মেহেদী হাসান, ৩০/১০/২০১৩
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ১১ তম সাক্ষী অ্যাডভোকেট মো : শামসুল হক ওরফে নান্নুর নামে ইউটিউবে যে বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে তা তারই বলে দাবি করেছে আসামী পক্ষ। ইউটিউবের বক্তব্য যে ১১ তম সাক্ষী শামসুল হক ওরফে নান্নুর সে বিষয়ে ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ সত্য মর্মে পরীক্ষায় প্রমানিত হয়েছে বলে দাবি আসামী পক্ষের।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর পক্ষে আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, শামসুল হক নান্নুর নামে ইউটিউবে যে বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে তা আমরা সংগ্রহ করেছি। এরপর বিভিন্ন টেলিভিশনে প্রচারিত তার বক্তব্যও সংগ্রহ করেছি। তার সব বক্তব্য আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কণ্ঠস্বর পরীক্ষা এবং ফরেনসিক তদন্তের জন্য বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ভেরিফিকেশন সার্ভিস (আইভিএস) এর কাছে পাঠাই পরীক্ষার জন্য। আইভিএস এর পাঠানো প্রতিবেদনে দেখা গেছে ইউটিউবে প্রচারিত বক্তব্য সাক্ষী শামসুল হক ওরফে নান্নুর এবং এটি ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ সত্য মর্মে নিশ্চিত হয়েছে তারা। অপরদিকে এ বক্তব্য তার নয় বলে সাক্ষী সংবাদ সম্মেলন করে যে দাবি করেছেন তাও ৯৮ ভাগ মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হয়েছে তাদের প্রতিবেদনে।
তাজুল ইসলাম আজ ট্রাইব্যুনালের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আইভিএস থেকে ফরেনসিক রিপোর্ট পাবার পর ট্রাইব্যুনালে দুটি আবেদন করি। একটি হল সাক্ষী শামসুল হক ওরফে নান্নুকে ট্রাইব্যুনালে ডেকে এনে জেরার করার জন্য পুনরায় আবেদন এবং তার কণ্ঠস্বর পরীক্ষার প্রতিবেদন প্রস্ততকারী আইভিএস এর বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন (অব) জন পি স্লেটারকে আসামী পক্ষে সাক্ষী হিসেবে আনার জন্য সমন ইস্যু করা। তবে আবেদন দুটি আজ ( বুধবার) ট্রাইব্যুনাল শুনানী ছাড়া চেম্বারে বসে খারিজ করে দিয়েছেন।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ২০ জুন বৃহষ্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ ১১ তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন পাবনার অ্যাডভোকেট মোঃ শামছুল হক ওরফে নান্নু । আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে তিনি তার জবানবন্দীতে অনেকগুলো গুরুতর অভিযোগ করেন। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহায়তার জন্য মাওলানা নিজামীসহ অন্যান্যরা মিলে স্বাধীনতা বিরোধী সেল গঠন, সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প উদ্বোধন, রুপসী প্রাইমারি স্কুলে শান্তিকমিটি গঠনের নির্দেশ এবং আলবদর বাহিনী গঠনের নেতৃত্ব দান। এছাড়া মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষনের নেতৃত্ব দানের বেশ কয়েকটি অভিযোগ করেন সাক্ষী। পাবনা এলাকায় সংঘটিত এসব অপরাধের নেতৃত্ব দানের সময় সাক্ষী মাওলানা নিজামীকে দেখেছেন বলে সাক্ষ্য দেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনী গানবোট নিয়ে নগরবাড়ি ঘাটের দিকে অগ্রসর হয়। মাওলানা নিজামী এবং তার দলবল তাদের সাথে থেকে তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। সেদিনের যুদ্ধে প্রায় দেড়শ লোক শহীদ হয়। ১১ এপ্রিল মাওলনা নিজামী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিয়ে পাবনা শহরে প্রবেশ করে এবং রাস্তার দুপাশের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, দোকানপাট লুটপাট করে। ১৯ এপ্রিল একইভাবে মাওলানা নিজামীর সহায়তায় ডাববাগান আক্রমন পরিচালনা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ১৪ই মে, ১৯৭১ ফজরের আযানের পর সশস্ত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মতিউর রহমান নিজামী, রফিকুন নবী, কুখ্যাত দালাল আসাদ এবং তার দলবল রূপসী, বাউশগাড়ী এবং ডেমরা গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং ব্যাপক গোলাগুলি চালিয়ে নিরস্ত্র নীরিহ এবং নির্দোষ মানুষদেরকে হত্যা করে। এতে ৪৫০ জনের অধিক শহীদ হন । এভাবে আরো বেশ: কিছু ঘটনা উল্লেখ করে সাক্ষী বলেন, মাওলানা নিজামীর দেখানো মতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনেককে হত্যা করে। এসব অনেক অপরাধ সংঘটনের সময় মাওলানা নিজামীকে তিনি দেখার কথা বলেছেন।
ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার পূর্বে সাক্ষী মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী দেন এবং সে জবানবন্দীতেও মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য লিখিত আছে তার নামে।
অ্যাডভোকেট শামসুল হক ওরফে নান্নুর এ সাক্ষ্য গ্রহনের পর আসামী পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় সাক্ষী অ্যাডভোকেট শামসুল হক ওরফে নান্নুর একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে ইউটিউবে। সেটি তারা সংগ্রহ করেছেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ইউটিউবে তার সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার আগে গত বছর জুলাই মাসের দিকে তিনি এ সাক্ষাৎকার ধারন করা হয়েছে। ধারনকৃত এ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধচলাকালে মাওলানা নিজামীকে তিনি কোনদিন পাবনায় দেখেননি। মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে তিনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কোন জবানবন্দীও দেননি। ১৯৮৬ সালের আগে তিনি মাওলানা নিজামীকে চিনতেনও না। মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে তার নামে তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দীতে যদি কিছু লেখা থাকে তাহলে তা মিথ্যা।
ইউটিউিবে এ ভিডিও প্রচারিত হবার পর গত ২১ সেপ্টেম্বর সাক্ষী অ্যাডভোকেট শামসুল হক ওরফে নান্নু প্রসিকিউশন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ইউটিউবের সাক্ষাতকারে যে ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে সে ব্যক্তি তিনি নন। তিনি এ ধরনের কোন সাক্ষাৎকার কাউকে দেননি।
এ প্রসঙ্গে আসামী পক্ষ তাকে তলব করে পুনরায় জেরার আবেদন জানায়। আসামী পক্ষ দাবি করে ইউটিউবের যে রেকর্ড তারা সংগ্রহ করেছে তা সাক্ষী শামসুল হক ওরফে নান্নুরই। ইউটিউবে তার প্রদত্ত বক্তব্যই সত্য এবং তিনি ট্রাইব্যুনালে এসে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তা মিথ্যা। তিনি চাপের মুখে বাধ্য হয়ে এ মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে এসে। গত ৮অক্টোবর শুনানী শেষে আবেদনটি খারিজ করে দেয় ট্রাইব্যুনাল।
এরপর আসামী পক্ষ তাদের সংগৃহীত বিভিন্ন ভিডিও কিপ পরীক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইভিএস বররাবর পাঠায় এবং সে রিপোর্ট সম্প্রতি তাদের হাতে আসার পর সাক্ষীকে পুনরায় ডেকে আনার যে আবেদন ৮ অক্টেবার খারিজ করে দিয়েছে আদালত তা পুনরায় বিবেচনার জন্য আবেদন করে তারা। এছাড়া কণ্ঠস্বর পরীক্ষার প্রতিবেদন প্রস্ততকারী জন পি স্লেটারকেও আসামী পক্ষের সাক্ষী হিসেবে তলবের জন্য আবেদন করে। দুটি আবেদনই আজ খারিজ করে দেয়া হয়েছে।
তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, কন্ঠস্বর পরীক্ষা এবং এ জাতীয় তদন্তের জন্য আইভিএস নামকরা প্রতিষ্ঠান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার দক্ষ লোকজন এখানে কাজ করে। আমরা আমাদের দরখাস্তের সাথে আইভিএস এর প্রতিবেদন এবং ইউটিউবের বক্তব্য, বিভিন্ন টিভিতে প্রচারিত সাক্ষীর বক্তব্য সিডি এবং ট্রান্সিক্রিপ্ট আকারে জমা দিয়েছিলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন