৮/৯/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ২০ তম সাক্ষী হিসেবে আজ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী দিয়েছেন তহুরুল আলম মোল্লা (৬২)। তার জবানবন্দী গ্রহণ শেষে ট্রাইব্যুনাল সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো : আলীকে প্রশ্ন করেন কত নম্বর চার্জের ওপর এই সাক্ষীর জবানবন্দী দেয়ালেন। জবানবন্দী দেয়ার সময় আমি খোঁজার চেষ্টা করলাম কোন অভিযোগের ওপর সাক্ষী জবানবন্দী দিচ্ছেন। কিন্তু খুঁজে পেলামনা কোথাও। আপনি বলেন, কোন চার্জের ওপর আপনি এই সাক্ষীর জবানবন্দী নিলেন।
জবাবে মো : আলী বলেন, মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে পাঁচ নং অভিযোগের ওপর এই সাক্ষীর জবানবন্দী নেয়া হয়েছে।
বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন চার্জ দেখে বলেন, কোথায়, পাঁচ নং অভিযোগের সাথে তো এর কোন মিল আমি দেখতে পাচ্ছিনা।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো : আলী বলেন, সাক্ষী ঈশ্বরদী জামে মসজিদে হত্যাকান্ড বিষয়ে জবানবন্দী দিয়েছে।
বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, তাতো বুঝলাম। কিন্তু কোন চার্জের ওপর জবানবন্দী দিয়েছে? এটা চার্জে আছে কোথায়?
কিন্তু এরপরও মো: আলী নির্দিষ্ট কোন চার্জ এর নাম না বলে জানান সাক্ষী ঈশ্বরদী জামে মসজিদ ঘটনা বিষয়ে জবানবন্দী দিয়েছেন।
তখন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আগামীকাল আপনি আমাকে বলবেন সাক্ষী কোন চার্জের ওপর জবানবন্দী দিয়েছেন।
মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়েছে।
জবানবন্দী : আমার নাম আলহাজ্ব তহুরুল আলম মোল্লা। আমার বয়স ৬২ বৎসর। আমার ঠিকানা সাং- শেরশাহ রোড, থানা- ঈশ্বরদী, জেলা- পাবনা।
বর্তমানে আমি একজন ব্যবসায়ী। ঈশ্বরদী বাজারে আমার বেকারীর দোকান আছে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে আমি ঈশ্বরদী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। সেই সময় কলেজের নাম ছিল জিন্নাহ কলেজ। ১৯৭১ সালে আমরা শেরশাহ রোডের বাড়িতে থাকতাম। ১৯৭০ সালে আমি যখন ঈশ্বরদী কলেজের ছাত্র ছিলাম তখন নির্বাচন হয়। ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও ন্যাপ মোজাফফর অংশ গ্রহন করে, যাদের নির্বাচনী প্রতীক ছিল যথাক্রমে নৌকা, দাঁড়িপাল্লা ও কুড়েঘর। ঐ সময় আমি কলেজ শাখার ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। সেই হিসাবে আমি আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা প্রতীকে কাজ করতাম। সেই সুবাদে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন জায়গায় সভা করে। জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী জনসভায় ঘোষনা করা হলো ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সাহেব বক্তৃতা করবেন। তখন আমি তার বক্তৃতা শুনি।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন, অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। তারপর আমরা বাশের লাঠি এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করে পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ রাতে পাকিস্তান আর্মি, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্র সংঘের লোকজন নিয়ে আমাদের পাবনা শহরে পুলিশ লাইনসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আক্রমন করে। পাবনা পুলিশ লাইনে আক্রমন করলে পুলিশ লাইনের পুলিশ, আনসার ও আর্মির মধ্যে যারা বাঙ্গালী ছিল তারা প্রতিরোধ করে। এতে আমাদের লোকও মারা যায় পাক আর্মিদের লোকও মারা যায়। আমরা রাস্তাঘাটে বেরিকেট দেই এবং আমাদের প্রতিরোধী যুদ্ধের মুখে তারা টিকতে না পেরে তারা পিছু হটে। ঐ দিন আমাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ অনেক আর্মি নিহত হয় এবং ঈশ্বরদী এয়ারপোর্ট থেকে ১১ জন পাকিস্তান আর্মিকে ধরে এনে আমরা শেষ করি।
১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল আগ পর্যন্ত ঈশ্বরদীসহ পাবনা আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে রাখি। ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল পাকিস্তানী সৈন্যরা নতুনভাবে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নগরবাড়ি থেকে শুরু করে পাবনা শহর হয়ে ঈশ্বরদীতে প্রবেশ করে। ঐ সময় তাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ, নেজামে ইসলামের লোকজন তাদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং উল্লাশ প্রকাশ করে। ঈশ্বরদীতে অনেক বিহারী ছিল তারা পাক আর্মিদের সহিত যোগ দিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করল। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের পরে আমার মা ও ভাই-বোনদেরকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমার বাবা খুব ধার্মিক লোক ছিলেন, তিনি বাড়িতেই থেকে যান এবং আমাদেরকে সরে যেতে বললেন। তখন আমি বাড়ি থেকে গ্রামের দিকে চলে যাই। এরপরে আমি বাড়িতে এসে জানতে পারলাম যে, আমার বাবা, আমার ফুফাতো ভাই, ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে, মামা উনারা বাড়িতে টিকতে না পেরে আমাদের ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেয়। ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল বিকালের দিকে আমি আমার এক বন্ধু ফজলুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে বাবা, মামা ও ভাইদের খোজ করার জন্য কেন্দ্রীয় মসজিদের দিকে যাই। তখন ঐ মসজিদের পিছনে আমার বড় ফুফোর বাড়ি ছিল। ঐ মসজিদের পাশেই একটি পরিত্যক্ত বাড়ি ছিল। সেখানেই আমাদের ঈশ্বরদীর জামায়াতে ইসলামীর নেতা এম,পি,এ প্রার্থী ছিলেন খোদা বক্স খান, তিনি তার দলবল নিয়ে একটি অফিস খোলে। সেখান থেকে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে যারা আশ্রয় নিয়েছিল তাদেরকে হত্যা করার জন্য একটি লিস্ট করা হয়। আমি মসজিদ পর্যন্ত যেতে না পেরে খোদা বক্সের অফিসের ১০/১৫ হাত দূরে একজন বাঙ্গালীর বাড়িতে লোকজনের নিকট শুনতে পাই যে, পাকিস্তানী আর্মি ও একটি সাদা জীপে থাকা কিছু লোক আমার মামা হাবিবুর রহমানকে মসজিদ থেকে পশ্চিম পাশে কয়লার ডিপুতে নিয়ে হত্যা করে। পরে তাদের নিকট শুনি যে, তাদের মধ্যে ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা মতিউর রহমান নিজামী, সোবহান মাওলানা ও ইছহাক মাওলানাসহ আরো কিছু লোক খোদা বক্সের সাথে আলোচনা করে আমার মামাকে হত্যা করে। এই ঘটনার পর আমরা উখান থেকে গ্রামের ভিতরে চলে যাই। এরপর আমরা কয়েকদিন গ্রামের ভিতর থাকি।
এরপর আমার বাবা, ফুফাতো ভাই ও ফুফাতো ভাইয়ের ছেলেদেরকে না পেয়ে আবার আমি ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১ সাল বিকাল আনুমানিক ০৪.০০ ঘটিকার দিকে ঈশ্বরদী তাদের খোজে আসি। তখন আমরা অনুমান বিকাল ০৫.০০ ঘটিকার দিকে মসজিদের পিছনে আমার ফুফুর বাড়িতে পিছন দিক দিয়ে উঠি। তখন বাবার জন্য আমার মন কাদায় আমি আমার ঐ বন্ধুকে নিয়ে মসজিদের কাছে রেল লাইনের ধারে এবং কয়লার ডিপুর কাছে কিছু জঙ্গল ও গাছগাছলা আছে সেখানে লুকাই। আমাদের ঐ আশ্রয়ের জায়গা থেকে খোদা বক্সের ঐ অফিস যেটা টর্চার সেল করা হয়েছিল তা থেকে ১০/১৫ হাত দূরে ছিল। সেখান থেকে আমরা দেখতে পেলাম একটি আর্মির গাড়ি ও একটি সাদা জীপ মসজিদ ও টর্চার সেলের পাশে দাড়িয়ে আছে। তখন ঝোপের আড়াল থেকে তাকিয়ে দেখি গাড়ির পাশেই ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা মতিউর রহমান নিজামী, সোবহান মাওলানা ও ইছহাক মাওলানা খোদা বক্সের সাথে কি যেন আলাপ আলোচনা করে। এরপর দেখি ঐখান থেকে কিছু লোক মসজিদে গিয়ে আমার বাবাকে টানতে টানতে নিয়ে আসে এবং অফিসের সামনে দিয়ে কয়লার ডিপুর পাশে নিয়ে যায় তাদের সঙ্গে কিছু বিহারীও ছিল। সেখানে চাকু এবং তলোয়ার দিয়ে কোপ দেয়, তখন আমার আব্বা আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার দেয়। এরপরও আমার আব্বাকে কোপাতে থাকে। এরপর আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়, আমার মনে হয়েছিল ঐখানে আমি আমার বাবার কাছে ছুটে যাই কিন্তু আমার বন্ধু আমার মুখ চেপে ধরে। এরপর আর্মির গাড়ি ও সাদা জীপ চলে যাওয়ার পর আমার বন্ধু আমাকে নিয়ে আমাদের গ্রামের দিকে চলে যায়। এরপর আমি আমার বাবার আর কোন সন্ধান পাই নাই, কারণ তখন ঈশ্বরদীতে ঢুকার কোন সুযোগ ছিল না। আসরের নামাজের পরপরই এই ঘটনাটি ঘটে। ঐখানেই ঐ ঘটনায় আমার বাবা মৃত্যুবরণ করেন।
এরপর আমি আমাদের বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর ৭/৮ জন নিয়ে মে মাসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করার জন্য কুষ্টিয়ার ভিতর দিয়ে ভারতের জলঙ্গী ক্যাম্পে ট্রেনিং নিতে যাই। সেখানে ১০/১২ দিন থাকার পর উচ্চ প্রশিক্ষনের জন্য শিলং-এর পানিঘাটাতে পাঠানো হয়। সেখানে আমরা ২১ দিন ট্রেনিং নেই। তারপর ১৯৭১ সালের জুন মাসে কোম্পানী কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম মন্টুর নেতৃত্বে ৬০/৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশে প্রবেশ করি এবং ঈশ্বরদীর বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় রাজাকারদের ক্যাম্প আক্রমন করি এবং বিভিন্ন ব্রীজ ভাঙ্গি ও বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেই। এই মামলার ঘটনা সম্পর্কে আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট ৪/৫ মাস আগে জবানবন্দি দিয়েছি। অত্র মামলার আসামী মতিউর রহমান নিজামী সাহেব অদ্য ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন (সনাক্তকৃত)।
জবানবন্দীর পর সাক্ষীকে একটি প্রশ্নের মাধ্যমে জেরা শুরু করেন অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। এরপর জেরা সোমবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
আসামী পক্ষে ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন, অ্যাডভোকেট তারিকুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আসাদ উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ২০ তম সাক্ষী হিসেবে আজ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী দিয়েছেন তহুরুল আলম মোল্লা (৬২)। তার জবানবন্দী গ্রহণ শেষে ট্রাইব্যুনাল সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো : আলীকে প্রশ্ন করেন কত নম্বর চার্জের ওপর এই সাক্ষীর জবানবন্দী দেয়ালেন। জবানবন্দী দেয়ার সময় আমি খোঁজার চেষ্টা করলাম কোন অভিযোগের ওপর সাক্ষী জবানবন্দী দিচ্ছেন। কিন্তু খুঁজে পেলামনা কোথাও। আপনি বলেন, কোন চার্জের ওপর আপনি এই সাক্ষীর জবানবন্দী নিলেন।
জবাবে মো : আলী বলেন, মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে পাঁচ নং অভিযোগের ওপর এই সাক্ষীর জবানবন্দী নেয়া হয়েছে।
বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন চার্জ দেখে বলেন, কোথায়, পাঁচ নং অভিযোগের সাথে তো এর কোন মিল আমি দেখতে পাচ্ছিনা।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো : আলী বলেন, সাক্ষী ঈশ্বরদী জামে মসজিদে হত্যাকান্ড বিষয়ে জবানবন্দী দিয়েছে।
বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, তাতো বুঝলাম। কিন্তু কোন চার্জের ওপর জবানবন্দী দিয়েছে? এটা চার্জে আছে কোথায়?
কিন্তু এরপরও মো: আলী নির্দিষ্ট কোন চার্জ এর নাম না বলে জানান সাক্ষী ঈশ্বরদী জামে মসজিদ ঘটনা বিষয়ে জবানবন্দী দিয়েছেন।
তখন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আগামীকাল আপনি আমাকে বলবেন সাক্ষী কোন চার্জের ওপর জবানবন্দী দিয়েছেন।
মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়েছে।
জবানবন্দী : আমার নাম আলহাজ্ব তহুরুল আলম মোল্লা। আমার বয়স ৬২ বৎসর। আমার ঠিকানা সাং- শেরশাহ রোড, থানা- ঈশ্বরদী, জেলা- পাবনা।
বর্তমানে আমি একজন ব্যবসায়ী। ঈশ্বরদী বাজারে আমার বেকারীর দোকান আছে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে আমি ঈশ্বরদী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। সেই সময় কলেজের নাম ছিল জিন্নাহ কলেজ। ১৯৭১ সালে আমরা শেরশাহ রোডের বাড়িতে থাকতাম। ১৯৭০ সালে আমি যখন ঈশ্বরদী কলেজের ছাত্র ছিলাম তখন নির্বাচন হয়। ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও ন্যাপ মোজাফফর অংশ গ্রহন করে, যাদের নির্বাচনী প্রতীক ছিল যথাক্রমে নৌকা, দাঁড়িপাল্লা ও কুড়েঘর। ঐ সময় আমি কলেজ শাখার ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। সেই হিসাবে আমি আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা প্রতীকে কাজ করতাম। সেই সুবাদে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন জায়গায় সভা করে। জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী জনসভায় ঘোষনা করা হলো ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সাহেব বক্তৃতা করবেন। তখন আমি তার বক্তৃতা শুনি।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন, অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। তারপর আমরা বাশের লাঠি এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করে পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ রাতে পাকিস্তান আর্মি, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্র সংঘের লোকজন নিয়ে আমাদের পাবনা শহরে পুলিশ লাইনসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আক্রমন করে। পাবনা পুলিশ লাইনে আক্রমন করলে পুলিশ লাইনের পুলিশ, আনসার ও আর্মির মধ্যে যারা বাঙ্গালী ছিল তারা প্রতিরোধ করে। এতে আমাদের লোকও মারা যায় পাক আর্মিদের লোকও মারা যায়। আমরা রাস্তাঘাটে বেরিকেট দেই এবং আমাদের প্রতিরোধী যুদ্ধের মুখে তারা টিকতে না পেরে তারা পিছু হটে। ঐ দিন আমাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ অনেক আর্মি নিহত হয় এবং ঈশ্বরদী এয়ারপোর্ট থেকে ১১ জন পাকিস্তান আর্মিকে ধরে এনে আমরা শেষ করি।
১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল আগ পর্যন্ত ঈশ্বরদীসহ পাবনা আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে রাখি। ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল পাকিস্তানী সৈন্যরা নতুনভাবে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নগরবাড়ি থেকে শুরু করে পাবনা শহর হয়ে ঈশ্বরদীতে প্রবেশ করে। ঐ সময় তাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ, নেজামে ইসলামের লোকজন তাদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং উল্লাশ প্রকাশ করে। ঈশ্বরদীতে অনেক বিহারী ছিল তারা পাক আর্মিদের সহিত যোগ দিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করল। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের পরে আমার মা ও ভাই-বোনদেরকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমার বাবা খুব ধার্মিক লোক ছিলেন, তিনি বাড়িতেই থেকে যান এবং আমাদেরকে সরে যেতে বললেন। তখন আমি বাড়ি থেকে গ্রামের দিকে চলে যাই। এরপরে আমি বাড়িতে এসে জানতে পারলাম যে, আমার বাবা, আমার ফুফাতো ভাই, ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে, মামা উনারা বাড়িতে টিকতে না পেরে আমাদের ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেয়। ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল বিকালের দিকে আমি আমার এক বন্ধু ফজলুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে বাবা, মামা ও ভাইদের খোজ করার জন্য কেন্দ্রীয় মসজিদের দিকে যাই। তখন ঐ মসজিদের পিছনে আমার বড় ফুফোর বাড়ি ছিল। ঐ মসজিদের পাশেই একটি পরিত্যক্ত বাড়ি ছিল। সেখানেই আমাদের ঈশ্বরদীর জামায়াতে ইসলামীর নেতা এম,পি,এ প্রার্থী ছিলেন খোদা বক্স খান, তিনি তার দলবল নিয়ে একটি অফিস খোলে। সেখান থেকে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে যারা আশ্রয় নিয়েছিল তাদেরকে হত্যা করার জন্য একটি লিস্ট করা হয়। আমি মসজিদ পর্যন্ত যেতে না পেরে খোদা বক্সের অফিসের ১০/১৫ হাত দূরে একজন বাঙ্গালীর বাড়িতে লোকজনের নিকট শুনতে পাই যে, পাকিস্তানী আর্মি ও একটি সাদা জীপে থাকা কিছু লোক আমার মামা হাবিবুর রহমানকে মসজিদ থেকে পশ্চিম পাশে কয়লার ডিপুতে নিয়ে হত্যা করে। পরে তাদের নিকট শুনি যে, তাদের মধ্যে ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা মতিউর রহমান নিজামী, সোবহান মাওলানা ও ইছহাক মাওলানাসহ আরো কিছু লোক খোদা বক্সের সাথে আলোচনা করে আমার মামাকে হত্যা করে। এই ঘটনার পর আমরা উখান থেকে গ্রামের ভিতরে চলে যাই। এরপর আমরা কয়েকদিন গ্রামের ভিতর থাকি।
এরপর আমার বাবা, ফুফাতো ভাই ও ফুফাতো ভাইয়ের ছেলেদেরকে না পেয়ে আবার আমি ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১ সাল বিকাল আনুমানিক ০৪.০০ ঘটিকার দিকে ঈশ্বরদী তাদের খোজে আসি। তখন আমরা অনুমান বিকাল ০৫.০০ ঘটিকার দিকে মসজিদের পিছনে আমার ফুফুর বাড়িতে পিছন দিক দিয়ে উঠি। তখন বাবার জন্য আমার মন কাদায় আমি আমার ঐ বন্ধুকে নিয়ে মসজিদের কাছে রেল লাইনের ধারে এবং কয়লার ডিপুর কাছে কিছু জঙ্গল ও গাছগাছলা আছে সেখানে লুকাই। আমাদের ঐ আশ্রয়ের জায়গা থেকে খোদা বক্সের ঐ অফিস যেটা টর্চার সেল করা হয়েছিল তা থেকে ১০/১৫ হাত দূরে ছিল। সেখান থেকে আমরা দেখতে পেলাম একটি আর্মির গাড়ি ও একটি সাদা জীপ মসজিদ ও টর্চার সেলের পাশে দাড়িয়ে আছে। তখন ঝোপের আড়াল থেকে তাকিয়ে দেখি গাড়ির পাশেই ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা মতিউর রহমান নিজামী, সোবহান মাওলানা ও ইছহাক মাওলানা খোদা বক্সের সাথে কি যেন আলাপ আলোচনা করে। এরপর দেখি ঐখান থেকে কিছু লোক মসজিদে গিয়ে আমার বাবাকে টানতে টানতে নিয়ে আসে এবং অফিসের সামনে দিয়ে কয়লার ডিপুর পাশে নিয়ে যায় তাদের সঙ্গে কিছু বিহারীও ছিল। সেখানে চাকু এবং তলোয়ার দিয়ে কোপ দেয়, তখন আমার আব্বা আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার দেয়। এরপরও আমার আব্বাকে কোপাতে থাকে। এরপর আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়, আমার মনে হয়েছিল ঐখানে আমি আমার বাবার কাছে ছুটে যাই কিন্তু আমার বন্ধু আমার মুখ চেপে ধরে। এরপর আর্মির গাড়ি ও সাদা জীপ চলে যাওয়ার পর আমার বন্ধু আমাকে নিয়ে আমাদের গ্রামের দিকে চলে যায়। এরপর আমি আমার বাবার আর কোন সন্ধান পাই নাই, কারণ তখন ঈশ্বরদীতে ঢুকার কোন সুযোগ ছিল না। আসরের নামাজের পরপরই এই ঘটনাটি ঘটে। ঐখানেই ঐ ঘটনায় আমার বাবা মৃত্যুবরণ করেন।
এরপর আমি আমাদের বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর ৭/৮ জন নিয়ে মে মাসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করার জন্য কুষ্টিয়ার ভিতর দিয়ে ভারতের জলঙ্গী ক্যাম্পে ট্রেনিং নিতে যাই। সেখানে ১০/১২ দিন থাকার পর উচ্চ প্রশিক্ষনের জন্য শিলং-এর পানিঘাটাতে পাঠানো হয়। সেখানে আমরা ২১ দিন ট্রেনিং নেই। তারপর ১৯৭১ সালের জুন মাসে কোম্পানী কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম মন্টুর নেতৃত্বে ৬০/৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশে প্রবেশ করি এবং ঈশ্বরদীর বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় রাজাকারদের ক্যাম্প আক্রমন করি এবং বিভিন্ন ব্রীজ ভাঙ্গি ও বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেই। এই মামলার ঘটনা সম্পর্কে আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট ৪/৫ মাস আগে জবানবন্দি দিয়েছি। অত্র মামলার আসামী মতিউর রহমান নিজামী সাহেব অদ্য ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন (সনাক্তকৃত)।
জবানবন্দীর পর সাক্ষীকে একটি প্রশ্নের মাধ্যমে জেরা শুরু করেন অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। এরপর জেরা সোমবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
আসামী পক্ষে ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন, অ্যাডভোকেট তারিকুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আসাদ উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন