Bali |
Bali's wife crying after abduction of Bali |
সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান পাওয়া গেছে। কলকাতার দম দম কারাগারে বন্দী সে।
সুখরঞ্জন বালী ভারতের কারাগারে বন্দী রয়েছে মর্মে আজ নিউএজ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি করেছেন নিউএজ পত্রিকার সাংবাদিক (এডিটর স্পেশাল রিপোর্টস) ডেভিড বার্গম্যান। এখানে তার প্রতিবেদনটির অনুবাদ তুলে ধরা হল।
(সুখরঞ্জন বালী ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের একজন সাক্ষী। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দিতে না এসে বালী মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। কিন্তু সাক্ষ্য দেয়ার আগে অপহরনের শিকার হন তিনি। দেশে বিদেশে এ নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় তখন। )
ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন সাক্ষী ছিলেন সুখরঞ্জন বালী। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ করে বলে আসামী পক্ষ দাবি করে আসছে। কলকাতার একটি কারাগারে তার খোঁজ পাওয়া গেছে।
দণিাঞ্চলীয় জেলা পিরোজপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক সুখরঞ্জন বালী। গত বছরের ৫ নভেম্বর সকালে তিনি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে যাচ্ছিলেন। এসময় সকালে ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে অপহরন করে নিয়ে য়াওয়ার বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করেছেন।
সুখরঞ্জন বালী কলকাতার দম দম সংশোধন কেন্দ্রে আটক রয়েছেন এবং তাকে দেখতে তার পরিবারের সদস্যরা সেখানে গিয়েছে মর্মে চলতি বছরের ফেব্রয়িারি মাসে জানতে পারে নিউএজ। এরপর এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে এবং কিভাবে তিনি সেখানে গেলেন তা খুজের বের করার জন্য অনুসন্ধান চালায় পত্রিকাটি।
পত্রিকাটি তার সঙ্গে দেখা করতে এবং তার বক্তব্য জানার জন্য ওই কারাগারে প্রবেশে সক্ষম একজন ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিরাপত্তার কারণে তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছর কথা জানান ওই ব্যক্তি। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির অনেক নেতৃবৃন্দের বিচার চলছে। এর কোন একটি দলের সাথেও ওই ব্যক্তির কোন সম্পৃক্ততা নেই।
যাকে দিয়ে আমরা সুখরঞ্জন বালীর কাছ থেকে বক্তব্য সংগ্রহ করেছি তিনি নিউএজকে নিশ্চিত করেছেন যে, যে ব্যক্তির বক্তব্য সংগ্রহ করা হয়েছে তার সাথে বালীর আসল ছবির সম্পূর্ণ মিল রয়েছে।
বালীর কাছ থেকে বক্তব্য সংগ্রহ করা ওই ব্যক্তি নিউএজকে জানান, বালী পুরো অপহরন ঘটনার অত্যন্ত স্পষ্ট বিবরন দিয়েছেন। । আমি মনে করি, ঘটনাটি সত্য না হলে এ রকম মুহূর্তে তার কাছ থেকে এমন বিবরণ আসা খুবই কঠিন।’ অবশ্য বালীকে তখন নার্ভাস দেখাচ্ছিল বলেও ওই ব্যক্তি নিউ এইজ-কে জানান।
বালী জানান, অপহরনের পর তাকে কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি। তবে তারা প্রশ্ন করেছে ‘কেন আমি সাঈদী সাহেবের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছি। তারা বলেছে- আমাকে হত্যা করা হবে এবং সাঈদী সাহেবকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে।’
তার বক্তব্য অনুযায়ী ২০১২ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার আগে ঢাকায় তাকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত আটক রাখা হয়। গত সাড়ে চার মাস তাকে ভারতের বিভিন্ন কারাগারে আটক রাখা হয়েছে।
বালীর এসব দাবির সত্যতা নিউএইজ স্বাধীনভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি। কারণ, এর আগে তার পরিবারের এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আসামী পক্ষ তার অপহরন বিষয়ে যেসব কথা বলেছিল তার সাথে বালীর সর্বশেষ বক্তব্যের কিছু কিছু গরমিল রয়েছে। তবে বালী আটক থাকা থাকার সময়সীমার যে তথ্য দিয়েছে তার সাথে মিল রয়েছে ভারতীয় আদালতে তার আটক থাকা বিষয়ে পুলিশের দাখিলকৃত তথ্যের সাথে।
ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে দেশটির ফরেইনার অ্যাক্ট-১৯৪৬ এর অধীনে কলকাতার একটি আদালত বালীকে ১০৫ দিনের কারাদণ্ড দেয় গত ৩ এপ্রিল । । যেহেতু বিচার চলাকালে এই মেয়াদটা তিনি কারাভোগ করেছেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাকে যেকোনো দিন বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া এবং পাবলিক রিলেশনস কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে (বালীর বিষয়ে) কোনো তথ্য নেই। আমি যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তিনি বলেছেন- তিনি কিছুই জানেন না। এই মুহূর্তে বালী কোথায় আছে তিনি তা জানেন না।’ মনিরুল ইসলাম ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় দুটি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে। এরমধ্যে একটি হলো- সুখরঞ্জন বালীর ভাই বিশাবালীকে হত্যায় জাতি থাকার অভিযোগ।
আদালত রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে বিশাবালীকে একটি নারিকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয় এবং ‘অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নির্দেশে রাজাকাররা তাকে গুলি করে হত্যা করে। আদালত আরো ছয়টিঅপরাধের জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও কোনো সাজা ঘোষণা করেনি। মামলাটি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে বালীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ করেছে এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে সরকার এবং ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ।
গত বছরের ৫ নভেম্বর সকালে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বালীকে অপহরনের ঘটনাটি ট্রাইব্যুনালকে জানায়। এর কিছুক্ষন পর চিফ প্রসিকিউটর আদালতকে বলেন, ‘আদালত চত্বরে সাক্ষী অপহরনের কোন ঘটনাই ঘটেনি। আদালত চত্বরে যেসব পুলিশ সদস্য রয়েছে তাদের সাথে আমি কথা বলেছি। তারা আমাকে জানিয়েছে এখানে আজ এ ধরনের কোন ঘটনাই ঘটেনি। তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেননা। চিফ প্রসিকিউটর যখন ট্রাইব্যুনালকে এ তথ্য জানান তখন তার পাশে তদন্ত সংস্থার প্রধানও উপস্থিত ছিলেন এবং তিনিও এ বক্তব্য সমর্থন করেন।
এরপর প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয় সাক্ষী অপহরনের ঘটনাটি আসামী পক্ষের একটি অগ্রহনযোগ্য নাটক। নেতাদের বেআইনিভাবে মুক্ত করতে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম বনচাল করতে তাদের (জামায়াাতে ইসলামীর) চেষ্টার অংশ এটি।
অপহরণের ঘটনার এক সপ্তাহ পর বালীর পক্ষে দায়ের করা হেবিয়াস করপাস আবেদনের পরিপ্রেেিত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম হাই কোর্টকে বলেন, ‘এই গল্প একেবারেই উদ্ভট এবং ট্রাইব্যুনালের সুনাম নষ্ট, ট্রাইব্যুনালকে হেয় প্রতিপন্ন করাই এর উদ্দেশ্য।
বালীর জেলখানায় থেকে দেয়া বিবৃতিতে জানন, ছয় সপ্তাহ তাকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটকে রাখার পর ২৩ ডিসেম্বর তাকে চোক বেঁধে পুলিশ তাকে সীমান্তে নিয়ে যায়। এরপর ভারতীয় সীমান্তরী বাহিনী-বিএসএফের হাতে তাকে তুলে দেয়া হয়। নিজের সই করা বিবৃতিতে বালী বলেন, ‘তারা আমাকে খাবার দেয়ার জন্য মাগুরার একটি হোটেলের সামনে গাড়ি থামায় । এসময় তারা আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয় এবং আমি বুঝতে পারি আমাকে প্রাইভেটকারে এখানে আনা হয়েছে।
‘আমার খাবার খাওয়া শেষ হলে ফের আমার চোখ বেঁধে রওয়ানা দেয়া হয় গাড়িতে করে। সর্বশেষ বিকেল ৫টার দিকে বিএসএফের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে তারা চলে যায।
বালী বলেন, বিএসএফ সদস্যরা তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করে। ‘তারা আমাকে নির্যাতন করে এবং জানতে চায় আমি সেখানে কী করছিলাম। বিএসএফের হাতে তুলে দেয়ার আগ পর্যন্ত আমি কী করেছি তা তুলে ধরার চেষ্টা করি। সম্ভবত তারা আমার কাছ থেকে সন্তোষজনক জবাব পায়নি এবং আমাকে আরো বেধধড়়ক মারধর করা হয়।’
এতে আহত হলে বিএসএফ তাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে স্বরূপনগর থানায নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে পরদিন তাকে বসিরহাট আদালতে তোলা হয়। । বসিরহাট কারাগারে ২০ দিন আটক থাকার পর তাকে দম দম সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয় বলে জানান বালী।
বালী তার বক্তব্যে বলেন, ২০১২ সালের মে মাসের কিছুদিন পর সাঈদীর ছেলে ‘বুলবুল’ তার বাড়িতে যান তার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু এসময় তিনি বাড়িতে ছিলেননা। পরে ফোনে তিনি তিনি তাকে প্রথমবারের মত তার পিতা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে বলেন। বুলবুল তার বাবার জন্য সাক্ষী হতে আমাকে অনুরোধ করে। কিছুদিন পর বুলবুল মারা যান। বালী উল্লেখ করেন ২০১২ সালের ১৩ জুন সাঈদীর বড় ছেলে রফিক-বিন-সাঈদী মারা যান।
এই ছেলে হৃদরোগে মারা যাওয়ার পর সাঈদীর আরেক ছেলে তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ রাখেন বলে জানান বালী এবং দুর্গাপূজার আগে (অক্টোবর ২০-২৪) তিনি ঢাকা আসেন। সাঈদীর বাসায় ১৫ থেকে ১৬ দিন থাকেন।
তিনি বলেন, ৫ নভেম্বর তাকে সাঈদীর আইনজীবীদের অফিস পল্টনের একটি ভবনের ১০ম তলায় নেয়া হয়। সেখানে সাঈদীর আইনজীবীদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। এরপর তাকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যায় তারা।
এর আগে সাঈদীর আইনজীবীরা এবং বালীর স্ত্রী দাবি করেন, বালী নভেম্বরের শুরুতে প্রথমে ঢাকা আসেন। ঢাকায় অবস্থানকালে বালী সাঈদীর পরিবারের কোনো সদস্যের বাড়িতে অবস্থান করেননি বলেও দাবি করেন তারা আইনজীবীরা।
ভারতীয় পুলিশের ২০১২ সালের ২৪ ডিসেম্বর দাখিল করা প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ কর্মকর্তা কুলদীপ সিং ভারতীয় সীমান্তবর্তী স্বরূপনগরে ‘সন্দেহজনক গতিবিধি পর্যবেক্ষন’ করেন এবং বালীকে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি পালান। এফআইআর-এ বলা হয়, আটক করা হলে বালী তাদের জানায়, ‘তিনি বাংলাদেশ থেকে তার ভাইযয়ের সঙ্গে দেখা করতে ভারতে এসেছে।’
কলকাতায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) শরিফ উদ্দিন নিউ এইজ-কে বলেন, ‘বিভিন্ন সংশোধন কেন্দ্রে আটক বাংলাদেশিদের দেখতে এপ্রিলের শেষের দিকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি দল কলকাতায় আসেন।’
‘আমরা দম দম সংশোধন কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। আমি তাদের সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলটি বালী সঙ্গে দেখা করেছেন কিনা আমি বলতে পারবো না’ বলে জানান শরিফ উদ্দিন।
ওই প্রতিনিধি দলের একজন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির লে. কর্নেল তৌহিদ বলেন, ‘বালীর সঙ্গে তারা দেখা করেছেন কিনা তা তিনি বলতে পারবেন না।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু কারাগারে প্রায় ১৩০ জন ছিল, তাই আমি বিষয়টি স্মরণ করতে পারছি না। আপনাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে হবে।’
সুখরঞ্জন বালীর নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরনের শিকার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীর জীবনের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে বালীকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো উচিত হবেনা। কারণ এখানে ফেরত আসলে তার জীবন সত্যিই হুমকীর সম্মুখীন হবে।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক নিউএজ পত্রিকায় আজ রিপোর্ট করা হয়েছে সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান পাওয়া গেছে। বর্তমানে সে ভারতের দম দম জেলখানায় বন্দী রয়েছে। বালীকে নিয়ে এ রিপোর্ট প্রকাশের পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিতে বলা হয়েছে- দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীর নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশ কর্তৃক সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিতে বালীর অপহরনের বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়-বালীর দাবিমতে তাকে ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে বাংলাদেশী পুলিশ অপহরন করে । এরপর তাকে কিছুদিন বাংলাদেশে বন্দী করে রাখার পর আইনশঙ্খলা বাহিনী তাকে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেয় জোর করে। বালী অভিযোগ করেছেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) সদস্যরা তাকে আটক করে এবং তার ওপর নির্যাতন চালায়। এরপর তাকে দমদম জেলে পাঠানো হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড এ্যাডমা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতিতে বলেছেন- ‘ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে সাক্ষী অপহরনের বিষয়টি প্রসিকিউশন, বিচারক এবং সরকারের আচরন নিয়ে গভীর উদ্বেগ এবং সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। অনেক প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন হল কে এই অপহরনের নির্দেশ দিয়েছিল এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কিভাবে এর সাথে নিজেরা জড়িত ছিলেন?’
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়-ট্রাইব্যুনালে আসামী পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার কথা ছিল বালীর। বালী জানিয়েছেন, ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর তাকে সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গ্রেফতার করে ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে। এরপর তাকে একটি পুলিশ ভ্যানে তুলে পুলিশের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।
ট্রাইবু্যুনালের সামনে অবস্থানকারী অনেকে এ অপহরন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে।
আসামী পক্ষ ট্রাইব্যুনালে এ অপহরন ঘটনা জানানোর পর ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের (প্রসিকিউশন) নির্দেশ দেন বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য। অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য স্বাধীন কোন সংস্থাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়নি। কিছুপক্ষন পর প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে ফিরে এসে বললেন আদৌ এ ধরনের কোন ঘটনাই ঘটেনি। কোন অপহরনের ঘটনা ওইদিন ঘটেনি। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপক্ষ আসামী পক্ষের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করলেন।
বালীর নিরুদ্দেশ হওয়া বিষয়ে তদন্তের জন্য বিচারকরা পরবর্তীতে আর কোন নির্দেশ দিলেননা। সে কোথায় আছে সে বিষয়ে কোন তথ্য প্রকাশ করা হয়নি জনসম্মুখে। বালী বিষয়ে তদন্তের দাবিও অস্বীকার করল সরকার। বালীর পক্ষে দায়ের করা হেবিয়াস করপাস শুনানীতে এটর্নি জেনারেল বললেন আদালতের সুনাম ুন্ন করার জন্য এ অভিযোগ করা হচ্ছে আসামী পক্ষ থেকে।
১৯৭১ সালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগসমূহের মধ্যে একটি অভিযোগ ছিল সুখরঞ্জন বালীর ভাই বিশাবালীকে হত্যার অভিযোগ। রাষ্ট্রপক্ষের এ অভিযোগের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে চেয়েছিলেন সুখরঞ্জন বালী। সাঈদীকে যে দুটি হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে তার মধ্যে একটি অভিযোগ হল বিশাবালীকে হত্যা।
বালী দাবী করেছেন তাকে ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে পুলিশ অপহরন করেছে। এরপর সরকারী হেফাজতে তাকে কয়েক সপ্তাহ আটকে রাখা হয়। এরপর সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়-বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে সীমান্ত পারি দিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করে তাদেরকে কিভাবে বিএসএফ হত্যা করে তার ডকুমেন্ট হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কাছে রয়েছে। ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশের দায়ে এপ্রিল মাসে বালীকে ভারতের একটি কোর্ট ১১০ দিনের জেল দেয়। তার কারাবাসের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো সে জেলে রয়েছে।
ভারতের দম দম জেলে বালীর বন্দী থাকার বিষয়টি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত মার্চ মাসে জানতে পেরেছে। কিন্তু বালীর নিরাপত্তার স্বার্থে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। গত বৃহষ্পতিবার ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ পত্রিকায় এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর আমরা বালী বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করছি বলে উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএন এইচসিআর) ভারতীয় অফিস কর্তৃক বালীর সাথে কথা বলার আগে যেন বালীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো না হয়। বালী কোন রাজনৈতিক আশ্রয় চায় কি-না এবং সে উদ্বাস্তু কি-না সেটি তারা নির্ধারন করতে পারে। বালী যদি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা নাও করে এবং তার এ দাবি যদি প্রত্যাখ্যানও হয় তবু তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো ঠিক হবেনা বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। কারণ এখানে তার এখানে জীবনের নিরাপত্তাহীনতার ঝুকি রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়-বালীকে যারা অপহরন করে সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঠেলে দিয়েছে তাদের ধারণা ছিল বিএসএফ তাকে হত্যা করবে অথবা সে চিরতের নিখোঁজ হয়ে যাবে।
ব্রাড অ্যাডাম বলেন, সত্যিই বালীর জীবন এখানে হুমকির সম্মুখীন। কারণ এখানে তাকে ফেরত পাঠালে অপহরনের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়বে। বালীর এখন একজন নিরপেক্ষ স্বাধীন আইনজীবী এবং ইউএনএইচসিআর এর সহায়তা দরকার যাতে তাকে তার নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি তুলে ধরা যায় এবং এ প্রেক্ষিতে সে সে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন