রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৩

নিজামীর মামলায় ফের যুক্তি উপস্থাপন শুরু// তদন্ত কর্মকর্তা আড়াইশ মিথ্যা বলেছে

মেহেদী হাসান, ১৭/১১/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মামলায় আসামী পক্ষকে অসমাপ্ত যুক্তি উপস্থাপনের অনুমতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ফলে আজ  থেকে আবার এ মামলায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়।

এর আগে হরতালে  পরপর চারদিন আসামী পক্ষের সিনিয়র কোন আইনজীবী ট্রাইব্যুনালে হাজির না হওয়ায় আসামী পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন বন্ধ করে গত বুধবার মামলার কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষনা করা হয় এবং রায় অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়।

এ আদেশ পুনরায় বিবেবচনার জন্য আসামী পক্ষ আবেদন করে। আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আজ আবেদনের পক্ষে শুনানী পেশ করেন। এরপর আদালত আজ  এবং আগামীকাল দুই দিন ধার্য্য করেন শুনানীর জন্য। আগামী বৃহষ্পতি এবং রোববার আরো দুইদিন সময় বাড়ানোর জন্য ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক অনুমতি চাইলে ট্রাইব্যুনাল আশ্বাস দিয়ে বলেন, শুরু করেন, তারপর দেখা যাবে।

শুনানীতে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ পর্যন্ত যত হরতাল হয়েছে তাতে আমরা কোন সিনিয়র আইনজীবী নিরাপত্তার কারনে ট্রাইব্যুনালে আসিনি। এর আগে সকল মামলার ক্ষেত্রেই হরতালের কারনে সময় দেয়া হয়েছে। কোন জেলা জজ আদালত এভাবে হরতালে আসামী পক্ষের অনুপস্থিতিতে আদেশ পাশ করেনা। হাইকোর্ট সুপ্রীম কোর্টেও আইনজীবীরা আসেননা। তাই এ মামলায় হরতালের মধ্যে এভাবে আসামী পক্ষের বিরুদ্ধে আদেশ পাশ করলে আমরা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হব।

তদন্ত কর্মকর্তা আড়াইশ মিথ্যা বলেছে
অসমাপ্ত যুক্তি উপস্থাপনের অনুমতি পাবার পর মাওলানা নিজামীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম আজ  দ্বিতীয় দিনের মত যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন। মিজানুল ইসলাম বলেন, এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ যেসব ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে তাতে তদন্ত কর্মকর্তা আড়াইশ মিথ্যা কথা বলেছেন। এসময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবুল কালাম আযাদ বলেন, এভাবে বললে হবেনা। কোথায় কিভাবে মিথ্যা বলেছে তা বলতে হবে। তখন মিজানুল ইসলাম বলেন, অবশই আমি তা লিখিত আকারে জমা দেব। এই মামলায় তদন্ত কাজ শেষ হয় ২০১১ সালের ১ নভেম্বর। তদন্ত কর্মকর্তা  জেরায় বলেছেন, তদন্ত  প্রতিবেদন জমা দেয়ার পরও তিনি তদন্ত কাজ অব্যাহত রাখেন এবং তখন সাক্ষী শ্যামলী নাসরিনের জবানবন্দী রেকর্ড করেন। কিন্তু শ্যামলী নাসরিনের যে ডকুমেন্ট তিনি আদালতে জমা দিয়েছেন তাতে দেখা যায় শ্যামলী নাসরিনের জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়েছে ২০১১ সালের ১১ মার্চ। তার জমা দেয়া ডকুমেন্ট অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে তদন্ত শেষ হবার আগেই তার জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়েছে। আর কোর্টে এসে বললেন, তদন্ত শেষ হবার পর তিনি তার জবানবন্দী রেকর্ড করেছেন। আদালত এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে মিজানুল ইসলাম বলেন, তদন্ত কর্মকর্তার মিথ্যার এই ডকুমেন্ট এই মুহুর্তে আপনাদের সামনে আছে; আপনারা মিলিয়ে দেখতে পারেন।

মিজানুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ মাওলানা নিজামী বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করেছেন। আবার তাদের জমা দেয়া ডকুমেন্টে দেখা যায় হামিদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে অবজারভার ভবনে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হয়। কোনটি সত্য?
মিজানুল ইসলাম বলেন, আলবদর একটি সামরিক বাহিনী। রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ মাওলানা নিজামী আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। অপর দিকে তদন্ত কর্মকর্তা দাবি করেছেন পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় মাওলানা নিজামী একজন বেসামরিক ব্যক্তি ছিলেন। পুরো সময় তিনি যদি বেসামরিক ব্যক্তি থাকেন তাহলে আবার আলবদর বাহিনীর প্রধান হন কি করে?

এরপর মিজানুল ইসলাম মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে বিভিন্নি অভিযোগ এবং তার পক্ষে সাক্ষীদের বক্তব্য খন্ডন করে যুক্তি পেশ করেন।

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে ৩ নং অভিযোগ হল মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিউিটে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে অপরহন নির্যাতন।   এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের বর্তমান গার্ড় রুস্তম আলীকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করে। তার পিতা ১৯৭১ সালে ওই প্রতিষ্ঠানের গার্ড ছিল।

মিজানুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এ অভিযোগ বিষয়ে বলেছে, ১৯৭১ সালের মে মাস থেকে  মাওলানা নিজামী মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। আর সাক্ষী রুস্তম আলী বলছেন, সেখানে আর্মি ক্যাম্প স্থাপনের চার/পাঁচ মাস পরে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। সাক্ষীর বক্তব্য অনুযায়ী নিজামী সাহেব জুলাই আগস্টের আগে সেখানে যাননি। আর রাষ্ট্রপক্ষ বলছে মে মাস থেকে সেখানে গেছেন তিনি। কোনটি সত্য?
মিজানুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ কোন তারিখে স্বাধীন হয় তাও বলতে পারেনি সাক্ষী। এ সাক্ষী একজন নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি। সাক্ষী বলেছেন তিনি মুশুরীখোলা ও বাকুড়া ক্যাম্পে যাননি। কিন্তু অপর সাক্ষী জহিরুদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল বলেছেন  ওই ক্যাম্পে রুস্তম আলীর সাথে তার দেখা হয়েছে। কার কথা সত্য?
সাক্ষী রুস্তম আলী বলেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পর তিনি বিচ্ছু জালালের নাম শুনেছেন। আর বিচ্ছু জালাল বলেছেন সেপ্টেম্বরে তাকে বিচ্ছু জালাল খেতাব দেয়া  হয়। মিজানুল ইসলাম বলেন তাহলে এটাও রুস্তম আলীর একটা  মিথ্যা কথা।

১১ নং সাক্ষী শামসুল হক নান্নু বলেছেন ১১ এপ্রিল মাওলানা নিজামীর নেতৃত্বে তাদের পাবনার বাড়ি ভাংচুর করা হয় এবং পাশের বাড়ির ছাদে বসে তিনি তা দেখেছেন। অপর দিকে জহিরুদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল বলেছেন একই সময়ে তিনি মাওলানা নিজামীকে ঢাকায় সার্কিট হাউজে দেখেছেন। মিজানুল ইসলাম বলেন, কার কথা সত্য?
বিচ্ছু জালাল আবার বলেছেন ৩০ আগস্ট তাকে এমপি হোস্টেলে ধরে নিয়ে মাওলানা নিজামী পিস্তল দিয়ে তাকে পিটিয়েছেন। আবার সাক্ষী অনিল বলেছেন, আগস্টের শেষের দিকে মাওলানা নিজামীকে মুক্তিযোদ্ধা বাতেন পাবনায়  তার নৌকায় আটকে রেখে নির্যাতন করে। মিজানুল ইসলাম প্রশ্ন করে বলেন, আসলে মাওলানা নিজামী কোথায় ছিলেন এবং কার কথা সত্য?
বিচ্ছুু জালাল বলেছেন ৩০ আগস্ট রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে যায়। আবার জেরায় সে বলেছে ৩ সেপ্টেম্বর মেলাঘরে সে প্রথম রাজাকার শব্দ শুনেছে। কোনটি সত্য?

বিচ্ছু জালাল ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দেয়ার সময় বলেছেন, বদী, রুমী এবং জুয়েলকে ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট রমনা থানায় ধরে নিয়ে যায় বলে যেকথা বলেছেন  দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে তা তিনি ভুল করে বলেছেন।
মিজানুল ইসলাম বলেছেন,  বিচ্ছু জালাল দুই ট্রাইব্যুালে দুইজন আসামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে ভুল সাক্ষ্য দেয়ার কথা বলেছেন। এখানে যা বলেছেন তা সঠিক বলেছেন তার প্রামন কি? জাহানারা ইমাম তার বইয়ে বলেছেন, বদী, রুমি, জুয়েল নির্যাতন, হত্যার সাথে কোন বাঙ্গালী জড়িত ছিলনা। আর বিচ্ছু জালাল বলেছেন মাওলানা নিজামী এর সাথে জড়িত। বিচ্ছু জালাল বলেছেন, স্বাধীনতার পর তিনি রুমিদের বাসায় গেছেন এবং রুমির পিতার সাথেও দেখা হয়েছে। অথচ রুমির পিতা মারা গেছেন ১৩ ডিসেম্বর। তাহলে স্বাধীনতার পর তার সাথে তার দেখা হল কি করে? এরপরও কি এই সাক্ষীকে বিশ্বাস করা যায়? তাছাড়া জাহানারা ইমামের বইয়ে বিচ্ছু জালাল বিষয়ে কোন কথা উল্লেখ নেই।

পাবনার কছিম উদ্দিন মাওলানা হত্যার অভিযোগ বিষয়ে মিজানুল ইসলাম বলেন, পাবনার ইতিহাস বইয়ে এ হত্যার বিবরন রয়েছে। সেখানে মাওলানা নিজামীর নাম নেই।
মিজানুল ইসলাম বলেন, পাবনার বৃশালিকায় হিন্দু পাড়ায় হত্যা, নির্যাতন ধর্ষণ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষে শাহজাহান আলী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন তিনি তার ফুফু বাড়ি যাবার পথে হিন্দু পাড়ায় যান । সেখানে গিয়ে দেখতে পান  একটি হিন্দু বাড়িতে ৪/৫ জন মুসলমান লোক দাড়িয়ে আছে। তাদেরকে দেখে তিনি ওই বাড়িতে যাই। তিনি সেখানে দেখতে পান  তিন/চার জন মহিলা  বিবস্ত্র অবস্থায় বসে আছে। তারা জানায় মতিউর রহমান নিজামী উপস্থিত থেকে পাকিস্তানী আর্মি দিয়ে তাদের ধর্ষণ করিয়েছে।

মিজানুল ইসলাম বলেন, ধর্ষনের পর সব মহিলারা উলঙ্গ হয়ে প্রকাশে বসে থাকবে আর তাদের ঘিরে কতগুলো লোক দাড়িয়ে থাকবে এবং তাদেরকে বলবে তাদেরকে অমুক ধর্ষণ করিয়েছে একথা কি কোন বিশ্বাসযোগ্য কথা? মিজানুল ইসলাম বলেন, মাই লর্ড, নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ধর্ষনের কোন অভিযোগ আনেনি। অভিযোগ হল তিনি পাকিস্তানীদের নারি সাপ্লাই দিয়েছেন তার উপস্থিত থেকে পাকিস্তানী সেনাদের ধর্ষণ করিয়েছেন।  নিজামী সাহেব তখন  যুবক ছিলেন। তিনি অপরকে দিয়ে ধর্ষণ করিয়েছেন নিজে করেননি। কেন তিনি কি নপুংশক ছিলেন? আমরা তো জানি তার ছয়টি সন্তান আছে।
মিজানুল ইসলাম বলেন, কতগুলো টাউট বাটপাড় নিয়ে এসেছে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার জন্য।

মিজানুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সারা দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের নামের তালিকা করা হয়। মাওলানা নিজামী এত অপকর্ম করলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার মত এতবড় পরিকল্পনা করলেন আর তার নামই তালিকায় আসলনা?

যুক্তি উপস্থাপনের সময় অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলামকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন, আসাদ উদ্দিন প্রমুখ।
 ট্রাইব্যুনাল-১ চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়রুল হক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন