহত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমান করা অত্যন্ত দূরুহ। উক্ত মামলায় ট্রায়াল চেম্বার গনহতার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে মর্মে রায় দিলেও পরবর্তীতে আপীলেট চেম্বার সে রায় খারিজ করে দেয়। আপীলেট চেম্বারের রায় উল্লেখ করে ডিফেন্স নিবেদন করে যে, অধ্যাপক গোলাম আজমের মামলায় যে সাক্ষ্য প্রমান এসেছে, তা থেকে কোনভাবেই বলা যায় না যে রাষ্ট্রপক্ষ গনহত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমান করাও সক্ষম হয়েছে।
পরিকল্পনা [Planning] [চার্জ নং - ২]
অধ্যাপক গোলাম আজমের বিরুদ্ধে “গনহত্যা” বা “মানবতা বিরোধী অপরাধ” এর পরিকল্পনার তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে।
ডিফেন্সের পক্ষ থেকে নিবেদন করা হয় যে, ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(২) ধারায় “পরিকল্পনা” করা কোন অপরাধ হিসেবে সংগায়িত করা হয়নি। তবে আইনের ৪(২) ধারায় “উর্দ্ধতন কর্মকর্তা” বা “কমান্ডার ” এর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সুযোগ রুয়েছে। এই মামলায় গোলাম আজমকে “উর্দ্ধতন কর্মকর্তা” বা “কমান্ডার” হিসাবে আখ্যায়িত করে কোন অভিযোগ আনা হয়নি, এমনকি এমন কোন অভিযোগ আনা সম্ভবও নয় কেননা তিনি বেসামরিক ব্যক্তি। তাই পরিকল্পনাকারী হিসেবে গোলাম আজমের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগের আইনগত ভিত্তি নেই।
ডিফেন্স আরো নিবেদন করে যে ১৯৭১ সালে গোলাম আজম আদৌ গনহত্যা বা মানবতা বিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা করেছিল এমন কোন দালিলিক প্রমান বা সাক্ষ্য প্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারে নাই। উপরন্তর রাষ্ট্রপক্ষ তার ফর্মাল চার্জ-এ অধ্যাপক গোলাম আজমের কথিত পরিকল্পনার ফলে ১৯৭১ সালে সংঘটিত একটি অপরাধের ও সুনির্দিষ্ট বর্ণনা দিতে পারেন নাই।
উস্কানি [Incitement [চার্জ নং - ৩]
অধ্যাপক গোলাম আজমের বিরুদ্ধে উস্কানীর ২৮টি অভিযোগ আনা হয়েছে।
আসামী পক্ষ থেকে নিবেদন করা হয়, উস্কানীর অভিযোগ প্রমান করতে হলে রাষ্ট্রপক্ষকে জেনোসাইড কনভেনশনের অধীনে সংরক্ষিত চারটি গোষ্ঠীর কোন একটি সদস্যের বিরুদ্ধে সেই গোষ্ঠীকে নিধনের উদ্দেশ্যে উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রমান করতে হবে। রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের “কাজেলিজেলি” ও “আকায়েসু” কেস উল্লেখ করে ডিফেন্স নিবেদন করে যে কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে গঠিত কোন গোষ্ঠীকে নিধন করার উদ্দেশ্যে গোলাম আজম ১৯৭১ সালে কোন উস্কানীমূলক বক্তব্য দিয়েছেন এ মর্মে কোন সাক্ষ্যপ্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারে নাই। নাহিমানার কেস উল্লেখ করে ডিফেন্স নিবেদন করে যে সেই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ দালিলিক ও সাক্ষ্য প্রমানের মাধ্যমে প্রমান করেছিল যে নব্বইয়ের দশকে রুয়ান্ডায় কাঙ্গুরা প্রত্রিকা এবং আর.টি.এল.এম. রেডিওর মাধ্যমে টুটসি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক বক্তব্য এবং বিষোদাগার প্রচারিত হতো শুধুমাত্র এই কারনেই যে তারা টুটসির সম্প্রদায়ের সদস্য। একইভাবে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষকে প্রমান করতে হবে যে কেবলমাত্র বাঙালী বিধায় বাঙালী জাতির কোন সদস্যের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। বা শুধুমাত্র হিন্দু বিধায় হিন্দুধর্মাবলম্বী কোন সদস্যের বিরুদ্ধে বিষাদাগার করা হয়েছে। তবে ১৯৭১ সালে গোলাম আজমের কোন বক্তব্য বা বিবৃতিতে এমন অভিপ্রায় প্রমানিত হয় মর্মে সাক্ষ্যপ্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারে নাই।
ডিফেন্স আরো নিবেদন করে যে, জেনোসাইড কনভেনশনের অধীনে সংরক্ষিত চারটি গোষ্ঠীর কোন একটি গোষ্ঠীর সদস্যের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে অধ্যাপক গোলাম আজম কোন উস্কানীমূলক বক্তব্য দিয়েছেন মর্মে কোন দালিলিক বা সাক্ষ্য প্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারেনি। অতএব উস্কনীর ২৮টি অভিযোগের মধ্যে কোনটাই রাষ্ট্রপক্ষ প্রমান করতে পারেনি।
সম্পৃক্ততা [ Complicity[চার্জ নং - ৪]
অধ্যাপক গোলাম আজমের বিরুদ্ধে “গনহত্যা” ও “মানবতা বিরোধী অপরাধের” সম্পৃক্ততার ২৩টি অভিযোগ আনা হয়েছে। ডিফেন্সের পক্ষ থেকে নিবেদন করা হয় যে, “সম্পৃক্ততা” প্রমান করতে হলে রাষ্ট্রপক্ষকে একটি সুনির্দিষ্ট অপরাধের বর্ণনা দিতে হবে যা আসামীর সহযোগীতার ফলশ্রুতিতে সংঘটিত হয়েছে। এক্ষেত্রে রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের “সেমানজা” মামলার উদ্ধৃতি দেয়া হয়। ডিফেন্স নিবেদন করে যে গোলাম আজম পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বা উহার আক্সিলারী ফোর্সকে সহযোগীতা করেছে বা এরুপ সহযোগীতার ফলশ্রুতিতে ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(২) ধারায় কোন সুনির্দিষ্ট অপরাধ সংগটিত হয়েছে এ মর্মে কোন দালিলিক বা সাক্ষ্য প্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারে নাই। উপরন্তু এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন যে, গোলাম আজমের বক্তৃতা/ বিবৃতি শুনে বা পাঠ করে বা উনার নির্দেশে ১৯৭১ সালে কোন অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল কিনা তা তিনি জানে না। অতএব সম্পৃক্ততার ২৩টি অভিযোগের একটিও রাষ্ট্রপক্ষ প্রমান করতে সক্ষম হয়নি।
সিরু মিয়া হত্যাকন্ড [চার্জ নং - ৫]
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে গোলাম আজম সিরু মিয়া ও তার সহযোগীদের হত্যার নির্দেশ সম্বলিত একটি চিঠি ব্রাহ্মনবাড়ীয়া পিস কমিটির সভাপতি পিয়ার মিয়াকে প্রেরণ করে যার ফলশ্রুতিতে তাদের সকলকে হত্যা করা হয়। তবে গোলাম আজমের জারীকৃত কথিত চিঠি রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত করেত পারেনি।
সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ট্রাইবব্যুনালে বলেন যে, তার বোনের স্বামী মহসিন আলী খান ১৯৭১ সালে আযমের ছেলেদের শিক্ষক ছিলেন এবং সেই সুবাদে তিনি সিরু মিয়াকে বাঁচানোর জন্য একটি চিঠি গেলাম আযমের নিকট সংগ্রহ করেন। উক্ত মহসিন আলী খান আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষী দেন নাই। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে তার দেয়া বক্তব্য ১৯ (২) ধারা অনুযায়ী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে- সেখানে তিনি বলেন যে ১৯৭১ সালে তিনি খিলগাঁও মডেল কলেজে শিক্ষকতা করতেন। তবে আনোয়ারা বেগম আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে বলেন যে মহসীন আলী খান খিলগাঁও মডেল কলেজে স্বাধীনতার পর যোগদান করেন।
ডিফেন্স নিবেদন করেন যে, পেয়ারা মিয়ার কাছে সিরু মিয়ার হত্যার নির্দেশ সম্বলিত চিঠি আনোওয়ারা বেগম দেখেননি বলে স্বীকার করেছেন। জেরায় তিনি বলেন, তার ভাই সেই চিঠি দেখেছে। তবে তিনি (আনোওয়ারা বেগম) বা তার ভাই গোলাম আযমের হাতের লেখা বা স্বাক্ষরের সাথে পরিচিত নয় বলে স্বীকার করেন। এও বলেন যে কথিত চিঠি কাকে সম্বোধন করে লেখা হয়েছে তা তিনি জানে না বা কীভাবে কথিত চিঠিতে পেয়ারা মিয়াকে প্রেরন করা হয়েয়ে তাও তিনি জানেন না। ডিফেন্সের পক্ষ থেকে নিবেদন করা হয়, কথিত চিঠি যাকে প্রেরন করা হয়েছে (সিরু মিয়া) সে মৃত, যার মাধ্যমে প্রেরিত হয়েছে এবং যাকে দেখানে হয়েছে (ফজলুর রহমান) সেও মৃত। এবং কথিত চিঠিটিরও কোন হদিস নেই। তাই সিরুমিয়া হত্যাকান্ড সংক্রান্ত অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।
কমান্ড রেসপনসিবিলিটি
রাষ্ট্র পক্ষের অভিযোগ যে শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস কর্তৃক সংঘটিত সকল অপরাধের জন্য গোলাম আযম দায়ী। ডিফেন্সের নিবেদন হল যে কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায় ১৯৭৩ সালের আইনে ৪(২) ধারা অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে। আইনের ৪(২) ধারা অনুযায়ী কেবলমাত্র “ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা” বা “কমান্ডার” এর কামান্ড রেসপনসিবিলিটি থাকার সুযোগ রয়েছে। তবে ১৯৭১ সালে গোলাম আযম কোন বাহিনী বা সংগঠনের “ঊদ্ধতন কর্মকর্তা” বা “কমান্ডার” ছিলেন এই মর্মে কোন দালিলিক বা সাক্ষ্য প্রমাণ রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারেনি। সুতরাং আইনের ৪(২) ধারা গোলাম আযমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন মামলার নজির পেশ করে এও বলা হয় যে কোন বাহিনী বা সংগঠনের কোন সদস্যের অপরাধের দায় আসামীর উপর কেবল তখনই বর্তাবে যখন প্রমাণিত হয় যে আসামী সেই বাহিনী বা সংগঠনের সদস্যদের আদেশ, নির্দেশ এবং শাস্তি প্রদান করতে পারত।
তবে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী এ্যডভোকেট সুলতানা কামাল জেরায় স্বীকার করেন যে, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনীর কোন সদস্যকে বরখাস্ত করা বা শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা গোলাম আযমের ছিল কিনা তিনি জানেন না। মামলার অপর সাক্ষী মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম জেরায় স্বীকার করেন যে, আল বদর, আল-শামস, শান্তি কমিটির সদস্যদের অধ্যাপক গোলাম আযম অপরাধমূলক কর্মকান্ড কর্মের আদেশ বা নির্দেশ দিয়েছেন এই মর্মে কোন দারিলিক প্রমাণ তাঁর নিকট নেই। তাছাড়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেন যে তিনি যে পুলিশের পাক্ষিক রিপোর্ট এবং সরকারের গোপন নথি জব্দ করেছে তার কোনটাতেই গোলাম আযমকে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের কোন সদস্যকে নিয়ন্ত্রন, নিয়োগ, শস্তি প্রদান বা আদেশ প্রদানের কোন ক্ষমতা দেয়া হয়নি।
ডিফেন্স নিবেদন করে যে, রাষ্ট্রপক্ষের উপরোক্ত তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বা পিস কমিটির কোন সদস্যকে আদেশ, নির্দেশ বা শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা গোলাম আযমের ছিল না। অতএব উক্ত বাহিনী বা কমিটির সদস্যদের কর্তৃক সংঘটিত আপরাধের জন্য অধ্যাপক গোলাম আযমকে দায়ী করবার আইনগত কোন সুযোগ নেই।
ষড়যন্ত্র [Conspiracy [চার্জ নং - ১]
অধ্যাপক গোলাম আজমের বিরুদ্ধে “ষড়যন্ত্রের” ছ’টি অভিযোগ আনা হয়েছে। ডিফেন্স নিবেদন করেন যে, গনহত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমান করতে হলে, রাষ্ট্রপক্ষকে আসামীর সাথে ইয়াহিয়া খান বা টিক্কা খানের গনহত্যার একটি চুক্তি হয়েছিল মর্মে সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে হবে। তবে এমামলায় তেমন কোন সাক্ষ্য প্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারেনি। কেবল মাত্র বলা হয়েছে যে গোলাম আযম টিক্কা খান এবং ইয়াহিয়া খানের সাথে বৈঠক করেছে। পাকিস্তান আর্মির কোন অফিসারের সাথে কেবলমাত্র বৈঠক করে গনহত্যার ষড়যন্ত্রে অভিযোগ প্রমানিত করা যায় না। ডিফেন্সের পক্ষ থেকে এও বলা হয় যে গনহত্যার চুক্তি
Circumstantial Evidence এর মাধ্যমে প্রমান করা সম্ভব, তবে তেমন কোন সাক্ষ্য প্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে। গোলাম আযমের সাথে টিক্কা খানের পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ছবি দিয়ে গনহত্যার ষড়যন্ত্র প্রমান করা যায় না। ডিফেন্সের পক্ষ থেকে এও নিবেদন করা হয় যে রাষ্ট্রপক্ষকেই প্রমান করতে হবে অধ্যাপক গোলাম আজম বাঙালী জাতি বা হিন্দু গোষ্ঠী নিধন করার উদ্দেশ্য নিয়ে গণহত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। তবে কোন জাতি বা গোষ্ঠী নিধনের অভিপ্রায় গোলাম আজমের ছিল মর্মে কোন সাক্ষ্যপ্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারেনি।
ফর্দিনান্দ নাহিমানার কেস উল্লেখ করে বলা হয় যে, গনহত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমান করা অত্যন্ত দূরুহ। উক্ত মামলায় ট্রায়াল চেম্বার গনহতার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে মর্মে রায় দিলেও পরবর্তীতে আপীলেট চেম্বার সে রায় খারিজ করে দেয়। আপীলেট চেম্বারের রায় উল্লেখ করে ডিফেন্স নিবেদন করে যে, অধ্যাপক গোলাম আজমের মামলায় যে সাক্ষ্য প্রমান এসেছে, তা থেকে কোনভাবেই বলা যায় না যে রাষ্ট্রপক্ষ গনহত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমান করাও সক্ষম হয়েছে।
পরিকল্পনা [Planning] [চার্জ নং - ২]
অধ্যাপক গোলাম আজমের বিরুদ্ধে “গনহত্যা” বা “মানবতা বিরোধী অপরাধ” এর পরিকল্পনার তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে।
ডিফেন্সের পক্ষ থেকে নিবেদন করা হয় যে, ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(২) ধারায় “পরিকল্পনা” করা কোন অপরাধ হিসেবে সংগায়িত করা হয়নি। তবে আইনের ৪(২) ধারায় “উর্দ্ধতন কর্মকর্তা” বা “কমান্ডার ” এর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সুযোগ রুয়েছে। এই মামলায় গোলাম আজমকে “উর্দ্ধতন কর্মকর্তা” বা “কমান্ডার” হিসাবে আখ্যায়িত করে কোন অভিযোগ আনা হয়নি, এমনকি এমন কোন অভিযোগ আনা সম্ভবও নয় কেননা তিনি বেসামরিক ব্যক্তি। তাই পরিকল্পনাকারী হিসেবে গোলাম আজমের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগের আইনগত ভিত্তি নেই।
ডিফেন্স আরো নিবেদন করে যে ১৯৭১ সালে গোলাম আজম আদৌ গনহত্যা বা মানবতা বিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা করেছিল এমন কোন দালিলিক প্রমান বা সাক্ষ্য প্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারে নাই। উপরন্তর রাষ্ট্রপক্ষ তার ফর্মাল চার্জ-এ অধ্যাপক গোলাম আজমের কথিত পরিকল্পনার ফলে ১৯৭১ সালে সংঘটিত একটি অপরাধের ও সুনির্দিষ্ট বর্ণনা দিতে পারেন নাই।
উস্কানি [Incitement [চার্জ নং - ৩]
অধ্যাপক গোলাম আজমের বিরুদ্ধে উস্কানীর ২৮টি অভিযোগ আনা হয়েছে।
আসামী পক্ষ থেকে নিবেদন করা হয়, উস্কানীর অভিযোগ প্রমান করতে হলে রাষ্ট্রপক্ষকে জেনোসাইড কনভেনশনের অধীনে সংরক্ষিত চারটি গোষ্ঠীর কোন একটি সদস্যের বিরুদ্ধে সেই গোষ্ঠীকে নিধনের উদ্দেশ্যে উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রমান করতে হবে। রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের “কাজেলিজেলি” ও “আকায়েসু” কেস উল্লেখ করে ডিফেন্স নিবেদন করে যে কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে গঠিত কোন গোষ্ঠীকে নিধন করার উদ্দেশ্যে গোলাম আজম ১৯৭১ সালে কোন উস্কানীমূলক বক্তব্য দিয়েছেন এ মর্মে কোন সাক্ষ্যপ্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারে নাই। নাহিমানার কেস উল্লেখ করে ডিফেন্স নিবেদন করে যে সেই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ দালিলিক ও সাক্ষ্য প্রমানের মাধ্যমে প্রমান করেছিল যে নব্বইয়ের দশকে রুয়ান্ডায় কাঙ্গুরা প্রত্রিকা এবং আর.টি.এল.এম. রেডিওর মাধ্যমে টুটসি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক বক্তব্য এবং বিষোদাগার প্রচারিত হতো শুধুমাত্র এই কারনেই যে তারা টুটসির সম্প্রদায়ের সদস্য। একইভাবে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষকে প্রমান করতে হবে যে কেবলমাত্র বাঙালী বিধায় বাঙালী জাতির কোন সদস্যের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। বা শুধুমাত্র হিন্দু বিধায় হিন্দুধর্মাবলম্বী কোন সদস্যের বিরুদ্ধে বিষাদাগার করা হয়েছে। তবে ১৯৭১ সালে গোলাম আজমের কোন বক্তব্য বা বিবৃতিতে এমন অভিপ্রায় প্রমানিত হয় মর্মে সাক্ষ্যপ্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারে নাই।
ডিফেন্স আরো নিবেদন করে যে, জেনোসাইড কনভেনশনের অধীনে সংরক্ষিত চারটি গোষ্ঠীর কোন একটি গোষ্ঠীর সদস্যের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে অধ্যাপক গোলাম আজম কোন উস্কানীমূলক বক্তব্য দিয়েছেন মর্মে কোন দালিলিক বা সাক্ষ্য প্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারেনি। অতএব উস্কনীর ২৮টি অভিযোগের মধ্যে কোনটাই রাষ্ট্রপক্ষ প্রমান করতে পারেনি।
সম্পৃক্ততা [ Complicity[চার্জ নং - ৪]
অধ্যাপক গোলাম আজমের বিরুদ্ধে “গনহত্যা” ও “মানবতা বিরোধী অপরাধের” সম্পৃক্ততার ২৩টি অভিযোগ আনা হয়েছে। ডিফেন্সের পক্ষ থেকে নিবেদন করা হয় যে, “সম্পৃক্ততা” প্রমান করতে হলে রাষ্ট্রপক্ষকে একটি সুনির্দিষ্ট অপরাধের বর্ণনা দিতে হবে যা আসামীর সহযোগীতার ফলশ্রুতিতে সংঘটিত হয়েছে। এক্ষেত্রে রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের “সেমানজা” মামলার উদ্ধৃতি দেয়া হয়। ডিফেন্স নিবেদন করে যে গোলাম আজম পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বা উহার আক্সিলারী ফোর্সকে সহযোগীতা করেছে বা এরুপ সহযোগীতার ফলশ্রুতিতে ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(২) ধারায় কোন সুনির্দিষ্ট অপরাধ সংগটিত হয়েছে এ মর্মে কোন দালিলিক বা সাক্ষ্য প্রমান রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারে নাই। উপরন্তু এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন যে, গোলাম আজমের বক্তৃতা/ বিবৃতি শুনে বা পাঠ করে বা উনার নির্দেশে ১৯৭১ সালে কোন অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল কিনা তা তিনি জানে না। অতএব সম্পৃক্ততার ২৩টি অভিযোগের একটিও রাষ্ট্রপক্ষ প্রমান করতে সক্ষম হয়নি।
সিরু মিয়া হত্যাকন্ড [চার্জ নং - ৫]
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে গোলাম আজম সিরু মিয়া ও তার সহযোগীদের হত্যার নির্দেশ সম্বলিত একটি চিঠি ব্রাহ্মনবাড়ীয়া পিস কমিটির সভাপতি পিয়ার মিয়াকে প্রেরণ করে যার ফলশ্রুতিতে তাদের সকলকে হত্যা করা হয়। তবে গোলাম আজমের জারীকৃত কথিত চিঠি রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত করেত পারেনি।
সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ট্রাইবব্যুনালে বলেন যে, তার বোনের স্বামী মহসিন আলী খান ১৯৭১ সালে আযমের ছেলেদের শিক্ষক ছিলেন এবং সেই সুবাদে তিনি সিরু মিয়াকে বাঁচানোর জন্য একটি চিঠি গেলাম আযমের নিকট সংগ্রহ করেন। উক্ত মহসিন আলী খান আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষী দেন নাই। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে তার দেয়া বক্তব্য ১৯ (২) ধারা অনুযায়ী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে- সেখানে তিনি বলেন যে ১৯৭১ সালে তিনি খিলগাঁও মডেল কলেজে শিক্ষকতা করতেন। তবে আনোয়ারা বেগম আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে বলেন যে মহসীন আলী খান খিলগাঁও মডেল কলেজে স্বাধীনতার পর যোগদান করেন।
ডিফেন্স নিবেদন করেন যে, পেয়ারা মিয়ার কাছে সিরু মিয়ার হত্যার নির্দেশ সম্বলিত চিঠি আনোওয়ারা বেগম দেখেননি বলে স্বীকার করেছেন। জেরায় তিনি বলেন, তার ভাই সেই চিঠি দেখেছে। তবে তিনি (আনোওয়ারা বেগম) বা তার ভাই গোলাম আযমের হাতের লেখা বা স্বাক্ষরের সাথে পরিচিত নয় বলে স্বীকার করেন। এও বলেন যে কথিত চিঠি কাকে সম্বোধন করে লেখা হয়েছে তা তিনি জানে না বা কীভাবে কথিত চিঠিতে পেয়ারা মিয়াকে প্রেরন করা হয়েয়ে তাও তিনি জানেন না। ডিফেন্সের পক্ষ থেকে নিবেদন করা হয়, কথিত চিঠি যাকে প্রেরন করা হয়েছে (সিরু মিয়া) সে মৃত, যার মাধ্যমে প্রেরিত হয়েছে এবং যাকে দেখানে হয়েছে (ফজলুর রহমান) সেও মৃত। এবং কথিত চিঠিটিরও কোন হদিস নেই। তাই সিরুমিয়া হত্যাকান্ড সংক্রান্ত অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।
কমান্ড রেসপনসিবিলিটি
রাষ্ট্র পক্ষের অভিযোগ যে শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস কর্তৃক সংঘটিত সকল অপরাধের জন্য গোলাম আযম দায়ী। ডিফেন্সের নিবেদন হল যে কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায় ১৯৭৩ সালের আইনে ৪(২) ধারা অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে। আইনের ৪(২) ধারা অনুযায়ী কেবলমাত্র “ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা” বা “কমান্ডার” এর কামান্ড রেসপনসিবিলিটি থাকার সুযোগ রয়েছে। তবে ১৯৭১ সালে গোলাম আযম কোন বাহিনী বা সংগঠনের “ঊদ্ধতন কর্মকর্তা” বা “কমান্ডার” ছিলেন এই মর্মে কোন দালিলিক বা সাক্ষ্য প্রমাণ রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারেনি। সুতরাং আইনের ৪(২) ধারা গোলাম আযমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন মামলার নজির পেশ করে এও বলা হয় যে কোন বাহিনী বা সংগঠনের কোন সদস্যের অপরাধের দায় আসামীর উপর কেবল তখনই বর্তাবে যখন প্রমাণিত হয় যে আসামী সেই বাহিনী বা সংগঠনের সদস্যদের আদেশ, নির্দেশ এবং শাস্তি প্রদান করতে পারত।
তবে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী এ্যডভোকেট সুলতানা কামাল জেরায় স্বীকার করেন যে, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনীর কোন সদস্যকে বরখাস্ত করা বা শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা গোলাম আযমের ছিল কিনা তিনি জানেন না। মামলার অপর সাক্ষী মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম জেরায় স্বীকার করেন যে, আল বদর, আল-শামস, শান্তি কমিটির সদস্যদের অধ্যাপক গোলাম আযম অপরাধমূলক কর্মকান্ড কর্মের আদেশ বা নির্দেশ দিয়েছেন এই মর্মে কোন দারিলিক প্রমাণ তাঁর নিকট নেই। তাছাড়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেন যে তিনি যে পুলিশের পাক্ষিক রিপোর্ট এবং সরকারের গোপন নথি জব্দ করেছে তার কোনটাতেই গোলাম আযমকে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের কোন সদস্যকে নিয়ন্ত্রন, নিয়োগ, শস্তি প্রদান বা আদেশ প্রদানের কোন ক্ষমতা দেয়া হয়নি।
ডিফেন্স নিবেদন করে যে, রাষ্ট্রপক্ষের উপরোক্ত তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বা পিস কমিটির কোন সদস্যকে আদেশ, নির্দেশ বা শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা গোলাম আযমের ছিল না। অতএব উক্ত বাহিনী বা কমিটির সদস্যদের কর্তৃক সংঘটিত আপরাধের জন্য অধ্যাপক গোলাম আযমকে দায়ী করবার আইনগত কোন সুযোগ নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন