শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৩

রায় ফাঁস আরেক স্কাইপ কেলেঙ্কারি

মেহেদী হাসান, ৪/১০/২০১৩
স্কাইপ কেলেঙ্কারির মত আরেকটি কেলেঙ্কারীর ঘটনা ঘটল ট্রাইব্যুনাল ঘিরে।  এবার ঘোষনার আগেই ফাঁস হয়ে গেল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে তৈরি করা রায়। রায় ফাঁস হয়েছে সেটি যতনা গুরুতর  তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়  হল কোথা থেকে এ রায় ফাঁস হল সেটি। আসামী পক্ষের অভিযোগ আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার থেকে উদ্ধার হয়েছে রায়ের অনুলিপি। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে যে রায় ট্রাইব্যুনাল দিয়েছে তা লেখা হয়েছে আইন মন্ত্রণালয় থেকে। ফাঁস হওয়া রায়ের কপির সঙ্গেই  তার প্রমান রয়েছে। তাদের দাবি আইন মন্ত্রণালয়ের লিখে দেয়া রায়  ট্রাইব্যুনাল পড়ে শুনিয়েছে মাত্র। ট্রাইব্যুনাল এ রায় লেখেনি।
ফাঁস হওয়া রায়ের সাথে আরো যে চাঞ্চল্যকর তথ্য রয়েছে তা হল গত ২৩ মে থেকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে রায় লেখা শুরু হয়েছে যখন তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ চলছিল। এ তথ্য অনুসারে  বিচার শেষ হবার তিন মাস আগেই শরু হয়ে যায় রায় লেখার কাজ।

রায় ফাঁসের খবর :
৩০ সেপ্টেম্বর সোমবার ট্রাইব্যুনাল-১ ঘোষনা দেয় আগামীকাল মঙ্গলবার সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষনা করা হবে। সোমবার মধ্যরাতের পর বেলজিয়ামের www.tribunalleaks.be নামক একটি ওয়েবসাইট, বিদেশী আরেকটি ওয়েবসাইট
www.justiceconcern.com  এবং www.bdtoday.net  এর ব্লগে  রায় প্রকাশিত হয়। এরপর এর সূত্র ধরে ফেসবুক, বিভিন্ন ব্লগ এবং ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন অনলাইন গনমাধ্যমে এ রায় ফাঁসের  খবর প্রচারিত হতে থাকে। সাথে সাথে ইন্টারনেট, মোবাইল এবং অন্যান্য তথ্য প্রযুক্তির বরাতে অতি দ্রুত এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। মঙ্গলবার সকালে রায় প্রকাশের আগে বাংলাদেশেরও কোন কোন অনলাইন সংবাদমাধ্যমে এ খবর প্রচারিত হতে থাকে।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষনা উপলক্ষে ১ অক্টোবর মঙ্গলবার সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনালের সামনে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকজন ভিড় করতে থাকেন। এসময় হাইকোর্ট এবং ট্রাইব্যুনাল অঙ্গনে রায় ফাঁস হওয়ার ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। যারা এ বিষয়ে অনবহিত ছিল তাদের কাছেও এ খবর ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে সকালে হাইকোর্টে সাংবাদিকদের মাঝে ফাঁস হওয়া রায় নিয়ে তৈরি করা একটি বুলেটিন প্রচার করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। সেখানে ফাঁস হওয়া রায়ের সারমর্ম এবং  আইন মন্ত্রণালয় থেকে রায় ফাঁস হওয়া বিষয়ে তথ্য প্রমান তুলে ধরা হয়।

ফাঁস হওয়া রায়ের কপি হাতে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ আসামী পক্ষ :
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী এবং পরিবারের সদস্যরা ফাঁস হওয়া রায়ের কপি ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে  হাজির হন ট্রাইব্যুনালে।  সাড়ে দশটায় ট্রাইব্যুনাল বসার আগেই ট্রাইব্যুনালের সামনে অপেক্ষমান  অনেককে তারা এটি দেখিয়ে বলেন আমরা রায়ের কপি আগেই পেয়ে গেছি। রায় তো ফাঁস হয়ে গেছে ইন্টারনেটে। আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার থেকে এ রায়ের কপি ফাঁস হয়েছে এবং রায় আইন   মন্ত্রনালয় থেকেই লেখা হয়েছে।
এরপর পৌনে  ১১টায়  ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষনা শুরু করে। ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক রায় ঘোষনার সময়ই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন এ রায় পড়ে কি লাভ। রায় তো অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। রায় ঘোষনার পরপরই সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে  ঘিরে ধরেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষের আইনজীবী এবং পরিবারের সদস্যদেরকে তাদের প্রতিকৃয়া জানার জন্য। এসময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম এবং স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী  টিভি ক্যামেরার সামনে রায়ের কপি উচু করে তুলে ধরে বলেন, এই যে দেখেন রায় আগেই ফাঁস হয়ে গেছে। আমরা ইন্টারনেট এবং অনলাইন গনমাধ্যম থেকে রায়ের কপি ডাউন লোড করে  নিয়ে এসেছি। ট্রাইব্যুনালে একটু আগে যে রায় পড়ে শোনানো হল তার সাথে আমরা ফাঁস হওয়া এ রায় মিলিয়ে দেখেছি। আমাদের কাছে থাকা ফাঁস হওয়া রায়ের সাথে ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায় হুবহু মিলে গেছে।

তারা যে রায় পড়ে শুনিয়েছেন সেটি আসলে আইন মন্ত্রণালয় থেকে লিখে পাঠানো হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা আইন মন্ত্রণালয়ের লেখা রায় পড়ে শুনিয়েছেন মাত্র। এটি তাদের রায় নয়। 
ফরহাত কাদের চৌধুরী বলেন, আমরা  বিস্মিত আইনমন্ত্রণালয়ের লেখা রায় কিভাবে বিচারপতিরা পড়ে শোনাতে পারলেন। তাদের এ রায় ঘোষনা থেকে বিরত থাকা উচিত ছিল। আমরা দেশবাসী ও দুনিয়াকে দেখাতে চাই এখানে জুডিশিয়াল কিলিং হচ্ছে। এখানে কেউ বিচার পাবে না। আমরা বুঝতে পারছি না কোথায় যাব, কোথায় বিচার পাব। আমরা আগে থেকেই জানতাম এখানে বিচার পাব না।

রায় ফাঁস নিয়ে বুলেটিন :
রায় ফাস নিয়ে ১ অক্টোবর মঙ্গলবার সকালে যে বিশেষ বুলেটিন প্রচার করা হয় তাতে ফাঁসের ঘটনা বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
বুলেটিনের প্রতিবেদন এবং অন্যান্য গনমাধ্যমে  রায় ফাঁস নিয়ে রায় যে প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে তাতে  দাবি করা হয়েছে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক যে রায় ঘোষনা করা হয়েছে তার  অনুলিপি আইন  মন্ত্রনালয়েল আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মোহাম্মদ জহিরুল হকের অফিসের কম্পিউটারে রতি ছিল। আইন মন্ত্রণালয়ের ষষ্ঠ তলার একটি কম্পিউটারে ‘ডি ড্রাইভে’ এ রায়ের কপি পাওয়া যায়। কম্পিউটারের প্রত্যেকটি ফাইল বা ডকুমেন্টের উৎস নির্ণয়ক তথ্য ওই ফাইল বা ডকুমেন্টে সংরক্ষিত থাকে। এই তথ্য ওই ফাইল বা ডকুমেন্টের প্রপারটিস অপশনে গেলে পাওয়া যায়। এই রায়ের কপিটি যে ফাইলে পাওয়া গেছে তার প্রাপারটিস অপশনে গিয়ে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাহলো- ‘ডি ড্রাইভ’র ‘আলম’ নামে একটি ফোল্ডার রয়েছে। তার অধীনে আরেকটি সাব ফোল্ডারের নাম  ‘ডিফারেন্ট কোর্টস অ্যান্ড পোস্ট ক্রিয়েশন’ । এর অধীনৈ আরেকটি সাব ফোল্ডার হল  ‘ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল’। এই ‘ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল’ এর মধ্যে আরেকটি ফোল্ডার ‘চিফ প্রসিকিউটর-ওয়ার ট্রাইব্যুনাল’ । এর মধ্যে রাখা রায়ের খসড়া কপিটির নাম ছিলো ‘সাকা ফাইনাল-১’। রায় লেখা চূড়ান্ত করার পর খসড়া কপিটির নাম ‘সাকা-১’ পরিবর্তন করে রাখা হয়, ‘আইসিটি বিডি কেস নং ০২ অব ২০১১ (ডেলিভারি অব জাজমেন্ট)(ফাইনাল)’।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়ছে আলম নামের যে ব্যক্তির কম্পিউটারে ফাইলটি পাওয়া গেছে সেই আলম হলেন আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব  আবু সালেহ শেখ মো : জহিরুল হক এর কম্পিউটার অপারেটর।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে কম্পিউটারের তথ্যে  দেখা যায় আইন মন্ত্রণালয়ে উক্ত ফাইলটি তৈরি করা হয়েছে চলতি বছর ২৩ মে ১২টা ১ মিনিটের সময় যখন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ চলছিলো। ফাইলের সাইজ ১৬৭ কেবি। ফাইলটি এডিট করা হয়েছে ২৫৮৭ মিনিট পর্যন্ত।  অর্থাৎ ফাইলটি লিখতে মোট ২৫৮৭ মিনিট ব্যয় করা হয়েছে।
এ তথ্য থেকে আসামী পক্ষ দাবি করেছে বিচার শেষ হওয়ার আগেই ২৩ মে থেকে রায় লেখা শুরু হয়েছিল। গত ১৪ জুলাই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়। সে হিসেবে বিচার শেষ হওয়ার ৩ মাস আগে রায় লেখা  শুরু হয়েছে যা বিচার জগতে বিস্ময়কর ঘটনা বলে দাবি করেছে আসামী পক্ষ। 

ফাঁস হওয়া রায়ের সাথে ঘোষিত রায়ের মিল :
মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল থেকে রায় ঘোষনার  আগে যে রায় ফাঁস হয়েছে এবং ফাঁস হওয়া রায় নিয়ে যেসব প্রতিবেদন এবং বুলেটিন প্রচারিত হয়েছে সেই সব প্রতিবেদনে রায় বিষয়ে যেসব তথ্য পরিবেশিত হয়েছে তার সাথে হুবহু মিলে গেছে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ঘোষিত রায়ের তথ্যের সাথে।

মঙ্গলবার সকালে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক রায় প্রকাশের আগেই বিভিন্ন অনলাইন এবং অন্যান্য গনমাধ্যমে ফাঁস হওয়া রায় নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে  ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী মোট ২৩টি অভিযোগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। সেখান থেকে মোট ১৭টি অভিযোগের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী হাজির করে। যেহেতু রাষ্ট্রপক্ষ ১৭টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষী হাজির করেছে, তাই এ ১৭টি অভিযোগের বিষয়ে রায় লেখা হয়েছে মর্মে তথ্য দেখা যায় আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া রায়ের কপিতে। আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া রায়ে দেখা যায়, ১৭টি অভিযোগের মধ্যে মোট ৯টি অভিযোগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আটটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। এছাড়া যে ছয়টি অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করেনি সেগুলো থেকেও তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ৯টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ১৪টি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়। তবে ফাঁস হওয়া রায়ে শাস্তির কথা উল্লেখ ছিলনা।
ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক রায় ঘোষনার পর ফাঁস হওয়া রায়ের তথ্যের সাথে মিলিয়ে দেখা গেছে আগেই পরিবেশিত তথ্য হুবহু এক।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এবং মেম্বারদের সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী মাঝে মধ্যে চেয়ারম্যান সাহেব, মেম্বার সাহেব বলে সম্বোধন করতেন। এসব বিষয়সহ আরো কিছু বিষয়ে রায়ে চৌধুরী সাহেবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিচারপতিরা। ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ বিষয়টি উল্লেখ আছে। রায় প্রকাশের আগে ফাঁস হওয়া রায় নিয়ে তৈরি করা বুলেটিনেও এ তথ্য উল্লেখ ছিল।

ট্রাইব্যুনালের স্বীকারোক্তি :
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় ফাঁস হওয়ার কথা স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তবে ফাঁস হওয়া রায়ের কপিটি  খসড়া রায়ের কপি বলে দাবি করা হয়েছে। রায় ফাঁসের ঘটনা স্বীকার করে  ২ অক্টোবর বুধবার   শাহবাগ থানায় জিডি করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর পক্ষে ট্রাইব্যুনালের মুখপাত্র রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ আনষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ তথ্য জানান।  ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে রেজিস্ট্রার বলেন, কথিত ফাঁস হওয়া রায়ের কপি নিতান্তই একটি খসড়া যা রায় ঘোষণার অনেক আগেই কোন না কোনভাবে ‘লিকড’ বা ফাঁস হয়েছে এবং একটি দুষ্টচক্রের হস্তগত হয়েছে। খসড়া এ রায় ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটারে কম্পোজ করার পর তা কোন না কোনভাবে ফাঁস হয়েছে। একটি সংঘবদ্ধ দুষ্ট চক্র যারা ট্রাইব্যুনাল ও এর বিচারিক কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান তারা এবং যারা এই অপকর্মের সুবিধাভোগী তারাই এই অপকর্মটি করেছে।
এই বিষয়টি উদঘাটনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ট্রাইব্যুনালের নির্দেশক্রমে থানায় জিডি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেখা যায় যে, কথিত ‘লিকড’ হওয়া রায়ের খসড়ার সাথে ঘোষিত রায়ের কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু এটি আদৌ কোন রায় নয় যা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন,

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল-১-এর মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়ের নির্দেশক্রমে ট্রাইব্যুনালের স্পোকসম্যান হিসেবে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী একটি তথ্য সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু কথা বলা প্রয়োজন। গত ০১ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে ট্রাইব্যুনাল-১ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায় ঘোষণা করেছেন। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর তারিখে ট্রাইব্যুনাল উন্মুক্ত আদালতে জানিয়েছেন যে, রায় প্রস্তুত এবং পর দিন অর্থাৎ ০১ অক্টোবর রায় ঘোষিত হবে।

আইন ও বিধি অনুসারে রায় ঘোষণার দিনই সাথে সাথে রায়ের সার্টিফাইড কপি পক্ষগণকে দিতে হয় যা অন্য কোন আইনে দেখা যায় না। তাই সঙ্গত কারণে রায় চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত না করে রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ ও রায় ঘোষণা করা হয় না। এ কারণে সাধারণত রায় ঘোষণার ২/১ দিন আগে রায় চূড়ান্ত করা হয়ে থাকে। কেবল সাজা সংশ্লিষ্ট অংশটি রায়ের দিন মাননীয় বিচারকগণ একমত হয়ে চূড়ান্ত করে থাকেন।
রেজিস্ট্রার বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, মঙ্গলবার  যথারীতি রায় ঘোষণার পর অভিযুক্ত সাজাপ্রাপ্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী এবং অভিযুক্তের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের মিডিয়াকে দেয়া বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, রায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার পূর্বে তা ইন্টারনেটে কিছু ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে। তারা এটিও দাবি করেছেন যে, কথিত ‘রায়’ আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটারে সংরক্ষিত আছে।

তিনি বলেন, আপনারা জানেন যে, প্রসিকিউটর এবং অভিযুক্ত পক্ষের নিযুক্ত আইনজীবীগণ কোর্টের অফিসার। গতকাল (মঙ্গলবার) রায় ঘোষণার জন্য ট্রাইব্যুনাল আসন গ্রহণের পর অভিযুক্ত পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীর দায়িত্ব ছিল কোন কোন ওয়েবসাইটে কথিত খসড়া রায় আগের দিন রাতে আপলোডেড পাওয়া গেছে সেই বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের নজরে আনা। কিন্তু তিনি তা না করে আনুষ্ঠানিকভাবে রায় ঘোষণার পর কথিত খসড়ার হার্ড কপি দেখিয়ে মিডিয়ার সামনে এটি দাবি করেন যে, রায় আগেই ‘লিকড’ হয়েছে এবং এটি আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটারে রয়েছে এবং এটি একটি ‘ডিকটেটেড রায়’। অভিযুক্তের বিজ্ঞ আইনজীবীর এই উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য অসদাচরণ বটে। নিঃসন্দেহে রায় ঘোষণার পর এমন দাবি করা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চক্রান্তের অংশ।

লিখিত বক্তব্যে রেজিস্ট্রার বলেন, দেখা যায় যে, কথিত ‘লিকড’ রায়ের খসড়ার সাথে ঘোষিত রায়ের কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু এটি আদৌ কোন রায় নয় যা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। আপনারা লক্ষ্য করবেন যে, ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ঘোষিত রায়ে অনুচ্ছেদ নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে কথিত ‘লিকড’ খসড়া রায়ে কোন অনুচ্ছেদ নম্বর নেই এবং এটি নিতান্তই একটি খসড়া যা রায় ঘোষণার অনেক আগেই কোনভাবে ‘লিকড’ হয়েছে এবং খসড়া পর্যায়ে লিকড হওয়া খসড়াটি রায় ঘোষণার বেশ ক’দিন পূর্বেই দুষ্ট চক্রের হস্তগত হয়েছে মর্মে অনুমিত। তাই যদি হয় তবে তা পূর্বে প্রকাশ না করে ঠিক আনুষ্ঠানিক রায় ঘোষণার আগের রাতে কথিত ওয়েবসাইটে আপলোডেড পাওয়া গেল কেন এবং কিভাবে? এ থেকে এটি স্পষ্ট অনুমিত যে, একটি সংঘবদ্ধ দুষ্ট চক্র যারা ট্রাইব্যুনাল ও এর বিচারিক কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান তারা এবং যারা এই অপকর্মের সুবিধাভোগী তারাই এই অপকর্মটি করেছে।

তিনি বলেন, সার্বিক বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে এটি অনুমান করা হচ্ছে যে, কথিত খসড়া রায় ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটারে কম্পোজ করার পর তা কোন না কোনভাবে ‘লিকড’ হয়েছে। এই বিষয়টি উদঘাটনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ট্রাইব্যুনালের নির্দেশক্রমে রেজিস্ট্রার থানায় জিডি করেছেন। আমরা আশা করি, সত্য বেরিয়ে আসবে এবং এই ষড়যন্ত্রের সাথে কারা কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করা যাবে। ট্রাইব্যুনালে কর্মরত কেউ যদি এই অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত থাকেন তবে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

রায় ঘোষণার পর অভিযুক্ত পক্ষে তার বিজ্ঞ আইনজীবী এবং পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন যে, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য বিচারপতি শামীম হাসনাইনকে ট্রাইব্যুনাল অনুমতি দেননি এবং এতে তার অধিকার ুণœ হয়েছে। এটি আদৌ সঠিক নয়। গত ২৭/৬/২০১৩ তারিখের ১৮৯ নং আদেশে ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করেছেন যে,



Ô Proposed witness No. 5 Mr. Justice Shamim Hasnain is the sitting Judge of the Supreme Court of Bangladesh, and as such without obtaining his consent, no summons will be issued upon him.


 ’ কিন্তু দেখা যায় যে, পরবর্তীতে মাননীয় বিচারপতি শামীম হাসনাইন এর নিকট থেকে এ বিষয়ে সম্মতি সংশ্লিষ্ট কোন কিছু ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করা হয়নি।

যে বিষয়ে আপনাদের মাধ্যমে সবাইকে অবহিত করা হলো সে বিষয়ে পরবর্তী যে কোন অগ্রগতি যথারীতি আপনাদের অবহিত করা হবে। পরিশেষে এটি বলব যে, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সহযোগিতা আমরা সব সময় পেয়েছি। প্রত্যাশা আগামীতেও এটি অব্যাহত থাকবে।
আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

রায় ফাঁসের ঘটনা বিষয়ে জিডি :
ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে শাহবাগ থানায় দায়ের করা জিডির কপি সংবাদ সম্মেলনে বিলি করা হয় সাংবাদিকদের মাঝে। জিডির বিবরনে লেখা হয়েছে-
আমি নিম্নস্বাক্ষরকারী এই মর্মে আদিষ্ট হয়ে জানাচ্ছি যে, গত ০১/১০/২০১৩ ইং তারিখ রোজ মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচারাধীন আইসিটি বিডি কেস নং -২/২০১১ চীফ প্রসিকিউটর বনাম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী-এর রায় প্রচারের জন্য দিন ধার্য ছিল। রায় ঘোষণার পর পরই আসামী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সদস্যগণ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে জানান যে, উক্ত মামলার রায়ের কপি তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে পূর্বেই প্রাপ্ত হয়েছেন। আসামী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে আদালত হতে রায়ের কপি সরবরাহ করার পূর্বেই একটি ডকুমেন্ট ক্যামেরার সামনে প্রদর্শন করে বলেন যে, এই সেই ইন্টারনেট হতে প্রাপ্ত রায়ের কপি যা রায় ঘোষণার পূর্বেই তারা প্রাপ্ত হয়েছেন এবং সেটি নিয়েই তারা আদালত কক্ষে প্রবেশ করেছেন। তিনি আরো বলেন যে, আদালত হতে প্রচারিত রায় এবং ইন্টারনেট হতে প্রাপ্ত রায়ের মধ্যে মিল আছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হতে প্রচারিত সমস্ত রায় ট্রাইব্যুনালেই প্রস্তুত করা হয়। রায় ঘোষণার পূর্বে রায়ের কোন অংশের কপি অন্য কোনভাবে প্রকাশের সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরেও কথিত খসড়া রায়ের অংশ কিভাবে ইন্টারনেটে প্রচারিত হল বা কিভাবে ট্রাইব্যুনাল হতে খসড়া রায়ের অংশবিশেষ ফাঁস (Leaked) হল তা উদ্বেগের বিষয়। বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার প্রতি হুমকি স্বরূপ। উল্লেখ্য যে,
www.tribunalleaks.be  ওয়েবসাইটে কথিত খসড়া রায়ের অংশ আপলোডেড দেখা যায়।
এমতাবস্থায় বিষয়টি তদন্ত পূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হল।
এ কে এম নাসির উদ্দিন মাহমুদ
রেজিস্ট্রার
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
পুরাতন হাইকোর্ট ভবনম ঢাকা।
জিডি নং ৮৫ তাং ০২/১০/ডি

আলোচনায় নতুন মাত্রা :
ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলার রায় হয়েছে এবং আরো যেসব মামলা বিচারাধীন রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত মামলা ছিল মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মামলা। এরপর নানা কারনে অন্যতম আলোচিত মামলা ছিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী মামলা। রায় প্রকাশের আগেই রায় ফাঁস হয়ে যাবার ঘটনার মধ্য দিয়ে এ মামলায় আলোচনার নতুন মাত্রা যোগ হল।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী হলেন  বিএনপির প্রথম কোন নেতা যার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক রায় প্রদান করা হল। ২০১১ সালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিচারের উদ্যোগ গ্রহন উপলক্ষে তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজিরের পর থেকে বিচার চলাকালে নানা ধরনের রসাত্মক, শ্লেষাত্মক এবং ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য করে বিভিন্ন সময় সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন জনপ্রিয় এই রাজনীতিক।

ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজে সাক্ষীকে জেরা করেছেন মাঝে মধ্যে। বিচার শুরুর আগে বিভিন্ন বিষয়ে দায়ের করা আবেদনের ওপর নিজেই  শুনানী করেছেন এবং জ্ঞানগর্ভ যুক্তি ও আলোচনা পেশ করেছেন ট্রাইব্যুনালে।  নিজের মামলায় নিজেই ইংরেজিতে দীর্ঘ জবানবন্দী প্রদান করেছেন। তার পক্ষে তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান, হাইকোর্টের বিচারপতি শামীম হাসনাইন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ পরিচিত এবং জনপ্রিয় বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গকে সাক্ষী মানার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়েছেন।  বিচারের শুরুতে তিনি তার পক্ষে কোন আইনজীবী নিয়োগ না করে নিজেই নিজের মামলায় লড়বেন বলে ঘোষনা দেন। এরপর তার পক্ষে একজন রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার পর তিনি নিজে আবার আইনজীবী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন।

রায় ফাঁস এবং  স্কইপ একই মুদ্রার দুই পিঠ
ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমে বাইরের বিভিন্ন মহলের প্রভাব বিস্তারের মাত্রা, বিস্তৃতি এবং তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায় ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান  বিচারপতি নিজামুল হক এর  স্কাইপ সংলাপের মাধ্যমে। আর রায় ফাঁসের ঘটনাটি স্কাইপের চেয়েও কয়েক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। কারণ স্কাইপ সংলাপকে যদি ধরা হয় থিওরি  তবে রায় ফাঁসের ঘটনাটি হল প্রাকটিক্যাল। যাকে বলে কট রেড হ্যান্ডেড । রায় ফাঁসের ঘটনাকে   স্কাইপ ঘটনারই ধারাবাহিক ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। রায় ফাঁসের ঘটনা স্কাইপ কেলেঙ্কারিকে  সুস্পষ্ট ভিত্তির ওপর দাড় করিয়েছে।  স্কাইপ সংলাপ এবং রায় ফাঁসের ঘটনা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ । কেননা  বিচারপতি নিজামুল হক এবং বেলজিয়ামের ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যকার স্কাইপ সংলাপে এটি স্পষ্ট যে, ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন নেপথ্যে থেকে ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজে হস্তক্ষেপ করেছেন। বিচারপতি নিজামুল হক ম ট্রাইব্যুনালে এমন অনেক আদেশ পড়ে শুনিয়েছেন যা হুবহু বেলজিয়াম থেকে এসেছে মর্মে দেখা যায়। আসামী পক্ষ এসব ট্রাইব্যুনালে দায়ের করেছে। স্কাইপ সংলাপে আরো যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হল বেলজিয়াম ছিল মূলত একটি ভায়া মাধ্যম। বেলজিয়ামে বসে ড. আহেমদ জিয়াউদ্দিন নিয়মিত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, বিচার নিয়ে সোচ্চার দেশের বিভিন্ন মহল, সংশ্লিষ্ট  মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচু মহলে যোগাযোগ রাখতেন মর্মে প্রমান রয়েছে স্কাইপ সংলাপে। এসব মহলের দিক নির্দেশনা এবং পরামর্শ মোতাবেক তিনি বেলজিয়ামে বসে কার্যক্রম ঠিক করতেন এবং সে ভিত্তিতে তিনি ভায়া মাধ্যম হিসেবে ট্রাইব্যুনালের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন। স্কাইপ সংলাপে আইনমন্ত্রী, আইনপ্রতিমন্ত্রীসহ আরো বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে ট্রাইব্যুনালের বিচারকে ঘিরে।  এসব কারনে আসামী পক্ষ তখন অভিযোগ করে  ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজে  সরকারের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। এখন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী এবং আসামী পক্ষ অভিযোগ করল আইন মন্ত্রণালয়ের অফিসের কম্পিউটারের থেকে রায় ফাঁস এবং আইন   মন্ত্রণালয়ের অফিসে বসে রায় লেখা হয়েছে।
স্কাইপ এবং রায় ফাঁসের কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ে আসামী পক্ষের অভিযোগ মেলালে যেটি দাড়ায় তা হল  স্কাইপ কেলেঙ্কারি এবং রায় ফাঁস একই মুদ্রার দুই পিঠ। একটি ঘটনা অপর ঘটনাকে সমর্থন  করছে।

বলির পাঠা হবে কে?
ট্রাইব্যুনাল স্বীকার করেছে ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটার থেকে রায়ের খসড়া ফাঁস হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের এ স্বীকারোক্তি নিয়ে গুঞ্জন এবং আলোচনা চলছে নানা মহলে। কারো কারো মতে আইন মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের রক্ষার উদ্দেশে ট্রাইব্যুনালকে দিয়ে এ স্বীকারোক্তি করানো হতে পারে।  তারা এখন অপেক্ষায় আছে এ ঘটনায় কারা কারা বলির পাঠা হয় তা দেখার জন্য।

রায়ের সংক্ষিপ্ত বিবরন :
১ অক্টোবর মঙ্গলবার বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বিশিষ্ট পার্লামেন্টরিয়ান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষনা করে আন্তর্জঅতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। 

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধেল চারটি অভিযোগে তাকে   মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া তিনটি অভিযোগের  প্রত্যেকটিতে ২০ বছর এবং আরো দুটি অভিযোগের প্রতিটিতে পাঁচ বছর করে জেল দেয়া হয়েছে তাকে।
যে চারটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে সেগুলো হল রাউজানের গহিরায় কুন্ডেশ্বরী কমপ্লেক্সের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যাকান্ড, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা মোজাফফর এবং তার ছেলে শেখ আলমগীর হত্যা, রাউজানের  ঊনসত্তরপাড়ায় সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে  ৫০ থেকে ৫৫ জন হিন্দুকে  ব্রাশফায়ার করে হত্যা এবং সুলতানপুরে তিনজনকে গুলি করে হত্যা।

এছাড়া রাউজানের গহিরা  গ্রামের  হিন্দু  পাড়ায় সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে  পঞ্চবালা শর্মা, সুনীল শর্মা, মতিলাল শর্মা ও দুলাল শর্মা লাল শর্মা হত্যা; জগৎমলপাড়ায় ৩২ জনকে হত্যা এবং  রাউজান পৌরসভা এলাকার সতীশ চন্দ্র পালিতের বাড়িতে  প্রবেশ করে তাকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে ২০ বছর করে  জেল দেয়া হয়েছে।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মোট ২৩ টি অভিযোগে  চার্জ গঠন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপক্ষ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগের মধ্য থেকে ১৭টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষী হাজির করে । ১৭টি অভিযোগ থেকে  তাকে মোট ৯টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। বাকী আটটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া  হয়েছে।
এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ বাকী যে ছয়টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য প্রমান হাজির করেনি সে ছয়টি অভিযোগ থেকেও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে খালাস দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাকে মোট  ১৪টি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। 
ট্রাইব্যুনাল-১  চেয়ারম্যান বিচারপতি  এটিএম ফজলে কবির, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক পালাক্রমে রায় পড়ে শোনান।

পাকিস্তান অবস্থানের দাবি নাকচ :
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া এবং বোয়ালিয়া থানায় বিভিন্ন হত্যা, গনহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে হত্যা নির্যাতন এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে হত্যা, নির্মূল এবং দেশান্তরকরনের অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।  আর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দাবি ছিল ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ তিনি পাকিস্তানে চলে যান। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বদলী ছাত্র হিসেবে তিনি  পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং যুদ্ধের পুরো সময় পাকিস্তান অবস্থান করেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন শেষে ১৯৭১ সালের অক্টোবার মাসে  লন্ডনে চলে যান এবং লিঙ্কন ইনে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৭৪ সালে তিনি সর্বপ্রথম দেশে আসেন বলে দাবি করে তিনি।

১৯৭১ সালে তার পাকিস্তান অবস্থান বিষয়ে বাংলাদেশের এবং পাকিস্তানের জীবিত অনেক ভিআইপি ব্যক্তিবর্গের নাম  উল্লেখ করেছিলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার জবানবন্দীতে।  বাংলাদেশে যাদের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন সুপ্রীম কোর্টের বর্তমান বিচারপতি শামীম হাসনাইনের নাম। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন শামীম হাসনাইন তার সাথে তখন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন এবং তিনি তার বন্ধু ছিলেন। এছাড়া  বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও সেসময় পাকিস্তান অবস্থান করছিলেন এবং তার সাথে নিয়মিত দেখা সাক্ষাত হত দাবি করে  তাকেও তিনি সাক্ষী মেনেছিলেন।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানে অবস্থান বিষয়ে পাকিস্তানে বর্তমানে জীবিত যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট এবং ২০০৮ সালে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মিয়া সামরু, সাবেক তথ্যমন্ত্রী ইসকাহ খান খাকওয়ানী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিদ্দিক খান কানজু প্রমুখ। এরা সকলেই তার কাসমেট ছিলেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ট্রাইব্যুনালে বলেন, আমি যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ছিলাম সে মর্মে তারাসহ আরো অনেকে এফিডেভিড পাঠিয়েছেন আমাকে। তারা আমার পক্ষে এসে সাক্ষ্য দিতে চান কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের এদেশে আসার বিষয়ে ভিসা দিচ্চেনা।

তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার পাকিস্তান অবস্থান বিষয়ে দাবি নাকচ করে দেয়া হয়েছে রায়ে।  দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ২৯/৯/১৯৭১ সালে প্রকাশিত একটি খবরের ভিত্তিতে আসামী পক্ষের এ দাবি নাকচ করা হয়েছে। ওই খবরে বলা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের বোমা হামলায় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তখন আহত হন এবং গাড়িতে থাকা চালক নিহত হয়।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন
গত বছর ১৯ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। এক বছর চার মাসের মাথায় আলোচিত এ মামলার সমস্ত বিচার কার্যক্রম শেষ হয় গত ১৪ আগস্ট। ওই দিন যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়। 
২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোরে গ্রেফতার করা হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে।

১৭টি অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৪১ জন সাক্ষী হাজির করে। অপর দিকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে আসামী নিজেসহ মোট চারজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। 

কে এই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী?
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টমন্ডিত একজন  আলোচিত ব্যক্তিত্ব।  বক্তব্যের নিজস্ব স্টাইলের অধিকারী  এবং বাকপটু  এই ব্যক্তিত্ব  তীর্যক এবং স্পষ্ট উচ্চারনের জন্য সমধিক পরিচিত। বাংলাদেশে হাতেগোনা যে কয়জনকে  খ্যাতিমান পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে গন্য করা হয় তিনি তাদের অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি পরপর ছয়বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন এবং পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পীকার ছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় করাগারে বন্দী অবস্থায় ৫৪ বছর  বয়সে  তার মৃত্যু হয়।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় পিতার মুসলিম লীগের অনুসারী হিসেবে। ১৯৭৯ সালে তিনি মুসলিম লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচতি হন। এরপর ৮৮ সালে তিনি ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক লীগ গঠন করেন। ১৯৯৬  সালে দল বিলুপ্ত করে যোগ দেন বিএনপিতে। মাঝখানে জাতীয় পার্টি থেকে তিনি  মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন।

তৎকালীন পূর্ব  পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজে (বর্তমানে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ) ভর্তি হন  ১৯৬০ সালে এবং সেখান থেকে এসএসসি  পাশ করেন ১৯৬৬ সালে। এরপর  নটরডেম কলেজে ১৯৬৬ সালে ভর্তি হন।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্নাসে ভর্তির পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে বদলি হন এবং সেখানে অধ্যয়ন শেষে ১৯৭১ সালে অক্টোবর মাসে লন্ডনের লিঙ্কন ইনে ভর্র্তি  হন ব্যারিস্টারি পড়ালেখার জন্য। তবে ব্যারিস্টারি পাঠ শেষ করেননি তিনি।  ক্যাডেট কলেজে ভর্তির আগে তিনি পাকিস্তানের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাদিক পাবলিক স্কুলে পড়াশুনা করেন।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছাত্রজীবনে  সরাসরি কোন ছাত্রসংগঠনের সাথে জড়িত  না থাকলেও আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন।  ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক  ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশেও উপস্থিত ছিলেন বলেন তিনি তার জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছেন।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৯ সালে ১৩ মার্চ। বর্তমানে তার বয়স ৬৪ বছর ৭ মাস। বিচার চলাকালে তিনি একদিন ওপেন কোর্টে মন্তব্য করেন ঢাকার জেলখানা থেকে আমার পিতার লাশ বের করা হয়েছিল ৫৪ বছর বয়সে। আমার বয়স আমার পিতাকে ছাড়িয়ে গেছে। মৃত্যু নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই।
৪/১০/২০১৩









কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন