মেহেদী হাসান, ১১/১/২০১২
এমপি এ কে এম এ আউউয়ালের জেরায় স্বীকার করেছেন এই মামলার অপর দুই সাক্ষী সুলতান আহম্মেদ হাওলাদার এবং মানিক পসারীকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা আখ্যায়িত করে প্রত্যয়ন পত্র দিয়েছেন । এই দুই সাক্ষী এর আগে আদালতে জেরার সময় স্বীকারে করেছেন তারা কেউ মুক্তিযোদ্ধা নন। এছাড়া মফিজ উদ্দিন পসারী নামে আরো এক সাক্ষী আদালতে স্বীকারে করেছেন তিনিও মুক্তিযোদ্ধা নন। তবে এমপি এ কে এম এ আউয়ালের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যয়ন পত্র নিয়েছেন।
এই তিনজনের প্রত্যেককেই মামলা শুরুর পর ২০১০ সালে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়। প্রত্যয়ন পত্র প্রদানের তারিখও একই, ১৩/৯/২০১০। গতকাল এ প্রত্যয়নপত্র আদালতে উপস্থাপন করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী। প্রত্যয়নপত্রের ফটোকপি এমপি আউয়ালকেও দেয়া হয়। তিনজনেরই প্রত্যয়নপত্রে লেখা রয়েছে “সে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করিয়া আমার সাথে থাকিয়া সুন্দরবন এলাকায় বীরত্বের সাথে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করিয়াছে। ”
মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যয়নপত্র গ্রহণ বিষয়ে জেরার সময় উক্ত সাক্ষীদের কেউ কেউ বলেছিলেন তারা মুক্তিযোদ্ধাদের খায় খেদমত করেছেন। কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের আউগানি পাউছানি করেছেন। সেজন্য সহায়ক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হবার জন্য দরখাস্ত করেছিলেন এবং প্রত্যয়নপ্রত নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।
এছাড়া আব্দুল জলিল শেখ নামে আরো একজন সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হবার জন্য দরখাস্ত করেছেন বলে স্বীকার করেছেন জেরায়।
ট্রাইব্যুালে অধ্যাপক গোলাম আযম বিষয়ে আদেশ প্রদানের পর ১২টার দিকে সাক্ষী এমপি এ কে এম এ আউয়ালের অসমাপ্ত জেরা শুরু হয়।
এমপি আউয়ালের অসমাপ্ত জেরা:
আইনজীবী: সুন্দরবন ফরেস্ট অফিসে কবে ক্যাম্প করলেন?
সাক্ষী: ভারতে যাবার আগে জুলাই মাসের শেষ দিকে বা মাঝামাঝি সময়ে ।
আইনজীবী: আলাদা সাবসেক্টরে উন্নীত হবার আগে ঐ ক্যাম্প কোন সেক্টর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত?
সাক্ষী: ৯ নং সেক্টর।
আইনজীবী: ৯ নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর আব্দুল জলিল।
সাক্ষী: মেজর জলিল, জয়নাল আবেদন, মেজর মনজুর কাদের বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করেছেন । ৮ নং সেক্টর কমান্ডার মনজুর কাদের মাঝে মাঝে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন ৯ নং সেক্টরের।
আইনজীবী: সুন্দরবন ক্যাম্প সাব সেক্টরে উন্নীত হবার সময় ৯ নং সেক্টর কমান্ডার কে ছিলেন?
সাক্ষী: মেজর জলিল।
আইনজীবী: ৯ নং সেক্টর ক্যাম্প কোথায় ছিল?
সাক্ষী: ভারতের টাকি। জেলার নাম মনে নেই।
আইনজীবী: সেক্টর কমান্ড অফিসে কখনো গেছেন?
সাক্ষী: অনেকবার গেছি। অস্ত্র আনতেই তো যেতে হয়।
আইনজীবী: মুক্তিযুদ্ধের সময় সিভিলিয়ান গোয়েন্দারা সম্পূর্ণ পিরোজপুর এলাকার রাজাকার আল বদর আল শামস এসব বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অপকর্মসহ সামরিক বিষয়ে খবরাখবর আপনাদের দিত?
সাক্ষী: হ্যা।
আইনজীবী: মাহবুবুর রহমান সাধু নামে আনপার একজন ভাই ছিলেন?
সাক্ষী: হ্যা।
আইনজীবী: তিনি ২০০৮ সালে মারা যান?
সাক্ষী: সঠিক খেয়াল নেই। ২০০৬ বা ২০০৭ সাল হতে পারে।
আইনজীবী: তার জানাজা নামাজ মাওলানা সাঈদী সাহেব পড়িয়েছিলেন?
সাক্ষী: না। স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেব পড়ান। তবে মারা যাবার খবর শুনে সাঈদী সাহেব গিয়েছিলেন।
আইনজীবী: আমি বলছি মাওলানা সাঈদী সাহেব জানাজা নামজ পড়িয়েছিলেন।
সাক্ষী: না। তিনি গেছেন সেটা মনে আছে আর জানাজা নামাজ পড়ালে তা দেখতামনা?
আইনজীবী: স্বাধীনতার আগে থেকেই সাঈদী সাহেবকে চিনতেন?
সাক্ষী: আমরা একই এলাকার লোক। সেই হিসেবে আগে থেকেই চিনতাম।
আইনজীবী: ওনার পিতার নাম (স্পষ্ট শোনা যায়নি)
সাক্ষী: মৌলভী ইউসুফ সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন।
আইনজীবী: পিরোজপুর অস্ত্রাগার থেকে কত তারিখে কত তারিখে আপনারা অস্ত্র নিলেন?
সাক্ষী: ২৭ মার্চ বিকাল তিনটায়। এনায়েত হোসেন খান, প্রতিমন্ত্রী ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল আব্দুল হাই, নুরুল ইসলাম মন্ডল আরো অনেকের উপস্থিতিতে অস্ত্র বিতরন করা হয়।
আইনজীবী: লে. জিয়াউদ্দিন তখন ছিলেন?
সাক্ষী: না।
আইনজীবী: অস্ত্র নেয়ার পর ট্রেজারির টাকা নিয়ে নেন?
সাক্ষী: আমি তখন ছিলামনা। শুনেছি অস্ত্র নেয়ার পর ট্রেজারির টাকা নেয়া হয়।
আইনজীবী: টাকা কারা নেয় তাদের দুয়েকজনের নাম বলতে পারবেন?
সাক্ষী: পরে শুনেছি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের শহীদ ফজলুল হক।
আইনজীবী: তিনি কবে শহীদ হন?
সাক্ষী: শহীদ ফজলুল হক টাকা নেয়ার পর প্রতিপক্ষের বাঁধার সম্মুখীন হন। কয়েকজন নিহত হন। ফজলুল হককে ধরে নিয়ে বলেশ্বর নদীর বেদিতে হত্যা করা হয়। ট্রেজারি থেকে টাকা নেয়ার সময় সংগ্রাম পরিষদের কেউ সেখানে ছিলেননা।
আইনজীবী: পারেরহাট ৮ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়?
সাক্ষী: সম্ভবত।
আইনজীবী: আপনি কবে পিরোজপুর ফিরে আসেন?
সাক্ষী: ডিসেম্বরের শেষের দিকে।
আইনজীবী: পারের হাট এলাকা মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে শত্রুমক্তি হয়?
সাক্ষী: পাকিস্তান বাহিনী চলে যাবার পর মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ন্ত্রনে নেয়।
আইনজীবী: মেজর জিয়াউদ্দিনের উপস্থিতিতে এবং তার নেতৃত্বে মুক্ত হয়েছিল কিনা?
সাক্ষী: আমার স্মরন নেই।
আইনজীবী: একইদিনে ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পিরোজপুর থানা দখল করে?
সাক্ষী: মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে। তবে শাহজাহান ওমর উপস্থিত ছিলেন কি-না তা স্মরন নেই।
আইনজীবী: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যারা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পর পিরোজপুর ও অন্যান্য থানায় মামলা হয়।
সাক্ষী: আমার জানা নেই।
আইনজীবী: আপনিসহ যারা পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন তারা কেউ মামলার উদ্যোগ নেননি?
সাক্ষী: আমি নিজে কোন উদ্যোগ নেইনি।
আইনজীবী: বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আছে।
সাক্ষী: চারদলীয় জোট সরকারের সময় যে তালিকা হয় তা এখনো বাতিল হয়নি। সে তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারে।
আইনজীবী: সুলতান আহম্মদ হাওলাদার, পিতা হোসেন আলী হাওলাদার এবং মানিক পসরী পিতা সইজুদ্দীন পসারী। তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং আপনার সাথে সুন্দরবন থেকে পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়- এ মর্মে আপনি প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন তাদের?
সাক্ষী: হ্যা।
আইনজীবী: সিভিলিয়ানদের গোয়েন্দা দায়িত্ব দেয়ার সময় কোন প্রশিক্ষন দিয়েছিলেন?
সাক্ষী: আমার জানা নেই।
আইনজীবী: যাদের আপনি গোয়েন্দা দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারা কি আপনাকে রিপোর্ট দিত?
সাক্ষী: আমাকে পেলে আমাকে দিত। জিয়াউদ্দিনকে পেলে তাকে দিত।
আইনজীবী: আপনি কখনো এ জাতীয় গোয়েন্দা রিপোর্ট পেয়েছেন কি-না বা আপনার কাছে কেউ গেছে কি-না?
সাক্ষী: হ্যা।
আইনজীবী: এই গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং রিপোর্ট প্রদানের জন্য আলাদা একটি ইউনিট ছিল?
সাক্ষী: আমার জানামতে এ জাতীয় আলাদা কোন ইউনিট ছিলনা।
আইনজীবী: সুন্দরবন হেডকোয়ার্টার কি নদীতে না স্থলে ছিল?
সাক্ষী: প্রথমে নৌকায় পরে স্থলে ক্যাম্প করা হয়।
আইনজীবী: আপনি আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার সময় বলেছেন, “পারের হাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আসার পরে যেহেতু তারা উর্দুভাষী ছিলেন তাই তারা নাকি সাঈদী সাহেবকে তাদের সাথে অন্তর্ভুক্ত করেন ভাষার সুবিধার জন্য”। এই কথাগুলো আপনি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দীতে বলেননি।
সাক্ষী: সত্য নয়।
আইনজীবী: “আমি আমাদের সোর্সের মাধ্যমে শুনেছি মদন সাহার ঘরটি লুট হয় । সে ঘরটি লুট করে সাঈদী সাহেব তার শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে রাখেন।” এ কথাগুলোই আপনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আগে বলেননি।
সাক্ষী: বলেছি।
আইনজীবী: “যুদ্ধকালীন সময়ে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে শুনেছি লুটের মালামাল নিয়ে পাস তহবিলের একটি দোকান হয় । যুদ্ধের পরেও একথা শুনেছি। সেই পাস তহবিলের ট্রেজারির দায়িত্ব পালন করেন সাঈদী সাহেব”। একথাগুলোই আপনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আগে বলেননি।
সাক্ষী: বলেছি।
আইনজীবী: পাড়েরহাট এলাকা হিন্দু অধ্যূসিত এলাকা হওয়ায় ও ছাত্রলীগ আওয়ামীলীগের সমর্থকের সংখ্যাধিক্য থাকায় ঐ এলাকায় লুটপাট, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটেছিল। যুদ্ধকালীন সময় আমার নিজ ইউনিয়ন শংকরপাশার বাদুরা, চিথলিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম, রইজ্দ্দুীন পসারী, সইজুদ্দিন পসারী, মানিক পসারীসহ হিন্দু পাড়া একদিনে একটানা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা পুড়িয়ে দিয়েছিল । ঐ পোড়া বাড়িঘর আমি স্বাধীনতার পরে এসে দেখেছি। দানেশ মোল্লা, সেকান্দার শিকদার, শুনেছি সাঈদী সাহেবও তাদের সাথে ছিলেন এবং তারা পাড়েরহাট এলাকার ভিন্ন ইউনিয়নের লোক হওয়া সত্ত্বেও এতবেশি উৎসাহী ছিল যে, আমাদের ভিন্ন ইউনিয়নে শংকরপাশাতে এসেও লুটপাট, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি সংগঠন করে। গোয়েন্দাদের মাধ্যমে শুনেছি একথা।
এ বক্তব্যও আপনি আগে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেননি।
সাক্ষী: সত্য নয়।
আইনজীবী: আপনি যেহেতু আওয়ামী লীগের এমপি। মাওলানা সাঈদী সাহেব ভিন্ন মতাদর্শী রাজনৈতিক দলের সদস্য। তাই আপনি সরকারী সহযোগিতায় মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে এ মিথ্যা মামলা করিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছেন তার বিরুদ্ধে।
সাক্ষী: সত্য নয়।
এমিপ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ কে এম এ আউয়ালের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মাওলানা সাঈদী। এমপি আউয়াল মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে জবানবন্দীতে অন্যান্য সাক্ষীর মত হত্যা, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগ, লুটাপাট বিষয়ে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ না করায় জেরার সময় তাকে এ বিষয়ে তেমন কোন প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা। অন্যান্য সাক্ষী যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তার সত্যতা যাচাই চেষ্টার লক্ষ্যে এমপি আউয়ালকে কিছু প্রশ্ন করেন আইনজীবীরা। গতকাল বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে এমপিকে জেরা করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী। জেরার সময় হাশিখুসী মুডে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন এমপি আউয়াল। মাঝেমধ্যে তিনি রসিকতাপূর্ণ মন্তব্যও করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের লক্ষ্য করে।
এমপি আউয়ালকে জেরা করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম, মনজুর আহমদ আনছারী, কফিল উদ্দিন চৌধুরী। তাদের সহায়তা করেন তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মুন্সী আহসান কবির, ব্যারিস্টার তানভির আল আমিন, এস এম শাহজাহান কবীর প্রমুখ ।
আজ ১৩ তম সাক্ষীর জবানবন্দী প্রদানের কথা রয়েছে।
এমপি এ কে এম এ আউউয়ালের জেরায় স্বীকার করেছেন এই মামলার অপর দুই সাক্ষী সুলতান আহম্মেদ হাওলাদার এবং মানিক পসারীকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা আখ্যায়িত করে প্রত্যয়ন পত্র দিয়েছেন । এই দুই সাক্ষী এর আগে আদালতে জেরার সময় স্বীকারে করেছেন তারা কেউ মুক্তিযোদ্ধা নন। এছাড়া মফিজ উদ্দিন পসারী নামে আরো এক সাক্ষী আদালতে স্বীকারে করেছেন তিনিও মুক্তিযোদ্ধা নন। তবে এমপি এ কে এম এ আউয়ালের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যয়ন পত্র নিয়েছেন।
এই তিনজনের প্রত্যেককেই মামলা শুরুর পর ২০১০ সালে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়। প্রত্যয়ন পত্র প্রদানের তারিখও একই, ১৩/৯/২০১০। গতকাল এ প্রত্যয়নপত্র আদালতে উপস্থাপন করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী। প্রত্যয়নপত্রের ফটোকপি এমপি আউয়ালকেও দেয়া হয়। তিনজনেরই প্রত্যয়নপত্রে লেখা রয়েছে “সে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করিয়া আমার সাথে থাকিয়া সুন্দরবন এলাকায় বীরত্বের সাথে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করিয়াছে। ”
মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যয়নপত্র গ্রহণ বিষয়ে জেরার সময় উক্ত সাক্ষীদের কেউ কেউ বলেছিলেন তারা মুক্তিযোদ্ধাদের খায় খেদমত করেছেন। কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের আউগানি পাউছানি করেছেন। সেজন্য সহায়ক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হবার জন্য দরখাস্ত করেছিলেন এবং প্রত্যয়নপ্রত নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।
এছাড়া আব্দুল জলিল শেখ নামে আরো একজন সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হবার জন্য দরখাস্ত করেছেন বলে স্বীকার করেছেন জেরায়।
ট্রাইব্যুালে অধ্যাপক গোলাম আযম বিষয়ে আদেশ প্রদানের পর ১২টার দিকে সাক্ষী এমপি এ কে এম এ আউয়ালের অসমাপ্ত জেরা শুরু হয়।
এমপি আউয়ালের অসমাপ্ত জেরা:
আইনজীবী: সুন্দরবন ফরেস্ট অফিসে কবে ক্যাম্প করলেন?
সাক্ষী: ভারতে যাবার আগে জুলাই মাসের শেষ দিকে বা মাঝামাঝি সময়ে ।
আইনজীবী: আলাদা সাবসেক্টরে উন্নীত হবার আগে ঐ ক্যাম্প কোন সেক্টর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত?
সাক্ষী: ৯ নং সেক্টর।
আইনজীবী: ৯ নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর আব্দুল জলিল।
সাক্ষী: মেজর জলিল, জয়নাল আবেদন, মেজর মনজুর কাদের বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করেছেন । ৮ নং সেক্টর কমান্ডার মনজুর কাদের মাঝে মাঝে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন ৯ নং সেক্টরের।
আইনজীবী: সুন্দরবন ক্যাম্প সাব সেক্টরে উন্নীত হবার সময় ৯ নং সেক্টর কমান্ডার কে ছিলেন?
সাক্ষী: মেজর জলিল।
আইনজীবী: ৯ নং সেক্টর ক্যাম্প কোথায় ছিল?
সাক্ষী: ভারতের টাকি। জেলার নাম মনে নেই।
আইনজীবী: সেক্টর কমান্ড অফিসে কখনো গেছেন?
সাক্ষী: অনেকবার গেছি। অস্ত্র আনতেই তো যেতে হয়।
আইনজীবী: মুক্তিযুদ্ধের সময় সিভিলিয়ান গোয়েন্দারা সম্পূর্ণ পিরোজপুর এলাকার রাজাকার আল বদর আল শামস এসব বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অপকর্মসহ সামরিক বিষয়ে খবরাখবর আপনাদের দিত?
সাক্ষী: হ্যা।
আইনজীবী: মাহবুবুর রহমান সাধু নামে আনপার একজন ভাই ছিলেন?
সাক্ষী: হ্যা।
আইনজীবী: তিনি ২০০৮ সালে মারা যান?
সাক্ষী: সঠিক খেয়াল নেই। ২০০৬ বা ২০০৭ সাল হতে পারে।
আইনজীবী: তার জানাজা নামাজ মাওলানা সাঈদী সাহেব পড়িয়েছিলেন?
সাক্ষী: না। স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেব পড়ান। তবে মারা যাবার খবর শুনে সাঈদী সাহেব গিয়েছিলেন।
আইনজীবী: আমি বলছি মাওলানা সাঈদী সাহেব জানাজা নামজ পড়িয়েছিলেন।
সাক্ষী: না। তিনি গেছেন সেটা মনে আছে আর জানাজা নামাজ পড়ালে তা দেখতামনা?
আইনজীবী: স্বাধীনতার আগে থেকেই সাঈদী সাহেবকে চিনতেন?
সাক্ষী: আমরা একই এলাকার লোক। সেই হিসেবে আগে থেকেই চিনতাম।
আইনজীবী: ওনার পিতার নাম (স্পষ্ট শোনা যায়নি)
সাক্ষী: মৌলভী ইউসুফ সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন।
আইনজীবী: পিরোজপুর অস্ত্রাগার থেকে কত তারিখে কত তারিখে আপনারা অস্ত্র নিলেন?
সাক্ষী: ২৭ মার্চ বিকাল তিনটায়। এনায়েত হোসেন খান, প্রতিমন্ত্রী ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল আব্দুল হাই, নুরুল ইসলাম মন্ডল আরো অনেকের উপস্থিতিতে অস্ত্র বিতরন করা হয়।
আইনজীবী: লে. জিয়াউদ্দিন তখন ছিলেন?
সাক্ষী: না।
আইনজীবী: অস্ত্র নেয়ার পর ট্রেজারির টাকা নিয়ে নেন?
সাক্ষী: আমি তখন ছিলামনা। শুনেছি অস্ত্র নেয়ার পর ট্রেজারির টাকা নেয়া হয়।
আইনজীবী: টাকা কারা নেয় তাদের দুয়েকজনের নাম বলতে পারবেন?
সাক্ষী: পরে শুনেছি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের শহীদ ফজলুল হক।
আইনজীবী: তিনি কবে শহীদ হন?
সাক্ষী: শহীদ ফজলুল হক টাকা নেয়ার পর প্রতিপক্ষের বাঁধার সম্মুখীন হন। কয়েকজন নিহত হন। ফজলুল হককে ধরে নিয়ে বলেশ্বর নদীর বেদিতে হত্যা করা হয়। ট্রেজারি থেকে টাকা নেয়ার সময় সংগ্রাম পরিষদের কেউ সেখানে ছিলেননা।
আইনজীবী: পারেরহাট ৮ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়?
সাক্ষী: সম্ভবত।
আইনজীবী: আপনি কবে পিরোজপুর ফিরে আসেন?
সাক্ষী: ডিসেম্বরের শেষের দিকে।
আইনজীবী: পারের হাট এলাকা মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে শত্রুমক্তি হয়?
সাক্ষী: পাকিস্তান বাহিনী চলে যাবার পর মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ন্ত্রনে নেয়।
আইনজীবী: মেজর জিয়াউদ্দিনের উপস্থিতিতে এবং তার নেতৃত্বে মুক্ত হয়েছিল কিনা?
সাক্ষী: আমার স্মরন নেই।
আইনজীবী: একইদিনে ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পিরোজপুর থানা দখল করে?
সাক্ষী: মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে। তবে শাহজাহান ওমর উপস্থিত ছিলেন কি-না তা স্মরন নেই।
আইনজীবী: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যারা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পর পিরোজপুর ও অন্যান্য থানায় মামলা হয়।
সাক্ষী: আমার জানা নেই।
আইনজীবী: আপনিসহ যারা পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন তারা কেউ মামলার উদ্যোগ নেননি?
সাক্ষী: আমি নিজে কোন উদ্যোগ নেইনি।
আইনজীবী: বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আছে।
সাক্ষী: চারদলীয় জোট সরকারের সময় যে তালিকা হয় তা এখনো বাতিল হয়নি। সে তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারে।
আইনজীবী: সুলতান আহম্মদ হাওলাদার, পিতা হোসেন আলী হাওলাদার এবং মানিক পসরী পিতা সইজুদ্দীন পসারী। তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং আপনার সাথে সুন্দরবন থেকে পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়- এ মর্মে আপনি প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন তাদের?
সাক্ষী: হ্যা।
আইনজীবী: সিভিলিয়ানদের গোয়েন্দা দায়িত্ব দেয়ার সময় কোন প্রশিক্ষন দিয়েছিলেন?
সাক্ষী: আমার জানা নেই।
আইনজীবী: যাদের আপনি গোয়েন্দা দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারা কি আপনাকে রিপোর্ট দিত?
সাক্ষী: আমাকে পেলে আমাকে দিত। জিয়াউদ্দিনকে পেলে তাকে দিত।
আইনজীবী: আপনি কখনো এ জাতীয় গোয়েন্দা রিপোর্ট পেয়েছেন কি-না বা আপনার কাছে কেউ গেছে কি-না?
সাক্ষী: হ্যা।
আইনজীবী: এই গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং রিপোর্ট প্রদানের জন্য আলাদা একটি ইউনিট ছিল?
সাক্ষী: আমার জানামতে এ জাতীয় আলাদা কোন ইউনিট ছিলনা।
আইনজীবী: সুন্দরবন হেডকোয়ার্টার কি নদীতে না স্থলে ছিল?
সাক্ষী: প্রথমে নৌকায় পরে স্থলে ক্যাম্প করা হয়।
আইনজীবী: আপনি আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার সময় বলেছেন, “পারের হাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আসার পরে যেহেতু তারা উর্দুভাষী ছিলেন তাই তারা নাকি সাঈদী সাহেবকে তাদের সাথে অন্তর্ভুক্ত করেন ভাষার সুবিধার জন্য”। এই কথাগুলো আপনি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দীতে বলেননি।
সাক্ষী: সত্য নয়।
আইনজীবী: “আমি আমাদের সোর্সের মাধ্যমে শুনেছি মদন সাহার ঘরটি লুট হয় । সে ঘরটি লুট করে সাঈদী সাহেব তার শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে রাখেন।” এ কথাগুলোই আপনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আগে বলেননি।
সাক্ষী: বলেছি।
আইনজীবী: “যুদ্ধকালীন সময়ে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে শুনেছি লুটের মালামাল নিয়ে পাস তহবিলের একটি দোকান হয় । যুদ্ধের পরেও একথা শুনেছি। সেই পাস তহবিলের ট্রেজারির দায়িত্ব পালন করেন সাঈদী সাহেব”। একথাগুলোই আপনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আগে বলেননি।
সাক্ষী: বলেছি।
আইনজীবী: পাড়েরহাট এলাকা হিন্দু অধ্যূসিত এলাকা হওয়ায় ও ছাত্রলীগ আওয়ামীলীগের সমর্থকের সংখ্যাধিক্য থাকায় ঐ এলাকায় লুটপাট, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটেছিল। যুদ্ধকালীন সময় আমার নিজ ইউনিয়ন শংকরপাশার বাদুরা, চিথলিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম, রইজ্দ্দুীন পসারী, সইজুদ্দিন পসারী, মানিক পসারীসহ হিন্দু পাড়া একদিনে একটানা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা পুড়িয়ে দিয়েছিল । ঐ পোড়া বাড়িঘর আমি স্বাধীনতার পরে এসে দেখেছি। দানেশ মোল্লা, সেকান্দার শিকদার, শুনেছি সাঈদী সাহেবও তাদের সাথে ছিলেন এবং তারা পাড়েরহাট এলাকার ভিন্ন ইউনিয়নের লোক হওয়া সত্ত্বেও এতবেশি উৎসাহী ছিল যে, আমাদের ভিন্ন ইউনিয়নে শংকরপাশাতে এসেও লুটপাট, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি সংগঠন করে। গোয়েন্দাদের মাধ্যমে শুনেছি একথা।
এ বক্তব্যও আপনি আগে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেননি।
সাক্ষী: সত্য নয়।
আইনজীবী: আপনি যেহেতু আওয়ামী লীগের এমপি। মাওলানা সাঈদী সাহেব ভিন্ন মতাদর্শী রাজনৈতিক দলের সদস্য। তাই আপনি সরকারী সহযোগিতায় মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে এ মিথ্যা মামলা করিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছেন তার বিরুদ্ধে।
সাক্ষী: সত্য নয়।
এমিপ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ কে এম এ আউয়ালের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মাওলানা সাঈদী। এমপি আউয়াল মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে জবানবন্দীতে অন্যান্য সাক্ষীর মত হত্যা, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগ, লুটাপাট বিষয়ে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ না করায় জেরার সময় তাকে এ বিষয়ে তেমন কোন প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা। অন্যান্য সাক্ষী যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তার সত্যতা যাচাই চেষ্টার লক্ষ্যে এমপি আউয়ালকে কিছু প্রশ্ন করেন আইনজীবীরা। গতকাল বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে এমপিকে জেরা করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী। জেরার সময় হাশিখুসী মুডে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন এমপি আউয়াল। মাঝেমধ্যে তিনি রসিকতাপূর্ণ মন্তব্যও করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের লক্ষ্য করে।
এমপি আউয়ালকে জেরা করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম, মনজুর আহমদ আনছারী, কফিল উদ্দিন চৌধুরী। তাদের সহায়তা করেন তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মুন্সী আহসান কবির, ব্যারিস্টার তানভির আল আমিন, এস এম শাহজাহান কবীর প্রমুখ ।
আজ ১৩ তম সাক্ষীর জবানবন্দী প্রদানের কথা রয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন