মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক প্রদত্ত সাজা খারিজ চেয়ে আসামী পক্ষের দায়ের করা আবেদনের ওপর আপিল শুনানী চলছে। আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আজ কবি মেহেরুন্নেসা এবং পল্লব হত্যা বিষয়ে যুক্তি পেশ করেন। আব্দুল কাদের মোল্লাকে যে তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে তার মধ্যে এ দুটি হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসন এর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহণ করেন।
কবি মেহেরুন্নেসা বিষয়ে যুক্তি পেশ : কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে তিনজন সাক্ষী হাজির করে। তিনজনই এ ঘটনা বিষয়ে শোনা সাক্ষী।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আজ কাজী রোজী নামে একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য বিষয়ে বিভিন্ন স্ববিরোধীতা তুলে ধরে যুক্তি পেশ করেন।
তিনি বলেন সাক্ষী কাজী রোজী ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ নামে একটি বই লিখেছেন। সে বইয়ে তিনি কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা বিষয়ে আব্দুল কাদের মোল্লার নাম উল্লেখ করেননি। অথচ তিনি ট্রাইব্যুনালে এসে এ ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লাকে দায়ী করে সাক্ষ্য দিয়েছেন। জেরায় কাজী রোজীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনিতো আপনার নিজের লেখা বইয়ে আব্দুল কাদের মোল্লার নাম লেখেননি এ ঘটনা বিষয়ে। তখন তিনি জবাব দিয়েছিলেন ভয়ে তিনি আব্দুল কাদের মোল্লার নাম উল্লেখ করেননি।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আব্দুল কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়েছে ২০১০ সালের জুলাই মাসে আর কাজী রোজী তার বইটি লিখেছেন ২০১১ সালে। তাহলে এখানে জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় আসামীর নাম উল্লেখ করতে ভয়ের কি যুক্তি থাকতে পারে।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বরং যেটা সত্য তা হল কাজী রোজী তার বইয়ের ২৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন অবাঙ্গালীরা কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা করেছে। রাষ্ট্রপক্ষের দশম সাক্ষী আব্দুল কাইউমও বলেছেন কাজী রোজীকে নিজ বাড়িতে সপরিবারে হত্যা করে অবাঙ্গালীরা।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কাজী রোজী কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা বিষয়ে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার মধ্যে অনেক স্ববিরোধীতা রয়েছে এবং তিনি তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন।
তিনি তার সাক্ষ্যে একস্থানে বলেছেন তিনি ঘটনার কথা শুনেছেন, আরেক স্থানে বলেছেন তিনি দেখেছেন।
তিনি বলেছেন, গুলজার নামে একজন অবাঙ্গালীর কাছে কবি মেহের হত্যার কথা শুনেছেন। আবার আরেক জায়গায় বলেছেন তিনি কাদের কাছ থেকে শুনেছেন তাদের নাম বলতে পারবেননা।
এসময় বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী বলেন, সাক্ষী নাম বলতে পারবোনা বলে যে কথা বলেছেন সেটা অন্য বিষয় সম্পর্কে বলেছেন তিনি। ২৭ মার্চের পরের ঘটনা সম্পর্কে কার কাছ থেকে শুনেছেন তাদের নাম বলতে পারবেননা বলে বলেছেন। তিনি মেহেরুন্নেসা হত্যা বিষয়ে ২৭ মার্চের আগেই শুনেছেন।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আপনি ভিন্নমত পোষন করতেই পারেন। কিন্তু কাজী রোজী তার সাক্ষ্যে বলেছেন, কাদের মোল্লার নেতৃত্বে তারা কবি মেহেরুন্নেসার বাসায় ঢুকেছিল। কিন্তু কাদের মোল্লা নিজে ঘরে ঢুকেছিল কি-না তা বলতে পারবনা।
তিনি এমনভাবে এ ঘটনা বলছেন যেন মনে হয় তিনি সেখানে ছিলেন ঘটনার সময়।
তিনি তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছেন তাদের মাথায় সাদা পট্টি বাঁধা ছিল। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় বলেছেন সাক্ষী তাকে একথা বলেননি। আবার তিনি বলেছেন, কোরআন শরীফ বুকে চেপে বাঁচতে চেয়েছিল মেহের। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন একথাও তাকে বলেনি সাক্ষী।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সাক্ষী কাজী রোজী ২৪ মার্চ ভারতে যান। স্বাধীনতার পর ফিরে আসেন। তিনি কার কাছ থেকে কিভাবে ঘটনা শুনলেন? একবার বলেছেন গুলজার নামে একজন অবাঙ্গালীল কাছ থেকে শুনেছেন। তার কথায় অনেক বৈপরীত্য রয়েছে। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আব্দুল কাদের মোল্লাকে জড়িয়ে তিনি যে অভিযোগহ করেছেন তা সত্য হলে তিনি তার নিজের বইতে আব্দুল কাদের মোল্লার নাম উল্লেখ করতেন।
পল্লব হত্যা বিষয়ে জল্লাদখানা যাদুঘরের ডকুমেন্ট পড়ে শোনানো হল :
মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যা বিষয়ে গতকাল সোমবার যুক্তি উপস্থাপনের সময় ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আসামী পক্ষের চতুর্থ সাক্ষী সাহেরা বেগমের সাক্ষ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেন। সাহেরা বেগম হলেন পল্লবের ভাবী। সে ছিল রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। পরে সে পক্ষ ত্যাগ করে আসামী পক্ষে সাক্ষ্য দেন। এ কারনে তার সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এ বিষয়ে আজ যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ঠিক আছে, পল্লবের ভাবী পক্ষ ত্যাগ করে আসামী পক্ষে এসেছেন কিন্তু ২০০৮ সালে তিনি তার দেবর সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা নিয়েতো আর প্রশ্ন নেই। মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে সাহেরা বেগম পল্লব হত্যা বিষয়ে যে বিবরন দেন তা তিনি আজ আদালতের সামনে পড়ে শোনান। সেখানে তিনি পল্লব হত্যা বিষয়ে আব্দুল কাদের মোল্লার নাম বলেননি বলে উল্লেখ করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
পল্লব হত্যাকান্ড, শহীদ খন্দকার আবু তালেব, এবং হযরত আলী হত্যাকান্ডসহ আরো অনেক হত্যাকান্ড বিষয়ে শহীদ পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের সাক্ষাতকার, লিখিত বক্তব্যের মূল কপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়া লিখিত বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে জল্লাদখানা যাদুঘরে। মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত পাম্প হাউজে এনে ১৯৭১ সালে বিহারীরা বাঙ্গালীদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাংকি এবং পার্শবর্তী ডোবায়। ১৯৯০ দশকে এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্প হাউজটিকে জল্লাদ খানা যাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ যাদু ঘরের অংশ। জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের পরিবারে অনেক আত্মীয় স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন সময়ে তাদের সাক্ষাতকার বক্তব্য রেকর্ড করে তা যাদুঘরে সংরক্ষন করে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
পল্লব হত্যাকান্ড বিষয়ে যাদুঘর কর্তৃপক্ষ পল্লবের ভাবী সায়রা বেগমের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন ০৬/০৬/২০০৮ তারিখ।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এই ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার আগে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে পল্লব হত্যা বিষয়ে তার ভাবী সাহেরা বেগম যা বলেছিলেন তা নিম্নরূপ :
‘ ভোটাভুটি হয়ে যাওয়ার পর ধরাধরি শুরু হয়। আমি ভোট দিয়েছিলাম। তখন আমার এক ছেলে ফারুকের বয়স পাঁচ মাস। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথা মনে আছে। তার পর থেকে আমরা ঘরে থাকতে পারিনি। আশ্রয়ের জন্য আমরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে আবার ঢাকায় আসি। সাভার থাকার সময় আমার দেবর টুনটুনি মিয়া (পল্লাব) বাসা ছেড়ে চলে যায়। কারণ ও ছিল মুক্তিযোদ্ধা। পরে আবার একদিন সাভারে আমাদের কাছে এসেছিল। কিন্তু শুধু বলছিল যে, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা, আমি বসে থাকতে পারি না।’ বিহারিরা তাকে খুঁজছিল তা সে জানতে পারে। ফলে সে ভারতে যাওয়ার জন্য পথে বের হয়। নবাবপুর রোডে বিহারিরা তাকে ধরে ফেলে। কেউ তার হাত কাটে, কেউ তার পা কাটে, এভাবে তাঁকে হত্যা করে বিহারিরা।
বিয়ের জন্য আমরা রসিকতা করলে সে বলতো, ‘আমি রাজনীতি করি, আমার বিয়ে হবে ভাল পরিবেশ।’ শেষ রাতের তারা’ নামে একটা সিনেমায় সে অভিনয় করেছিল। নাটকে অভিনয় করতো। আমাদের বলতো সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে। টুনটুনি মিয়া তার কলেজে প্যারেড করাতো। সেই গল্প আমাদের শুনাতো বাসায় এসে। পেটে বাচ্চা বেঁধে দৌড়াতে হতো সেই প্যারেডে। আর সে থাকতো খুব ফিটফাট। কবি নজরুলের ভক্ত ছিল টুনটুনি মিয়া। কবির মতো তাঁর গায়ে পেঁচানো থাকতো একখানা চাদর। সে কত ভাল ছিল তা আর কি বলবো! আমার বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ঘুরতো সব সময়। বাইরে বাইরে থাকতো প্রায়ই। তবু তাঁর জন্য এতদিন পরেও আমার চোখে জল আসে। ’
সাহেরা বেগম ছাড়াও আব্বাস নামে আরো এক ব্যক্তির জবানবন্দী যা জল্লাদখানা যাদুঘরের কাছে রক্ষিত আছে তা পড়ে শোনান ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। সেখানেও পল্লব হত্যা বিষয়ে আব্দুল কাদের মোল্লার নাম বলা হয়নি বলে আদালতকে জানান তিনি।
সাহেরা বেগম পল্লব হত্যা বিষয়ে আসামী পক্ষের হয়ে ট্রাইব্যুনালে যে জবানবন্দী দেন তাও আদালতে আজ পড়ে শোনান ব্যারিস্টার আব্দুর রাজাক।
যুক্তি উপস্থাপনে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাককে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট শিশির মো : মনির। এসসময় আসামী পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, অ্যাডভোকেট সাজ্জাদ আলী চৌধুরী প্রমুখ ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন