মেহেদী হাসান, ১/১০/২০১৩
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বিশিষ্ট পার্লামেন্টরিয়ান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুাল -১ আজ তার বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষনা করে।
চারটি অভিযোগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া তিনটি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে ২০ বছর এবং আরো দুটি অভিযোগের প্রতিটিতে পাঁচ বছর করে জেল দেয়া হয়েছে।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মোট ২৩ টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপক্ষ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগের মধ্য থেকে ১৭টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষী হাজির করে । ১৭টি অভিযোগ থেকে তাকে মোট ৯টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। বাকী আটটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে।
এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ বাকী যে ছয়টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য প্রমান হাজির করেনি সে ছয়টি অভিযোগ থেকেও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে খালাস দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাকে মোট ১৪টি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। বিস্তারিত আসছে।
জনাকীর্ন ট্রাইব্যুনাল কক্ষে আজ আলোচিত এবং ঘটনাবহুল এ মামলার রায় প্রদান করা হয়। রায় ঘোষনা উপলক্ষে সকাল থেকেই বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে কোর্ট প্রাঙ্গনে। এছাড়া রায় ঘোষনার আগেই সুপ্রীম কোর্ট এবং ট্রাইব্যূনালে উপস্থিত সাংবাদিক এবং অন্যান্য লোকজনের মুখে ছড়িয়ে পড়ে রায় ফাঁস হওয়ার বিষয়টি। সব মিলিয়ে আলোচিত এ রায়কে কেন্দ্র করে আজ একটি ভিন্ন মাত্রা বিরাজ করে কোর্ট প্রাঙ্গনে। সকাল ১০টা ৪২ মিনিটের সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালের বিচার কক্ষে হাজির করা হয়। এরপরপরই ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারপতি এজলাশে প্রবেশ করেন এবং রায় পড়ে শোনাতে শুরু করেন। ট্রাইব্যুনাল-১ চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক পালাক্রমে রায় পড়ে শোনান। মূল রায়টি ১৭২ পৃষ্ঠার। সেখান থেকে সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনানো হয়।
মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ৪ অভিযোগ :
যে চারটি অভিযোগে মুত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে সেগুলো হল ৩, ৫, ৬ এবং ৮ নং অভিযোগ।
অভিযোগ-৩ : রাষ্ট্রপক্ষের এ অভিযোগে বলা হয় ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে এবং নির্দেশে রাউজানের গহিরায় অবস্থিত কুন্ডেশ্বরী কমপ্লেক্স এর প্রতিষ্ঠাতা সমাজসেবক অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে পাকিস্তান আর্মি গুলি করে হত্যা করে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজেও তাকে গুলি করে ।
অভিযোগ-৫ : এ অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয় ১৯৭১ সালে ১৩ এপ্রিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কতিপয় অনুসারীদের নিয়ে রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে।
অভিযোগ-৬ : ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় সশস্ত্র অভিযান চালান। এসময় ৫০ থেকে ৫৫ জন হিন্দুকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-৮ : ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ তার পুত্র শেখ আলমগীরসহ তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য প্রাাইভেটকারযোগে চট্টগ্রামের রাউজান থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসছিলেন। পথে হাটহাজারী থানার খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি তিন রাস্তার মোড়ে সকাল অনুমান ১১টার দিকে পৌঁছামাত্র আসামি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যরা তাদের প্রাাইভেট গাড়িটি অবরোধ করে শেখ মোজাফফর আহম্মেদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আটক করে স্থানীয় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে আর তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
২০ বছর জেলদন্ডের ৩ অভিযোগ :
২, ৪ এবং ৭ নং অভিযোগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
অভিযোগ ২ : ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একদল সদস্য রাউজানের গহিরা গ্রামের হিন্দু পাড়ায় সশস্ত্র অভিযান চালায়। এসময় পঞ্চবালা শর্মা, সুনীল শর্মা, মতিলাল শর্মা ও দুলাল শর্মা লাল শর্মা তিন চারদিন পর মারা যায়।
অভিযোগ ৪ : এ অভিযোগে বলা হয় ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী স্থানীয় সহযোগী এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত জগৎমলপাড়ায় অভিযান চালান। এসময় ৩২ জনকে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ ৭ : ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি সেনা সদস্য রাউজান পৌরসভা এলাকার সতীশ চন্দ্র পালিতের বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয।
পাঁচ বছর কারাদান্ডের ২ অভিযোগ :
১৭ এবং ১৮ নং অভিযোগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ১৭ নং অভিযোগে বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে বন্দী করে রাখা হয়। ১৮ নং অভিযোগে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম জেলার চান্দগাঁও থানার মোহারা গ্রামের সালেহউদ্দিনকে অপহরণ করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পারিবারিক বাসভবন গুড়সহিলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার গালে চড় মারেন।
আলোচিত ঘটনাবহুল একটি মামলা :
ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলার রায় হয়েছে এবং আরো যেসব মামলা বিচারাধীন রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম আলোচিত মামলা ছিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী মামলা। তবে আজ রায় প্রকাশের আগেই রায় ফাঁস হয়ে যাবার অভিযোগের ঘটনার মধ্য দিয়ে এ মামলায় আলোচনার নতুন মাত্রা যোগ হল। রায় ঘোষনা উপলক্ষে সকালে আদালতে আসেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সদস্য এবং আইনজীবীরা। তারা ফাঁস হওয়া রায়ের একটি কবি হাতে করে আদালতে আসেন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী হল বিএনপির প্রথম কোন নেতা যার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক রায় প্রদান করা হল। ২০১১ সালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিচারের উদ্যোগ গ্রহন উপলক্ষে তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজিরের পর থেকে বিচার চলাকালে নানা ধরনের মন্তব্য করে বিভিন্ন সময় সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন জনপ্রিয় এই রাজনীতিক। আজও তিনি রায় ঘোষনার সময় দাড়িয়ে বলেছেন এ রায় পড়ে লাভ কি। এসবতো আগেই ইন্টারনেটে অনলাইনে চলে এসেছে।
ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজে সাক্ষীকে জেরা করেছেন মাঝে মধ্যে। তার পক্ষে তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান, হাইকোর্টের বিচারপতি শামীম হাসনাইন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ পরিচিত এবং জনপ্রিয় বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গকে সাক্ষী মানার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়েছে। বিচারের শুরুতে তিনি তার পক্ষে কোন আইনজীবী নিয়োগ না করে নিজেই নিজের মামলায় লড়বেন বলে ঘোষনা দেন। এরপর তার পক্ষে একজন রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার পর তিনি নিজে আবার আইনজীবী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। বিচার চলাকালে এক পর্যায়ে আবার নিজের আইনজীবী প্রত্যাহর করে নেন এবং আবারো তার পক্ষে রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নিয়োগের ঘটনা ঘটে।
পাকিস্তান অবস্থানের দাবি নাকচ :
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া এবং বোয়ালিয়া থানায় বিভিন্ন হত্যা, গনহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে হত্যা নির্যাতন এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে হত্যা, নির্মূল এবং দেশান্তরকরনের অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। আর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দাবি ছিল ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ তিনি পাকিস্তানে চলে যান। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বদলী ছাত্র হিসেবে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং যুদ্ধের পুরো সময় পাকিস্তান অবস্থান করেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন শেষে ১৯৭১ সালের অক্টোবার মাসে লন্ডনে চলে যান এবং লিঙ্কন ইনে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৭৪ সালে তিনি সর্বপ্রথম দেশে আসেন বলে দাবি করে তিনি।
১৯৭১ সালে তার পাকিস্তান অবস্থান বিষয়ে বাংলাদেশের এবং পাকিস্তানের জীবিত অনেক ভিআইপি ব্যক্তিবর্গের নাম উল্লেখ করেছিলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার জবানবন্দীতে। বাংলাদেশে যাদের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন সুপ্রীম কোর্টের বর্তমান বিচারপতি শামীম হাসনাইনের নাম। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন শামীম হাসনাইন তার সাথে তখন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন এবং তিনি তার বন্ধু ছিলেন। এছাড়া বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও সেসময় পাকিস্তান অবস্থান করছিলেন এবং তার সাথে নিয়মিত দেখা সাক্ষাত হত দাবি করে তাকেও তিনি সাক্ষী মেনেছিলেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানে অবস্থান বিষয়ে পাকিস্তানে বর্তমানে জীবিত যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট এবং ২০০৮ সালে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মিয়া সামরু, সাবেক তথ্যমন্ত্রী ইসকাহ খান খাকওয়ানী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিদ্দিক খান কানজু প্রমুখ। এরা সকলেই তার কাসমেট ছিলেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ট্রাইব্যুনালে বলেন, আমি যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ছিলাম সে মর্মে তারাসহ আরো অনেকে এফিডেভিড পাঠিয়েছেন আমাকে। তারা আমার পক্ষে এসে সাক্ষ্য দিতে চান কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের এদেশে আসার বিষয়ে ভিসা দিচ্চেনা।
তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার পাকিস্তান অবস্থান বিষয়ে দাবি নাকচ করে দেয়া হয়েছে রায়ে। এ দাবি নাকচের পক্ষে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ২৯/৯/১৯৭১ সালে একটি খবর প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রপক্ষ সে ডকুমেন্ট আদালতে দাখিল করেছে। ওই খবরের শিরোনাম ছিল বোমার আঘাতে ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে আহত। খবরে বলা হয়েছে তাদের গাড়ির ওপর বোমা হামলা হয় এবং এতে ফজলুল কাদের চৌধুরীর বড় ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আহত হয়। তাদের চালক নিহত হয়েছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এ ঘটনার পর যে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন সে মর্মে তখনকার একজন ডাক্তার সাক্ষ্য দিয়েছেন। কাজেই রাষ্ট্রপক্ষ যে সাক্ষ্য প্রমান হাজির করেছে তাতে এটি প্রমানিত যে তিনি তখন দেশে ছিলেন। তিনি দেশে ছিলেনননা আসামী পক্ষ এ দাবি প্রমানে ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই এ আবেদন নাকচ করা হল।
রায়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রতি উষ্মা : রায়ে বলা হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এ পর্যন্ত ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি একজন বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান, আইন প্রনেতা। কিন্তু তিনি বিচার চলাকালে এ কোর্টে যেসব আচরন করেছেন মাঝে মাঝে তা দু:খজনক। আমরা তার অনেক বিষয় খেয়াল করেছি। তিনি কোর্টের ডেকোরাম মানতে চাননি। মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে চিৎকার করেছেন। তাকে সতর্কও করা হয়েছে এজন্য বিভিন্ন সময়। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এবং মেম্বারদের তিনি চেয়ারম্যান সাহেব এবং মেম্বার সাহেব বলে সম্বোধন করেছেন। বিচারপতিরা আদালত কক্ষ ত্যাগ করার সময় তিনি বসে থাকতেন বলে লক্ষ্য করা গেছে ।
রায়ের কপি হাতে ট্রাইব্যুনালে আসেন আসামী পক্ষ :
আজ সকাল থেকেই হাইকোর্ট এবং ট্রাইব্যুনাল অঙ্গনে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় ফাঁস হওয়ার অভিযোগের ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী এবং পরিবারের সদস্যরা ফাঁস হওয়া রায়ের ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা কপি নিয়ে হাজির হন ট্রাইব্যুনালে। তারা অনেককে এটি দেখিয়ে বলেন আমরা রায়ের কপি আগেই পেয়ে গেছি। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী এবং স্ত্রী অভিযোগ করেন আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার থেকে এ রায়ের কপি ফাঁস হয়েছে এবং রায় আইন মন্ত্রনালয় থেকেই লেখা হয়েছে।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি পরিচিত নাম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি পরপর ছয়বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি আলোচিত একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজে (বর্তমানে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ) ভর্তি ১৯৬০ সালে এবং সেখান থেকে এসএসসি ১৯৬৬ সালে। এরপর নটরডেম কলেজে ১৯৬৬ সালে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্নাসে ভর্তির পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে বদলি হন এবং সেখানে অধ্যয়ন শেষে ১৯৭১ সালে অক্টোবর মাসে লন্ডনের লিঙ্কন ইনে ভর্র্তি হন ব্যারিস্টারি পড়ালেখার জন্য। তবে তা শেষ করেননি তিনি। ক্যাডেট কলেজে ভর্তির আগে তিনি পাকিস্তানের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাদিক পাবলিক স্কুলে পড়াশুনা করেন।
ছাত্রজীবনে তিনি সরাসরি কোন ছাত্রসংগঠনের সাথে জড়িত না থাকলেও আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে এই আন্দোলনে নিহত আসাদ এর মৃত্যুর সময় ঘটনাস্তল থেকে মাত্র ১০ ফুট দূরে অবস্থান করছিলেন বলে জবানবন্দীতে উল্লেখ করেন।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
গত বছর ১৯ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। এক বছর চার মাসের মাথায় আলোচিত এ মামলার সমস্ত বিচার কার্যক্রম শেষ হয় গত ১৪ আগস্ট। ওই দিন যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়।
২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোরে গ্রেফতার করা হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে।
১৭টি অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৪১ জন সাক্ষী হাজির করে। অপর দিকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে আসামী নিজেসহ মোট চারজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বিশিষ্ট পার্লামেন্টরিয়ান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুাল -১ আজ তার বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষনা করে।
চারটি অভিযোগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া তিনটি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে ২০ বছর এবং আরো দুটি অভিযোগের প্রতিটিতে পাঁচ বছর করে জেল দেয়া হয়েছে।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মোট ২৩ টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপক্ষ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগের মধ্য থেকে ১৭টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষী হাজির করে । ১৭টি অভিযোগ থেকে তাকে মোট ৯টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। বাকী আটটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে।
এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ বাকী যে ছয়টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য প্রমান হাজির করেনি সে ছয়টি অভিযোগ থেকেও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে খালাস দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাকে মোট ১৪টি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। বিস্তারিত আসছে।
জনাকীর্ন ট্রাইব্যুনাল কক্ষে আজ আলোচিত এবং ঘটনাবহুল এ মামলার রায় প্রদান করা হয়। রায় ঘোষনা উপলক্ষে সকাল থেকেই বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে কোর্ট প্রাঙ্গনে। এছাড়া রায় ঘোষনার আগেই সুপ্রীম কোর্ট এবং ট্রাইব্যূনালে উপস্থিত সাংবাদিক এবং অন্যান্য লোকজনের মুখে ছড়িয়ে পড়ে রায় ফাঁস হওয়ার বিষয়টি। সব মিলিয়ে আলোচিত এ রায়কে কেন্দ্র করে আজ একটি ভিন্ন মাত্রা বিরাজ করে কোর্ট প্রাঙ্গনে। সকাল ১০টা ৪২ মিনিটের সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালের বিচার কক্ষে হাজির করা হয়। এরপরপরই ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারপতি এজলাশে প্রবেশ করেন এবং রায় পড়ে শোনাতে শুরু করেন। ট্রাইব্যুনাল-১ চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক পালাক্রমে রায় পড়ে শোনান। মূল রায়টি ১৭২ পৃষ্ঠার। সেখান থেকে সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনানো হয়।
মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ৪ অভিযোগ :
যে চারটি অভিযোগে মুত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে সেগুলো হল ৩, ৫, ৬ এবং ৮ নং অভিযোগ।
অভিযোগ-৩ : রাষ্ট্রপক্ষের এ অভিযোগে বলা হয় ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে এবং নির্দেশে রাউজানের গহিরায় অবস্থিত কুন্ডেশ্বরী কমপ্লেক্স এর প্রতিষ্ঠাতা সমাজসেবক অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে পাকিস্তান আর্মি গুলি করে হত্যা করে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজেও তাকে গুলি করে ।
অভিযোগ-৫ : এ অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয় ১৯৭১ সালে ১৩ এপ্রিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কতিপয় অনুসারীদের নিয়ে রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে।
অভিযোগ-৬ : ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় সশস্ত্র অভিযান চালান। এসময় ৫০ থেকে ৫৫ জন হিন্দুকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-৮ : ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ তার পুত্র শেখ আলমগীরসহ তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য প্রাাইভেটকারযোগে চট্টগ্রামের রাউজান থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসছিলেন। পথে হাটহাজারী থানার খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি তিন রাস্তার মোড়ে সকাল অনুমান ১১টার দিকে পৌঁছামাত্র আসামি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যরা তাদের প্রাাইভেট গাড়িটি অবরোধ করে শেখ মোজাফফর আহম্মেদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আটক করে স্থানীয় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে আর তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
২০ বছর জেলদন্ডের ৩ অভিযোগ :
২, ৪ এবং ৭ নং অভিযোগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
অভিযোগ ২ : ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একদল সদস্য রাউজানের গহিরা গ্রামের হিন্দু পাড়ায় সশস্ত্র অভিযান চালায়। এসময় পঞ্চবালা শর্মা, সুনীল শর্মা, মতিলাল শর্মা ও দুলাল শর্মা লাল শর্মা তিন চারদিন পর মারা যায়।
অভিযোগ ৪ : এ অভিযোগে বলা হয় ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী স্থানীয় সহযোগী এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত জগৎমলপাড়ায় অভিযান চালান। এসময় ৩২ জনকে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ ৭ : ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি সেনা সদস্য রাউজান পৌরসভা এলাকার সতীশ চন্দ্র পালিতের বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয।
পাঁচ বছর কারাদান্ডের ২ অভিযোগ :
১৭ এবং ১৮ নং অভিযোগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ১৭ নং অভিযোগে বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে বন্দী করে রাখা হয়। ১৮ নং অভিযোগে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম জেলার চান্দগাঁও থানার মোহারা গ্রামের সালেহউদ্দিনকে অপহরণ করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পারিবারিক বাসভবন গুড়সহিলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার গালে চড় মারেন।
আলোচিত ঘটনাবহুল একটি মামলা :
ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলার রায় হয়েছে এবং আরো যেসব মামলা বিচারাধীন রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম আলোচিত মামলা ছিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী মামলা। তবে আজ রায় প্রকাশের আগেই রায় ফাঁস হয়ে যাবার অভিযোগের ঘটনার মধ্য দিয়ে এ মামলায় আলোচনার নতুন মাত্রা যোগ হল। রায় ঘোষনা উপলক্ষে সকালে আদালতে আসেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সদস্য এবং আইনজীবীরা। তারা ফাঁস হওয়া রায়ের একটি কবি হাতে করে আদালতে আসেন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী হল বিএনপির প্রথম কোন নেতা যার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক রায় প্রদান করা হল। ২০১১ সালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিচারের উদ্যোগ গ্রহন উপলক্ষে তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজিরের পর থেকে বিচার চলাকালে নানা ধরনের মন্তব্য করে বিভিন্ন সময় সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন জনপ্রিয় এই রাজনীতিক। আজও তিনি রায় ঘোষনার সময় দাড়িয়ে বলেছেন এ রায় পড়ে লাভ কি। এসবতো আগেই ইন্টারনেটে অনলাইনে চলে এসেছে।
ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজে সাক্ষীকে জেরা করেছেন মাঝে মধ্যে। তার পক্ষে তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান, হাইকোর্টের বিচারপতি শামীম হাসনাইন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ পরিচিত এবং জনপ্রিয় বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গকে সাক্ষী মানার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়েছে। বিচারের শুরুতে তিনি তার পক্ষে কোন আইনজীবী নিয়োগ না করে নিজেই নিজের মামলায় লড়বেন বলে ঘোষনা দেন। এরপর তার পক্ষে একজন রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার পর তিনি নিজে আবার আইনজীবী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। বিচার চলাকালে এক পর্যায়ে আবার নিজের আইনজীবী প্রত্যাহর করে নেন এবং আবারো তার পক্ষে রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নিয়োগের ঘটনা ঘটে।
পাকিস্তান অবস্থানের দাবি নাকচ :
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া এবং বোয়ালিয়া থানায় বিভিন্ন হত্যা, গনহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে হত্যা নির্যাতন এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে হত্যা, নির্মূল এবং দেশান্তরকরনের অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। আর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দাবি ছিল ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ তিনি পাকিস্তানে চলে যান। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বদলী ছাত্র হিসেবে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং যুদ্ধের পুরো সময় পাকিস্তান অবস্থান করেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন শেষে ১৯৭১ সালের অক্টোবার মাসে লন্ডনে চলে যান এবং লিঙ্কন ইনে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৭৪ সালে তিনি সর্বপ্রথম দেশে আসেন বলে দাবি করে তিনি।
১৯৭১ সালে তার পাকিস্তান অবস্থান বিষয়ে বাংলাদেশের এবং পাকিস্তানের জীবিত অনেক ভিআইপি ব্যক্তিবর্গের নাম উল্লেখ করেছিলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার জবানবন্দীতে। বাংলাদেশে যাদের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন সুপ্রীম কোর্টের বর্তমান বিচারপতি শামীম হাসনাইনের নাম। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন শামীম হাসনাইন তার সাথে তখন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন এবং তিনি তার বন্ধু ছিলেন। এছাড়া বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও সেসময় পাকিস্তান অবস্থান করছিলেন এবং তার সাথে নিয়মিত দেখা সাক্ষাত হত দাবি করে তাকেও তিনি সাক্ষী মেনেছিলেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানে অবস্থান বিষয়ে পাকিস্তানে বর্তমানে জীবিত যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট এবং ২০০৮ সালে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মিয়া সামরু, সাবেক তথ্যমন্ত্রী ইসকাহ খান খাকওয়ানী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিদ্দিক খান কানজু প্রমুখ। এরা সকলেই তার কাসমেট ছিলেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ট্রাইব্যুনালে বলেন, আমি যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ছিলাম সে মর্মে তারাসহ আরো অনেকে এফিডেভিড পাঠিয়েছেন আমাকে। তারা আমার পক্ষে এসে সাক্ষ্য দিতে চান কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের এদেশে আসার বিষয়ে ভিসা দিচ্চেনা।
তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার পাকিস্তান অবস্থান বিষয়ে দাবি নাকচ করে দেয়া হয়েছে রায়ে। এ দাবি নাকচের পক্ষে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ২৯/৯/১৯৭১ সালে একটি খবর প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রপক্ষ সে ডকুমেন্ট আদালতে দাখিল করেছে। ওই খবরের শিরোনাম ছিল বোমার আঘাতে ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে আহত। খবরে বলা হয়েছে তাদের গাড়ির ওপর বোমা হামলা হয় এবং এতে ফজলুল কাদের চৌধুরীর বড় ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আহত হয়। তাদের চালক নিহত হয়েছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এ ঘটনার পর যে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন সে মর্মে তখনকার একজন ডাক্তার সাক্ষ্য দিয়েছেন। কাজেই রাষ্ট্রপক্ষ যে সাক্ষ্য প্রমান হাজির করেছে তাতে এটি প্রমানিত যে তিনি তখন দেশে ছিলেন। তিনি দেশে ছিলেনননা আসামী পক্ষ এ দাবি প্রমানে ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই এ আবেদন নাকচ করা হল।
রায়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রতি উষ্মা : রায়ে বলা হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এ পর্যন্ত ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি একজন বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান, আইন প্রনেতা। কিন্তু তিনি বিচার চলাকালে এ কোর্টে যেসব আচরন করেছেন মাঝে মাঝে তা দু:খজনক। আমরা তার অনেক বিষয় খেয়াল করেছি। তিনি কোর্টের ডেকোরাম মানতে চাননি। মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে চিৎকার করেছেন। তাকে সতর্কও করা হয়েছে এজন্য বিভিন্ন সময়। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এবং মেম্বারদের তিনি চেয়ারম্যান সাহেব এবং মেম্বার সাহেব বলে সম্বোধন করেছেন। বিচারপতিরা আদালত কক্ষ ত্যাগ করার সময় তিনি বসে থাকতেন বলে লক্ষ্য করা গেছে ।
রায়ের কপি হাতে ট্রাইব্যুনালে আসেন আসামী পক্ষ :
আজ সকাল থেকেই হাইকোর্ট এবং ট্রাইব্যুনাল অঙ্গনে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় ফাঁস হওয়ার অভিযোগের ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী এবং পরিবারের সদস্যরা ফাঁস হওয়া রায়ের ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা কপি নিয়ে হাজির হন ট্রাইব্যুনালে। তারা অনেককে এটি দেখিয়ে বলেন আমরা রায়ের কপি আগেই পেয়ে গেছি। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী এবং স্ত্রী অভিযোগ করেন আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার থেকে এ রায়ের কপি ফাঁস হয়েছে এবং রায় আইন মন্ত্রনালয় থেকেই লেখা হয়েছে।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি পরিচিত নাম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি পরপর ছয়বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি আলোচিত একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজে (বর্তমানে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ) ভর্তি ১৯৬০ সালে এবং সেখান থেকে এসএসসি ১৯৬৬ সালে। এরপর নটরডেম কলেজে ১৯৬৬ সালে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্নাসে ভর্তির পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে বদলি হন এবং সেখানে অধ্যয়ন শেষে ১৯৭১ সালে অক্টোবর মাসে লন্ডনের লিঙ্কন ইনে ভর্র্তি হন ব্যারিস্টারি পড়ালেখার জন্য। তবে তা শেষ করেননি তিনি। ক্যাডেট কলেজে ভর্তির আগে তিনি পাকিস্তানের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাদিক পাবলিক স্কুলে পড়াশুনা করেন।
ছাত্রজীবনে তিনি সরাসরি কোন ছাত্রসংগঠনের সাথে জড়িত না থাকলেও আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে এই আন্দোলনে নিহত আসাদ এর মৃত্যুর সময় ঘটনাস্তল থেকে মাত্র ১০ ফুট দূরে অবস্থান করছিলেন বলে জবানবন্দীতে উল্লেখ করেন।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
গত বছর ১৯ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। এক বছর চার মাসের মাথায় আলোচিত এ মামলার সমস্ত বিচার কার্যক্রম শেষ হয় গত ১৪ আগস্ট। ওই দিন যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়।
২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোরে গ্রেফতার করা হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে।
১৭টি অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৪১ জন সাক্ষী হাজির করে। অপর দিকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে আসামী নিজেসহ মোট চারজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন