10/9/2013
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে আজ ২১ তম সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ। জবানবন্দী শেষে সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় মামলার কার্যক্রম আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।
জবানবন্দী :
আমার নাম ইউসুফ আলী বিশ্বাস। আমার বয়স আনুমানিক ৬৭/৬৮ বৎসর। আমার ঠিকানা- গ্রাম-ভাড়ারা, থানা- পাবনা সদর, জেলা- পাবনা।
৩০-১২-১৯৭০ সালে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করি। চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে ০৬ মাসের ট্রেনিং কোর্স শুরু করি। তম্মধ্যে আনুমানিক ০৩ মাস ট্রেনিং নেই। ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ পাকিস্তান আর্মির মেজর কামাল সাহেব আমাদের বাঙ্গালী সৈনিকদের নিকট থেকে অস্ত্র জমা নিয়ে আমাদেরকে নিরস্ত্র করে। আমরা সাধারণ সৈনিক যারা আমরা অস্ত্র জমা দিয়েছিলাম কিন্তু আমাদের ওস্তাদরা তাদের অস্ত্র জমা দেয় নাই। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত্রি অনুমান ০১.০০টার দিকে পাকিস্তান আর্মিরা আমাদের বাঙ্গালী সৈনিকদের উপর আক্রমণ করে। এই আক্রমণে আমাদের কিছু বাঙ্গালী সৈনিক মারা যান, কিছু আহত হন এবং কিছু পাঞ্জাবীদের হাতে ধরা পড়ে। ঐ ইবিআরসিতে আমরা আড়াই হাজার বাঙ্গালী সৈনিক ছিলাম। নায়েক শফি এবং আমাদের উস্তাদদের নেতৃত্বে বাঙ্গালী সৈনিকরাও প্রতিরোধ আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকিস্তানী বেশ কিছু সৈনিক নিহত হয়। ইহাতে পাকিস্তান সৈনিকরা একটু পেছনে হটে। এই সময়ে আমাদের ওস্তাদরা আমাদের নির্দেশ দেয় যে, তোমরা রুম থেকে বের হয়ে আস্ত্রাগারে হামলা করো এবং অস্ত্র হাতে নাও এবং অস্ত্র হাতে নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। ঐ সময়ে আমরা প্রায় দুই থেকে আড়াই’শ বাঙ্গালী সৈনিক অস্ত্রাগারে ঢুকে অস্ত্র তুলে নেই। আমি নিজেও একটি লাইট মেশিন গান হাতে তুলে নেই। এরপর আমরা ওস্তাদদের নির্দেশে পাহাড়ের এক সাইডে গিয়ে অবস্থান নেই এবং ডিফেন্স লাগাই। এইভাবে যখন ভোর হয়ে যায় তখন পাকিস্তান আর্মিরা আমাদের দিকে এডভান্স হতে থাকে। তখন আমরা তাদের প্রতি পাল্টা আক্রমণ করি। এই আক্রমণ কিছুক্ষণ চলার পর আমাদের গোলাবারুদ শর্ট হয়ে গেলে আমাদের ওস্তাদরা ওখান থেকে আমাদেরকে পিছু হটে জীবন বাঁচাতে বলতে আমরা পিছু হটে যাই। ওখান থেকে আমরা সারাদিন না খেয়ে পায়ে হেটে ছলিমপুর চলে যাই। ওখান থেকে পরদিন সাম্পানে করে সন্দ্বিপ চলে যাই। সেই সময় আমরা তিন জন ছিলাম। ওখান থেকে আমরা জনগণের সাহায্যে ও সহযোগিতায় হাতিয়ায় চলে যাই। তারপর সেখানে রামগঞ্জ থানার পুলিশ অফিসার আমাদেরকে তাদের গাড়ি করে রামগঞ্জ থানায় নিয়ে যায়। তখনও আমাদের হাতে অস্ত্র ছিল। তখন ওসি সাহেবের অনুরোধে ওসি সাহেবের নিকট থানায় অস্ত্র জমা দেই এবং রাত্রে সেখানেই থাকি। ওসি সাহেব আমাদেরকে রাতে খাওয়া দাওয়া করান এবং সম্মানের সাথে রাখেন। এরপর ওসি সাহেবের ওখান থেকে চা নাস্তা খেয়ে পায়ে হেটে চাঁদপুর আসি। ওখান থেকে আমাদের কাছ থেকে একজন জামালপুরে চলে যায় আর আমরা নদী ও সড়ক পথে পাবনায় আমার নিজের গ্রামের বাড়িতে ৩০শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে গিয়ে পৌঁছি। দুই/চার দিন রেষ্ট নেওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের সাথে মিটিং করি এবং তাদের সহিত আলোচনা করি যে, কিভাবে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিয়া পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে তাড়িয়ে দেশকে স্বাধীন করবো। এইভাবে প্রায় বেশ কিছু দিন রাত্রি বেলায় বাড়ির দক্ষিণের চরে বাঙ্গালী যুবকদের সংঘটিত করি এবং ট্রেনিং দেই। পরবর্তীতে পাকিস্তান আর্মিরা নগরবাড়ি ঘাট দখল করে তারপরে পাবনা শহর দখল করে। পাবনায় কয়েক জায়গায় ক্যাম্প করার পরে পিস কমিটি গঠন করে। পরে সুবহান মাওলানা, মতিউর রহমান নিজামী ও ইছহাক মাওলানা এবং তাদের সংগঠনের লোক পিস কমিটি গঠন করে। এরপর তারা রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে। এরপরে তারা মহল্লায় মহল্লায় আওয়ামীলীগ নেতাদের, ইপিআর পুলিশদের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লিষ্ট করে পাকসেনাদের নিয়ে ঐ সব গ্রাম ঘিরে লিষ্ট ধরে আলাদা লাইন করে হত্যা করে এবং কিছু লোকদের ধরে নিয়ে যায় এবং তারা অগ্নিসংযোগ করে এবং নারী ধর্ষণ করে। এইভাবে প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হয়।
১৯৭১ সালের ৯ই জুন তারিখে আমার বন্ধু আরশেদ আলী, সেকেন্দার আলী ও কুদ্দুসদের মাধপুরের গ্রামের বাড়িতে যাই। সেখানে রাত্রে তাদেরকে ডেকে তাদের সঙ্গে আলোচনা করি। সেখানে আমরা আলোচনা করি যে, ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে ভারী অস্ত্রসহ দেশে ঢুকে পাকসেনা, রাজাকার ও আলবদরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শত্রুমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হবে। ঐ রাত্রি পুটিগাড়ায় আরশেদ আলী প্রামনিকের বাড়িতে অবস্থান করি। পরদিন ১০ই জুন সকাল ৭/৮টার দিকে আমরা মাধপুর বাজারে চা নাস্তা খেতে যাই। ঐ সময়ে পাবানার দিক থেকে দুইটি পাকিস্তানী আর্মির পিকআপ গাড়ি আসতে দেখি এবং ঐ গাড়ি দুটি মাধপুর মোড়ে এসে থামে। তখন আমি দেখতে পাই আর্মির সামনের পিকআপ গাড়িতে সামনের সিটে মেজর সাহেবের পাশে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব বসে আছেন। আরো দেখি যে, আর্মির ঐ পিকআপে পিছনের সিটে তিনজন বাঙ্গালী লোক চোখ বাধা অবস্থায় ছিল এবং আরো কিছু পাকিস্তানী সৈনিক তাদের পাশে বসা ছিল। সেই সময় আমার সঙ্গে চায়ের দোকানে কুদ্দুস ও আরশেদ আলী বসা ছিল। কিছুক্ষণ পরে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব সাথিয়ার রাস্তার দিকে ইশারা করেন। তখন পিকআপ গাড়ি দুটি সাথিয়ার রাস্তার দিকে যেতে থাকে। তারপর আনুমানিক ১৫/২০ মিনিট পরে ঐ সাথিয়া রাস্তায় ইছামতি নদীর পাড়ের দিক থেকে কয়েকটি গুলির শব্দ শুনতে পাই। তারপর চায়ের দোকানে বসে থাকা নিরাপদ মনে না করে আমরা তিনজনই পাশের একটি বাড়িতে খড়ির বেড়ার ঘরে গিয়ে লুকাই। তখন ওখান থেকে খড়ির বেড়া ফাক করে দেখতে থাকি গাড়ি দুটি আবার এদিকে আসে কিনা। ঐ গুলির শব্দের আনুমানিক ১০/১৫ মিনিট পরে দেখি যে, ঐ পিকআপ গাড়ি দুটি এদিকে পাবনার দিকে আসছে। ঐ গাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তখনও ঐ পিকআপ গাড়িতে মেজর সাহেবের পাশে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব বসা আছে। এরপর দেখি গাড়ি পাবনার দিকে চলে গেল। তখন আমরা যে বাড়িতে লুকিয়ে ছিলাম সেই বাড়ি থেকে দেখি যে, ঐ দুটি পিকআপ গাড়ি পাবনার দিকে চলে গেছে। তখন আমরা তিনজন আবার মাধপুর বাজারে গেলাম। এই সময় আশেপাশে থেকে কয়েকজন লোক ঐ বাজারে এসে তারা বলে যে, পাবনা থেকে আর্মিরা এসে ইছমতি নদীর পাড়ে মানুষ মেরে চলে গেল, চলো আমরা উখানে গিয়ে দেখি কি ঘটেছে। তখন আমরা তিনজন সহ ঐ স্থানীয় লোকজন নিয়ে ইছামতি নদীর ধার দিয়ে ঘটনাস্থলে যাই। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি যে, একটি গর্তের মধ্যে তিনজন বাঙ্গালীকে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বাধা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত অবস্থায় মৃত দেখতে পাই। তখন আমি গর্তের মধ্যে নেমে ঐ তিনজন বাঙ্গালীর চোখ থেকে কালো কাপড় খুলে দেখতে পাই যে, ঐ তিন জনের মধ্যে পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা কছিমুদ্দিন স্যারের লাশ ছিল। বাকী দুইজনের লাশ চিনতে পারি নাই। তখন ঐখানে স্থানীয় লোকজন বলাবলি করে যে, ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তান আর্মিদের নিয়ে এসে এই তিন জন লোককে মাইরা থুইয়া গেল। তখন আমি উপস্থিত লোকদেরকে ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক লাশ তিনটিকে দাফন করার কথা বলে আমরা তিনজন আবার মাধপুর বাজারে চলে যাই। এরপর ১৫ই জুন আমি আমার সঙ্গীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য ট্রেনিং নিতে ভারতে যাই এবং ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে লেঃ জাহাঙ্গীর সাহেবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করি এবং বিভিন্ন জায়গায় আর্মি ও রাজাকার আলবদরদের ক্যাম্পে অপারেশন করি। আমি এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দি প্রদান করি। আমি যে মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের কথা বলেছি তিনি অদ্য ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন (সনাক্তকৃত)।
জেরা ঃ
বর্তমানে আমি কালিবাড়িতে থাকি, এটি আমার চতুর্থ স্ত্রীর পিতার বাড়ি। আমি পঞ্চম শ্রেণী পাশ করেছি। আমি আমাদের গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেছি। আমার দাদার বাড়ি জহুরপুরের পাশে ললিপাড়া গ্রামে। আমি এই গ্রামে কোনদিন যাই নাই। আমাদের গ্রাম থেকে পাবনা জেলা স্কুল ৬ মাইল দূরে। আমার সহপাঠি শাহজাহান পাবনা জেলা স্কুলের ছাত্র ছিল। শাহজাহান সাহেব বর্তমানে জীবিত আছেন। তিনি এখনও শিক্ষকতা করেন। ১৯৭১ সালে পাবনা জেলা স্কুলের শরীরচর্চা শিক্ষককে আমি চিনতাম না। শাহজাহান সাহেব ১৯৭০ সালের আগে না পরে এস,এস,সি পাশ করেছেন তাহা আমি বলতে পারব না। শাহজাহান সাহেব পাবনা জেলা স্কুলে লেখাপড়া করাকালীন শহরেও থাকতেন এবং মাঝে মধ্যে গ্রামেও থাকতেন। আমি যখন সেনাবাহিনীতে যোগদান করি তখন আমার বয়স ছিল ২৪ বৎসর। আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হয়েছি। প্রভিডেন্ট ফান্ড ছাড়া অন্য কোন প্রকার সুযোগ সুবিধা পাই নাই। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে আমি বাড়িতে কৃষি কাজ করতাম। সেনাবাহিনীতে আমার সাথে পাবনার লোক ছিল। তার নাম নতুব আলী। আমরা আমাদের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গিয়ে পাহাড়ে থাকা অবস্থায় মেজর জিয়াউর রহমানের নাম শুনি নাই। ট্রেনিং থেকে যারা পালিয়ে যে যার মত পালিয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে কেউ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল কিনা তাহা আমি জানি না। পাহাড় থেকে রামগঞ্জ থানায় আসার পথে আমাদের সাথে কোন মুক্তিযোদ্ধার দেখা হয় নাই। আমরা যখন রামগঞ্জ থানায় পৌছাই তখন পাকিস্তান আর্মিরা সেখানে পৌছায় নাই। নগরবাড়ী ফেরী ঘাট ও লঞ্চ ঘাট পাশাপাশি। আমরা আরিচা থেকে লঞ্চযোগে নগরবাড়ি পৌছেছি। ঐ সময় ফেরি চলাচল করতে আমি দেখি নাই শুধু লঞ্চ চলাচল করতে দেখেছি। নগরবাড়ী ঘাটে পৌছে কোন পাকিস্তান আর্মি বা মুক্তিযোদ্ধা ছিল না। আমি নগরবাড়ি থেকে কাশিনাথপুর, পাবনা হয়ে নিজ বাড়ি যাই। ঐ সময় নগরবাড়ি থেকে পাবনা যাওয়ার একটি মাত্র রাস্তা ছিল। নিজ বাড়িতে আসার পর আমার গ্রামের মতিয়ার সর্দারের সাথে প্রথম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের বিষয়ে আলোচনা করি। বাড়িতে আসার পরে ১১ই এপ্রিল সময়কালের মধ্যে নগরবাড়ী ঘাট বা পাবনা শহরে যাই নাই, নিজ এলাকাতেই ছিলাম। এই সময়ের মধ্যে আমার নিকট কোন অস্ত্র ছিল না। এই সময়ের মধ্যে আমাদের এলাকায় স্বাধীনতা বিরোধী কোন তৎপরতা ছিল না। আমি শাহজাহান মাস্টারের নিকট থেকে চাইনিজ স্টেইন গান নিয়ে স্থানীয় লোকদের ট্রেনিং দিয়েছিলাম। যাদেরকে ট্রেনিং দিয়েছিলাম তাদের মধ্যে দুইজন আমার সঙ্গে ভারতে গিয়েছিল। আমি ভারতে যাওয়ার পূর্বে আমাদের গ্রামে আর্মি গিয়ে প্রায় দুইশ থেকে তিনশ লোককে হত্যা করে। আমাদের গ্রামে আর্মি আসার সম্ভাবনা দেখলে গ্রামের লোকজন আমাদের গ্রামের দক্ষিন দিকে চরে আশ্রয় নিত। আমি এপ্রিল মে মাসে আমার গ্রামের বাড়িতেই থাকতাম, তবে রাত্রে পালিয়ে থাকতাম। আতাইকুলার রঘুনাথপুরে আমার আত্মীয় আফসারের বাড়িতে মাঝে মধ্যে থাকতাম। মাধবপুরের নজরুলকে আমি চিনতাম। তিনি ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ করতেন, অধ্যাপক আবু সাঈদ সাহেবের সম্ভবত আত্মীয়। তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল না। তিনি জীবিত আছেন। আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে নিজস্ব জমিতে চর বলরামপুরে চাষাবাদ করতাম। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আর্মিদের গুলিতে শহীদ আব্দুল মজিদ আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল। ১৯৭১ সালে ৯ই জুনের আগে মাধপুর গ্রামে আমি যাই নাই। পাক আর্মির যে পিকআপ গাড়ি দুটি আমি দেখেছি সেই দুটি গাড়ি পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে মাধপুর মোড়ে এসে দাড়ায়। ঐ পিক আপ গাড়িতে ড্রাইভারের সিটের পাশে একটি বড় সিট ছিল তাহাতে একজনও বসা যায় দুইজনও বসা যায়। আমি আর্মিতে থাকা অবস্থায় আর্মির পিক আপ গাড়িতে আমি উঠেছি। আমি ড্রাইভারের সিট ও তার পাশের সিট ও তার পাশের সিট মেপে দেখি নাই, তবে ড্রাইভারের সিটের চেয়ে পাশের সিটটি বড়। পিকআপের উপর ও দুইপাশে ত্রিপল দিয়ে ঢাকা থাকতো, পিছন খোলা থাকতো। পিকআপ গাড়িতে বসা অবস্থায় আমি মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের মুখ দেখেছি। আমি চায়ের দোকানে দক্ষিন মুখ হয়ে বসেছিলাম। (চলবে)
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে আজ ২১ তম সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ। জবানবন্দী শেষে সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় মামলার কার্যক্রম আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।
জবানবন্দী :
আমার নাম ইউসুফ আলী বিশ্বাস। আমার বয়স আনুমানিক ৬৭/৬৮ বৎসর। আমার ঠিকানা- গ্রাম-ভাড়ারা, থানা- পাবনা সদর, জেলা- পাবনা।
৩০-১২-১৯৭০ সালে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করি। চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে ০৬ মাসের ট্রেনিং কোর্স শুরু করি। তম্মধ্যে আনুমানিক ০৩ মাস ট্রেনিং নেই। ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ পাকিস্তান আর্মির মেজর কামাল সাহেব আমাদের বাঙ্গালী সৈনিকদের নিকট থেকে অস্ত্র জমা নিয়ে আমাদেরকে নিরস্ত্র করে। আমরা সাধারণ সৈনিক যারা আমরা অস্ত্র জমা দিয়েছিলাম কিন্তু আমাদের ওস্তাদরা তাদের অস্ত্র জমা দেয় নাই। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত্রি অনুমান ০১.০০টার দিকে পাকিস্তান আর্মিরা আমাদের বাঙ্গালী সৈনিকদের উপর আক্রমণ করে। এই আক্রমণে আমাদের কিছু বাঙ্গালী সৈনিক মারা যান, কিছু আহত হন এবং কিছু পাঞ্জাবীদের হাতে ধরা পড়ে। ঐ ইবিআরসিতে আমরা আড়াই হাজার বাঙ্গালী সৈনিক ছিলাম। নায়েক শফি এবং আমাদের উস্তাদদের নেতৃত্বে বাঙ্গালী সৈনিকরাও প্রতিরোধ আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকিস্তানী বেশ কিছু সৈনিক নিহত হয়। ইহাতে পাকিস্তান সৈনিকরা একটু পেছনে হটে। এই সময়ে আমাদের ওস্তাদরা আমাদের নির্দেশ দেয় যে, তোমরা রুম থেকে বের হয়ে আস্ত্রাগারে হামলা করো এবং অস্ত্র হাতে নাও এবং অস্ত্র হাতে নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। ঐ সময়ে আমরা প্রায় দুই থেকে আড়াই’শ বাঙ্গালী সৈনিক অস্ত্রাগারে ঢুকে অস্ত্র তুলে নেই। আমি নিজেও একটি লাইট মেশিন গান হাতে তুলে নেই। এরপর আমরা ওস্তাদদের নির্দেশে পাহাড়ের এক সাইডে গিয়ে অবস্থান নেই এবং ডিফেন্স লাগাই। এইভাবে যখন ভোর হয়ে যায় তখন পাকিস্তান আর্মিরা আমাদের দিকে এডভান্স হতে থাকে। তখন আমরা তাদের প্রতি পাল্টা আক্রমণ করি। এই আক্রমণ কিছুক্ষণ চলার পর আমাদের গোলাবারুদ শর্ট হয়ে গেলে আমাদের ওস্তাদরা ওখান থেকে আমাদেরকে পিছু হটে জীবন বাঁচাতে বলতে আমরা পিছু হটে যাই। ওখান থেকে আমরা সারাদিন না খেয়ে পায়ে হেটে ছলিমপুর চলে যাই। ওখান থেকে পরদিন সাম্পানে করে সন্দ্বিপ চলে যাই। সেই সময় আমরা তিন জন ছিলাম। ওখান থেকে আমরা জনগণের সাহায্যে ও সহযোগিতায় হাতিয়ায় চলে যাই। তারপর সেখানে রামগঞ্জ থানার পুলিশ অফিসার আমাদেরকে তাদের গাড়ি করে রামগঞ্জ থানায় নিয়ে যায়। তখনও আমাদের হাতে অস্ত্র ছিল। তখন ওসি সাহেবের অনুরোধে ওসি সাহেবের নিকট থানায় অস্ত্র জমা দেই এবং রাত্রে সেখানেই থাকি। ওসি সাহেব আমাদেরকে রাতে খাওয়া দাওয়া করান এবং সম্মানের সাথে রাখেন। এরপর ওসি সাহেবের ওখান থেকে চা নাস্তা খেয়ে পায়ে হেটে চাঁদপুর আসি। ওখান থেকে আমাদের কাছ থেকে একজন জামালপুরে চলে যায় আর আমরা নদী ও সড়ক পথে পাবনায় আমার নিজের গ্রামের বাড়িতে ৩০শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে গিয়ে পৌঁছি। দুই/চার দিন রেষ্ট নেওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের সাথে মিটিং করি এবং তাদের সহিত আলোচনা করি যে, কিভাবে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিয়া পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে তাড়িয়ে দেশকে স্বাধীন করবো। এইভাবে প্রায় বেশ কিছু দিন রাত্রি বেলায় বাড়ির দক্ষিণের চরে বাঙ্গালী যুবকদের সংঘটিত করি এবং ট্রেনিং দেই। পরবর্তীতে পাকিস্তান আর্মিরা নগরবাড়ি ঘাট দখল করে তারপরে পাবনা শহর দখল করে। পাবনায় কয়েক জায়গায় ক্যাম্প করার পরে পিস কমিটি গঠন করে। পরে সুবহান মাওলানা, মতিউর রহমান নিজামী ও ইছহাক মাওলানা এবং তাদের সংগঠনের লোক পিস কমিটি গঠন করে। এরপর তারা রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে। এরপরে তারা মহল্লায় মহল্লায় আওয়ামীলীগ নেতাদের, ইপিআর পুলিশদের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লিষ্ট করে পাকসেনাদের নিয়ে ঐ সব গ্রাম ঘিরে লিষ্ট ধরে আলাদা লাইন করে হত্যা করে এবং কিছু লোকদের ধরে নিয়ে যায় এবং তারা অগ্নিসংযোগ করে এবং নারী ধর্ষণ করে। এইভাবে প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হয়।
১৯৭১ সালের ৯ই জুন তারিখে আমার বন্ধু আরশেদ আলী, সেকেন্দার আলী ও কুদ্দুসদের মাধপুরের গ্রামের বাড়িতে যাই। সেখানে রাত্রে তাদেরকে ডেকে তাদের সঙ্গে আলোচনা করি। সেখানে আমরা আলোচনা করি যে, ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে ভারী অস্ত্রসহ দেশে ঢুকে পাকসেনা, রাজাকার ও আলবদরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শত্রুমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হবে। ঐ রাত্রি পুটিগাড়ায় আরশেদ আলী প্রামনিকের বাড়িতে অবস্থান করি। পরদিন ১০ই জুন সকাল ৭/৮টার দিকে আমরা মাধপুর বাজারে চা নাস্তা খেতে যাই। ঐ সময়ে পাবানার দিক থেকে দুইটি পাকিস্তানী আর্মির পিকআপ গাড়ি আসতে দেখি এবং ঐ গাড়ি দুটি মাধপুর মোড়ে এসে থামে। তখন আমি দেখতে পাই আর্মির সামনের পিকআপ গাড়িতে সামনের সিটে মেজর সাহেবের পাশে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব বসে আছেন। আরো দেখি যে, আর্মির ঐ পিকআপে পিছনের সিটে তিনজন বাঙ্গালী লোক চোখ বাধা অবস্থায় ছিল এবং আরো কিছু পাকিস্তানী সৈনিক তাদের পাশে বসা ছিল। সেই সময় আমার সঙ্গে চায়ের দোকানে কুদ্দুস ও আরশেদ আলী বসা ছিল। কিছুক্ষণ পরে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব সাথিয়ার রাস্তার দিকে ইশারা করেন। তখন পিকআপ গাড়ি দুটি সাথিয়ার রাস্তার দিকে যেতে থাকে। তারপর আনুমানিক ১৫/২০ মিনিট পরে ঐ সাথিয়া রাস্তায় ইছামতি নদীর পাড়ের দিক থেকে কয়েকটি গুলির শব্দ শুনতে পাই। তারপর চায়ের দোকানে বসে থাকা নিরাপদ মনে না করে আমরা তিনজনই পাশের একটি বাড়িতে খড়ির বেড়ার ঘরে গিয়ে লুকাই। তখন ওখান থেকে খড়ির বেড়া ফাক করে দেখতে থাকি গাড়ি দুটি আবার এদিকে আসে কিনা। ঐ গুলির শব্দের আনুমানিক ১০/১৫ মিনিট পরে দেখি যে, ঐ পিকআপ গাড়ি দুটি এদিকে পাবনার দিকে আসছে। ঐ গাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তখনও ঐ পিকআপ গাড়িতে মেজর সাহেবের পাশে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব বসা আছে। এরপর দেখি গাড়ি পাবনার দিকে চলে গেল। তখন আমরা যে বাড়িতে লুকিয়ে ছিলাম সেই বাড়ি থেকে দেখি যে, ঐ দুটি পিকআপ গাড়ি পাবনার দিকে চলে গেছে। তখন আমরা তিনজন আবার মাধপুর বাজারে গেলাম। এই সময় আশেপাশে থেকে কয়েকজন লোক ঐ বাজারে এসে তারা বলে যে, পাবনা থেকে আর্মিরা এসে ইছমতি নদীর পাড়ে মানুষ মেরে চলে গেল, চলো আমরা উখানে গিয়ে দেখি কি ঘটেছে। তখন আমরা তিনজন সহ ঐ স্থানীয় লোকজন নিয়ে ইছামতি নদীর ধার দিয়ে ঘটনাস্থলে যাই। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি যে, একটি গর্তের মধ্যে তিনজন বাঙ্গালীকে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বাধা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত অবস্থায় মৃত দেখতে পাই। তখন আমি গর্তের মধ্যে নেমে ঐ তিনজন বাঙ্গালীর চোখ থেকে কালো কাপড় খুলে দেখতে পাই যে, ঐ তিন জনের মধ্যে পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা কছিমুদ্দিন স্যারের লাশ ছিল। বাকী দুইজনের লাশ চিনতে পারি নাই। তখন ঐখানে স্থানীয় লোকজন বলাবলি করে যে, ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তান আর্মিদের নিয়ে এসে এই তিন জন লোককে মাইরা থুইয়া গেল। তখন আমি উপস্থিত লোকদেরকে ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক লাশ তিনটিকে দাফন করার কথা বলে আমরা তিনজন আবার মাধপুর বাজারে চলে যাই। এরপর ১৫ই জুন আমি আমার সঙ্গীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য ট্রেনিং নিতে ভারতে যাই এবং ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে লেঃ জাহাঙ্গীর সাহেবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করি এবং বিভিন্ন জায়গায় আর্মি ও রাজাকার আলবদরদের ক্যাম্পে অপারেশন করি। আমি এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দি প্রদান করি। আমি যে মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের কথা বলেছি তিনি অদ্য ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন (সনাক্তকৃত)।
জেরা ঃ
বর্তমানে আমি কালিবাড়িতে থাকি, এটি আমার চতুর্থ স্ত্রীর পিতার বাড়ি। আমি পঞ্চম শ্রেণী পাশ করেছি। আমি আমাদের গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেছি। আমার দাদার বাড়ি জহুরপুরের পাশে ললিপাড়া গ্রামে। আমি এই গ্রামে কোনদিন যাই নাই। আমাদের গ্রাম থেকে পাবনা জেলা স্কুল ৬ মাইল দূরে। আমার সহপাঠি শাহজাহান পাবনা জেলা স্কুলের ছাত্র ছিল। শাহজাহান সাহেব বর্তমানে জীবিত আছেন। তিনি এখনও শিক্ষকতা করেন। ১৯৭১ সালে পাবনা জেলা স্কুলের শরীরচর্চা শিক্ষককে আমি চিনতাম না। শাহজাহান সাহেব ১৯৭০ সালের আগে না পরে এস,এস,সি পাশ করেছেন তাহা আমি বলতে পারব না। শাহজাহান সাহেব পাবনা জেলা স্কুলে লেখাপড়া করাকালীন শহরেও থাকতেন এবং মাঝে মধ্যে গ্রামেও থাকতেন। আমি যখন সেনাবাহিনীতে যোগদান করি তখন আমার বয়স ছিল ২৪ বৎসর। আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হয়েছি। প্রভিডেন্ট ফান্ড ছাড়া অন্য কোন প্রকার সুযোগ সুবিধা পাই নাই। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে আমি বাড়িতে কৃষি কাজ করতাম। সেনাবাহিনীতে আমার সাথে পাবনার লোক ছিল। তার নাম নতুব আলী। আমরা আমাদের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গিয়ে পাহাড়ে থাকা অবস্থায় মেজর জিয়াউর রহমানের নাম শুনি নাই। ট্রেনিং থেকে যারা পালিয়ে যে যার মত পালিয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে কেউ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল কিনা তাহা আমি জানি না। পাহাড় থেকে রামগঞ্জ থানায় আসার পথে আমাদের সাথে কোন মুক্তিযোদ্ধার দেখা হয় নাই। আমরা যখন রামগঞ্জ থানায় পৌছাই তখন পাকিস্তান আর্মিরা সেখানে পৌছায় নাই। নগরবাড়ী ফেরী ঘাট ও লঞ্চ ঘাট পাশাপাশি। আমরা আরিচা থেকে লঞ্চযোগে নগরবাড়ি পৌছেছি। ঐ সময় ফেরি চলাচল করতে আমি দেখি নাই শুধু লঞ্চ চলাচল করতে দেখেছি। নগরবাড়ী ঘাটে পৌছে কোন পাকিস্তান আর্মি বা মুক্তিযোদ্ধা ছিল না। আমি নগরবাড়ি থেকে কাশিনাথপুর, পাবনা হয়ে নিজ বাড়ি যাই। ঐ সময় নগরবাড়ি থেকে পাবনা যাওয়ার একটি মাত্র রাস্তা ছিল। নিজ বাড়িতে আসার পর আমার গ্রামের মতিয়ার সর্দারের সাথে প্রথম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের বিষয়ে আলোচনা করি। বাড়িতে আসার পরে ১১ই এপ্রিল সময়কালের মধ্যে নগরবাড়ী ঘাট বা পাবনা শহরে যাই নাই, নিজ এলাকাতেই ছিলাম। এই সময়ের মধ্যে আমার নিকট কোন অস্ত্র ছিল না। এই সময়ের মধ্যে আমাদের এলাকায় স্বাধীনতা বিরোধী কোন তৎপরতা ছিল না। আমি শাহজাহান মাস্টারের নিকট থেকে চাইনিজ স্টেইন গান নিয়ে স্থানীয় লোকদের ট্রেনিং দিয়েছিলাম। যাদেরকে ট্রেনিং দিয়েছিলাম তাদের মধ্যে দুইজন আমার সঙ্গে ভারতে গিয়েছিল। আমি ভারতে যাওয়ার পূর্বে আমাদের গ্রামে আর্মি গিয়ে প্রায় দুইশ থেকে তিনশ লোককে হত্যা করে। আমাদের গ্রামে আর্মি আসার সম্ভাবনা দেখলে গ্রামের লোকজন আমাদের গ্রামের দক্ষিন দিকে চরে আশ্রয় নিত। আমি এপ্রিল মে মাসে আমার গ্রামের বাড়িতেই থাকতাম, তবে রাত্রে পালিয়ে থাকতাম। আতাইকুলার রঘুনাথপুরে আমার আত্মীয় আফসারের বাড়িতে মাঝে মধ্যে থাকতাম। মাধবপুরের নজরুলকে আমি চিনতাম। তিনি ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ করতেন, অধ্যাপক আবু সাঈদ সাহেবের সম্ভবত আত্মীয়। তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল না। তিনি জীবিত আছেন। আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে নিজস্ব জমিতে চর বলরামপুরে চাষাবাদ করতাম। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আর্মিদের গুলিতে শহীদ আব্দুল মজিদ আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল। ১৯৭১ সালে ৯ই জুনের আগে মাধপুর গ্রামে আমি যাই নাই। পাক আর্মির যে পিকআপ গাড়ি দুটি আমি দেখেছি সেই দুটি গাড়ি পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে মাধপুর মোড়ে এসে দাড়ায়। ঐ পিক আপ গাড়িতে ড্রাইভারের সিটের পাশে একটি বড় সিট ছিল তাহাতে একজনও বসা যায় দুইজনও বসা যায়। আমি আর্মিতে থাকা অবস্থায় আর্মির পিক আপ গাড়িতে আমি উঠেছি। আমি ড্রাইভারের সিট ও তার পাশের সিট ও তার পাশের সিট মেপে দেখি নাই, তবে ড্রাইভারের সিটের চেয়ে পাশের সিটটি বড়। পিকআপের উপর ও দুইপাশে ত্রিপল দিয়ে ঢাকা থাকতো, পিছন খোলা থাকতো। পিকআপ গাড়িতে বসা অবস্থায় আমি মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের মুখ দেখেছি। আমি চায়ের দোকানে দক্ষিন মুখ হয়ে বসেছিলাম। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন