সোমবার, ৮ জুলাই, ২০১৩

সংশোধিত আপিল আইন কাদের মোল্লার মামলায় প্রযোজ্য বলে মত দিলেন দুই অ্যামিকাস কিউরি


মেহেদী হাসান
আব্দুল কাদের মোল্লার মামলাকে কেন্দ্র করে সংশোধিত আপিল আইন আব্দুল কাদের মোল্লার আপিলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলে মত দিয়েছেন দুই অ্যামিকাস কিউরি। এরা হলেন বিশিষ্ট আইনবিদ ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম। যুদ্ধাপরাধ আইনের আপিল সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করে সরকার আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড দাবি করে যে আপিল আবেদন করেছে তা এ দুই আইনজীবীর মতে বৈধ।

আব্দুল কাদের মোল্লা মামলায় আপিল শুনানীতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্ত বিশিষ্ট আইনজীবীদের মতমত গ্রহণ আজ শুরু হয়েছে।  প্রথম দিন ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম এর মতামত গ্রহণ করা হয়।  প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহণ করেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক  আদালতে উপস্থিত না হয়ে তিনি   ২৫ পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য পাঠান এবং তা আদালতের সামনে পড়ে শোনান অ্যাডভোকেট মো : ওয়াহিদউদ্দিন। এরপর ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম তার ৫৫ পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য পাঠ করা শুরু করেন।
প্রথম দিন যুক্তি পেশ শেষে ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের কাছে বলেন, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ আমাদের কাছে দুটি বিষয় জানতে চেয়েছিলেন। এর একটি হল ১৯৭৩ সালের আইন গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংশোধন করে সরকার পক্ষকে আপিলের যে সুযোগ দেয়া হয়েছে তা আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি-না। আমি আমার বক্তব্যে ‘প্রযোজ্য হবে’ বলে মতামত তুলে ধরেছি।
আদালতের আরেকটি প্রশ্ন ছিল কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল’ বা প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন এই বিচারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি-না। আমি বলেছি- ‘প্রযোজ্য হবে’ । কারণ ১৯৭৩ সালের আইন বিদ্যমান প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনকে ধারন করেছে। একথা আইনে বলা আছে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়াসহ যেসব দেশে যুদ্ধাপরাধ  বিচার হয়েছে এবং যুদ্ধাপরাধ বিচারকে কেন্দ্র করে যেসব আইন তৈরি হয়েছে তাও ধারন করবে আমাদের আইন। আমরা জেনেভা কনভেনশন সাক্ষর করেছি। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন আমরা ধারন করেছি।
অপর দিকে ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক এ  প্রশ্নে বলেছেন, কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল আইন বাংলাদেশের এ বিচারের ক্ষেত্রে প্রযোজন নেই।

১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল সংশোধনী আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় প্রযোজ্য হবে মতামত তুলে ধরে ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক তার লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন-“যুদ্ধবন্দী, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনে বর্নিত অন্যান্য অপরাধ বিচারের জন্য প্রণীত  আইনের যেকোন বিধান তা যদি বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হয়  তবে তাকে বেআইনী বা অবৈধ হওয়াকে থেক্ষে রক্ষার জন্য  বাংলাদেশের সংবিধানে ৪৭(৩) ধারায় সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে । এমনকি ২০১৩ সালের সংশোধিত আইনের ১(২) ধারা যদি বাংলাদেশের সংবিধানের  কোন বিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হয় তবু একে অবৈধ বা বেআইনী বলা যাবেনা । কাজেই ৩০১৩ সালের সংশোধিত ১(২) ধারা সংবিধান কর্তৃক সুরক্ষিত, ২১ ধারা ১৪ জুলাই ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর বলে ধরে নিতে হবে। কাজেই ১৯৭৩ সালের আইনে নতুন যে ২১ ধারা সংযোজন করা হয়েছে তার মাধ্যমে সরকার আপিল করতে পারবে।”

এদিকে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম আজ মঙ্গলবারও তার লিখিত বক্তব্য পেশ করা অব্যাহত রাখবেন।

ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ক্ষেত্রে পূর্বের বিধান ছিল- আসামী পক্ষ সাজার  বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আসামীকে সাজা দেয়া হলে রাষ্ট্রপক্ষ আর  আপিল করতে পারবেনা। ট্রাইব্যুনালের রায়ে যদি আসামীকে  খালাস দেয়া হয় শুধুমাত্র সেক্ষেত্রে সরকার পক্ষ বা অভিযোগকারী আপিল করার সুযোগ পাবে; অন্যথায় নয়। কিন্তু আব্দুল কাদের মোল্লাকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের পর তার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে  ওঠে।  সে প্রেক্ষিতে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইবুনাল আইনের আপিল সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করা হয় সংসদে।  সংশোধিত আইনে বলা হয়- আসামী পক্ষের মত সরকার পক্ষও আপিলের সমান সুযোগ পাবে। অর্থাৎ শুধু খালাসের ক্ষেত্রে নয়, ট্রাইব্যুনালের যেকোন রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষও আপিল করতে  পারবে । আপিল সংক্রান্ত বিধান সংশোধনী বিষয়ে বলা হয়েছে-এ সংশোধনী ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে কার্যকর ছিল বলে ধরে নিতে হবে।
আইনের আপিল সংক্রন্তা ধারা সংশোধনের পর সরকার পক্ষ আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের দাবি জানিয়ে আপিল আবেদন করে।
আপিল শুনানীতে  রাষ্ট্রপক্ষ আদালতের কাছ থেকে অনেক আইনগত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে ।  এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হল- গত ১৮ ফেব্রুয়ারি যে আইন সংশোধন করা হয়েছে  তা আব্দুল কাদের মোল্লার মামলায় প্রযোজ্য কি-না।  এছাড়া অপর যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপিত হয়েছে তাহল- আদালত  এটর্নি জেনারেল এর কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন- উপমহাদেশ বা ইংল্যান্ডের এমন কোন নিজর আছে কি-না যেখানে  রায় হবার পর এভাবে  আইন সংশোধন করে রিট্রোসপেকটিভ ইফেক্ট কার্যকর করা হয়েছে।
কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এ বিষয়ে সন্তোষজনক জবাব না আসায় আপিল বিভাগ সুপ্রীম কোর্টের সাতজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন এ বিষয়ে তাদের কাছ থেকে মতামত গ্রহনের জন্য।

অপর দিকে আসামী পক্ষ থেকে শুনানী পেশ করার সময় যুক্তি তুলে  ধরে বলা হয় গনহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, দেশান্তারকরন, ইনহিউম্যান অ্যাক্ট, পারসিকিউশন প্রভৃতি আন্তর্জাতিক অপরাধের সংজ্ঞা বাংলাদেশের আইনে নেই। এসব অপরাধের সংজ্ঞা নিরূপন করা আছে আন্তর্জাতিক প্রচলিত আইনে। কাজেই গনহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রভৃতি অপরাধ  বলতে সত্যিকার অর্থৈ কি বোজায়  তা চিহ্নিতকরন এবং এ বিচারের ক্ষেত্রে প্রচালিত আন্তর্জাতিক আইন বা কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল প্রয়োগ করতে হবে।

শুনানীর সময় রাষ্ট্রপক্ষে অন্যান্যের মধ্যে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আসামী পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত ছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন