বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

জেরায় সাক্ষীর উত্তর নিয়ে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বাক বিতন্ডা

মেহেদী হাসান, ১২/৯/২০১৩
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (১) জেরায় সাক্ষীর একটি প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বাক বিতন্ডা এবং বিতর্ক সৃষ্টি হয়। আজ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর  বিরুদ্ধে ২২ তম সাক্ষীর জবানবন্দী শেষে জেরা শুরু হয়। জেরার শুরুতেই মাওলানা নিজামীর পক্ষে আইনজীবী মিজানুল ইসলাম সাক্ষীকে  প্রশ্ন করেন ‘ট্রাইব্যুনালে এসে কি সাক্ষ্য দিতে হবে, কোন ভাষায় কথা বলতে হবে তা আপনাকে লিখিতভাবে আগেই সরবরাহ করা হয়েছে এবং আপনি সেটা পড়ে এখানে সাক্ষ্য দিতে এসেছেন।’

এ প্রশ্ন করার সাথে সাথেই রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আলী দাড়িয়ে বলেন, এটা কেমন প্রশ্ন। এ প্রশ্ন করা যায় নাকি? এসময় সাক্ষীর দিকে তাকিয়ে মোহাম্মদ আলী আরো বলেন, আমরা আপনাকে শিখিয়ে এখানে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য নিয়ে এসেছি সেটা জানতে চাচ্ছে আপনার কাছে। এসব  বলে তিনি আপত্তি দিতে থাকেন।
এসময় আসামী পক্ষের আইনজীবীরাও মোহাম্মদ আলীর বিরোধীতা করতে থাকেন।
প্রশ্নটি করার পর সাক্ষী শাহজাহান আলী কাঠগড়ায় বসা অবন্থা থেকে দাড়ান।  এরপর মিজানুল ইসলাম আবারো তাকে প্রশ্নটি করেন। সাক্ষী তখন কাঠগড়ায় মিজানুল ইসলামের দিকে ঝুকে প্রশ্নটি বোঝার চেষ্টা করেন। প্রশ্নটি দ্বিতীয়বার করা হলে সাক্ষী  বলেন প্রশ্নটি তিনি বোঝেননি। এসময়ও রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রশ্নটির ব্যাপারে আপত্তি তোলা হতে থাকে।  এরপর পরিস্থিতি শান্ত হলে মিজানুল ইসলাম চতুর্থবার  একই প্রশ্ন করেন সাক্ষীকে। সাক্ষী তখন আস্তে করে বলেন, ‘জি’। একথা বলার সাথে সাথে মিজানুল ইসলামসহ আসামী পক্ষের অন্যান্য আইনজীবীরা বলেন সাক্ষী  ‘জি’ বলেছেন। এর পরপরই রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ  আলী দাড়িয়ে বলেন, সাক্ষী বোঝেননি। না বুঝে বলেছেন। এই জি সেই জি না। আমরা অনেক সময় কারো কথা শোনার সময় মাঝে মাঝে জি বলে থাকি। এটা সেই জি। সাক্ষী প্রশ্নের উত্তর হিসেবে জি বলেননি এখানে। সাক্ষীকে মিসলিড করা হয়েছে।
এরপর সাক্ষীও বলেন, তিনি প্রশ্নটি বোঝেননি।
এসময় দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষন বিতর্ক চলে।
মিজানুল ইসলাম বলেন, না বুঝে বলার প্রশ্নওই ওঠেনা। সাক্ষীকে তিনবার প্রশ্নটি করা হয়েছে। তিনি যতক্ষন পর্যন্ত বলেছেন প্রশ্নটি তিনি বোঝেননি ততক্ষন উত্তর দেননি। চতুর্থবার প্রশ্নটি করার পর তিনি যখন বুঝেছেন তখন তিনি উত্তর দিয়েছেন। এখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আপত্তি তোলার পর সাক্ষী বলছেন তিনি বোঝেননি।  না বুঝলে তিনি উত্তর দিলেন  কেন। তাছাড়া প্রশ্নটি করার পর  থেকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বারবার বাঁধা দিয়ে সাক্ষীকে সতর্ক করে দিয়েছেন। এরপরও সাক্ষী প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন ‘জি’।
মিজানুল ইসলাম বলেন, এভাবে যদি প্রশ্ন করার সময় বাঁধা আসে এবং সাক্ষীকে সতর্ক করে দেয়া হয় তাহলে আমাদের পক্ষে জেরা  চালিয়ে যাওয় সম্ভব নয়।

এসময় মাওলানা নিজামীর পক্ষে অপর আইনজীবী তাজুল ইসলাম দাড়িয়ে বলেন, আমাদের প্রশ্নটির উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বাঁধা দিয়ে। এভাবে বাঁধা আসলে জেরা করার কোন অর্থ থাকেনা। সাক্ষীকে চারবার প্রশ্ন করার পর সে বুঝে উত্তর দিয়েছেন। আর এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী যখন বলছেন সাক্ষী না বুঝে উত্তর দিয়েছে তখন সাক্ষীও তার সাথে সুর মিলিয়ে বলছেন তিনি প্রশ্ন বোঝেননি।
এভাবে কিছুক্ষন বিতর্ক করার পর ট্রাইব্যুনাল মিজানুল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি জেরা শুরু করেন। এ প্রশ্নটি আপনি পরে অন্যভাবে করতে পারবেন।
মিজানুল ইসলাম বলেন, সেটা আর হয়না। আমার প্রশ্নটা  এবং তার উত্তরে সাক্ষী যা বলেছেন তা রেকর্ড করা হোক। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। এখানে অডিও ভিডিও রেকডিংয়ের ব্যবস্থা আছে । আপনারা প্রয়োজনে রেকর্ড বাজিয়ে শুনতে পারেন । তাহলেই বুঝতে পারবেন সাক্ষী বুঝে বা না বুঝে উত্তর দিয়েছে কি-না।
তখন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সাক্ষী যেভাবে  আস্তে করে জবাব দিয়েছে তা মনে হয় রেকর্ডে আসেনি। তাছাড়া সাক্ষী প্রশ্ন করার সময় সম্পূর্ণরুপে আপনার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমরাও আসলে উত্তরটি শুনতে পাইনি। এসময় ট্রাইব্যুনালের অপর দুই বিচারপতিও উত্তরটি না শোনার কথা জানান।
চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির বলেন, আমরা আসলে কনফিউজড। আপনরা বলেছেন সে প্রথমে জি বলেছেন। এখন সাক্ষী বলছেন তিনি  প্রশ্নটি বোঝেননি। আমরা আসলে কনফিউজড।  মিজান সাহেব আপনি আবার জেরা শুরু করেন। বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির মিজানুল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সাক্ষী পঞ্চম শ্রেণী পাশ। এখানে এসে এম এ পাশ সাক্ষীও সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং আপনি তাকে জেরা করেছেন। অনেক সময় আমরা দেখেছি এম এ পাশ সাক্ষীও আপনার প্রশ্নে কনফিউজড হয়েছে। সাথে সাথে বুঝতে পারেননি কোন কোন  প্রশ্ন। তাই আমরা বলছি আপনি জেরা শুরু করেন। যে প্রশ্নটি করেছেন তা পরে আপনি অন্যভাবেও করতে পারবেন।

এসময় মিজানুল ইসলাম বলেন, কনফিউজড হওয়ার যে বিষয়টি বললেন তার সাথে আমি একমত হতে পারলামনা। প্রশ্নটি সাক্ষীকে চারবার করা হয়েছে। সে বুঝে শুনেই উত্তর দিয়েছে।

এসময় তাজুল ইসলাম বলেন, সাক্ষী কি পাশ সেটার চাইতেও বড় বিষয় হল সে যে জবানবন্দী দিয়েছে তাতে একজন লোকের জীবন মরনের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। এরকম মারাত্মক জবানবন্দী দেয়ার পর সাক্ষীকে পঞ্চম শ্রেণী পাশ বিবেচনা করা ঠিক হবেনা। তাকে আমরা সফলভাবে জেরা করতে পারলে  আসামীকে তার অভিযোগ থেকে খালাস করার বিষয়টি নির্ভর করছে। কিন্তু সাক্ষীকে প্রশ্ন করার পর যদি রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এভাবে বাঁধা দেয়া হয়, প্রশ্নের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দেয়া হয় এবং বিতর্ক তুলে সতর্ক করে দেয়া হয় তাহলে জেরার আর কোন অর্থ থাকেনা।

এরপর ট্রাইব্যুনাল জেরা চালিয়ে যাবার জন্য আবার নির্দেশ দিলে আসামী পক্ষ থেকে আবারো রেকর্ড বাজানোর অনুরোধ করা হয় । তখন ট্রাইব্যুনাল  তাতে সম্মতি দিয়ে বলেন, আমরা রেকর্ড দেখব। এরপর   এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এরপর আসামী পক্ষ জেরা শুরু করে আবার।
আজ সারা দিন জেরা চলে। বিকালে জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় রোববার পর্যন্ত জেরা মুলতবি  করা হয়েছে।


জবানবন্দী :
আমার নাম মোঃ শাহজাহান আলী। আমার বয়স আনুমানিক ৬৯/৭০ বৎসর। আমার ঠিকানা- গ্রামঃ বৃশালিখা, থানা- বেড়া, জেলা- পাবনা।
আমি ১৯৭১ সালে আমার পিতার সাথে শুটকী মাছের ব্যবসা করতাম। ১৯৭১ সালে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর আমার চাচাতো ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সেলিম লতিফ এলাকার যুবকদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য বেড়ার বিপিন বিহারী হাই স্কুল প্রাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের ট্রনিং শুরু করে। আমিও মাঝে মাঝে ঐ ট্রেনিং-এ অংশগ্রহণ করেছিলাম। ১৯৭১ সালে ২৬ শে মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। এই ঘোষণার পর আমার চাচাতো ভাই আব্দুস সেলিম লতিফের নেতৃত্বে আমিও মুক্তিযুদ্ধে কাজ করতাম।
১৯৭১ সালে আগষ্ট মাসের প্রথম দিকে আমার ভাই আব্দুস সেলিম লতিফ ও আমার অপর চাচাতো ভাই আলাউদ্দিনদেরকে বেড়ায় ফুড গোডাউনের পাশে লঞ্চ ঘাট হতে রাজাকার ও আলবদরা ধরে ফেলে এবং এই দুই জনকে তারা নগরবাড়ি ঘাটের আর্মি ক্যাম্পে পাকিস্তানী আর্মিদের হাতে তুলে দেয়। তুলে দেওয়ার পর পাকিস্তানী আর্মিরা এ দুইজনের উপর অমানসিক নির্যাতন করে। তাদের দুইজনকে পাকিস্তানী আর্মিরা জ্বলন্ত সিগারেটের  আগুন দিয়া তাদের পিঠে ও বুকে পুড়িয়ে ক্ষত বিক্ষত করে দেয়। এরপর মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের নির্দেশে রাজাকার আলবদররা তাদের হাত পা বেধে যমুনা নদীতে ফেলে দেয়। তাদেরকে নদীতে ফেলে দেওয়ার দুই/তিন পর আব্দুস সেলিম লতিফ ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে ফিরে আসে। লতিফ আসার দুই দিন পর আমার চাচাতো ভাই আলাউদ্দিনও অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে ফিরে আসে। তারপর তারা দুইজনই বাড়িতে পালিয়ে পালিয়ে থাকে এবং স্থানীয় ডাক্তার দিয়ে গোপনে চিকিৎসা করায়। তার অল্প কিছুদিন পর তারা দুইজনই মোটামোটি সুস্থ হয়ে উঠে।
সুস্থ হয়ে উঠার পর আমার ঐ চাচাতো ভাই আব্দুস সেলিম লতিফ, আলাউদ্দিন ও আমার কাকা শহীদ সোহরাব আলী প্রামানিক এবং গ্রামের আরো বিশ পঁচিশ জন যুবককে সাথে নিয়া মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য ট্রেনিং নিতে ভারতে চলে যান। তারপর তারা ভারতে চলে যাওয়ার পর আমরা লক্ষ্য করি যে, মতিউর রহমান নিজমাী ও পাকিস্তানী আর্মি এদেশের রাজাকার, আলবদরদের সাথে করে নিয়ে মাঝেঁ মাঝে আমাদের গ্রামে আসতেন। তাহারা আমাদের গ্রামে আসিয়া কারা কারা মুক্তিযোদ্ধা তাদের খোঁজ খবর নিতেন।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ০২ তারিখে বিকাল অনুমান ৪.০০/৫.০০টার দিকে আমার কাকা শহীদ সোহরাব আলী প্রামানিক হঠাৎ করে ভারত থেকে বাড়িতে চলে আসে। তারপর আমি এবং আমার বাড়ির সবাই অনেক দিন পর কাকাকে দেকিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না কাটি করি। তারপর রাত্রের বেলা আমার কাকা, চাচীমা ও তাদের ছেলে মেয়ে নিয়ে তার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েন। তারপর ১৯৭১ সালে ডিসেম্বর মাসের ০৩ তারিখে ভোর রাত্রে আযানের পূর্ব মুহূর্তে আমাদের বাড়িতে একটা জোরে শব্দ হয়। ঐ শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন আমি আমার ঘরের দরজা খুলে দেখতে পাই রফিকুন্নবী বাবুল, আসাদ ও আরো চার পাঁচ জন রাজাকার আলবদর বাহিনী আমার কাকার ঘরের দরজা লাঠি মেরে ভেঙ্গে ঘরের ভিতর ঢুকে আমার চাচাকে টেনে হেচড়ে ঘর থেকে বের করে বাড়ির সামনে হালটে (কাচা রাস্তা) নিয়ে যায়। আমার চাচাকে নিয়ে যাওয়ার পর আমি, আমা চাচীমা এবং আমাদের বাড়ির সবাই পিছে পিছে হালটে চলে আসি। এরপর হালটে এসে আমরা দেখি আমার চাচাকে ওরা টানতে টানতে আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে অনুমান পোয়া মাইল দূরে চৌরাস্তার দিকে নিয়ে যায়। তখন আমি আমার আমার চাচীমা ও বাড়ির লোকজনদেরকে ঐ স্থানে রেখে আমি নিজে চাচার খোজে চৌরাস্তার দিকে যাই। চৌরাস্তার কাছে একটি বাঁশঝাড় আছে আমি সেখানে গিয়ে লুকাই। আমি সেখানে মাথা উচু করে দেখি মতিউর রহমান নিজামী সাহেব পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকার আলবদরদের পাশে দাড়িয়ে আছে। ঐ সময় আমি বুঝতে পারি যে, মতিউর রহমান নিজামী  সাহেবের নির্দেশে রাজাকার, আলবদররা আমার চাচাকে ধরিয়া নিয়েছে। তারপর আমি দেখি পাকিস্তানী আর্মিরা আমার কাকাকে কি যেন জিজ্ঞাসা করলে আমার কাকা হাত নেড়ে নেড়ে না করে। না করার সাথে সাথে আর্মিরা আমার কাকাকে রাইফেলের বাট দিয়ে বেধর মারধর করে। এরপর দুইবার মারধর করার  পরে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আর্মিদেরকে কি যেন বলে আমার কাকার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে, বলার সাথে সাথে একজন পাকিস্তানী আর্মি আমার কাকাকে দুই/তিনটি গুলি করে। গুলি করার সাথে সাথে আমার কাকা মাটিতে লুটিয়ে পরে। এই গুলি করার ৫/৬ মিনিট পর আমাদের গ্রামের চৌরাস্তা থেকে উত্তর দিকে একটি লাইন গেছে ঐ লাইনের দুই পাশ দিয়ে হিন্দুদের বাড়ি। তখন মতিউর রহমান নিজমী সাহেব ঐ দিকে ইশারা দিয়ে কি যেন বলে তখন আর্মিরা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের পিছে পিছে ঐ দিকে চলে যায়। আলবদর ও রাজাকাররাও তাদের সঙ্গে চলে যায়। কিছু সময় পর আমি বুঝতে পারলাম যে, আমি বাঁশঝাড় থেকে বের হলে ওরা আমাকে আর দেখতে পাবে না। সেই জন্য আমি বাঁশঝাড় থেকে বের হয়ে আমার চাচা শহীদ সোহরাব আলী প্রামানিককে জাড়িয়ে ধরি। জড়িয়ে ধরে আমি বুঝতে পারি যে, আমার চাচা আর বেচে নাই। ঐ সময় আমি আমার চাচাকে ছেড়ে দিয়ে চাচার পাশে ১০/১৫ মিনিট অথর্ব হয়ে বসে থাকি। তারপর আমি অনেক গুলির শব্দ শুনি হিন্দু পাড়ার দিক থেকে। তরপর দেখি হিন্দু পাড়ার বাড়ি ঘরে আগুন দিয়েছে কালো ধুয়ায় ছেয়ে গেছে। তখন ঐ অবস্থায় আমার কাকাকে সেখানে রেখে আমি বাড়িতে যাই। আমি বাড়িতে গিয়ে বাড়ির সবাইকে কাকার মরার কথা না বলে তাদেরকে বাড়িতে পালিয়ে থাকার কথা বলে পুনরায় আমি আমার কাকার কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। তারপর আমি আমার বাড়ি ও আমার পাশের বাড়ি থেকে ৫/৬ জন ১২/১৩ বৎসরের ছেলে নিয়ে চাচার লাশ আনার জন্য যাই। যাওয়ার সময় পথিমধ্যে আমাদের গ্রামের মসজিদ থেকে মৃতা নেওয়ার খাট নিয়ে যাই। তখন আমার কাকার লাশ ঐ মৃতার ঘাটে উঠিয়ে বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে ঐ লাশ নেওয়ার পর বাড়িতে যে কি করুণ দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তা আমি বর্ণনা করতে পারছি না। তারপর আমাদের গ্রামেই হিন্দু পাড়ায় আমার এক ফুফুর বাড়ি যাবো। এর বেশ কিছুক্ষণ পর ঐ হিন্দু পাড়ার দিক থেকে গোলাগুলির শব্দ বন্ধ হয়ে যায়।। কিছুক্ষণ পর আমি আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে ফাঁকা মাঠে দেখতে পাই যে, মতিউর রহমান নিজামী সাহেব পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকার আলবাদরদের নিয়ে পূর্ব দিকে চলে যাচ্ছে। তারপর আমি আমার ফুফুর বাড়ি যাহা হিন্দু পাড়ায় অবস্থিত সেখানে চলে যাই। হিন্দুপাড়ায় গিয়ে দেখলাম অনেকগুলো বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে এবং ৭/৮ জন নিরীহ নিরস্ত্র হিন্দু লোককে গুলি কইরা মাইরা রাস্তায় ফেলে রাখছে। তারপর আমি দেখতে পাই যে, একটি হিন্দু বাড়িতে ৪/৫ জন মুসলমান লোক দাড়িয়ে আছে। তাদেরকে দেখে আমিও ঐ বাড়িতে যাই। আমি ঐ বাড়িতে গিয়ে দেখলাম তিন/চার জন মহিলা বেবস্ত্র হইয়া বসে আসে। তখন ঐ মুসলমান চার/পাঁচ জন তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতেছে যে, তোমাদের কি হয়েছে। তখন একজন মহিলা বলিতেছে যে, মতিউর রহমান নিজামী সাহেব উপস্থিত থাকিয়া পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকার আলবদর দিয়া ঐ হিন্দু বাড়ি ঘর পুড়িয়েছে আর উনার উপস্থিতিতেই ৭/৮ জন হিন্দু লোককে গুলি করে মেরেছে। তারপর আরো বলে যে, পাকিস্তানী আর্মিরা জোর পূর্বক আমাদের ইজ্জত নষ্ট করেছে। এই কথা শুনার পরে আমি আমার ঐ ফুফুর বাড়ি চলে যাই এবং আমার ফুফুকে নিয়া আমি আমাদের বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে এসে আমি দেখতে পাই যে, গ্রামের কয়েকজন মুরব্বী এবং স্থানীয় কয়েকজন লোক ও আত্মীয়-স্বজনরা আমাদের বাড়িতে এসেছে। এরপর বেলা অনুমান ০২.৩০ মিনিটের দিকে উপস্থিত লোকজনকে আমি বললাম যে, আপনারা আমার চাচাকে জানাজার ব্যবস্থা করেন। তখন কেউ কেউ গোরস্থানে কবর খুড়তে যায় এবং অন্যরা আমার চাচাকে গোসল করায়। এরপর বাদ আসর আমাদের গ্রামের মসজিদে আমার চাচার জানাজা শেষে আমাদের গ্রামের গোরস্থানে দাফন করা হয়।
১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে অধ্যাপক আবু সাঈদ সাহেবের পক্ষে নৌকা মার্কার কাজ করতাম। ঐ সময় সাথিয়া থানার করমজা ইউনিয়নের করমজা গ্রামের এডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম জামায়াত ইসলামীর দাঁড়িপাল্লা মার্কায় প্রার্থী ছিলেন। ঐ সময় দাঁড়িপাল্লা মার্কার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারনা করতেন মাতিউর রহমান নিজামী সাহেব এবং নির্বাচনী জনসভায় মতিউর রহমান নিজামী সাহেব বক্তব্যও  রেখেছেন। ঐ বক্তৃতার পূর্বে মাইকে প্রচার করতেন যে, এই সভায় এখন বক্তব্য রাখবেন পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সাহেব। ঐ সময় থেকেই আমি জনাব মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে চিনি। অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট আমি জবানবন্দি প্রদান করেছি। আমি যে মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের কথা বলেছি তিনি অদ্য ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন (সনাক্তকৃত)।



জেরা
আমি পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। আমার দাদার পিতার নাম মো: পল্টন আলী প্রামাণিক। আব্দুস সেলিম লতিফ বৃশালিখা প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক লেখাপড়া করেছে। সে আমার থেকে ১২/১৩ বছরের ছোট। বেড়ার ডাকবাংলা রোডের সম্ভুপুর আমি চিনি। ঐ গ্রামের ফজলুল বাড়ি পিতা মতিউর রহমানকে আমি চিনি না। সুরাইয়া সোহরাব নামে আমাদের গ্রামে আমি কোন মেয়েকে চিনি না। আমার চাচা শহীদ সোহরাবের ৫ জন মেয়ে। তাদের সকলের নাম আমার মনে আছে। যথা- বানী, মনি, চমন, তার ছোটজন বেলী, সব ছোট বিউটি। বিউটির শ্বশুর বাড়ী সম্ভুপুর। বিউটির স্বামীর নাম শাহীন। শাহীনকে বিয়ের সময় থেকে চিনি। শাহীন ও বিউটির মধ্যে শাহীন বড়। শাহীন আমার থেকে কত বছরের ছোট আমি অনুমান করে বলতে পারি না। আব্দুস সেলিম লতিফ স্কুলে স্বাভাবিক ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করেছেন কোন বিরতি ছাড়া। আমার ভোটার পরিচয় পত্র আছে। ভোটার পরিচয় পত্রে আমার পেশা- ব্যবসা কিনা আমি জানিনা, গ্রাম বৃশালিখা লেখা আছে। আমাদের গ্রামে মো: শাহজাহান আলী পিতা মৃত মো: লোকমান আলী নামে আমি ব্যতিত কোন লোক নাই। আমাদের গ্রামে মো: শাহাজান আলী পিতা মৃত লোকমান হোসেন প্রামাণিক নামে কোন লোক আছে কিনা আমার জানা নাই। ভোটার আইডি কার্ডে আমি স্বাক্ষর করেছি, সেখানে নাম ছাড়া কি লেখা ছিল স্মরন নাই। আমার ভোটার কার্ডটি আমার বাড়িতে সংরক্ষিত আছে। আমার জন্ম তারিখ ১০-১২-১৯৫০ আছে কিনা আমার স্মরন নাই। ভোটার নম্বর ০৬৯৮ এর পাশে সংযুক্ত ছবিটি আমার তবে ঐ ভোটার নম্বরটি আমার কিনা আমি চিনতে পারছি না। ভোটার নং- ০৫৪৬ সংযুক্ত ছবিটি শাহীনের কিন্তু ভোটার নম্বর ও নাম ফজলুল প্রামাণিক তার কিনা তা আমি জানিনা। বিউটি কতদুর লেখাপড়া করেছে তা আমি বলতে পারব না। বিউটির ভোটার আইডি কার্ড এর তার জন্ম তারিখ কত লেখা আছে তা আমি জানি না।
আমি ১৯৭০ সাল থেকে আওয়ামী লীগ করি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমি ভোটার ছিলাম। ১৯৭০ সালের আগে ইউনিয়ন কাউন্সিল এর নির্বাচনে আমি ভোটার ছিলাম কিনা আমার মনে নাই। ১৯৭০ সালে আমাদের বেড়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়াম্যান কে ছিল তার নাম মনে নাই। আমাদের ওয়ার্ডের মেম্বারের নাম আমার মনে নাই। ১৯৭১ সালে বেড়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সেক্রেটারী কে ছিল তা আমার স্মরন নাই। বেড়া থানা মুসলীম লীগের সভাপতি ও সেক্রেটারী কে ছিল আমার মনে নাই। ১৯৭০ সালে অধ্যাপক আবু সাঈদ সাহেবের নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে আমাদের এলকায় এম.এন.এ এবং এম.পি.এ কে ছিল তাহা আমি বলতে পারি না। আমি লেখাপড়া না করায় ঐ সময় ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল কাকে বলতো তা আমি জানতাম না। সে কারনে ছাত্রলীগের কার্যক্রম ছিল কি না তা বলতে পারি না।
একই কারণে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও সেক্রেটারী কে ছিল তা আমি বলতে পারবো না। আমাদের এলাকায় ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোন জনসভা করেন নাই।

পূনরায় জেরা শুরু ঃ
    ১৯৭০ সালে নির্বাচনের সময় বেড়ার সব থেকে বড় আওয়ামী লীগের জনসভা কোন জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা আমার স্মরন নাই। আমার বাড়ি থেকে সব থেকে কাছে আওয়ামী লীগের জনসভা হয়েছিল বেড়া হাইস্কুল মাঠে। এ জনসভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। এ জনসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন আব্দুল মজিদ মোল্লা। মাইকে ঘোষনার সময় উনার নাম ছাড়া কিছু বলা হয় নাই। ঐ জনসভা কে পরিচালনা করেছেন আমার মনে নাই। ঐ জনসভায় কোন ছাত্র নেতা ভাষন দিয়েছিল কিনা তা আমার স্মরন নাই। বেড়া হাইস্কুল মাঠে জামায়াতে ইসলামীর ১৯৭০ এর নির্বাচনী জনসভা হয় নাই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বেড়াতে আওয়ামী লীগের জনসভা ছাড়া অন্য কোন দলের জনসভা হয় নাই। আমাদের গ্রামে মাহমুদ আলী নামে কাউকে আমি চিনতাম না। আমাদের গ্রামে আব্বাস প্রামানিক নামে একজন নৌকার মাঝিকে চিনতাম। আব্বাস সাহেব নিজে মুক্তিযুদ্ধ করেন নাই, ট্রেনিংও দেন নাই। আমাদের গ্রামের জানে আলম জানুকে চিনতাম। জানে আলম জানু একজন মুক্তিযোদ্ধা। জানে আলম জানু সাহেবের সাথে ৮/৯ দিন আগে আমার দেখা হয়েছে গ্রামে। ১৯৭১ সালে আমাদের গ্রামে মোজাহার আলী নামে একজনকে চিনতাম। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন নাই। আনসারদের আফসার কমান্ডার আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দিতেন, তিনি আমাদের একমাত্র ট্রেইনার ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর আমার কাকা শহীদ সোহরাব যখন বাড়িতে ফেরত আসেন তখন তার সাথে মুক্তিযোদ্ধা জানে আলম জানু ছিলেন না। ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর বা ৩ ডিসেম্বর জানে আলম জানুর সাথে আমার দেখা হয় নাই। কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য অন্য এলাকায় ছিলেন। তিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও আমাদের এলাকায় এসেছিলেন, তবে তারিখ বলতে পারব না, ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখ পর্যন্ত আব্দুস সেলিম লতিফ আমাদের এলাকায় আসেন নাই। আমাদের এলাকা ডিসেম্বর তারিখের কোন তারিখে বা ১৬ই ডিসেম্বরের আগে বা পরে মুক্ত হয় তা আমি বলতে পারব না। আমাদের গ্রামের আজাহার সরকার নামে একজন মাত্র রাজাকার ছিল। দেশ স্বাধীনের আগেই আজাহার সরকারকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে। দেশ স্বাধীনের আগে তিনি মুক্তিবাহিনীর কাছে শাহজাদপুর থানার করশালিকা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আত্মসমর্পন করতে গেলে তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনাটি ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরের পরে ঘটেছিল। ঐ করশালিকা ক্যাম্পে জানে আলম জানু এবং আব্দুস সেলিম লতিফ ছিল। আমাদের গ্রামের উত্তর দিকে নদী, আমাদের গ্রামের পূর্ব দিকে কাগমারী গ্রাম, পশ্চিমে কোলা গ্রাম। দক্ষিন দিকে বেড়া বাজার ও বনগ্রাম। এই কোলা গ্রামে কোন রাজাকার, আলবদর ছিল কি ছিল না তা আমার জানা নাই। বেড়া থানা আমাদের বাড়ি থেকে আধা মাইলের মত পূর্ব দিকে। থানা এলাকার পাশে বাজার। বাজার এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল। রাজাকার ও আলবদর ক্যাম্প বেড়া স্কুলে ছিল না বা আমাদের গ্রামের বৃশালিখা প্রাইমারী স্কুলেও ছিল না। আমাদের গ্রামের শান্তি কমিটির অফিস কোথায় ছিল তা আমার জানা নাই। রাজাকার আলবদররা খাকি পোষাকে থাকতো, নিজামী সাহেব পাঞ্জাবী পায়জামা পরতো। ১৯৭০ সালে আফসার আলী আমাদের থানা আনসার কমান্ডার ছিলেন। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের পূর্বে অর্থাৎ দেশ স্বাধীনের পূর্বে আমি কোনদিন থানায় যাই নাই। দেশ স্বাধীনের পরে দু-এক বার গিয়েছি। থানায় দু-তিনটি নয় বেশি রুম ছিল। আর্মিরা প্রথমে নগরবাড়িতে ক্যাম্প করেছিল পরে বেড়া বিপিন বিহারী হাই স্কুলে এবং হাসপাতালেও ক্যাম্প করেছিল। আমি সহ এলাকার যুবক শ্রেনীর লোকজন পালিয়ে থাকতাম। আর্মি ক্যাম্পের ধারে কাছেও যেতাম না। ১৯৭১ সালের বর্ষাকালের আগে না পরে আমি রাজাকারদের নাম শুনেছি তাহা আমার স্মরন নাই। আমি যে লঞ্চ ঘাটের কথা বলেছি সেখানে ১৯৭০, ১৯৭১ সালেও লঞ্চ ঘাট ছিল। এ লঞ্চ ঘাটে আমি কোন দিন আর্মিদের দেখি নাই। সর্ব প্রথম রাজাকাররা পাবনা থেকে আমাদের এলাকায় আসে। পাবনা থেকে যে রাজাকাররা আসে তাদের নাম আমি বলতে পারব না। জবানবন্দিতে উল্লেখিত রাজাকারদের নাম ব্যতিত অন্য কোন রাজাকারদের নাম জানি না। আমাদের গ্রাম ছিল দত্তকান্দি গ্রাম। ঐ গ্রামটি সাথিয়া ও বেড়া থানার মাঝে কোন থানায় পড়েছে তা আমি বলতে পারব না। রাজাকার হওয়ার আগে সে দর্জির কাজ করতো। ১৯৭০ সালে আমি করমজা গ্রামে গিয়েছি। রফিকুন্নবী বাবলুর বাড়ি করমজা গ্রামে তবে তার প্রাথমিক, উচ্চ মাধ্যমিক লেখা পড়া কোথায় করেছে তা আমি জানি না। রাজাকার হওয়ার পূর্বে তার পেশা কি ছিল তা আমি বলতে পারব না। রাজাকার হওয়ার ৩/৪ বৎসরের মধ্যে তাকে আমি দেখি নাই। আসাদ রাজাকার জামায়াতে ইসলামীর দল করতো। ১৯৭০ এবং ১৯৭১ সালে আমাদের এলাকায় জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগ করতো এরকম লোক ছাড়া অন্য কোন দলের কোন সদস্যকে আমি দেখি নাই। ১৯৭০ সালে ইউনিয়ন কাউন্সিল মেম্বার কাউকে আমি চিনতাম না। আমাদের ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন রাজা মিয়া তিনি পিস কমিটিরও চেয়ারম্যান ছিলেন, তবে তিনি কোন দল করতো তাহা আমি জানি না। পিস কমিটির সদস্যদের মধ্যে এস এম রইস নুরু মিয়া সহ আরো অনেককে চিনতাম। ১৯৭১ সালে আমাদের সুটকি মাছের ব্যবসা ছিল, পিতার সাথে সেই ব্যবসা করতাম এবং আমাকে সুটকি মাছের খোলা (তৈরির স্থান) ছিল চর অঞ্চল। বিভিন্ন মোকামে গিয়ে সুটকি বিক্রি করতাম। তিস্তা এবং নীলফামারী মোকামে গিয়ে সুটকি বিক্রি করতাম, তখন এ দুটি মোকামই রংপুর জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল।
    আমি মুক্তিযুদ্ধে যাই নাই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল। আমি করশালিখা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করতাম। করশালিকা এলাকায় পাকিস্তানী আর্মিরা কোন দিন যায় নাই। আমার চাচার হত্যাকান্ডের খবর আমি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে যাই নাই। মুক্তিযোদ্ধারা বেড়া বাজারে এবং আমাদের এলাকায় এসে খবর নিয়ে গেছে, আমার কাছে থেকে তারা কোন খবর নিয়ে যায় নাই। যেসব মুক্তিযোদ্ধা আমার চাচার শহীদ হওয়ার খবর নিয়ে গিয়েছে তাদের মধ্যে আব্দুল লতিফ তুষ্ট, আমোদ আলী, আব্দুস সাত্তার প্রমুখ। ১৯৭১ সালে ৩রা ডিসেম্বর শীতকাল ছিল। ঐ দিন রাতে কুয়াশা ছিল তবে সকালে কুয়াশা ছিল না। ১৯৭১ সালে আমাদের এলাকায় বিদ্যুত ছিল না। অনুমান ঐ সময় ভোর ০৫.৩০- ৬.০০ সময় ফজরের আযান হত। ঐ সময় ফজরের আযানের ৫/১০ মিনিট পূর্বে আমাদের ঘুম ভেঙ্গেছিল। ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর যে বাড়িতে থাকতাম সে ঘরটি ছিল দক্ষিন মুখি। আমার চাচা সোহরাব সাহেবের বাড়িও ছিল দক্ষিন মুখি। আজিজ প্রামানিকের ঘরও দক্ষিন মুখি। কালু দারোগা হচ্ছে আমার দাদা। তার বাড়ির সদর দরজা ছিল পশ্চিম মুখি। আমার বাড়ির লাগোয়া উত্তর দিকে রাস্তা। সোহরাব সাহেবের বাড়ির দুটি ঘর ছিল। উনার বাড়ির দক্ষিন দোয়ার ও উত্তর দোয়ারী ঘরের মধ্যে তিনি দক্ষিন দুয়ারী ঘরের মধ্যে ছিলেন। আমি যে বাঁশ ঝাড়ের আড়াল থেকে ঘটনা দেখেছি সেই বাঁশ ঝাড়ের মালিক ছিলেন আফজাল সরদার। তার বাড়ি বাশ ঝাঁড়ের পাশে ছিল। ঘটনাস্থলের চৌরাস্তায় চতুর্পাশেই বাড়ি ঘর ছিল, এখনও আছে। সাধু মন্ডল, সেকান প্রামানিক, আজগর মাস্টার, মাফত মোল্লা প্রমুখদের বাড়ি ঐ চৌরাস্তার মোড়ের আশে পাশেই। ঘটনার দিন আমাদের পাড়ার আমার কাকা সোহরাব প্রামানিক ছাড়া অন্য কোন বাড়িতে রাজাকার আলবদররা প্রবেশ করে নাই। আমদের পাড়ায় ৭/৮ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। রাজাকাররা ঐ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জানত কি না জানি না তবে খোজ খবর নিয়েছে। ১৯৭১ সালে ঘটনার সময় আমাদের গ্রামের রাস্তায় কোন জীপ, ট্রাক, পিক আপ যাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। শুধুমাত্র গরু ও মহিষের গাড়ি ছিল। আমাদের বাড়ি থেকে ঘটনাস্থল চৌরাস্তার মোড় পায়ে হেটে যেতে ১০/১৫ মিনিট সময় লাগতো। আমাদের বেড়া ইউনিয়ন কাউন্সিল এলাকার মধ্যে কোন পাকা রাস্তা ছিল না, কোন প্রকার মটর যান যাওয়ার সুযোগ ছিল না। গরু ও মহিষের গাড়ি যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল। চৌরাস্তার মোড়ে আমার চাচাকে মৃত দেখার পর যখন কিছুটা স্বাভাবিক হই তখন পর্যন্ত সেখানে কোন লোকজন আসে নাই। আমি ঐখান থেকে বাড়ি চলে আসার আগ পর্যন্ত আমার সাথে আর কারো দেখা হয় নাই। হিন্দুপাড়ায় যে ফুফুর বাড়িতে গিয়েছিলাম তার নাম নজেদা খাতুন। আমার ফুফার নাম ছিল মীর আলী সরকার। মীর আলীর আদিবাস হিন্দুপাড়ায় ছিল না। তিনি ১৯৭১ সালে জীবিত ছিলেন না। তার পুরানো বাড়ি ছিল বৃশালিখা মধ্যপাড়ায় হিন্দু পাড়া থেকে ৫/৬ বাড়ি পূর্ব দিকে। হিন্দু পাড়ায় আমার ফুফুর বাড়ির উত্তর দিক ছাড়া বাকি তিন দিকে হিন্দুবাড়ী ছিল। ঘটনার সময় হিন্দুপাড়ায় প্রায় ১০০ বাড়ি ছিল তার মধ্যে প্রায় ১০/১২টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে বাড়িগুলো পোড়ানো হয়েছিল তার মধ্যে একটি বাড়ি আমার ফুফুর বাড়ির লাগোয়া ছিল। ঐ লাগোয়া বাড়ির মালিক সহদেব হালদার। তার পেশা ছিল মাছ ধরা। সহদেব হালদারের বাড়ির কেউ মারা যায় নাই। আক্রমনের দিন বা ঘটনার দিন হিন্দুপাড়ার অধিকাংশ লোকজন ঐ পাড়া ছেড়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে মুসলমানদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই/এক মাসের মধ্যে আমাদের এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক লোক ভারত গিয়েছিল একইভাবে মুসলমানরাও ভারত গিয়েছিল। আমার ফুফুর লাগোয়া হিন্দু পোড়া বাড়ি ছাড়াও অন্যান্য পোড়া বাড়িও দেখতে গিয়েছিলাম। (চলবে)



 




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন