বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন

মেহেদী হাসান , ৫/৯/২০১৩
দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান (এমসি) জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য  মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে  চার্জ গঠন  করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ  আজ চার্জ গঠন করে আদেশ দেয়। এর মাধ্যমে মূলত মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে বিচার শুরু হল।  আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্যের জন্য তারিখ ধার্য্য করা হয়েছে। সূচনা বক্তব্যের পর শুরু হবে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ। এর মাধ্যমে শুরু হবে আনুষ্ঠানিক বিচার।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, নির্যাতন, অপহরন লুন্ঠন এবং অগ্নিসংযোগের মত ১৪টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। ১৪টি অভিযোগেই তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হল।

অভিযোগ পড়ে শোনানোর পর ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির মীর কাসেম আলীকে উদ্দেশ করে বলেন, মীর কাসেম আলী সাহেব, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো পড়ে শোনানো হল এবং আপনি তা শুনেছেন ও বুঝেছেন আশা করি। এসব অভিযোগ বিষয়ে আপনি নিজেকে কি দোষী না নির্দোষ দাবি করেন?
মীর কাসেম  আলী বলেন, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।
অভিযোগ গঠনের পর মীর কাসেম আলীর পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক কারনে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে। একদিন ইনশাআল্লাহ সত্য প্রকাশিত হবে  এবং মীর কাসেম আলী নির্দোষ প্রমানিত হবেন।

চার্জ গঠন আদেশ উপলক্ষে মীর কাসেম আলীকে সকালে আসামীর কাঠগড়া থেকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় আনা হয়। এরপর ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান অভিযোগগুলো পড়ে শোনাতে শুরু করেন।

অভিযোগ :
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগের মধ্যে দুটি নির্যাতন ও হত্যা বিষয়ক। বাকী  ১২টি অভিযোগ অপহরন, নির্যাতন এবং  বন্দী করে রাখা বিষয়ক। হত্যা বিষয়ক যে দুটি অভিযোগ আনা হয়েছে তাতে মোট সাতজনকে হত্যার ঘটনা রয়েছে।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালে মীর কাসেম আলী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন ।  তার নেতৃত্বে চট্টগ্রামে মহামায়া বা ডালিম হোটেলে স্বাধীনতাপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের অপহরন করে  নির্যাতন, হত্যা, গুম করা হত। এছাড়া  লুন্ঠন এবং অগ্নিসংযোগের মত মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড পারিচালিত হয়েছে তার নেতৃত্বে। মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে যে ১৪টি অভিযোগ আনা হয়েছে তার  সবগুলোর সাথেই হয়  তার নেতৃত্ব  অথবা  সরাসরি  সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয়েছে।

১ নং অভিযোগ  : মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর ওমরুল ইসলাম চৌধুরীকে  চাকতাই ঘাট থেকে অপহরন রা হয়। এরপর তাকে কয়েক দফায় চট্টগ্রামের আন্দর কিল্লাস্থ ডালিম হোটেল, পাচলাইশ থানার সালমা মঞ্জিল এবং একটি চামড়ার গুদামে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।

২ নং অভিযোগ : আসামীর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর চাকতাই থেকে লুৎফর রহমান ফারুককে অপহরন করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয় এবং বাড়িঘরে আগুন দেয়া  হয়।

৩ নং অভিযোগ : ২২ অথবা ২৩ নভেম্বর আসামীর নেতৃত্বে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে তার কদমতলা বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়।

৪ নং    অভিযোগ :  ডাবলমুরিং থানায় সালাহউদ্দিন খানকে তার নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে আল বদর বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন।

৫ নং অভিযোগ : ২৫ নভেম্বর আনোয়ারা থানার আব্দুল জব্বারকে  তার নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে মীর কাসেম আলীর সামনে হাজির করা হয় । এরপর তাকে নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়া হয়।

৬ নং অভিযোগ : চট্টগ্রাম শহরের একটি চায়ের দোকান থেকে হারুনুর রশিদ নামে একজনকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেল এবং সালমা মঞ্জিলে নির্যাতন করা হয়।

৭ নং অভিযোগ : মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে সাত/আট জন যুবক ডাবলমুরিং থানা থেকে সানাউল্লাহ চৌধুরীসহ ২ জনকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়।

৮ নং অভিযোগ : ২৯ নভেম্বর রাতে নুরুল কুদ্দুসসহ চারজনকে অপহরন করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন।

৯ নং অভিযোগ : ২৯ নভেম্বর সৈয়দ মো : এমরানসহ ছয় জনকে অপহরন ও নির্যাতন।

১০ নং অভিযোগ : আসামীর নির্দেশে মো : যাকারিয়াসহ চারজনকে অপহরন ও নির্যাতন।

১১ নং অভিযোগ : শহীদ জসিম উদ্দিনসহ ছয় জনকে অপহনের পর নির্যাতন করা হয়। এতে জসিমসহ পাঁচজন নিহত হয় এবং  পরে লাশ গুম করা হয়। ঈদের দিনের পর জসিমকে অপহন করে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়।

১২ নং অভিযোগ : জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ তিনজনকে অপহরন করে নির্যাতন করা হয়। এতে দুই জন নিহত হয় এবং তাদের লাশ গুম করা হয়।

১৩ নং     অভিযোগ : সুনীল কান্তিকে অপহরন ও নির্যাতন।

১৪ নং অভিযোগ : নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরন ও নির্যাতন ।


চার্জ গঠন আদেশে  মীর কাসেম আলীর জন্ম পরিচয় তুলে ধরা হয় ।  এতে বলা হয় মীর কাসেম আলী ১৯৫২ সালে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানায় জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা উপলক্ষে তিনি ১৯৭১ সালের পূর্ব থেকে চট্টগ্রাম শহরে অবস্থান করতেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম এ ডিগ্রী অর্জন করেন। ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হবার পূর্বে তিনি চট্টগ্রাম শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

অভিযোগ গঠনের শুরুতে মীর কাসেম আলীর পক্ষে ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন একদিন সময় প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, আমাদের টিমের প্রধান সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এ শুনানীতে সাবমিশন রাখতে চেয়েছেন এবং আমাদের আবেদনের কারনে  আপনারা আগের ২৯ আগস্ট থেকে তারিখ পিছিয়ে আজ ৫ সেপ্টেম্বর তারিখ নির্ধারন করেছিলেন। কিন্তু তিনি আজো দেশে আসতে পারেননি। আট তারিখ তিনি দেশে আসবেন। তাই আজ বৃহষ্পতিবার মাত্র একদিন যদি মুলতবি রাখেন তাহলে আগামী আট তারিখ তিনি শুনানীতে অংশ নিতে পারবেন। মাত্র একদিন পেছানো হলে মামলার তেমন কেন ক্ষতি হবেনা।
আবেদনের বিরোধীতা করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সুলতান মাহমুদ সিমন বলেন, তাদেরকে অনেকবার সুযোগ দেয়া হয়েছে। আইনজীবীর কারনে আর তারিখ পেছানো ঠিক হবেনা। তাদের টিমের সদস্য জনাব তানভির আহমেদ খুব ভাল শুনানী করেছেন।
এরপর ট্রাইব্যুনাল মুলতবি আবেদন খারিজ করে দিয়ে চার্জ গঠন আদেশ দেয়।
চেয়ারম্যান এটিএম ফজলে কবির, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল চার্জ গঠন আদেশ দেয়।
এসময় আসামী পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিক, অ্যাডভোকেট আবু বকর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষে অন্যান্যের মধ্যে চিফ প্রসিকিউটর গোলা আরিফ টিপু, অ্যাডভোটে জেয়াদ আল মালুম, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ উপস্থিত ছিলেন।

১৬ মে রাষ্ট্রপক্ষ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে ফরমাল চার্জ দাখিল করে ট্রাইব্যুনালে।

২০১২ সালের   ১৭ জুন মীর কাসেম আলীকে  ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১  এর নির্দেশে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন