সোমবার, ২০ মে, ২০১৩

মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে আজ অষ্টম সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।



Mehedy Hasan


জবানবন্দী :
আমার নাম মোঃ খলিলুর রহমান, আমার বয়স আনুমানিক ৬৩/৬৪ বৎসর। আমার ঠিকানাঃ গ্রাম- সোনাতলা, থানা- সাথিয়া, জেলা- পাবনা।
১৯৬৭ সালে আমি এস,এস,সি পাশ করি। ১৯৭২ সালে এইচ,এস,সি পাশ করেছি। এস,এস,সি পাশ করার পর আমি আমার মামার কনষ্ট্রাকশন ফার্মে চাকুরী করতাম। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমার বয়স ছিল ২১/২২ বৎসর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতের নদীয়া জেলার কেচুয়াডাঙ্গা ইয়ৎ ক্যাম্পে চলে যাই। সেখানে আনুমানিক আড়াই মাসের মত প্রাথমিক ট্রেনিং গ্রহণ করি। সেখান থেকে হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য দার্জিলিংয়ের পানিঘাটায় যাই। পানিঘাটায় গিয়ে ২৭ দিনের ট্রেনিং গ্রহণ করি। ট্রেনিং নেওয়ার পর ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে শিবগঞ্জ বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি এবং সোনা মসজিদে আসি। আমরা একত্রে ১০ জন ছিলাম। আমরা সোনা মসজিদে এসে কলাবাড়িয়া এলাকায় ২৪ দিন অবস্থান করি। সেখানে অবস্থান করা নিরাপদ নয় বিধায় আমরা আবার ভারতে ফিরে যাই। পরে আমরা মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি হয়ে নদীপথে পাবনা জেলার সুজানগর থানা এলাকায় আসি। সেখানে চর এলাকায় ২/৩ দিন অবস্থান করার পর ২৭শে নভেম্বর ১৯৭১ তারিখ দিবাগত রাত্রি আনুমানিক ১২.০০/১২.৩০ টার দিকে সাথিয়া থানার ধুলাউড়ি গ্রামে ডাঃ আব্দুল আওয়াল সাহেবের বাড়িতে চলে আসি। ঐদিন রাত্রি আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে হঠাৎ করে আর্মিদের পায়ের বুটের শব্দ শুনতে পাই। তখন আমি ঐ বাড়ির ঘরের পূর্ব দক্ষিণ দিকের জানালা খুলে দেখতে পাই যে, নিজামী এবং কিছু দখলদার বাহিনী এবং কিছু রাজাকার সহ আমাদের ঘরের দিকে আসছে। ঐ ঘরের উত্তর দিকের দরজা খুলে আমি ঘর থেকে বের হই। ঘর থেকে বের হওয়ার পর কয়েকটি গুলির শব্দ শুনতে পাই। এছাড়া লোকজনের কথাবার্তা ও আনাগোনা এবং হ্যান্ডস আপ শব্দ শোনা যায়। তখন আমি বুঝতে পারলাম আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। তখন আমি আওয়াল সাহেবের বাড়ির পশ্চিম পাশে থাকা বট গাছে উঠে আত্মগোপন করি। বটগাছের উপর থাকা অবস্থায় ভোর হয়ে আসলে দেখতে পাই আশে পাশের মহিলারা ঐ বটগাছের নীচে এসে বসেছে। তখন আরও দেখতে পাই যে, রাজাকাররা মহিলাদের নিকট থেকে গহনা ছিনিয়ে নিচ্ছে। আরও দেখতে পাই ঐ মহিলাদের মধ্য থেকে দুইজন যুবতী মহিলাকে পাক বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে পাশের একটি ঘরের মধ্যে ঢুকছে। ঐ ঘরের ভিতর থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ শোনা যায়। আমি বুঝতে পারলাম ঘরের ভিতর মহিলাদের রেপ করছে। এরপর আরও দেখতে পাই সেখানে নিজামী সাহেব রাজাকারদের বলছে পুরুষদের ধরে নিয়ে আস। এরপর দেখতে পাই যে রাজাকাররা পুরুষদের সেখানে ধরে নিয়ে আসার পর তাদেরকে নিয়ে প্রাইমারী স্কুলের দিকে চলে যায়। প্রাইমারী স্কুলটি ঐ বটগাছের দক্ষিণ দিকে। প্রাইমারী স্কুলের পাশে মাঠ এবং মাঠের পাশে ইছামতি নদী। আমি বটগাছ থেকে সকাল আনুমানিক ৯.০০টা/৯.৩০টার সময় নামি। গছ থেকে নামার পর গছের নীচে থাকা অনেক লোকজনের নিকট জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারি মিলিটারীরা চলে গেছে। তৎপর আমি স্কুলের পাশ দিয়ে ইছামতি নদীর পাড়ে মাঠে যাই। সেখানে গিয়ে ২৫/৩০ জন মানুষের লাশ পড়ে থাকতে দেখি। আরও দেখতে পাই আমার সহযোদ্ধাদের মধ্যে চারজন মারা গেছে এবং দুইজন জীবিত আছে। যে দুইজন জীবিত আছে তাদের একজনের নাম শাহজাহান এবং অন্যজনের নাম মাজেদ। শাহজাহানের গলা কাটা অবস্থায় এবং মাজেদের পেটে বেয়নেট চার্জ করা অবস্থায় দেখতে পাই। শাহজাহানের বাড়ি রসুলপুর এবং মাজেদের বাড়ি বনখোলা গ্রামে। বাকীরা স্থানীয় সাধারণ লোকজন। স্বাধীনতার পরে জীবিত দুইজন সহযোদ্ধার সংগে আমার দেখা হয়েছে। মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে আমি আগে থেকে চিনতাম, তার বাড়ি আমার বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত (আপত্তি সহকারে)। আমি শুনতে পেয়েছি যে, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে নিজামী সাহেব ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব অদ্য ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন (সনাক্তকৃত)। আমি অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি। (জবানবন্দী সমাপ্ত)


জেরা : আইনজীবীর প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী যে উত্তর প্রদান করে তা এখানে তুলে ধরা হল।
আমার আদিবাস সোনাতলা গ্রামে। আমি সোনাতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করি। সাথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি পাশ করি। এস.এস.সি পাশ করার পরে আমি কলেজে ভর্তি হই নাই, তবে প্রাইভেটে এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বা তিনি লেখাপড়া কোথায় করেছেন এ সম্পর্কে আমি জানি না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের বাড়িতে প্রয়োজন না হওয়ায় যাই নাই। মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের পিতার পেশা কি ছিল তাহা আমার জানা নাই। উনার পিতা স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে নাকি পরে মারা গেছেন তাহা আমার মনে নাই। নিজামী সাহেবের পিতা কয় ভাই বোন ছিল তাহা আমার জানা নাই। নিজামী সাহেবরা তিন ভাই বোন। বাকী দুইজন উনার বোন। উনার বোনেরা কোথায় লেখাপড়া করেছেন তাহা আমার জানা নাই, তবে একজন বোনের বিবাহ হয়েছে আমাদের গ্রামে। বাংলাদেশ হওয়ার আগে উনার ঐ বোনের বিবাহ হয়েছে। আমি অধ্যাপক আবু সাঈদ সাহেবকে চিনি। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পরে এবং ডাব বাগান যুদ্ধের আগে ভারতে চলে যান কিনা তাহা আমার জানা নাই, তবে তার সঙ্গে আমার ভারতে দেখা হয়েছিল। ২৫ শে মার্চ থেকে আমি ভারতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অধ্যাপক আবু সাঈদের সাথে আমার দেখা হয়েছিল কিনা তাহা আমার স্মরন নাই। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগে অনেকবার তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমাদের এলাকায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পরে সংগঠকের দায়িত্বে কে ছিলেন তাহা আমি জানি না। মদন মোহন দাস ও আমি একত্রে ভারতে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য গিয়েছিলাম। আমি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে আমাদের সঙ্গে কোন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাত হয় নাই এবং ঐ সময় এলাকায় কোন মুক্তিযোদ্ধা দেখি নাই। আমাদের সাথিয়া এলাকায় সর্বপ্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প সম্ভবত সেপ্টেম্বর মাসে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান নিজাম ভাই স্থাপন করেন। তখন আমি ভারতে ছিলাম। ইহা সত্য নহে যে, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকে ভারতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি নিজ গ্রামেই থাকতাম, বাইরে যেতাম না। আমাদের ইউনিয়নের নাম নাকডেমরা। ১৯৭১ সালে আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদ। আমার ওয়ার্ডের মেম্বার কে ছিলেন তাহা আমার এখন খেয়াল নেই। আমার সোনাতলা গ্রামে এখন অনেক মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে, তখন আমি এবং মদন মোহন ছাড়া আমাদের গ্রামে অন্য কোন মুক্তিযোদ্ধা ছিল না। ধুলাউড়ি গ্রাম থেকে আমি দুইজন আহত মুক্তিযোদ্ধা মাজেদ ও শাহজাহানকে নদী পার করে দিয়ে আমি ডাক্তার হাবিবুর রহমানের বাড়ী যাই, কিন্তু তিনি ভয়ে চিকিৎসা করার জন্য আসেন নাই। ২৭ নভেম্বর দিবাগত রাত্রি সাড়ে তিনটা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা কোন রাজাকার বা আলবদরদেরকে আটক করে নিয়ে যায় নাই। ঐ ঘটনার দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর বাহিনীর কোন যুদ্ধ হয়েছিল কিনা তাহা আমি জানি না, তবে গোলাগুলির শব্দ শুনেছিলাম। পদ্মাবিলা গ্রামের খবির উদ্দিন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা ঐ দিন ধুলাউড়ি গ্রামের অন্য একটি বাড়িতে ছিলেন, তিনি আমাদের ১০ জনের গ্রুপের সদস্য ছিলেন না। ঐদিন যে সমস্ত পুরুষ লোকজন রাজাকার, আলবদরদের এবং পাকিস্তানী আর্মিদের হাতে ধৃত হয়েছিল তাদের মধ্যে শাহজাহান, মাজেদ ও কুদ্দুস ছাড়া অন্য সকলেই শহীদ হয়। কুদ্দুসের বয়স কম থাকায় তাকে হত্যা করা হয় নাই। সে আমাদের ১০ জনের গ্রুপের একজন সদস্য ছিল। আর্মিরা আসার পরে সর্বপ্রথম কুদ্দুস ধরা পড়ে কিনা তাহা আমি জানি না, তবে সেদিন সে আওয়াল সাহেবের বাড়িতে সেন্ট্রির দায়িত্বে ছিল। কুদ্দুসকে পাকিস্তানী আর্মিরা ধরে পাবনা ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে তাকে প্রথমে সাত দিন ক্যাম্পে রাখতো এবং একদিন বাড়িতে যেতে দিত তৎপর সাতদিন তাকে বাড়িতে থাকতে দিত এবং একদিন পাবনা ক্যাম্পে হাজিরা দিতে হতো, তৎপর তাকে কবে কিভাবে ছেড়ে দেয় তাহা আমি জানিনা। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে কুদ্দুসের সঙ্গে সর্বপ্রথম কবে দেখা হয়েছিল তাহা আমার স্মরন নাই। কুদ্দস সাহেব অদ্য থেকে আনুমানিক তিন বৎসর আগে মারা গেছেন। শাহজাহান সাহেবকে নদী পার করে দেওয়ার পর কত দিন পরে তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় তাহা আমার মনে নাই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সম্ভবত আমি ভোট দিয়েছিলাম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভোট দিতে কয়দিন গিয়েছিলাম তাহা আমার খেয়াল নাই। আমাদের গ্রামে কোন শান্তি কমিটি গঠন হয় নাই। আমাদের ইউনিয়নে কোন রাজাকার বাহিনী বা আলবদর বাহিনী গঠিত হয় নাই। আমি ট্রেনিংয়ে যাওয়ার আগে রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির নাম শুনেছিলাম। সাথিয়া থানার শান্তি কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারীর নাম আমি বলতে পারব না। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ট্রেনিংয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি আমার কর্মস্থল চাটমোহরে থাকতাম। মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান সাহেবের সঙ্গে সর্বপ্রথম ভারতের ইয়ৎ ক্যাম্পে দেখা হয়। আমার ১০ জনের গ্রুপের মধ্যে আমি খলিলুর রহমান, আখতার আলম (কমান্ডার), শাহজাহান (আহত), অপর শাহজাহান, মোখলেছুর রহমান ওরফে রঞ্জু, সালাম, কুদ্দুস, মাজেদ, মোকছেদ ও জলিল ছিলাম, তবে জলিল এ ঘটনার দিন আমাদের সঙ্গে ছিল না। জামাল নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে চিনি, তার বাড়ি ডহরজানি গ্রামে। আমার বাড়ি থেকে পদ্মাবিলা গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৯/১০ কিলোমিটার। রতনপুর আমার গ্রাম থেকে কতদূরে তাহা বলতে পারব না। নূরপুর ও বামনডাঙ্গা গ্রাম আমি চিনিনা। রসুলপুর গ্রাম আমি চিনি, আমি সেখানে গিয়েছিলাম। পদ্মবিলা গ্রাম থেকে রসূলপুর কত দূরে তাহা বলতে পারব না, তবে পাশাপাশি হতে পারে। ধূলাউড়ি গ্রামে আমি ঘটনার দিনই প্রথম যাই নাই, তার আগে থেকে ঐ গ্রামে আমার যাতায়াত ছিল। আমরা যে আওয়াল সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম তার সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না। তার বাড়ির সদস্য সংখ্যা সম্পর্কে আমার ধারনা নাই। ১৯৭১ সালের আগে ধূলাউড়ি গ্রামের আব্দুল গফুর ফকির নামে আমার এক আত্মীয়ের বাড়ীতে আসা যাওয়া ছিল। আব্দুল গফুর সাহেব ১৯৭১ সালে বিবাহিত ছিল কিনা তাহা আমার জানা নাই। গফুররা দুই ভাই। তার অপর ভাইয়ের নাম আমার মনে নাই।  (চলবে)

তাং- ২১/০৫/২০১৩ ইং
 জেরা (পুণরায়) ঃ
উল্লেখিত গফুর সাহেব জীবিত আছে। ধূলাউড়ি গ্রামে আমার যাতায়াত আছে। ঐ গ্রামে ১৯৭১ সালে লোকসংখ্যা কত ছিল তাহা আমি বলতে পারব না। ১৯৭১ সালে ঐ গ্রামের যে সকল লোকের বয়স ১৫ বৎসর বা তার অধিক ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন জীবিত থাকতে পারে। ধূলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা ছিল তাদের মধ্যে আমি আবেদ আলী এবং লিয়াকত হোসেন কে চিনি। ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর তারিখে ধূলাউড়ি গ্রামে যাওয়ার আগের দিন চর এলাকা ঘরবাড়িতে ছিলাম। তার নাম মনে নাই এবং গ্রামের নামও মনে নাই। ১৯৭১ সালে পাবনা শহর থেকে ধূলাউড়ি গ্রামে ঢোকার রাস্তা গ্রামের মাঝখান দিয়ে ছিল। আওয়াল সাহেবের বাড়ীর তিন দিকে রাস্তা আছে শুধুমাত্র দক্ষিণ দিক ছাড়া। আওয়াল সাহেবের বাড়ির পূর্ব দিকে নয় উত্তর দিকে মোকলেছ চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ী। আওয়াল সাহেবের বাড়ী ও মোকলেছ চেয়ারম্যানের বাড়ির মাঝখানে বটগাঠটি ছিল না। আওয়াল সাহেবের বাড়ি থেকে প্রাইমারী স্কুলটির দূরুত্ব আনুমানিক ১০০ ফিট দূরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায়। স্কুলের মাঠ এবং ইছমতি নদী লাগালাগি নহে, মধ্যখানে চাষের জমি আছে প্রায় ২০০ ফিটের মত। লাশগুলি আমি চাষের জমির উপর পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। স্কুলের মাঠে কোন লাশ ছিল কি না তাহা বলতে পারব না, কারণ আমি সেই দিন স্কুলের মাঠে যাই নাই। যে লাশগুলি আমি পড়ে থাকতে দেখেছিলাম তার মধ্যে আমার পরিচিত ব্যক্তির লাশ ছিল। যার মধ্যে আকতার আলম, শাহজাহান, মোকছেদ, মোসলেম এর লাশ ছিল। তাছাড়া যেখানে আহত অবস্থায় শাহজাহান এবং মাজেদকে পেয়েছিলাম যাদেরকে চিনতাম। অন্যদের নাম আমার মনে নাই। উল্লেখিত নিহত আহত ৬ জনই আমার গ্রুপের সদস্য ছিলেন। বাকী নিহতদের নাম আমি জানি না। আমাদের গ্রুপের সালাম ঘটনার রাত্রে সেন্ট্রির দায়িত্বে ছিল এবং সে ঐ রাত্রে পালিয়ে গিয়েছিল। তিনি বর্তমানে জীবিত আছেন এবং তার বাড়ি গাঙ্গহাটি বনগ্রাম। গাঙ্গহাটি বনগ্রাম ১৯৭১ সালে সাথিয়া থানাধীন ছিল। আমি ঐ গ্রামে কখনও যাই নাই। সাথিয়া থানায় বনগ্রাম নামে গ্রাম আছে তাহা আমি জানি। বনগ্রামের উত্তর-পশ্চিম কর্ণারে গাঙ্গহাটি গ্রাম অবস্থিত। বনগ্রামে একটি হাট আছে। ঐ হাটে আমি নিজে গিয়েছি। গনগ্রাম বড় কিনা আমি জানি না। রসূলপুর বনগ্রামের কোন পাশে তাহা আমি জানি না। ১৯৭১ সালের ২৭শে নভেম্বরের আগে পাকিস্তান আর্মিদের আমি দেখেছিলাম। আমি তাদেরকে ঢাকায় দেখেছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি ঢাকায় এসেছিলাম কি না তাহা আমার স্মরণ নাই। আরও যে সকল মুক্তিযোদ্ধারা সাথিয়া থানাধীন এলাকায় ছিল তাদের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার উদ্দেশ্যে আমরা ২৭ নভেম্বর তারিখে ধূলাউড়ি গ্রামে গিয়েছিলাম। উপজেলা চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমরা এদিন ধূলাউড়ি গ্রামে গিয়েছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর তারিখে নিজাম উদ্দিন সাহেবের ক্যাম্প কোথায় ছিল তাহা আমি বলতে পারি না। ২৭ নভেম্বর, ১৯৭১ তারিখে আমার ধূলাউড়ি গ্রামে যাওয়ার এবং ২৮ নভেম্বর তারিখে ঐ গ্রাম থেকে চলে আসা পর্যন্ত আমার সঙ্গে নিজাম উদ্দিন সাহেবের দেখা হয় নাই। ১৯৭১ সালে ধূলাউড়ি গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। ১৯৭১ সালের ২৭শে নভেম্বর তারিখে দিবাগত রাত্রি তিনটার সময় যখন আমি জানাল খুলে দেখি তখন জোৎ¯œা রাত্রি ছিল। ১৯৭১ সালে রমজান মাস ইংরেজী কোন মাসে ছিল তাহা আমি বলতে পারি না। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোরবানীর ঈদ কোন মাসে হয়েছিল তাহা আমি বলতে পারিনা। ১৯৭১ সালে রমজান মাস শীতকালে নাকি গরমকালে হয়েছিল তাহা আমি বলতে পারব না। ১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর তারিখ সকালে কুয়াশা ছিল তবে ততবেশী নহে। চন্দ্রমাসের আট বা নয় তারিখে চাঁদ কয়টার সময় উঠে এবং কয়টার সময় ডুবে যায় তাহা আমি জানি না। ১৯৭১ সালের ২০ শে নভেম্বর ঈদ উল ফিতরের দিন ছিল কিনা তাহা আমার খেয়াল নেই। ইহা সত্য নহে যে, ১৯৭১ সালের ২৭ শে নভেম্বর দিবাগত রাত্রি ৩.৩০ মি. সময় জোৎ¯œা ছিলনা। ঐদিন রাত্র ১.২৩ মিনিট সময় চন্দ্র অস্ত গিয়েছিল, ইহা সত্য নহে। আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট ০৬-১১-২০১০ ইং তারিখে জবানবন্দী প্রদান করেছি। ১৯৭১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার থাকা অবস্থায় ধূলাউড়ি গ্রামের ঘটনা নিয়ে কোন মামলা হয়েছিল কিনা তাহা আমার জানা নাই। ঘটনার রাত্রে রেজাউল করীম নামে কোন মুক্তিযোদ্ধা ঐ গ্রামে ছিল কিনা তাহা আমার জানা নাই। রেজাউল করীম নামে একজনকে আমি চিনি, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি একটি বই লিখেছেন মর্মে জানি, তবে উহাতে ধূলাউড়ি গ্রামের বর্ণনা আছে কিনা তাহা আমি জানি না। উনার ঐ বইটি মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা এটা আমি শুনেছি। জহুরুল ইসলাম বিশু নামে কোন মুক্তিযোদ্ধার নাম আমি শুনি নাই। ট্রেনিং শেষে ভারত থেকে এসে পাবনার সুজানগরে প্রবেশ করি। সুজানগরের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইকবাল সাহেব ছিলেন কিনা তাহা আমি জানি না। ১৯৭১ সালে যুদ্ধাকালীন সময়ে সুজানগর থানার মুক্তিযোদ্ধাদের ডেপুটি কমান্ডার কে ছিলেন তাহা আমি বলতে পারব না। সাথিয়া থানার মুক্তিযোদ্ধাদের সি এ্যান্ড সি নিজাম উদ্দিন সাহেব ছাড়া অন্য কোন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার বা মুক্তিযোদ্ধা বা মুজিব বাহিনীর কমান্ডারের নাম আমি বলতে পারব না। ধূলাউড়ি গ্রামে শহীদদের স্মরনে যে স্মৃতিস্তম্ভ হয়েছে তাহা আমি দেখেছি। ঐ স্মৃতিস্তম্ভে সকল শহীদদের নাম লেখা আছে কিনা তাহা আমি জানিনা, তবে আমার গ্রুপের যে ৪ জন শহীদ হয়েছিল তাদের নাম লেখা আছে। মাজেদ ঘটনার সময় জীবিত ছিলেন একথা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য নহে।
    “...............কন্ট্রাডিকশন - এই কথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য নহে।”
“মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে” মতিউর রহমান নিজামী সাহেব ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন একথা আমাকে কে বলেছিল তাহা আমার মনে নাই, তবে আমি শুনেছিলাম। ঘটনার রাত্রে আক্রমনকারীদের মধ্যে নিজামী সাহেবকে আমি চিনতে পেরেছিলাম, বাকীদের চিনতে পারি নাই। নিজামী সাহেব বাংলাদেশের একজন পরিচিত ব্যক্তি। নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য আমি পাবনা থেকে এসেছি। আসামীর কাঠগড়ায় একজন ব্যাক্তিই উপস্থিত আছেন। আমি নিজামী সাহেবকে জড়িত করে যে বক্তব্য দিয়েছি তাহা অসত্য, ইহা সত্য নহে। মতিউর রহমান নিজামী সাহেব ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর দিবাগত রাত্রি সাড়ে তিনটার সময় হতে (২৮ শে নভেম্বর) পরবর্তী সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ধূলাউড়ি গ্রামে দেখেছি মর্মে অসত্য বক্তব্য দিয়েছি, ইহা সত্য নহে। ইহা সত্য নহে যে, ১৯৭১ সালে আমি মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে দেখি নাই। জহরুল ইসলাম বিশু এবং রেজাউল করীম কর্তৃক লিখিত বই দুইটি পড়েছি এবং সত্য প্রকাশের ভয়ে পড়ি নাই মর্মে বলেছি, ইহা সত্য নহে। (সমাপ্ত)



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন