মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

মাওলানা নিজামী চারদলের বদলে মহাজোটের মন্ত্রী হলে মহাসুখে থাকতেন ///ব্যারিস্টার রাজ্জাকের যুক্তি পেশ

মেহেদী হাসান, ১৯/১১/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মামলায় আসামী পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়েছে। আজ শেষ দিন যুক্তি পেশ করেন আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী যদি চারদলের বদলে মহাজোটের  দলের মন্ত্রী হতেন তাহলে তিনি মহান নেতা হয়ে আজ মহাসুখে থাকতে পারতেন। তাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আজ আসামীর কাঠগড়ায় থাকতে হতনা।
মাওলানা নিজামীকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, যুদ্ধাপরাধ নয়  মাওলানা নিজামীর ক্যারিয়ার ধ্বংসের জন্য এটি বেশ ভাল একটি মামলা। 

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মাওলানা নিজামীর বিচার চলছে। মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে হত্যা, গনহত্যা, ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনাসহ মানবতাবিরোধী ১৬টি অভিযোগ আনা হয়েছে।  সবগুলো অভিযোগের সাথেই সুরিরিয়র কমান্ড রেসপনিসিবিলিটি বা উর্দ্ধতন নেতৃত্বের দায় এবং জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ (জেসিইি) বা যৌথ অপরাধ সংঘটনের দায় চাপানো হয়েছে। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক উর্দ্ধতন নেতৃত্বের দায় এবং যৌথ অপরাধের অভিযোগ খন্ডন করে যুক্তি পেশ করেন আজ । এসময় তিনি বিশ্বের বিভিন্ন মামলার রেফারেন্স পেশ করেন এবং তা জমা দেন  ট্রাইব্যুনালে।

উর্দ্ধতন নেতৃত্বের দায় বিষয়ে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন,  এ অভিযোগে কাউকে অভিযুক্ত করতে হলে প্রমান করতে হবে যারা অপরাধ করেছে তাদের উপর মাওলানা নিজামীর  নিয়ন্ত্রন এবং কর্তৃত্ব ছিল।  পাকিস্তান আর্মির ওপর কি কারো নিয়ন্ত্রন ছিল? এমনকি ড. মালেক সরকারের কি কোন নিয়ন্ত্রন ছিল পাকিস্তান আর্মির ওপর? তাদের ওপর মাওলানা নিজামীর কি করে নিয়ন্ত্রন থাকতে পারে? তাদের ওপর মাওলানা নিজামীর নিয়ন্ত্রন এবং কর্তৃত্ব ছিল তার কোন প্রমান নেই রাষ্ট্রপক্ষের কোন ডকুমেন্টে। যদি ধরেও নেয়া হয় যে, মাওলানা নিজামী আলবদর বাহিনীর  কমান্ডার ছিল তাহলেও প্রমান কোথায় যে, তার নিয়ন্ত্রনে এবং নির্দেশে অমুক অমুক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে? যারা বুদ্ধিজীবী হত্যার সাথে জড়িত ছিল তাদের ওপর মাওলানা নিজামীর কার্যকর নিয়ন্ত্রন এবং কর্তৃত্ব ছিল এরকম কোন প্রমান তো নেই। প্রমান ছাড়া যদি আপনারা তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে চান করতে পারেন। সে ক্ষমতা আপনাদের আছে। কিন্তু অবিচারেরও তো একটি সীমা আছে।

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আলবদর বাহিনী গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ যে ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে তাতেই ভিন্ন ভিন্ন এবং পরষ্পরবিরোধী তথ্য রয়েছে। যেমন রাষ্ট্রপক্ষ সেলিম মনসুর খান রচিত ‘আলবদর’ নামে একটি বই জমা দিয়েছে এবং আদালতে তা প্রদর্শন করেছে। এ বইয়ে কোথাও মাওলানা নিজামীকে আলবদর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি।
রাষ্ট্রপক্ষের আরেকটি ডকুমেন্ট (প্রদর্শীনী ৩৫) এ বলা হয়েছে শর্ষিণা পীরের নেতৃত্বে আলবদর এবং রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়েছে।
তাদের আরেকটি ডকুমেন্ট এ বলা হয়েছে কামরান নামে একজন ছিলেন আলবদর কমান্ডার। তাহলে দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্টই রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ নাকচ করছে। এই ডকুমেন্ট এর ওপর ভিত্তি করে আসামীকে কি সাজা দেয়া যায়?
এসময় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ নিজামী সাহেব ছাত্রসংঘের প্রধান ছিলেন। ছাত্রসংঘের লোকজনই আলবদ বাহিনীর সদস্য ছিল। কাজেই তিনি ছাত্রসংঘের সভাপিত হিসেবে আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। এর জবাব কি?

এর জবাবে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, যুক্তিবিদ্যা তত্ত্ব অনুযায়ী এভাবে মিলিয়ে অনেক কিছু বলা যায়। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি ছাত্রসংঘের সভাপতি সে কারনেই তিনি আলবদর বাহিনীর প্রধান হয়ে যাবেন? আলবদর বাহিনী ছিল একটি প্যারামিলিটারি।  কিন্তু  তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, মাওলানা নিজামী মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় একজন বেসামরিক ব্যক্তি ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষ যেসব ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে তাতে কোথাও প্রমান নেই যে, মাওলানা নিজামী আলবদর প্রধান ছিলেন। ১৯৭১ সালের যেসকল গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে তার কোথাও মাওলানা নিজামীকে আলবদর হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। সবজায়গায় লেখা আছে ছাত্রসংঘ প্রধান। তিনি আলবদর কমান্ডার হলে নিশ্চয়ই  সসময়কার গোয়েন্দা রিপোর্টে তার উল্লেখ থাকত। রাষ্ট্রপক্ষ সংগ্রামের যেসব পেপারকাটিং জমা দিয়েছে তার সব জায়গায় মতিউর রহমান নিজামীর পরিচয় লেখা আছে  ছাত্রসংঘ নেতা। কোথাও আলবদর নেতা উল্লেখ নেই। আর একথা স্বয়ং তদন্ত কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন জেরায়। এরপরও তাকে আলবদর কমান্ডার বলা যাবে?

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের কথা নামে একটি বই জমা দিয়েছে। এই বয়ের ৫৮ পৃষ্ঠায় অধ্যাপক আবু সায়ীদ তার একটি লেখায় মাওলানা নিজামীকে আলবদর বলে উল্লেখ করেছেন। আর আবু সায়ীদ এর লেখাটি ছাপা হয়েছিল জনকন্ঠে। সেখান থেকে তুলে দেয়া হয়েছে বইয়ে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯ সালে। আরো মজার বিষয় হল আবু সায়ীদ সংগ্রামের একটি খবরের উদ্ধৃতি করে মাওলানা নিজামীকে আলবদর হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার লেখায়। কিন্তু তিনি সংগ্রামের যে খবরটিকে রেফার করেছেন সেই খবরটিতে কোথাও মাওলানা নিজামীকে আলবদর নেতা বলা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের এই ধরনের কাহিনী এবং ডকুমেন্ট কি আপনারা বিশ্বাস করবেন?

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ ১৯৭১ সালের ঘটনা বিষয়ে এত বড় অভিযোগ আনা হল। কিন্তু স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও কেউ কোনদিন তার বিরুদ্ধে দালাল আইনেও এসব অভিযোগে একটি মামলা করেনি কেন?
আমাদের দাবি  মাওলানা নিজামী সম্পূর্ণ নির্দোষ। আশা করছি আপনরা ন্যায়বিচার করবেন এবং তিনি খালাস পাবেন।

যৌথ অপরাধের দায় খন্ডন করে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কয়েকজন মিলে কোন অপরাধ করলে এবং সেখানে নিছক কোন ব্যক্তি উপস্থিত থাকলেই তার ওপর দায় চাপানো যায়না। কারো বিরুদ্ধে দায় চাপাতে হলে প্রমান করতে হবে যে, অপরাধটি সংঘটনের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র এবং বাস্তবায়নের সময় অন্যান্যের সাথে সেও জড়িত ছিল। কিন্তু মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে  অভিযোগের পক্ষে সাক্ষীরা যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাতে দেখা যায় মাওলানা নিজামী নিছক ঘটনাস্থলে বা আর্মির সাথে উপস্থিত ছিলেন। তারা তাকে আর্মির সাথে গাড়িতে বা কোন কোন সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত দেখেছেন। কিন্তু নিছক উপস্থিতির কারনে একজনের বিরুদ্ধে যৌথ অপরাধের দায় চাপানো যায়না। অপরাধটি সংঘটনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা, অংশগ্রহণ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে  আসামীর সংশ্লিষ্টতা কোন পর্যায়ে তা নির্দিষ্ট করে বলতে হবে।  তাছাড়া সাক্ষীদের বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নতো আছেই।

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চার্জ ফ্রেম যেভাবে হয়েছে তাতে তার বিরুদ্ধে যৌথ অপরাধের অভিযোগ নেই। নির্দিষ্ট করে এ বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। সবগুলো অভিযোগের সাথে এ অভিযোগের ধারা যুক্ত করা হয়েছে মাত্র। কাজেই দেখা যাচ্ছে গোড়ায় গলদ রয়ে গেছে। চার্জে যদি নির্দিষ্ট কোন অভিযোগ না থাকে তাহলে তা প্রমানেরও প্রশ্ন আসেনা রাষ্ট্রপক্ষের। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ১৬টি অভিযোগের যেখানেই যৌথ অপরাধের দায় আছে তার কোনটিতেই রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি।

যুক্তি উপস্থাপনের সময় অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন, অ্যাডভোকেট তারিকুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আসাদ উদ্দিন, অ্যাডভোকেট আমিনুল হক বাপ্পি প্রমুখ উপস্থতি ছিলেন।

আসামী পক্ষের যুক্ত খন্ডন করে আগামীকাল রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি পেশ করার কথা রয়েছে। এরপর শেষ হবে মামলার কার্যক্রম।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন