মেহেদী হাসান, ২/১০/২০১৩
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষনার আগেই রায় ফাঁস হওয়ার কথা স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তবে ফাঁস হওয়া রায়ের কপিটি নিতান্তই একটি খসড়া রায়ের কপি বলে দাবি করা হয়েছে। রায় ফাঁসের ঘটনা স্বীকার করে আজ শাহবাগ থানায় জিডি করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর পক্ষে ট্রাইব্যুনালের মুখপাত্র রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ আজ আনষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ তথ্য জানান। ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে রেজিস্ট্রার বলেন, কথিত ফাঁস হওয়া রায়ের কপি নিতান্তই একটি খসড়া যা রায় ঘোষণার অনেক আগেই কোন না কোনভাবে ‘লিকড’ বা ফাঁস হয়েছে এবং একটি দুষ্টচক্রের হস্তগত হয়েছে। খসড়া এ রায় ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটারে কম্পোজ করার পর তা কোন না কোনভাবে ফাঁস হয়েছে। এই বিষয়টি উদঘাটনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ট্রাইব্যুনালের নির্দেশক্রমে থানায় জিডি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেখা যায় যে, কথিত ‘লিকড’ হওয়া রায়ের খসড়ার সাথে ঘোষিত রায়ের কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু এটি আদৌ কোন রায় নয় যা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। ঘোসিত রায় এবং ফাঁস হওয়া রায়ের মধ্যে পার্থক্যের একটি দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, ঘোষিত রায়ে অনুচ্ছেদ নম্বর উল্লেখ আছে কিন্তু ফাঁস হওয়া কথিত রায়ে অনুচ্ছেদ নম্বর নেই। এটি নিতান্তই একটি খসড়া কপি।
আজ দপুরে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাইব্যুনালের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান তিনি। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল-১-এর মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়ের নির্দেশক্রমে ট্রাইব্যুনালের স্পোকসম্যান হিসেবে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী একটি তথ্য সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু কথা বলা প্রয়োজন। গত ০১ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে ট্রাইব্যুনাল-১ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায় ঘোষণা করেছেন। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর তারিখে ট্রাইব্যুনাল উন্মুক্ত আদালতে জানিয়েছেন যে, রায় প্রস্তুত এবং পর দিন অর্থাৎ ০১ অক্টোবর রায় ঘোষিত হবে।
আইন ও বিধি অনুসারে রায় ঘোষণার দিনই সাথে সাথে রায়ের সার্টিফাইড কপি পক্ষগণকে দিতে হয় যা অন্য কোন আইনে দেখা যায় না। তাই সঙ্গত কারণে রায় চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত না করে রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ ও রায় ঘোষণা করা হয় না। এ কারণে সাধারণত রায় ঘোষণার ২/১ দিন আগে রায় চূড়ান্ত করা হয়ে থাকে। কেবল সাজা সংশ্লিষ্ট অংশটি রায়ের দিন মাননীয় বিচারকগণ একমত হয়ে চূড়ান্ত করে থাকেন।
রেজিস্ট্রার বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, মঙ্গলবার যথারীতি রায় ঘোষণার পর অভিযুক্ত সাজাপ্রাপ্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী এবং অভিযুক্তের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের মিডিয়াকে দেয়া বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, রায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার পূর্বে তা ইন্টারনেটে কিছু ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে। তারা এটিও দাবি করেছেন যে, কথিত ‘রায়’ আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটারে সংরক্ষিত আছে।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন যে, প্রসিকিউটর এবং অভিযুক্ত পক্ষের নিযুক্ত আইনজীবীগণ কোর্টের অফিসার। গতকাল (মঙ্গলবার) রায় ঘোষণার জন্য ট্রাইব্যুনাল আসন গ্রহণের পর অভিযুক্ত পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীর দায়িত্ব ছিল কোন কোন ওয়েবসাইটে কথিত খসড়া রায় আগের দিন রাতে আপলোডেড পাওয়া গেছে সেই বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের নজরে আনা। কিন্তু তিনি তা না করে আনুষ্ঠানিকভাবে রায় ঘোষণার পর কথিত খসড়ার হার্ড কপি দেখিয়ে মিডিয়ার সামনে এটি দাবি করেন যে, রায় আগেই ‘লিকড’ হয়েছে এবং এটি আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটারে রয়েছে এবং এটি একটি ‘ডিকটেটেড রায়’। অভিযুক্তের বিজ্ঞ আইনজীবীর এই উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য অসদাচরণ বটে। নিঃসন্দেহে রায় ঘোষণার পর এমন দাবি করা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চক্রান্তের অংশ।
লিখিত বক্তব্যে রেজিস্ট্রার বলেন, দেখা যায় যে, কথিত ‘লিকড’ রায়ের খসড়ার সাথে ঘোষিত রায়ের কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু এটি আদৌ কোন রায় নয় যা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। আপনারা লক্ষ্য করবেন যে, ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ঘোষিত রায়ে অনুচ্ছেদ নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে কথিত ‘লিকড’ খসড়া রায়ে কোন অনুচ্ছেদ নম্বর নেই এবং এটি নিতান্তই একটি খসড়া যা রায় ঘোষণার অনেক আগেই কোনভাবে ‘লিকড’ হয়েছে এবং খসড়া পর্যায়ে লিকড হওয়া খসড়াটি রায় ঘোষণার বেশ ক’দিন পূর্বেই দুষ্ট চক্রের হস্তগত হয়েছে মর্মে অনুমিত। তাই যদি হয় তবে তা পূর্বে প্রকাশ না করে ঠিক আনুষ্ঠানিক রায় ঘোষণার আগের রাতে কথিত ওয়েবসাইটে আপলোডেড পাওয়া গেল কেন এবং কিভাবে? এ থেকে এটি স্পষ্ট অনুমিত যে, একটি সংঘবদ্ধ দুষ্ট চক্র যারা ট্রাইব্যুনাল ও এর বিচারিক কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান তারা এবং যারা এই অপকর্মের সুবিধাভোগী তারাই এই অপকর্মটি করেছে।
তিনি বলেন, সার্বিক বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে এটি অনুমান করা হচ্ছে যে, কথিত খসড়া রায় ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটারে কম্পোজ করার পর তা কোন না কোনভাবে ‘লিকড’ হয়েছে। এই বিষয়টি উদঘাটনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ট্রাইব্যুনালের নির্দেশক্রমে রেজিস্ট্রার থানায় জিডি করেছেন। আমরা আশা করি, সত্য বেরিয়ে আসবে এবং এই ষড়যন্ত্রের সাথে কারা কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করা যাবে। ট্রাইব্যুনালে কর্মরত কেউ যদি এই অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত থাকেন তবে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রায় ঘোষণার পর অভিযুক্ত পক্ষে তার বিজ্ঞ আইনজীবী এবং পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন যে, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য বিচারপতি শামীম হাসনাইনকে ট্রাইব্যুনাল অনুমতি দেননি এবং এতে তার অধিকার ুণœ হয়েছে। এটি আদৌ সঠিক নয়। গত ২৭/৬/২০১৩ তারিখের ১৮৯ নং আদেশে ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করেছেন যে,
Ô Proposed
witness No. 5 Mr. Justice Shamim Hasnain is the sitting Judge of the Supreme
Court of Bangladesh, and as such without obtaining his consent, no summons will
be issued upon him.
’ কিন্তু দেখা যায় যে, পরবর্তীতে মাননীয় বিচারপতি শামীম হাসনাইন এর নিকট থেকে এ বিষয়ে সম্মতি সংশ্লিষ্ট কোন কিছু ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করা হয়নি।
যে বিষয়ে আপনাদের মাধ্যমে সবাইকে অবহিত করা হলো সে বিষয়ে পরবর্তী যে কোন অগ্রগতি যথারীতি আপনাদের অবহিত করা হবে। পরিশেষে এটি বলব যে, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সহযোগিতা আমরা সব সময় পেয়েছি। প্রত্যাশা আগামীতেও এটি অব্যাহত থাকবে।
আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
রায় ফাঁসের ঘটনা বিষয়ে জিডি :
ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে শাহবাগ থানায় দায়ের করা জিডির কপি সংবাদ সম্মেলনে বিলি করা হয় সাংবাদিকদের মাঝে। জিডির বিবরনে লেখা হয়েছে-
আমি নিম্নস্বাক্ষরকারী এই মর্মে আদিষ্ট হয়ে জানাচ্ছি যে, গত ০১/১০/২০১৩ ইং তারিখ রোজ মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচারাধীন আইসিটি বিডি কেস নং -২/২০১১ চীফ প্রসিকিউটর বনাম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী-এর রায় প্রচারের জন্য দিন ধার্য ছিল। রায় ঘোষণার পর পরই আসামী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সদস্যগণ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে জানান যে, উক্ত মামলার রায়ের কপি তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে পূর্বেই প্রাপ্ত হয়েছেন। আসামী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে আদালত হতে রায়ের কপি সরবরাহ করার পূর্বেই একটি ডকুমেন্ট ক্যামেরার সামনে প্রদর্শন করে বলেন যে, এই সেই ইন্টারনেট হতে প্রাপ্ত রায়ের কপি যা রায় ঘোষণার পূর্বেই তারা প্রাপ্ত হয়েছেন এবং সেটি নিয়েই তারা আদালত কক্ষে প্রবেশ করেছেন। তিনি আরো বলেন যে, আদালত হতে প্রচারিত রায় এবং ইন্টারনেট হতে প্রাপ্ত রায়ের মধ্যে মিল আছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হতে প্রচারিত সমস্ত রায় ট্রাইব্যুনালেই প্রস্তুত করা হয়। রায় ঘোষণার পূর্বে রায়ের কোন অংশের কপি অন্য কোনভাবে প্রকাশের সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরেও কথিত খসড়া রায়ের অংশ কিভাবে ইন্টারনেটে প্রচারিত হল বা কিভাবে ট্রাইব্যুনাল হতে খসড়া রায়ের অংশবিশেষ ফাঁস (leaked) হল তা উদ্বেগের বিষয়। বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার প্রতি হুমকি স্বরূপ। উল্লেখ্য যে,
www.tribunalleaks.be ওয়েবসাইটে কথিত খসড়া রায়ের অংশ আপলোডেড দেখা যায়।
এমতাবস্থায় বিষয়টি তদন্ত পূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হল।
এ কে এম নাসির উদ্দিন মাহমুদ
রেজিস্ট্রার
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
পুরাতন হাইকোর্ট ভবনম ঢাকা।
জিডি নং ৮৫ তাং ০২/১০/ডি
মো : জাফর আলী
এস আই। শাহবাগ থানা।
রায় ফাঁস হয়নি দাবি এবং ট্রাইব্যুনালের স্বীকারোক্তি
ট্রাইব্যুনালের পক্ষে রেজিস্ট্রার গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছেন রায়ের খসড়া কপি কোন না কোনভাবে ফাঁস হয়েছে। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেছেন খসড়া কপির অংশ বিশেষ ফাঁস হয়েছে।
কিন্তু মঙ্গলবার সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হয় রায় ফাঁস হওয়ার প্রশ্নই আসেনা।
মঙ্গলবার সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক রায় ঘোষনার আগেই রায় ফাঁস হওয়া বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, এটি মিথ্যে কথা। আমি এটর্নি জেনারেল হয়ে জানতে পারলামনা ; ওনারা পেলেন কিভাবে। এটি একটি মনগড়া কথা।
আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিত আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হকও মঙ্গলবার দাবি করেন, রায় ফাঁস হওয়ার কোন প্রশ্নই আসেনা। মন্ত্রণালয় থেকে রায় ফাঁস হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তার পরও মন্ত্রণালয় এ বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রন কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দিয়েছে।
১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল-১ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়। কিন্তু সোমবার মধ্যরাতের পর থেকে ইন্টারনেটে রায় ফাঁস হওয়ার ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ে । ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক রায় ঘোষনার পরপরই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম এবং স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয় আইন মন্ত্রণালয় থেকে এ রায় লেখা হয়েছে। রায় আগেই ফাঁস হয়ে গেছে এবং তারা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে সে রায়ের কপি নিয়ে এসেছেন। সাংবাদিকদের সে কপি দেখিয়ে তারা দাবি করেন, ট্রাইব্যুনালে একটু আগে যে রায় ঘোষনা করা হল তার সাথে হুবহু মিল রয়েছে ফাঁস হওয়া রায়ের কপির সাথে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন