মেহেদী হাসান, ২৪/১/২০১২
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে পরপর তিনবার সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিরা। অবশেষে আজ বেলা দুইটায় নতুন সাক্ষী হাজির করতে সক্ষম হন তারা । এরপর তার জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়।
বারবার সময় নিয়েও যথাসময়ে সাক্ষী হাজির করতে না পারায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের প্রতি গতকাল অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ১৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার ১২টায় ১৪তম সাক্ষী আব্দুল হালিম বাবুলের জবানবন্দী এবং জেরা শেষ হয়। এরপর আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের নতুন সাক্ষী বিষয়ে জানতে চান। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানান তারা এ মুহুর্তে নতুন সাক্ষী আনতে পারছেননা। পরবর্তী সাক্ষী মধুসূদন ঘরামী অসুস্থ । এরপর আদালত তাদেরকে পরেরদিন বুধবার নতুন সাক্ষী আনতে বলেন। কিন্তু সেদিনও তারা সাক্ষী হাজির করতে পারেননি। এরপর আদালত গতকাল মঙ্গলবার ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত মাওলানা সাঈদীর বিচার মুলতবী করেন।
সকালে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে তখনো তারা নতুন সাক্ষী আনতে ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু আদালতকে জানান তারা সাক্ষী আনতে পারেননি। দুইটার পরে আনতে পারবেন কোর্টে। সাক্ষী আগের রাতে ঢাকায় এসেছে। তাদের হাতে চারজন সাক্ষী আছেন। আদালত তখন চারজন সাক্ষীর নামের তালিকা আসামী পক্ষকে দেয়ার আদেশ দেন। ড. সৈয়দ শরাফত আলী, আব্দুর রাজ্জাক, সোলায়মান হোসেন এবং জুলফিকার আলী এ চারজন সাক্ষীর তালিকা আসামী পক্ষকে হস্তান্তর করে প্রসিকিউশন। এর মধ্যে প্রথম দুজনের যেকোন একজনকে বেলা দুইটায় আদালতে হাজির করতে বলেন আদালত। কিন্তু দুইটায় আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে প্রথম দজুনের বদলে শেষের দুজনের একজনকে একজনকে হাজির করেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিরা।
আদালত এর কারণ জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিরা জানান তারা অসুস্থ। সকালে চারজনের যে তালিকা দেয়া হয়েছে তার মধ্য থেকেই একজনকে আনা হয়েছে।
বারবার তারিখ দেয়া সত্ত্বেও যথাসময়ে সাক্ষী হাজির করতে না পারা প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলীদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা আমাদেরকে অসন্তোষ প্রকাশে বাধ্য করতেছেন।
আদালতের নির্দেশ মোতাবেক চারজনের তালিকা থেকে প্রথম দুইজনের বদলে শেষের দুইজনের একজনকে হাজির করায় এবং তার জবানবন্দী শুরু করা বিষয়ে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম তীব্র আপত্তি জানান। তিনি আদালতকে বলেন, এভাবে আটবার তারা সিরিয়াল ভঙ্গ
করেছেন। আমরা মানুষ। আমাদের প্রস্তুতির একটি বিষয় আছে। সকালে চারজনের তালিকা দেয়া হল আমাদের। সেখান থেকে প্রথম দুজনের যেকোন একজনকে আনার কথা। আমরা প্রথম দুজন বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু এখন তারা শেষের দুজন থেকে একজনকে আনল। শেষের দুজন বিষয়েতো আমাদের কোন প্রস্তুতি নেই। তাজুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, আমরা যাতে সাক্ষীকে ভালভাবে জেরা করতে না পারি সেজন্য তারা ইচ্ছা করে বারবার এটি করছেন। এটি ন্যায় বিচারের জন্য সহায়ক নয়। তিনি নতুন সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহনের জন্য একদিন সময় চান।
আদালত তখন নতুন সাক্ষীর জবানবন্দী প্রদানের নির্দেশ দেন। তাজুল ইসলাম এর বিরোধীতা করে বলেন, এক মিনিটের নোটিশে নতুন সাক্ষীর জবানবন্দী শুরু হবে?
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, দেখিনা উনি কি বলেন। আগে শুরু হোক। তারপর বিবেচনা করে দেখবো আমরা ।
তাজুল ইসলাম তখন বলেন, শুরু হলে তো শুরু হয়েই গেল। তাহলে আর থাকল কি। আমাদের তো প্রস্তুতি নেই নতুন সাক্ষী বিষয়ে। ১৪ তম সাক্ষীর জেরা শেষে আমরা ১৫ তম সাক্ষী হিসেবে মধুসূদন গরামী বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু তাকে আনা হলনা। সকালে তারা নতুন চারজনের তালিকা দিলেন। সে সিরিয়ালও তারা ভঙ্গ করা হল। এ পর্যায়ে বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, তাই যদি বলেন, তাহলে আমরা বলব এভাবে সাক্ষীদের তালিকা আগে দেয়ার নিয়ম নেই। ন্যায় বিচারের স্বার্থে আমরা এটি আপনাদের দিচ্ছি।
তাজুল ইসলাম তখন বলেন এভাবে এক মিনিটের নোটিশে যদি নতুন সাক্ষীর জবানবন্দী শুরু হয় তাহলে আর ন্যায় বিচার থাকল কি করে।
এ পর্যায়ে মাওলানা সাঈদীর অপর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি বললেন তারা যখন যাকে খুসী আনবেন। এভাবে সিরিয়াল ভঙ্গ করে যখন যাকে খুসী আনা যদি তাদের অধিকার হয়ে থাকে তাহলে আমাদের কোন অধিকারই তো আর থাকলনা।
বিচারপতি নিজামুল হক এসময় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আপনারা দুই পক্ষ ফাইট করেন। আমরা বসে থাকি। আমি বললাম জবানবন্দী নেয়া শুরু হোক। এরপর আমরা যদি দেখি আপনাদের জেরায় সমস্যা হচ্ছে, আপনরা প্রিজুডিস হচ্ছেন তখন আমরা দেখবো বিচেনা করে এবং মুলতবিও করতে পারি প্রয়োজনে। কিন্তু আপনারা শুরু করতেই দিতে চাচ্ছেননা।
এরপর আদালতের নির্দেশে নতুন সাক্ষী সোলায়মান হোসেনের জবানবন্দী গ্রহণ শুরু হয়। জবানবন্দী গ্রহণ শেষ হলে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী গতকাল এক ঘন্টার জন্য মুলতবী চাইলে আদালত মুলতবী ঘোষনা করেন। আজ বুধবার সাক্ষীর জেরা শুরু হবে। গতকাল আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে সাক্ষীকে দুটি প্রশ্নের মাধ্যমে জেরা শুরু করা হয় মুলতবীর আগে।
জবানবন্দী:
আমার নাম সোলায়মান হোসেন। বয়স ৬০ বছর। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের সময় দোহাকুলা (যশোর) আমাদের বাড়ির পাশে মাঠে জামায়াতে ইসলামীর একটি নির্বাচনী সভা হয়। ঐ সভায় যারা বক্তব্য রাখেন তাদের সবার নাম মনে নেই। তবে জামায়াতের ক্যান্টিডডেট মশিউল আযম উপস্থিত ছিলেন। সেখানে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বক্তব্য রাখেন। ঐ বক্তব্যে তিনি বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখার সময় বঙ্গবন্ধুকে জগবন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেন। আমি মিটিংয়ের পাশে ছিলাম। আমি তার এ কথা শুনেছি। তার এ বক্তব্য নিয়ে আমরা আরো ১০/১৫ জন একত্র হয়ে আলোচনা করি। তারাও একথা শুনেছে। এ বক্তব্য নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। ঐ সময় থেকে সাঈদী সাহেবকে আমি চিনি।
এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী দোহাকুলা গ্রামের রওশন আলীর বাড়িতে গিয়ে থাকতেন। রওশন আলীর বাড়িতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর থাকা বিষয়ে আমরা এলাকার লোকজন জানতে পারি যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকার কারনে ঐ বাড়িতে গিয়ে তিনি আত্মগোপন করেন।
২০০৫ অথবা ২০০৬ সালে বাঘরপাড়া পাইলট স্কুলে একটি ধর্মসভা হয়। ঐ সভায় বক্তব্য রাখার সময় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বলেন যে, এখানে রওশন ভাই উপস্থিত আছেন কি-না। তিনি আমাকে দুর্দিনে শেল্টার দিয়েছিলেন। একথা শোনার পর রওশন উঠে দাড়ান এবং স্টেজে গিয়ে হ্যান্ডশেক করেন । দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পাশে বসেন। এরপর সাঈদী তার বাড়িতেও যান মিটিং শেষে।
তাজুল ইসলামের প্রতিকৃয়া: আজ আদালতের কার্যক্রম শেষে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী সাংবাদিকদের বলেন, ১৪ তম সাক্ষীর জবানবন্দী এবং জেরা শেষে মধুসূদন ঘরামীর সাক্ষ্য দেয়ার কথা ছিল। আমরা তার বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু তাকে তারা আনতে পারলেননা। সকালে চারজনের যে তালিকা দিলেন সেখান থেকেও তারা ক্রমিক অনুসারে সাক্ষী আনতে পারলেননা। তারা আমাদের যে ৬৮ জন সাক্ষীর তালিকা দিয়েছেন তাতে এই চারজনের নাম ৬০ নম্বর সিরিয়ালের পরে। এভাবে সিরিয়াল ভঙ্গ করে আমাদের অপ্রস্তুত করাই তাদের লক্ষ্য। প্রসিকিউশন বলল তারা যখন যাকে খুশী হাজির করবেন। এভাবে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়না। তিনি বলেন, ক্রিমিনাল কেসে পরের তারিখে কোন সাক্ষীকে হাজির করা হবে তা আগের তারিখে আদালতে জানিয়ে দেয়া হয়।
এর আগে আদালতে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, আমাদেরকে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ৬৮ জনের একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। সকালে চারজন সাক্ষীর যে তালিকা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে আব্দুর রাজ্জাকের নাম ঐ ৬৮ জনের তালিকায় নেই। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব।
আজ মাওলানা সাঈদীর পক্ষে আদালতে আরো উপস্থিত ছিলেন এ্যাডভোকেট কফিলউদ্দিন চৌধুরী, ব্যারিস্টার তানভির আল আমিন এবং এস এম শাহজাহান কবীর ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন