মেহেদী হাসান, ৮/১০/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১১ তম সাক্ষী অ্যাডভোকেট শামসুল হক ওরফে নান্নুকে পুনরায় তলব করে জেরার আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়েছে। আসামী পক্ষের এ আবেদন শুনানী শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আবেদনটি খারিজ করে দেয়। আবেদনের পক্ষে ডিফেন্স টিমের প্রধান ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক শুনানী পেশ করেন।
সাক্ষী অ্যাডভোকেট শামসুল হক ওরফে নান্নু মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে গত ২০ জুন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। তিনি তার জবানবন্দীতে ১৯৭১ সালে পাবনায় মাওলানা নিজামীকে দেখেছেন উল্লেখ করে অনেকগুলো অপরাধ সংঘটনে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দানের অভিযোগ করেন । অপরদিকে আসামী পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে সাক্ষী অ্যাডভোকেট শামসুল হক ওরফে নান্নুর একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে ইউটিউবে। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার আগে ধারনকৃত এ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন ১৯৭১ সালে মাওলানা নিজামীকে তিনি কোনদিন পাবনায় দেখেননি। মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে তিনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কোন জবানবন্দীও দেননি। ১৯৮৬ সালের আগে তিনি মাওলানা নিজামীকে চিনতেনও না।
ইউটিউিবে এ ভিডিও প্রচারিত হবার পর গত ২১ সেপ্টেম্বর সাক্ষী অ্যাডভোকেট শামসুল হক ওরফে নান্নু সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ইউটিউবের সাক্ষাতকারে যে ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে সে ব্যক্তি তিনি নন। তিনি এ ধরনের কোন সাক্ষাৎকার কাউকে দেননি। সাক্ষাতকারে যাকে দেখা যাচ্ছে তার গোফ নেই। তার বর্তমানে গোফ আছে।
এ প্রসঙ্গে আসামী পক্ষ তাকে তলব করে পুনরায় জেরার আবেদন জানায়। আজ শুনানীতে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা তার পাসপোর্ট, ভোটার আইডি কার্ড এবং সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবীদের তালিকা থেকে অ্যাডভোকেট শামসুল হক ওরফে নান্নুর ছবি সংগ্রহ করেছি। এ ছবি আব্দুর রাজ্জাক কোর্টকে দেখিয়ে বলেন, এসব ছবিতে সাক্ষীর গোফ নেই। ইউটিউবের সাক্ষাৎকারে আমরা যাকে শামসুল হক ওরফে নান্নু বলে দাবি করছি তার চেহারার সাথে এসব ছবির চেহারর মিল রয়েছে। তাছাড়া পাবনায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সাথে তার একটি ভিডিও ফুটেজ আমাদের কাছে আছে যেখানে তাকে গোফবিহনীন অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। পুনরায় তলবের পক্ষে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা তাকে প্রশ্ন করব পাসপোর্ট, ভোটার আইডিকার্ড এবং আইনজীবীদের তালিকায় প্রদত্ত এসব ছবি তার কি-না। এছাড়া কণ্ঠ পরীক্ষার জন্য তিনি কণ্ঠ দিতে রাজি আছেন কি-না এবং মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদানের বিষয়ে তার ওপর সরকারের কোন চাপ ছিল কি-না।
আসামীপক্ষের দাবিকৃত অ্যাডভোকেট শামসুল হক ওরফে নান্নুর ইউটিউবের সাক্ষাৎকার পড়ে শোনান ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ইউটিউবে প্রচারিত সাক্ষাতকারে দেখা যায় সাক্ষী বলছেন “তা তো তখন আমি কোন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমার সামনেও সে (নিজামী) কোন দিন পড়ে নাই। তার কারণ তাকে কোথাও কোন দিন দেখিও নাই। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কিছু করার দেখি নাই বিরোধীতা করার কিছু করারও দেখি নাই।.. আমি নিজামী সাহেবকে কখনো দেখিনি। আমি একচুয়ালি যখন ওই যে পলিটিকস ওপেন হলো ৮৬ ইলেকশনে এ তখন থেকে তার সঙ্গে পরিচয়।”
শুনানী শেষে আবেদনটি খারিজ করে দেয় ট্রাইব্যুনাল।
নিম্নে এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন রয়েছে যা গত ২৪ জুন দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত হয়।
মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে ট্রাইব্যুনালে এবং ট্রাইব্যুনালের বাইরে সাক্ষীর দুই ধরনের বক্তব্য
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে চলতি মাসের ২০ জুন বৃহষ্পতিবার ১১ তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন মোঃ শামছুল হক ওরফে নান্নু । তিনি পেশায় অ্যাডভোকেট এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন বলে ট্রাইব্যুনালে জানান।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে তিনি তার জবানবন্দীতে অনেকগুলো অভিযোগ করেন। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহায়তার জন্য মাওলানা নিজামীসহ অন্যান্যরা মিলে স্বাধীনতা বিরোধী সেল গঠন, সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প উদ্বোধন, রুপসী প্রাইমারি স্কুলে শান্তিকমিটি গঠনের নির্দেশ এবং আলবদর বাহিনী গঠনের নেতৃত্ব দান। এছাড়া মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষনের নেতৃত্ব দানের বেশ কয়েকটি অভিযোগ করেন সাক্ষী। পাবনা এলাকায় সংঘটিত এসব অপরাধের নেতৃত্ব দানের সময় সাক্ষী মাওলানা নিজামীকে দেখেছেন বলে সাক্ষ্য দেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনী গানবোট নিয়ে নগরবাড়ি ঘাটের দিকে অগ্রসর হয়। মাওলানা নিজামী এবং তার দলবল তাদের সাথে থেকে তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। সেদিনের যুদ্ধে প্রায় দেড়শ লোক শহীদ হয়। ১১ এপ্রিল মাওলনা নিজামী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিয়ে পাবনা শহরে প্রবেশ করে এবং রাস্তার দুপাশের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, দোকানপাট লুটপাট করে। ১৯ এপ্রিল একইভাবে মাওলানা নিজামীর সহায়তায় ডাববাগান আক্রমন পরিচালনা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ১৪ই মে, ১৯৭১ ফজরের আযানের পর সশস্ত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মতিউর রহমান নিজামী, রফিকুন নবী, কুখ্যাত দালাল আসাদ এবং তার দলবল রূপসী, বাউশগাড়ী এবং ডেমরা গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং ব্যাপক গোলাগুলি চালিয়ে নিরস্ত্র নীরিহ এবং নির্দোষ মানুষদেরকে হত্যা করে। এতে ৪৫০ জনের অধিক শহীদ হন । এভাবে আরো বেশ: কিছু ঘটনা উল্লেখ করে সাক্ষী বলেন, মাওলানা নিজামীর দেখানো মতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনেককে হত্যা করে। এসব অনেক অপরাধ সংঘটনের সময় মাওলানা নিজামীকে তিনি দেখার কথা বলেছেন।
ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার পূর্বে সাক্ষী মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী দেন এবং সে জবানবন্দীতেও মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য লিখিত আছে তার নামে।
ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার পূর্বে গত বছর জুলাই মাসে মোঃ শামছুল হক ওরফে নান্নু অ্যাডভোকেট দিগন্ত টেলিভিশনের সাথে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। সে সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কোন জবানবন্দী দেননি তিনি। ১৯৭১ সালে তিনি পাবনায় মাওলানা নিজামীকে দেখেননি। মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে তার নামে তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দীতে যদি কিছু লেখা থাকে তাহলে তা মিথ্যা। দিগন্ত টিভি কর্তৃক গ্রহণ করা তার সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়নি ; তবে সে সাক্ষাতকারটি এখন ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া ইউটিউবে তার আরো একটি ভিডিও সাক্ষাকার রয়েছে এবং সেখানেও তিনি মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে কোন কিছু বলার কথা অস্বীকার করছেন। তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দীতে তার নামে মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে জবানবন্দী বিষয়টি নজরে আসার পর সাক্ষী মোঃ শামছুল হক ওরফে নান্নু অ্যাডভোকেট ২০১২ সালে একটি এফিডেভিট তৈরি করেন এবং সেখানে তিনি ঘোষনা করেন- ১৯৭১ সালের ঘটনা বিষয়ে মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে তার নামে তদন্ত কমকর্তার তৈরি করা জবানবন্দীতে যা আছে তা মিথ্যা। তিনি তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দী উল্লেখ করে বলেন তিনি এসব কথা তার কাছে বলেননি।
প্রথমে আসা যাক দিগন্ত টিভিতে ধারন করা ইউটিউবে প্রচারিত তার সাক্ষাতকার বিষয়ে। নিম্নের এ লিংক দুটিতে তার সাক্ষাতকার দেখা এবং শোনা যাবে।
দিগন্ত টিভিতে প্রদত্ত সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, বাউশগাড়ী ঘেরাও করার সময় পাকিস্তানী আর্মিকে সাহায্য করছে বেড়ার আসাদ নাম করে একটা লোক। সে ওদেরকে রাস্তা দেখায়ে নিয়ে আসছে। ... বিষয়টা হলো তখন পাকিস্তান মিলিটারীর দাবড় খাইয়া লোক যার যার মত লাইফ নিয়ে পালায়। যেটা বাস্তবতা। পালায়ে চলে যায়। আসাদকে সামনা সামনি আমি দেখিনি, তবে লোক সবাই বলছে, যারা দেখছে যে, আসাদ ছিল। এইখানে মাওলানা নিজামী সাহেব, সোবহান সাহেব বা আদারস্ যারা আছে, ওদের ওখানে কেউ বলে নি যে, তারা ছিল বা আমরাও দেখিনি।....স্বাধীন হওয়ার পর যখন যাদের লোকজন মারা গেছে তারা আসাদকে দেখায়ে দিল যে এই লোকটি আনছিল, তখন মুক্তিযোদ্ধারা গণআদালতে আসাদের বিচার করে, বিচার করে তার মৃত্যুদ- দেয়।...ডেমরা হত্যাকান্ডে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে রাস্তা আসাদ দেখায়ে নিয়ে আসছে।
এক প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন, এ ঘটনায় আমি মতিউর রহমান নিজামীর নাম বলিনি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন, তখন আমি মাওলানা নিজামী সাহেবকে চিনতামও না।আরেক প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন, আমি তো বললাম, একাত্তরে তার সাথে আমার পরিচয়ই ছিলো না।
সাক্ষী বলেন, যে আসাদ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু সে মারা যাবার আগে কখনো মাওলানা নিজামী, আব্দুস সোবহানের নাম বলেনি।
তার নামে তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক জমা দেয়া জবানবন্দীতে মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে সরাসরি অনেক অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সাক্ষী বলেন, তিনি এটা বলেননি। যদি এধরনের কথা লেখা থাকে তাহলে তা ঠিক নয় এবং তিনি এর প্রতিবাদ করবেন।
ইউটিউবে প্রচারিত তার আরেকটি সাক্ষাতকারে দেখা যায় যেখানে সাক্ষী বলছেন “তা তো তখন আমি কোন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমার সামনেও সে (নিজামী) কোন দিন পড়ে নাই। তার কারণ তাকে কোথাও কোন দিন দেখিও নাই। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কিছু করার দেখি নাই বিরোধীতা করার কিছু করারও দেখি নাই।.. আমি নিজামী সাহেবকে কখনো দেখিনি। আমি একচুয়ালি যখন ওই যে পলিটিকস ওপেন হলো ৮৬ ইলেকশনে এ তখন থেকে তার সঙ্গে পরিচয়।
এফিডেভিট : সাক্ষী মো : মোঃ শামছুল হক ওরফে নান্নু ২০১২ সালে ১ম শ্রেণীর মেজিস্ট্রেট/ নোটারি পাবলিক এর কার্যালয়, পাবনা একটি হলফনামা তৈরি করেন। ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে তৈরি করা সে হলফনামায় সাক্ষী মো : শামছুল হক ঘোষনা করেন- স্বাধীনতাবিরোধী সেল গঠন, বাউশগাড়ীসহ বিভিন্ন অপারেশনে মাওলানা নিজামী কর্তৃক পাকিস্তানী সেনাবাহিীনকে নিয়ে যাওয়া এবং পথ দেখিয়ে দেয়া, রাজাকার বাহিনী গঠনসহ মাওলানা নিজামীকে জড়িয়ে আমার নামে তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দীতে যা উল্লেখ রয়েছে তা মিথ্যা।
তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক জমা দেয়া জবানবন্দী কোট করে তিনি ঘোষনা করেন-“এ বিষয়ে আমার পরিস্কার বক্তব্য এই যে, আমি অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জনাব আব্দুর রাজ্জাক খানের নিকট প্রদত্ত জবানবন্দীকালে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে জড়াইয়া এ ধরনের কোন বক্তব্য প্রদান করিনাই। যদি আমার নামে উল্লিখিত কোন বক্তব্য লিখিত থাকে তাহা হইলে তা তদন্ত কর্মকর্তার মনগড়া বক্তব্য।
আমি এই মর্মে আরো ঘোষনা করিতেছি যে, আমি যে বক্তব্য প্রদান করিয়াছি তাহাতে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে জড়াইয়া কোন বক্তব্য প্রদান করিনাই। কারণ তিনি উল্লিখিত ঘটনার সাথে কোনভাবেই জড়িত ছিলেননা।”
এফিডেভিট, দিগন্ত টিভিতে প্রদত্ত সাক্ষাতকার যা এখন ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে এ বিষয়ে সাক্ষীর মতামত জানানর জন্য তাকে ফোনে চেষ্টা করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন