মেহেদী হাসান, ৭/১০/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে তার মধ্যে অন্যতম একটি অভিযোগ হল পাবনা জিলা স্কুলের হেড মাওলানা কছিমউদ্দিনকে হত্যা। রাষ্ট্রপক্ষ আনিত এ অভিযোগের পক্ষে দুজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবুর রহমান হাবিব। কছিমউদ্দিন হত্যার ঘটনা তিনি বর্ননা করতে গিয়ে ট্রাইব্যুনালে বলেছেন যে, ১৯৭১ সালে তিনি ঘটনার পর সমবেদনা জানানোর জন্য কছিমউদ্দিনের পাবনা শহরের বাসায় যান। তখন কছিমউদ্দিনের ছেলে শিবলী তাকে তার পিতার হত্যার ঘটনা জানায়। শিবলীর বরাত দিয়ে তিনি কছিমউদ্দিন হত্যার ঘটনা বর্ননা করেছেন ট্রাইব্যুনালে ।
কিন্তু কছিমউদ্দিনের ছেলে শিবলী এর প্রতিবাদ করে জানিয়ে বলেছেন পাবনা শহরে হাবিবুর রহমান হাবিবের সাথে দেখা হওয়ার ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা। শিবলী বলেছেন, ১৯৭১ সালে আমি বা আমার পরিবারের কেউ মাওলানা নিজামীকে চিনতামনা। শিবলী দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। নিউয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাক্ষাৎকারে তিনি এ দাবি করেছেন। সাক্ষাকারে তিনি বলেন, আমাদের পিতা হত্যার সাথে মাওলানা নিজামী জড়িত একথা আমাদের কেউ কোনদিন বলেনি।
হাবিবুর রহমানের জবানবন্দী এবং শিবলীর প্রতিবাদ বিষয়ে জানানর আগে কছিমউদ্দিন হত্যার ঘটনা বিষয়ে জানা যাক।
ঘটনার বিবরণঃ
কছিমউদ্দিন হত্যা বিষয়ে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আনিত অভিযোগে বলা হয়েছে শহীদ মাওলানা কছিমুদ্দিন আহমেদ পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা ছিলেন। মতিউর রহমান নিজামী তাকে হত্যার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে। তিনি এ খবর জানতে পেরে আত্মপোগন করেন। ১৯৭১ সালের ৪ জুন ১৯৭১ তারিখ সকালে উলাপাড়া যাওয়ার জন্য বাস যোগে রওয়ানা করেন। এসময় মোসলেম খার তেমাথার মোড়ে অবস্থিত পাকিস্তানী আর্মির চেকপোষ্টে আর্মিরা তাকে বাস থেকে নামিয়ে পাবনা শহরের নূরপুর ওয়াপদা পাওয়ার হাউজ আর্মি ক্যাম্পে নিয়া আসামী মতিউর রহমান নিজামীর উপস্থিতিতে ও ইঙ্গিতে তার উপর সীমাহীন নির্যাতন চলে। অতঃপর ১০ জুন ১৯৭১ তারিখ ভোর অনুমান ছয় টার সময় মাধপুর আর্মি ক্যাম্প সংলগ্ন ইছামতী নদীর পাড়ে অজ্ঞাত দুই সঙ্গী সহ তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
হাবিবুর রহমানের জবানবন্দী :
গত ১৪ এপ্রিল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন মোঃ হাবিবুর রহমান হাবিব। তিনি পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। তিনি তার জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালে ১১ এপ্রিল হানাদার বাহিনী পাবনা দখল করে নেয়। তখন আমি এবং আমার বড় ভাই শহিদুল্লাহ এবং আমাদের সঙ্গে আরও তিন/চারশত ছাত্র ভারতে চলে যাই। আমরা ৪৫ জনের একটি দল মুক্তিযুদ্ধের উপর উচ্চ শ্রেণীর ট্রেনিং নেওয়ার জন্য দেরাদুন যাই। সেখানে আমরা ৪৫ দিন ট্রেনিং গ্রহণ শেষে ১৭ আগষ্ট তারিখে পাবনা ফিরে আসি। আমরা ভারতে থাকা অবস্থায় জানতে পারি পাবনা জেলা স্কুলের হেড মওলানা শিক্ষক কছিমুদ্দিন স্যারকে মেরে ফেলা হয়েছে। ঐ স্যারের ছেলের নাম শিবলী, সে আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল। ১৯ আগষ্ট গভীর রাতে আমি স্যারের মৃত্যুর সমবেদনা জানাতে স্যারের বাসায় শিবলীর সঙ্গে দেখা করি। তখন সে তার বাবার মৃত্যুর বর্ণনা আমাকে বলে। সে বলে যে, ৪ জুন, ১৯৭১ তারিখে তার বাবা বাড়ি থেকে পালানোর জন্য বলে, মতিউর রহমান নিজামী তাকে (কছিমুদ্দিন সাহেব) মেরে ফেলার জন্য তালিকা করেছে। কছিমুদ্দিন সাহেব তার পরিবারের লোকজনকে বলেন যে, তিনি নিরাপদ নন এবং বাড়ির অন্যান্যদের সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে বাড়ি থেকে তিনি পালিয়ে যান এবং মোসলেম পরামানিকের তেমাথা নামক স্থান থেকে একটি চলন্ত বাসে উঠেন। সেখানে কিছু জামায়াতের লোকজন তাকে চিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরায়ে দেয়। তৎপর মাওলানা সাহেবকে নূরপুর আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বন্ধু শিবলী আরও জানায় যে, তার বাবাকে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। শিবলী এবং তার মা, ভাই, বোনেরা নূরপুর আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে মাওলানা সাহেবকে ছাড়িয়ে আনার জন্য কাকুতি মিনতী করতে থাকে। তখন তারা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে আর্মি ক্যাম্পের গেটে ঢুকতে দেখে মাওলানা সাহেবকে মুক্ত করার জন্য নিজামী সাহেবের পায়ে ধরে কান্নাকাটি করতে থাকে। তখন নিজামী সাহেব শিবলীর মাকে বলে যে, তোমার স্বামীকে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে বলো গিয়ে। কছিমুদ্দিন মাওলানা সাহেব অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাবনা জেলা স্কুলে ডামী রাইফেল দিয়ে ছাত্রদের ট্রেনিং দিতেন। ১০ জুন, ১৯৭১ তারিখে নূরপুর আর্মি ক্যাম্প থেকে কছিমুদ্দিন মাওলনা সাহেবকে মাধপুর ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে এবং আরও দুইজনকে বাঁশ বাগানের মধ্যে নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে। শিবলী আমাকে আরও বলে যে, খবর পেয়ে তাদের পরিবার সেখানে গিয়ে কছিমুদ্দিন সাহেবের কবর দেখতে পান এবং স্থানীয় লোকজনের নিকট শুনতে পায় যে, মতিউর রহমান নিজামী সাহেব হত্যার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
কছিম উদ্দিনের ছেলে শিবলীর দাবি :
নিউয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে কছিমউদ্দিনের ছেলে শিবলী বলেছেন আমার নামে ট্রাইব্যুনালে হাবিবুর রহমান হাবি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার প্রতিবেদনটি এখানে উল্লেখ করা হল।
পাবনা জেলার প্রখ্যাত শিক্ষক ও সমাবসেবক, মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মাওলানা কছিমুদ্দিন সাহেবের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী পুত্র শিবলী এই প্রতিবেদকের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি পত্রপত্রিকার মাধ্যমে সম্প্রতি জানতে পেরেছি যে, পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান কমান্ডার হাবিবুর রহমান হাবিব আমার বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিযে বরেছেন যে, আমি নাকি তার ঘনিষ্ট বন্ধু এবং ১৯৭১ সালের ১৯ আগস্ট, তিনি আমার সাথে আমাদের পাবনাস্থ বাসায় এসে দেখা করেন। সে সময় আমি নাকি তাকে বলেছিলাম যে, ‘৪ঠা জুন ১৯৭১ তারিখে আমার বাবা মাওলানা কছিমুদ্দিন বাড়ি থেকে পালানোর সময় বলে যে, মতিউর রহমান নিজামী সাহেব তাকে (মাওলানা কছিমুদ্দিনকে) মেরে ফেলার জন্য তালিকা করেছে।’ আমি নাকি তাকে আরো বলেছিলাম যে, ‘আমি এবং আমার মা নুরপুর ওয়াপদা হাউসের গেটে মাওলানা নিজামী সাহেবের পা ধরে আমার বাবার মুক্তির জন্য কান্নাকাটি করি’ এবং আমার পিতার শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে আমরা মাধপুরে কবর দেখতে যাই এবং স্থানীয় লোকজনের নিকট শুনতে পাই যে, মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আমার পিতার হত্যার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।’ এ ব্যাপারে আমার পরিষ্কার বক্তব্য হল, আমি হাবিবুর রহমান হাবিব সাহেবকে চিনি বটে কিন্তু বয়সে তিনি আমার চাইতে বছর পাঁচেকের ছোট এবং আমি কখনই কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম না। সঙ্গত কারণেই হাবিবুর রহমান হাবিব সাহেব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যে সময় হাবিব সাহেব আমার সাথে আমাদের পাবনাস্থ বাসায় দেখা হওয়ার কথা বলেছেন, সে সময় পাক হানাদার বাহিনীর হামলার আশঙ্কায় আমার মরহুম শহীদ পিতা আমাদের সবাইকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে বর্তমান সিরাজগঞ্জে জেলার শাহজাদপুরে রেখে আসেন। আমি এ সময়টিতে শাহজাদপুরে অবস্থান করছিলাম বিধায় আমার সাথে পাবনা শহরের বাসায় হাবিব সাহেবের সাথে দেখা হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ অবান্তর ঘটনা। আমরা পরবর্তীতে লোকমুখে শুনতে পেরে আমার মরহুম শহীদ পিতার কবর মাধপুরে আবিষ্কার করি।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে আমি কিংবা আমার পরিবার ১৯৭১ সালে চিনতাম না এমনকি আমারা তার নামও ১৯৭১ সালের বহুপর পর্যন্ত শুনি নাই। আমাদের পরিবারের কিংবা আমার শহীদ পিতার সাথে তার সঙ্গত কারণেই কোনো ধরনের শত্রুতা থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আমাদেরকে কেউ কোনোদিন বলেনি যে, আমার পিতার হত্যাকাণ্ডের সাথে মাওলানা নিজামী সাহেব জড়িত।
আমি দীর্ঘদিন প্রবাসে বাস করছি এবং দেশের কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে কোনোভাবেই জড়িত নই। আমার পিতা মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। বাংলাদেদেশের সরকার আমার পিতার স্মরণে ডাকটিকেট প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গ্রন্থে আমার পিতার শাহাদতের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আমরা সন্তানেরা বিভিন্ন পত্রিকায় এ ব্যাপারে সাক্ষাৎকার নিয়েছি। হঠাৎ করে আমাদের বরাত কাওকে নতুন করে জড়িয়ে কেউ অসত্য বক্তব্য দিক এটি আমাদের কাম্য নয়। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে তার মধ্যে অন্যতম একটি অভিযোগ হল পাবনা জিলা স্কুলের হেড মাওলানা কছিমউদ্দিনকে হত্যা। রাষ্ট্রপক্ষ আনিত এ অভিযোগের পক্ষে দুজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবুর রহমান হাবিব। কছিমউদ্দিন হত্যার ঘটনা তিনি বর্ননা করতে গিয়ে ট্রাইব্যুনালে বলেছেন যে, ১৯৭১ সালে তিনি ঘটনার পর সমবেদনা জানানোর জন্য কছিমউদ্দিনের পাবনা শহরের বাসায় যান। তখন কছিমউদ্দিনের ছেলে শিবলী তাকে তার পিতার হত্যার ঘটনা জানায়। শিবলীর বরাত দিয়ে তিনি কছিমউদ্দিন হত্যার ঘটনা বর্ননা করেছেন ট্রাইব্যুনালে ।
কিন্তু কছিমউদ্দিনের ছেলে শিবলী এর প্রতিবাদ করে জানিয়ে বলেছেন পাবনা শহরে হাবিবুর রহমান হাবিবের সাথে দেখা হওয়ার ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা। শিবলী বলেছেন, ১৯৭১ সালে আমি বা আমার পরিবারের কেউ মাওলানা নিজামীকে চিনতামনা। শিবলী দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। নিউয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাক্ষাৎকারে তিনি এ দাবি করেছেন। সাক্ষাকারে তিনি বলেন, আমাদের পিতা হত্যার সাথে মাওলানা নিজামী জড়িত একথা আমাদের কেউ কোনদিন বলেনি।
হাবিবুর রহমানের জবানবন্দী এবং শিবলীর প্রতিবাদ বিষয়ে জানানর আগে কছিমউদ্দিন হত্যার ঘটনা বিষয়ে জানা যাক।
ঘটনার বিবরণঃ
কছিমউদ্দিন হত্যা বিষয়ে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আনিত অভিযোগে বলা হয়েছে শহীদ মাওলানা কছিমুদ্দিন আহমেদ পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা ছিলেন। মতিউর রহমান নিজামী তাকে হত্যার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে। তিনি এ খবর জানতে পেরে আত্মপোগন করেন। ১৯৭১ সালের ৪ জুন ১৯৭১ তারিখ সকালে উলাপাড়া যাওয়ার জন্য বাস যোগে রওয়ানা করেন। এসময় মোসলেম খার তেমাথার মোড়ে অবস্থিত পাকিস্তানী আর্মির চেকপোষ্টে আর্মিরা তাকে বাস থেকে নামিয়ে পাবনা শহরের নূরপুর ওয়াপদা পাওয়ার হাউজ আর্মি ক্যাম্পে নিয়া আসামী মতিউর রহমান নিজামীর উপস্থিতিতে ও ইঙ্গিতে তার উপর সীমাহীন নির্যাতন চলে। অতঃপর ১০ জুন ১৯৭১ তারিখ ভোর অনুমান ছয় টার সময় মাধপুর আর্মি ক্যাম্প সংলগ্ন ইছামতী নদীর পাড়ে অজ্ঞাত দুই সঙ্গী সহ তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
হাবিবুর রহমানের জবানবন্দী :
গত ১৪ এপ্রিল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন মোঃ হাবিবুর রহমান হাবিব। তিনি পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। তিনি তার জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালে ১১ এপ্রিল হানাদার বাহিনী পাবনা দখল করে নেয়। তখন আমি এবং আমার বড় ভাই শহিদুল্লাহ এবং আমাদের সঙ্গে আরও তিন/চারশত ছাত্র ভারতে চলে যাই। আমরা ৪৫ জনের একটি দল মুক্তিযুদ্ধের উপর উচ্চ শ্রেণীর ট্রেনিং নেওয়ার জন্য দেরাদুন যাই। সেখানে আমরা ৪৫ দিন ট্রেনিং গ্রহণ শেষে ১৭ আগষ্ট তারিখে পাবনা ফিরে আসি। আমরা ভারতে থাকা অবস্থায় জানতে পারি পাবনা জেলা স্কুলের হেড মওলানা শিক্ষক কছিমুদ্দিন স্যারকে মেরে ফেলা হয়েছে। ঐ স্যারের ছেলের নাম শিবলী, সে আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল। ১৯ আগষ্ট গভীর রাতে আমি স্যারের মৃত্যুর সমবেদনা জানাতে স্যারের বাসায় শিবলীর সঙ্গে দেখা করি। তখন সে তার বাবার মৃত্যুর বর্ণনা আমাকে বলে। সে বলে যে, ৪ জুন, ১৯৭১ তারিখে তার বাবা বাড়ি থেকে পালানোর জন্য বলে, মতিউর রহমান নিজামী তাকে (কছিমুদ্দিন সাহেব) মেরে ফেলার জন্য তালিকা করেছে। কছিমুদ্দিন সাহেব তার পরিবারের লোকজনকে বলেন যে, তিনি নিরাপদ নন এবং বাড়ির অন্যান্যদের সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে বাড়ি থেকে তিনি পালিয়ে যান এবং মোসলেম পরামানিকের তেমাথা নামক স্থান থেকে একটি চলন্ত বাসে উঠেন। সেখানে কিছু জামায়াতের লোকজন তাকে চিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরায়ে দেয়। তৎপর মাওলানা সাহেবকে নূরপুর আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বন্ধু শিবলী আরও জানায় যে, তার বাবাকে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। শিবলী এবং তার মা, ভাই, বোনেরা নূরপুর আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে মাওলানা সাহেবকে ছাড়িয়ে আনার জন্য কাকুতি মিনতী করতে থাকে। তখন তারা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে আর্মি ক্যাম্পের গেটে ঢুকতে দেখে মাওলানা সাহেবকে মুক্ত করার জন্য নিজামী সাহেবের পায়ে ধরে কান্নাকাটি করতে থাকে। তখন নিজামী সাহেব শিবলীর মাকে বলে যে, তোমার স্বামীকে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে বলো গিয়ে। কছিমুদ্দিন মাওলানা সাহেব অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাবনা জেলা স্কুলে ডামী রাইফেল দিয়ে ছাত্রদের ট্রেনিং দিতেন। ১০ জুন, ১৯৭১ তারিখে নূরপুর আর্মি ক্যাম্প থেকে কছিমুদ্দিন মাওলনা সাহেবকে মাধপুর ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে এবং আরও দুইজনকে বাঁশ বাগানের মধ্যে নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে। শিবলী আমাকে আরও বলে যে, খবর পেয়ে তাদের পরিবার সেখানে গিয়ে কছিমুদ্দিন সাহেবের কবর দেখতে পান এবং স্থানীয় লোকজনের নিকট শুনতে পায় যে, মতিউর রহমান নিজামী সাহেব হত্যার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
কছিম উদ্দিনের ছেলে শিবলীর দাবি :
নিউয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে কছিমউদ্দিনের ছেলে শিবলী বলেছেন আমার নামে ট্রাইব্যুনালে হাবিবুর রহমান হাবি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার প্রতিবেদনটি এখানে উল্লেখ করা হল।
পাবনা জেলার প্রখ্যাত শিক্ষক ও সমাবসেবক, মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মাওলানা কছিমুদ্দিন সাহেবের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী পুত্র শিবলী এই প্রতিবেদকের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি পত্রপত্রিকার মাধ্যমে সম্প্রতি জানতে পেরেছি যে, পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান কমান্ডার হাবিবুর রহমান হাবিব আমার বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিযে বরেছেন যে, আমি নাকি তার ঘনিষ্ট বন্ধু এবং ১৯৭১ সালের ১৯ আগস্ট, তিনি আমার সাথে আমাদের পাবনাস্থ বাসায় এসে দেখা করেন। সে সময় আমি নাকি তাকে বলেছিলাম যে, ‘৪ঠা জুন ১৯৭১ তারিখে আমার বাবা মাওলানা কছিমুদ্দিন বাড়ি থেকে পালানোর সময় বলে যে, মতিউর রহমান নিজামী সাহেব তাকে (মাওলানা কছিমুদ্দিনকে) মেরে ফেলার জন্য তালিকা করেছে।’ আমি নাকি তাকে আরো বলেছিলাম যে, ‘আমি এবং আমার মা নুরপুর ওয়াপদা হাউসের গেটে মাওলানা নিজামী সাহেবের পা ধরে আমার বাবার মুক্তির জন্য কান্নাকাটি করি’ এবং আমার পিতার শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে আমরা মাধপুরে কবর দেখতে যাই এবং স্থানীয় লোকজনের নিকট শুনতে পাই যে, মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আমার পিতার হত্যার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।’ এ ব্যাপারে আমার পরিষ্কার বক্তব্য হল, আমি হাবিবুর রহমান হাবিব সাহেবকে চিনি বটে কিন্তু বয়সে তিনি আমার চাইতে বছর পাঁচেকের ছোট এবং আমি কখনই কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম না। সঙ্গত কারণেই হাবিবুর রহমান হাবিব সাহেব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যে সময় হাবিব সাহেব আমার সাথে আমাদের পাবনাস্থ বাসায় দেখা হওয়ার কথা বলেছেন, সে সময় পাক হানাদার বাহিনীর হামলার আশঙ্কায় আমার মরহুম শহীদ পিতা আমাদের সবাইকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে বর্তমান সিরাজগঞ্জে জেলার শাহজাদপুরে রেখে আসেন। আমি এ সময়টিতে শাহজাদপুরে অবস্থান করছিলাম বিধায় আমার সাথে পাবনা শহরের বাসায় হাবিব সাহেবের সাথে দেখা হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ অবান্তর ঘটনা। আমরা পরবর্তীতে লোকমুখে শুনতে পেরে আমার মরহুম শহীদ পিতার কবর মাধপুরে আবিষ্কার করি।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে আমি কিংবা আমার পরিবার ১৯৭১ সালে চিনতাম না এমনকি আমারা তার নামও ১৯৭১ সালের বহুপর পর্যন্ত শুনি নাই। আমাদের পরিবারের কিংবা আমার শহীদ পিতার সাথে তার সঙ্গত কারণেই কোনো ধরনের শত্রুতা থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আমাদেরকে কেউ কোনোদিন বলেনি যে, আমার পিতার হত্যাকাণ্ডের সাথে মাওলানা নিজামী সাহেব জড়িত।
আমি দীর্ঘদিন প্রবাসে বাস করছি এবং দেশের কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে কোনোভাবেই জড়িত নই। আমার পিতা মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। বাংলাদেদেশের সরকার আমার পিতার স্মরণে ডাকটিকেট প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গ্রন্থে আমার পিতার শাহাদতের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আমরা সন্তানেরা বিভিন্ন পত্রিকায় এ ব্যাপারে সাক্ষাৎকার নিয়েছি। হঠাৎ করে আমাদের বরাত কাওকে নতুন করে জড়িয়ে কেউ অসত্য বক্তব্য দিক এটি আমাদের কাম্য নয়। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন