হাজী মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে আজ প্রথম সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়।
Mehedy Hasan
আমার নাম মোঃ দারুল ইসলাম, আমার বয়স-৭৩ বৎসর। আমার ঠিকানা ঃ গ্রাম-বচিয়ারা, থানা-আখাউড়া, জেলা-ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া। বর্তমান ঠিকানা ঃ গ্রাম-গংগানগর, থানা-আখাউড়া, জেলা-ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া।
বর্তমানে আমি অবসরপ্রাপ্ত। ১৯৬৩ সালে আমি পাকিস্তান আর্মিতে ভর্তি হই। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি মুক্তিযোদ্ধার ইনটেলিজেন্স সার্ভিসে হাবিলদার ছিলাম। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখে আমি ৪ মাসের ছুটি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাড়ীতে আসি। মার্চ মাসে ঢাকায় আসি বেতন নেওয়ার জন্য। বেতন নিতে এসে জানলাম যে, ৭ই মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আমি উদ্ভূদ্ধ হয়ে নিজ বাড়িতে যাই। বাড়িতে যাওয়ার পর এ্যাডভোকেট সিরাজুল হক সাহেবের পরামর্শ অনুযায়ী আমি স্থানীয় ছেলে পেলেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ১লা এপ্রিল থেকে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত ট্রেনিং প্রদান করি। ১৬ই এপ্রিল তারিখে পাক সেনা বাহিনী আমাদের এলাকায় আসে এবং সেখানে আমাদের সাথে তাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আমরা টিকতে না পারায় আমরা ভারতের আগরতলায় চলে যাই। আমি ভারতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতাম এবং ট্রেনিং দেওয়ার পর দলে দলে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দেশে পাঠাতাম অপারেশনের জন্য। এপ্রিলের ২০ তারিখে আমি ভারত থেকে নিজ বাড়িতে আসি। ২১শে এপ্রিল তারিখ সকাল বেলা ই,পি,আর, এর ফেলে যাওয়া একটি লাইট মেশিনগান পাই। সেই মেশিনগান পাওয়ার পর আমি বাড়িতে আরও ৫/৬ জনকে যোগাড় করে তাদের নিয়ে পুনরায় ভারতে যাই এবং গোয়েন্দাগিরি করার জন্য মাঝে মধ্যে দেশে আসি। গংগাসাগর দীঘির উত্তর পাড়ে পাক সেনাদের ক্যাম্প ছিল। সেই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল মেজর সেকান্দার এবং আমাদের এলাকার কিছু লোকজন যেমন বজু মিয়া, আবরু মিয়া, মোবারক আলী, মুক্তা মিয়া এবং জমসেদ মিয়া ঐ ক্যাম্পে আর্মিদের সাথে থাকতো। মোবারক মিয়া পাকিস্তান আমলে ই,পি,আর, তর সোর্স হিসাবে কাজ করতো। উল্লেখিত ব্যক্তিগণ সহ অন্যান্যরা রাজাকারের একটি দল গঠন করল। ১৯শে আগষ্ট আমরা মান্দাইল গ্রামের লোকজনের সাহায্যে তিনলাখপীর স্থানে ব্রীজ ভাঙ্গার জন্য যাই এবং ব্রীজ ভাঙ্গা হয়। আমার সংগে ছিল সুবেদার গিয়াস উদ্দিন, নায়েব সুবেদার আব্দুল কাদির এবং মিন্টু মিয়া সহ প্রায় ১২০ জন। ব্রীজ ভেঙ্গে আমরা চলে আসি। ২১শে আগষ্ট তারিখে জানতে পারি পাক সেনারা এবং রাজাকাররা এই মর্মে সন্দেহ করে যে, মান্দাইল গ্রামের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা ঐ ব্রীজটি ভেঙ্গেছে। পরদিন ২২শে আগষ্ট সকাল ৯-০০ টার দিকে গংগাসাগর পাক সেনাদের ক্যাম্প থেকে জামসেদ, মুক্তা মিয়া ও মোবারক মান্দাইল গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবর দেয় হাজি নূর বক্স এর বাড়িতে মিটিং হবে সেখানে যাওয়ার জন্য তাদেরকে বলে। বেলা তিনটার দিকে হাজী নূর বক্সের বাড়িতে প্রায় ১৩০/১৩২ জন লোক জড়ো হয়। ঐ সময় গংগাসাগর ক্যাম্প থেকে পাক সেনারা নৌকা যোগে এসে হাজি নূর বক্স এর বাড়ি ঘেরাও করে। ঐ বাড়িতে জমায়েত লোকজনদেরকে পাক সেনা ও রাজাকাররা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নৌকায় করে গংগাসাগর দীঘির পাড়ে পাক সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে কার বাবা, কার ভাই, কার আত্মীয় স্বজন মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে তাদের বাছাই করা হয়। সেখানে জমসেদ, মুক্তা মিয়া, মোবারক আলী, বজু মিয়া উপস্থিত থেকে উল্লেখিতভাবে মান্দাইল গ্রামের ২৬ জন এবং অন্যান্য গ্রামের ৭জন মোট ৩৩ জনকে বাছাই করে তাদেরকে দীঘির পশ্চিম পাড়ে নিয়ে যায়। বাকী লোকদেরকে পাক সেনাদের ক্যাম্পে আটক রাখে। দীঘির পশ্চিম পাড়ে উল্লেখিত ৩৩ জনকে দিয়ে গর্ত খোড়ায়। এরপর পাক সেনারা ঐ ৩৩জনকে ব্রাশ ফায়ার করে গুলি করে হত্যা করে ঐ গর্তে মাটি চাপা দেয়। ঐ সময় সেখানে মোবারক আলী, জমসেদ, মুক্তা মিয়া উপস্থিত ছিল। পরদিন ২৩শে আগষ্ট তারিখে ক্যাম্পে আটক রাখা বাকী লোকজনদেরকে নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়। আর্মি ক্যাম্প থেকে যাদেরকে নির্যাতনের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন আবুল বাশার যিনি ঈমামতি করেন তিনি জীবিত আছেন, তার নিকট থেকে আমি ঘটনার বিষয় জানতে পারি এবং আমি নিজেও গোয়েন্দা সূত্রে ঘটনার বিষয় জানতে পারি। গংগাসাগর ক্যাম্প থেকে রাজাকার বাহিনী গঠন করে মোবারক আলীকে রাজাকার কমান্ডার করে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার আনন্দময়ী কালি মন্দিরে পাঠায়। সেখানে গিয়ে মোবারক আলী ও তাহার সহ রাজাকাররা কালি মন্দিরে মূর্তি ভেঙ্গে লুটপাট করে কালিমন্দিরের নাম পরিবর্তন করে ‘‘রাজাকার মঞ্জিল” নাম দিয়ে সেখানে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর মোবারক আলী অন্য রাজাকারের উপর ঐ ক্যাম্পের দায়িত্ব দিয়ে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার সুহিলপুর রাজাকার ক্যাম্পের কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। সুহিলপুর রাজাকার ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে মোবারক আলীর দায়িত্বে ঐ এলাকায় বেশ কিছু হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়। ছাতিয়ান গ্রামের আব্দুল খালেক নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা তার অসুস্থ মাকে দেখার জন্য নিজ বাড়িতে গেলে মোবারক আলী ও তার সহযোগীরা তাকে ধৃত করে গুলি করে হত্যা করে। আসামী মোবারক আলী ইউনিয়ন পর্যায়ের একজন রোকন ছিলেন এবং তিনি স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে জামায়াতে ইসলামীর একজন সদস্য ছিলেন। আমি যে মোবারক আলীর কথা বলেছি তিনি অদ্য ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন (সনাক্তকৃত)। আমি অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী করেছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন