সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০১৩

গোলাম আযমের ৯০ বছর জেল

মেহেদী হাসান. ১৫/৭/২০১৩. ঢাকা :
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের  মানবতাবিরোধ অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ তার বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষনা  করেন।

অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে পাঁচ ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। পাঁচ অভিযোগই প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

পাঁচ ধরনের অভিযোগ হল ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, সহযোগিতা এবং সিরু মিয়া দারোগা ও তার কিশোর পুত্র আনোয়ার কামালসহ মোট ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া কারাগারে হত্যা ।

এসব অভিযোগের মধ্যে ষড়যন্ত্র বিষয়ক অভিযোগের জন্য ১০ বছর, পরিকল্পনার জন্য ১০ বছর, উসকানি বিষয়ক অভিযোগে ২০ বছর, সহযোগিতার জন্য ২০ বছর এবং সিরু মিয়া দারোগাসহ ৩৮ জনকে হত্যার জন্য ৩০ বছর মিলিয়ে মোট ৯০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। প্রত্যেকটি দণ্ড একটির পর একটি আমৃত্যু তাকে ভোগ করতে হবে বলে রায়ে উল্লেখ করা  হয়।

রায়ে বলা হয় অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের যে অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে তা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের উপযুক্ত। তবে তার ৯১ বছর বয়স এবং দীর্ঘদিনের অসুস্থতার কারনে তাকে মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হল।

ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির রায় ঘোষনার শুরুতে বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়নি বা  অপরাধ স্থলে উপস্থিত থাকা বা তার কথায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে কেউ কোন অপরাধ সংঘটন করেছে সরাসরি এমন কোন অভিযোগও আনা হয়নি তার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা হল- উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় বা সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’র অভিযোগ। তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির। এ দলের আমির হিসেবে রাজাকার, শান্তি কিমিটি, আল বদর, আল শামস প্রভৃতি বাহিনী গঠন এবং এসব বাহিনীর কার্যক্রমের ওপর তার নিয়ন্ত্রন ছিল। এসব বাহিনী ১৯৭১ সালে  পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে হত্যা, গনহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে। তাছাড়া সরাসরি জামায়াতে ইসলামও পাকিস্তানের সহযোগী বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে। তাই এসব বাহিনীর অপরাধমূলক কর্মকান্ডের দায় তিনি এড়াতে পারেননা।
চেয়ারম্যানসহ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এবং বিচারপতি আনোয়ারুল হক পালাক্রমে রায় পাঠ করেন।
২৪৩ পৃষ্ঠার মূল রায় থেকে ৭৫ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনানো হয় ট্রাইব্যুনালে।

জামায়াতের ডাকা হরতালের মধ্যে জনাকীর্ন আদালত কক্ষে সকাল ১১টায় রায় ঘোষনা শুরু করে আদালত। অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রায় ঘোষনা উপলক্ষে নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ট্রাইব্যুনালের চারদিকে। রায় ঘোষনাকে কেন্দ্র করে  ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি সহ বিভিন্ন সংস্থার বিপুল সংখ্যক লোকজন উপস্থিত হন ট্রাইব্যুনালের সামনে।
রায় ঘোষনা উপলক্ষে সকালেই ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় অধ্যাপক গোলাম আযমকে। রায় ঘোষনা শুরুর আগ মুহুর্তে তাকে ট্রাইব্যুালের কাঠগড়ায় হাজির করা হয় হাজতখানা থেকে। সাদা পাঞ্জাবি এবং সাদা টুপি পরিহিত অধ্যাপক গোলাম আযম কোর্ট চলাকালীন প্রায় তিনঘন্টা নির্বিকারে চেয়ারে বসে ছিলেন।

সূচনা বক্তব্য :
সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে কোর্ট বসার পর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির সূচনা বক্তব্য রাখেন রায় বিষয়ে। তিনি বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযম খুবই সুপরিচিত একজন ব্যক্তি বিশেষ করে ১৯৭১ সালে তার পরিচিতি ব্যাপক আকারে ছিল। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির ছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি শান্তি কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যে পাঁচ ধরনের অভিযোগ এনেছে তাতে এমন কোন অভিযোগ নাই যেখানে দেখা যায় যে, তার নির্দেশে সরাসরি কোন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা তিনি নিজে কোন অপরাধ সংঘটন করেছেন বা কোন ঘটনা স্থলে তিনি উপস্থিত ছিলেন-এ ধরনের কোন অভিযোগ আনা হয়নি তার বিরুদ্ধে। অন্য মামলায় যেমন সরাসরি আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে এ মামলায় আসামীর বিরুদ্ধে সরাসরি কোন অপরাধের অভিযোগ আনা হয়নি। এদিক থেকে এটা একটা ব্যতিক্রম মামলা। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা হল উর্দ্ধতন নেতৃত্বের দায় বা সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি। আল বদর, রাজাকার, আল শামস, প্রভৃতি প্যারা মিলিশিয়া বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ছিল জামায়াতে ইসলামীর । পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে হত্যা, গনহত্যা এবং ধর্ষণসহ ব্যাপক অপরাধ করেছে এসব বাহিনী। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হল এসব বাহিনীর ওপর তার নিয়ন্ত্রন ছিল। তাই এসব অপরাধের দায় তিনি এড়াতে পারেননা। রাজাকার, আল বদর, আল শামস প্রভৃতি বাহিনীর সমস্ত অপরাধের দায় দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়।

রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যেসব পেপারকাটিং এবং দালিলিক প্রমানপত্র দাখিল করা হয়েছে তাতে দেখা যায় তিনি ১৯৭১ সালে কোথায় কখন কার সাথে দেখা করেছেন, কোন সভায় বক্তব্য দিয়েছেন, পাকিস্তানের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন সে বিষয়ে উল্লেখ আছে।

এটিএম ফজলে কবির বলেন, সাধারনত দৈনিক পত্রিকায় ঘটনার পরপর রিপোর্ট করা হয়। তাই পত্রিকায় ভুল রিপোর্টও হতে পারে। কিন্তু বই সাধারনত ঘটনার অনেক পরে লেখা হয় এবং লেখক তথ্য যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ পায়। কিন্তু এ মামলায় আমরা রেফারেন্স হিসেবে তেমন কোন বইপত্র পাইনি। আমাদের কাছে শুধুমাত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ডকুমেন্ট এর কপি আছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ৪২ বছরে যত বই লেখা হয়েছে তার তেমন কিছু আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি। ফলে এ মামলার রায় ঘোষনায় কিছুটা দেরি হয়েছে। আমরা যা কিছু পেয়েছি তাই দিয়ে রেফারেন্স দিয়েছি। রাষ্ট্রপক্ষ বই পত্র দাখিল করতে পারেনি। আমরাও তেমন একটা সংগ্রহ করতে পারিনি সন্তোষজনকভাবে।

রায়ে অভিযোগের স্বপক্ষে প্রমান এবং যুক্তি :
সূচনা বক্তব্যের পর সকাল  ১১টা থেকে রায় পড়া শুরু হয়। রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক জমা দেয়া ১৯৭১ সালের বিভিন্ন পেপারকাটিং  উপস্থাপন করা হয় অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, সহযোগিতা এবং উসকানীর অভিযোগ প্রমানের স্বপক্ষে। অধ্যাপক গোলাম আযম কবে কোথায় কি বক্তব্য দিয়েছেন, পাকিস্তানের কোন কোন নেতৃবৃন্দের সাথে কবে কখন কোথায় সাক্ষাৎ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের দমনের জন্য তাদের কাছে  কবে কোথায় অস্ত্র সহযোগিতা চেয়েছেন তার অনেক রেফারেন্স পড়ে শোনানো হয়েছে রায়ে। রায়ের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট বর্ননার সাথে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালিতা  বর্বর গণহত্যা, ধর্ষণ, নারকীয় কর্মকান্ডের চিত্র তুলে ধরা হয়। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধ প্রমানের স্বপক্ষে অধ্যাপক গোলাম আযম লিখিত ‘জীবনে যা দেখলাম’ বই থেকেও উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। তবে বেশিরভাগ উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে ১৯৭১ সালের পত্রপত্রিকা এবং কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র প্রামান্য গ্রন্থ থেকে।

এরপর অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি এবং সহযোগিতা প্রমানের স্বপক্ষে তার বক্তব্য, বিবৃতি এবং পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা সাক্ষাতের ঘটনা তারিখসহ উল্লেখ করা হয় ১৯৭১ সালের  পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে।  এরপর আসামী এবং রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপিত যুক্তির সার সংক্ষেপ তুলে ধরা হয়।

রায়ে বলা হয় ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে। রাজাকার, আল বদর, আল শামস, শান্তি কমিটি প্রভৃতি বাহিনীর ওপর তারা সরাসরি নিয়ন্ত্রন ছিল। এসব বাহিনী অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল এবং তিনি এজন্য প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তি। দৈনিক সংগ্রাম, ইত্তেফাক, পাকিস্তান অবজারভারসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে রেফারেন্স তুলে ধরে রায়ে বলা হয় অধ্যাপক গোলাম আযম  পাকিস্তানে হিন্দুদেরকে মুসলমানদের শত্রু আখ্যায়িত করে ঘৃন্য বক্তব্য দিয়েছেন। পাকিস্তান না থাকলে বাঙ্গালী মুসলমান থাকবেনা বলে বক্তব্য দিয়েছেন। এটা পরিস্কার উসকানিমূলক বক্তব্য। ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর লাহোরে  তিনি তার অনুগত বাহিনীর লোকজনের জন্য অস্ত্র সরবরাহের অনুরোধ জানিয়েছেন পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রপতির সাথে তার বৈঠকের খবর প্রকাশিত হয়েছে ২ ডিসেম্বর এর ইত্তেফাক পত্রিকায়। তার বিরুদ্ধে উসকানী এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমানের পক্ষে এসব রেফারেন্স তুলে ধরা হয়।

এরপর সহযোগিতার অভিযোগ  প্রমানের পক্ষে বলা হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে বর্বর কর্মকান্ড হয়েছে সে বিষয়ে তার প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছিল। কিন্তু তারপরও তিনি উপর্যপুরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রশংসা করেছেন উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে। তাদের কাছে অস্ত্র  চেয়েছেন তার অনুগতদের জন্য। জামায়াতের আমির হিসেবে এসব প্যারা মিলিশিয়া বাহিনীর ওপর তার সরাসরি নিয়ন্ত্রন ছিল।

রায়ে বলা হয় অধ্যাপক গোলাম আযম জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার, আল বদর আল শামস শান্তি কমিটিসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের  দ্বারা সংঘটিত  অপরাধের জন্য কাউকে কোন শাস্তি দেননি বা তাদেরকে অপরাধ থেকে নিবৃত রাখারও কোন ভূমিকা পালন করেননি।

১৯৭১ সালে প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী সভায় জামায়াতের দুজন সদস্য মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এ বিষয়ে অধ্যাপক গোলাম আযমের বক্তব্য উদ্ধৃত করে রায়ে বলা হয় ‘যে উদ্দেশে নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে লোক পাঠিয়েছি এবং যে উদ্দেশ নিয়ে শান্তি কমিটিতে যোগ দিয়েছি  সেই একই উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা মন্ত্রী সভায় লোক পাঠিয়েছি।’

এসব রেফারেন্স প্রদানের পর রায়ে উল্লেখ করা হয় জামায়াতের তৎকালীন আমির এবং শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে রাজাকার, আল বদর, আল শামস, শান্তি কমিটি প্রভৃতি বাহিনীর ওপর অধ্যাপক গোলাম আযমের সরাসরি নিয়ন্ত্রন এবং প্রভাব ছিল। কাজেই অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, সহযোগিতা এবং উসকানিসহ পাঁচটি অভিযোগই প্রমানিত হয়েছে।

সিরু মিয়া দারোগাসহ ৩৮ জনকে হত্যার ঘটনা :
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, সহযোগিতা এবং উসকানির চারটি অভিযোগের অধীনে মোট ৬১টি  ঘটনা রয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আলাদা একটি অভিযোগ আনা হয়েছে সিরু মিয়া দারোগাসহ ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধা হত্যা বিষয়ে। এ অভিযোগে অধ্যাপক গোলাম আযমকে ৩০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।

সিরু মিয়া দারোগা এবং তার ছেলে আনোয়ার কামালসহ ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ব্রাক্ষনবাড়িয়া কারাগারে হত্যা বিষয়ে রায়ে বলা হয় অধ্যাপক গোলাম আযম ইচ্ছা করলে এ ৩৮ জনকে বাঁচাতে পারতেন।  কিন্তু তিনি সে সুযোগ গ্রহণ করেননি। এ ঘটনা বিষয়ে রায়ে বলা হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সিরুমিয়া দারোগা এবং তার ছেলে আনোয়ার কামাল রাজাকারদের হাতে বন্দী হন কুমিল্লা থেকে ভারতে যাবার সময়। পরে তাদের ব্রাক্ষনবাড়িয়া কারাগারে রাখা হয়। সিরু মিয়া দারোগার স্ত্রীর বোনের স্বামী মহসিন  আলী খিলগাও গভ: স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। অধ্যাপক গোলাম আযমের দুই ছেলে যথা আজমী এবং আমিন ছিল শিক্ষক মহসিন আলীর ছাত্র।  সেই সূত্র  ধরে সিরু মিয়া দারোগার স্ত্রী  মহসিন আলীকে  পাঠিয়েছিলেন অধ্যাপক গোলাম  আযমের কাছে তার স্বামী এবং ছেলেকে মুক্ত করার ব্যাপারে সুপারিশ চেয়ে।
শিক্ষক মহসিন আলী  অধ্যাপক গোলাম আযমের সাথে দেখা করার পর অধ্যাপক গোলাম আযম একটি খাম দেন তাকে। সে খাম তিনি সিরু মিয়া দারোগার স্ত্রীর কাছে এনে দেন। এরপর অধ্যাপক গোলাম আযমের নির্দেশ মত সে চিঠি পাঠানো হয় ব্রাèবাড়িয়ার স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা পেয়ারা মিয়ার কাছে। পেয়ার মিয়া সে চিঠি পড়ার পর অধ্যাপক গোলাম আযমের আরেকটি চিঠি দেখান তাকে যেখানে তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দেয়া আছে বলে জানান তিনি। নতুন যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তাতেও নতুন কিছু নেই বলে জানান তিনি। এরপর ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর ঈদুল ফিতরের দিন সিরু মিয়া দারোগা এবং তার ছেলে আনোয়ার কামালসহ মোট ৩৮ জন বন্দী মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়।
সিরু মিয়া দারোগার স্ত্রী এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের একজন সাক্ষী ছিলেন।

রায়ে অধ্যাপক গোলাম আযমকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যগত কারনে তাকে পুনরায় বঙ্গবন্ধু শেখ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার পক্ষে নিযুক্ত এক আইনজীবী।
হরতালের কারনে অধ্যাপক গোলাম আযমের পক্ষে সিনিয়র কোন আইনজীবী যাননি ট্রাইব্যুনালে। 


হতাশ রাষ্ট্রপক্ষ :
রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল কে এম রহমান বলেন, আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। তবে আংশিক হলেও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত বলেন, আদালতের রায় মাথা পেতে নেয়া ছাড়া তো আমাদের করার কিছু নই। তবে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই এ রায়ে।
এছাড়া আদালত প্রাঙ্গনে উপস্থিত ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির নেতৃবৃন্দের বক্তব্যেও হতাশা এবং ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে।
প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ে নতুন একটি দিক হল প্রথমবার কোন বেসামরিক ব্যক্তিকে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির অভিযোগে অভিযুক্ত করে সাজা দেয়া হল।

আসামী পক্ষের প্রতিকৃয়া :
অপর দিকে আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন এটি একটি ন্যায়ভ্রস্ট রায়। আমরা সুবিচার পাইনি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ অধ্যাপক গোলাম আযমকে ১৯৭১ সালে সংঘটিত  গনহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে ৯০ বছরের সাজা প্রদান করেছেন। এ রায়ে আমরা ক্ষুব্ধ। এ রায়ে আমরা বিস্মিত। আমরা মনে করি এ রায় ন্যায়ভ্রষ্ট এবং আবেগতাড়িত। তিনি বলেন, এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার এই বক্তব্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সাথে গোলাম আযমের দুরতম কোন সম্পর্ক নাই। রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে আনীত ৬১টি অভিযোগের একটিও প্রমাণ করতে পারেন নাই। এটা রাষ্ট্রপক্ষের চরম ব্যর্থতা। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপীল দায়ের করব। এছাড়া রায়ে জামায়াতে ইসলামী সম্পার্কে যে মন্তব্য করা হয়েছে তা আইনের পরিপন্থী বলে তিনি উল্লেখ করেন।

রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ নিজ বাস ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক রায় সম্পার্কে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এসময় ডিফেন্স টিমের অন্যাতম সদস্য অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিকী, অ্যাডভোকেট শিশির মনির, অ্যাডভোকেট শাহীন জামান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষ ৬ টি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে অধ্যাপক গোলাম আযম পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, সামরিক শাসক টিক্কা খান এবং মাওলানা মওদূদীর সাথে বৈঠক করেছেন। এ সব বৈঠকে কি আলোচনা হয়েছে তার কোন কার্যবিবরনী প্রকাশ করতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। কারও সাথে দেখা সাক্ষাত করা মানবতা বিরোধী অপরাধ নয়, এটা হতে পারে না। এই অভিযোগগুলো মানবতা বিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় পরে না। তারপরও মাননীয় ট্রাইব্যুনাল তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন এবং ১০ বছরের সাজা দিয়েছেন। আইনের দৃষ্টিতে এটা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। যেভাবে সাজা দেয়া হয়েছে তা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রুয়ান্ডা, সিয়েরালিয়ন ট্রাইব্যুনাল, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসিসহ কোন আদালত এভাবে সাজা দেয়া হয়নি।
দ্বিতীয় অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষ ৩ টি ঘটনার উপর নির্ভর করেছেন। সেগুলো হচ্ছে অধ্যাপক গোলাম আযম কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় শান্তি কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন। শুধুমাত্র শান্তি কমিটি গঠনের সাথে জড়িত থাকা মানবতা বিরোধী অপরাধ হতে পারে না। তাই যদি হয় তাহলে মানবতা বিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে হবে। তারপরও মাননীয় ট্রাইব্যুনাল - আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি যে, অধ্যাপক গোলাম আযমকে গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধের পরিকল্পনাকারী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করে ১০ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন।
তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষ অধ্যাপক আযমের ৫০টি বক্তৃতা-বিবৃতির উপরে ভিত্তি করে অভিযোগ এনেছেন। শুধুমাত্র পত্রিকার খবর ছাড়া অন্যকোন সাক্ষ্য প্রমান উপস্থাপন করতে সম্পূর্ন ব্যর্থ হয়েছেন। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দ্ব্যর্থহীনভাবে তার স্বা্েয স্বীকার করেছেন যে, ১৯৭১ সালে অধ্যাপক আযমের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনে কেউ কোন অপরাধ সংঘটন করেছে মর্মে তার কাছে কোন তথ্য প্রমাণ নেই। তদন্তকারী কর্মকর্তার এই বক্তব্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সাথে গোলাম আযমের দুরতম কোন সম্পর্ক নাই।
পঞ্চম অভিযোগ হচ্ছে সিরু নামে এক ব্যক্তির হত্যা। এই পর্যায়ে প্রসিকিউশনের কাহিনী হচ্ছে অধ্যাপক গোলাম আযমের একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন সেই চিঠি উপস্থাপন করতে পারেননি। চিঠি নেই, চিঠির বাহক নেই, চিঠির পাঠকও নেই। তারপরও মাননীয় ট্রাইব্যুনাল তাদের ‘প্রজ্ঞা‘য় গোলাম ্আযমকে মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য সাজা প্রদান করেছেন। আমাদের দেশের ফৌজদারী আইনের দু‘শো বছরের ইতিহাসে এরকম সাক্ষ্য প্রমাণের উপর ভিত্তি করে কাউকে সাজা দেওয়ার কোন নজির নেই। তারপরও মাননীয় ট্রাইব্যুনাল তাকে ৩০ বছরের সাজা দিয়েছেন।
এটা নি:সন্দেহে সত্য যে, অধ্যাপক গোলাম আযম রাজনৈতিকভাবে অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিলেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সাবভৌমত্বের জন্য তিনি কাজ করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে কাজ করা আর গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটন করা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। এটি একটি সুক্ষ পার্থাক্য। অনেকেই এই পার্থাক্য বুঝতে পারেনা।
আমরা মনে করি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধের কোন উপাদান নেই। আইনের দৃষ্টিতে এ রায় কোন রায়ই নয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপীল দায়ের করব। 
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, রায়ে জামায়াতে ইসলামী সম্পার্কে যে মন্তব্য করা হয়েছে তা আইনের পরিপন্থী। এটা অগ্রহণযোগ্য ও এখতিয়ার বহির্ভূত। যে সাক্ষ্য প্রমাণ এসেছে তার ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোন পক্ষের বক্তব্য না শুনে রায়ে তাদের সম্পার্কে কিছু উল্লেখ করা যায় না। রায়ে বিচার বহির্ভূতভাবে জামায়াতের প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। এই এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের নেই।

গোলাম আযমের ছেলের প্রতিকৃয়া :
অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে সাবেক বিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমীও একই প্রতিকৃয়া ব্যক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ ন্যায়ভ্রষ্ট ও পপাতদুষ্ট রায়। আমরা এই রায়ে ুব্ধ ও বিস্মিত। আমরা সুবিচার পায়নি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এ রায় দেয়া হয়েছে। যারা তাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে তাদের ভিত্তিহীন রাজনৈতিক আবেগে এই রায় দেয়া হয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা আপিল করব।
জেনারল আবদুল্লাহিল আমান আল আযমী ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার সময় পরিবারের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অধ্যাপক গোলাম আযম আসামীর কাঠগড়ায় যেখানে বসে ছিলেন সেখানেই তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রায় দেয়া দেখেন। মাঝে মধ্যে ট্রাইব্যুনালের সামনের সারিতে বসা আইনজীবীদের সাথে কথা বলেন। রায় ঘোষনার পর কয়েকজন ডিফেন্স আইনজীবীর সাথে তিনি রায় সম্পার্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এসময় তার সাথে অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান, অ্যাডভোকেট শাহজাহান কবির, অ্যাডভোকে তারিকুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট গাজী এমএইচ তামিম, অ্যাডভোকেট সাজ্জাদ আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আবদুল্লাহ আমান আরো বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযম ’৭১ সালে মন্ত্রী ছিলেন না। অথচ যারা মন্ত্রী ছিল, আমলা ছিল তাদের বাদ দিয়ে একজন বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপসিবিলিটি বা কমান্ড রেসপনসিবিলিটি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এই ট্রাইব্যুনাল প্রথম থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ট্রাইব্যুনালের বিচারপতির স্কাইপ সংলাপ ফাস হওয়ার পর ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই রায় সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন।
আবদুল্লাহিল আমান বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযম একজন ভাষা সৈনিক। তার বিরুদ্ধে রায় দেয়ার অবকাশ নেই। ট্রাইব্যুনালই বলেছে তার উপস্থিতিতে কোন অপরাধ সংগঠিত হয়নি। তার পর তাকে কিভাবে সাজা দেয়া হল? আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব। আশাকরি আপিলে ন্যায় বিচার পাব। তিনি বলেন, একাত্তর সালে আমার বাবা পাকিস্তান অখণ্ডতার পে ছিলেন। কিন্তু কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা কোনো দলের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেননি।

গোলাম আযমের আত্মীয়ের ওপর হামলা
রায় ঘোষনার পরপরই অধ্যাপক গোলাম আযমের এক নিকট আত্মীয়  গতকাল ট্রাইব্যুনাল চত্বরে হামলার স্বীকার হন রায়ে নাখোঁস ব্যক্তিদের হাতে।

রায় ঘোষনার পরপরই বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে কিছু লোক ট্রাইব্যুনালের সামনে স্লোগান দিতে থাকে। প্রহসনের বিচার মানিনা, রাজাকারের ফাঁসি চাই বলে তারা স্লোগান দেয়। এসময়  গোলাম আযমের ওই আত্মীয় ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে বের হয়ে তাদের সামনে দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তখনই কিছু লোকজন  হামলে পরে তার ওপর। তারা তাকে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি এবং লাথি মারতে থাকে। তার গায়ের জামা টেনে ছিড়ে ফেলে। হামলার সময় বিপুল সংখ্যক পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।  হামলার শিকার গোলাম আযমের ওই আত্মীয় তখন  কোনমতে দৌড়ে আবার ট্রাইব্যুনালের ভেতরে প্রবেশ করে নিজেকে রক্ষা করেন।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
গত বছর ১৩ মে চার্জ গঠনের মাধ্যমে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। চলতি বছর ১৭ এপ্রিল অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সমস্ত বিচার প্রক্রিয়া শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়। প্রায় তিন মাস পরে ট্রাইব্যুনালের অন্যতম আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষনা করা হল গতকাল।
২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি অধ্যাপক গোলাম আযম ট্রাইব্যুনালে হাজির হন ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে। সেদিন ট্রাইব্যুনাল তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তখন থেকে  নব্বয়োর্ধ অধ্যাপক গোলাম আযম বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিজন সেলে বন্দী রয়েছেন।

সংক্ষিপ্ত অভিযোগ :

উর্দ্ধতন নেতৃত্বের দায় হিসেবে ১৯৭১ সালের যাবতীয় অপরাধের দায় আনা হয়েছে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ৩০ লাখ মানুষ হত্যা, ৪ লাখ নারী ধর্ষণসহ সমস্ত অপরাধ এবং  ধ্বংসযজ্ঞের দায়ভার চাপানো হয়েছে অধ্যাপক গোলাম আযমের ওপর ।

অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, সহযোগিতা এবং উসকানি বিষয়ে  অভিযোগের মধ্যে রয়েছে   ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল নুরুল আমীন, মৌলভী ফরিদ আহমেদ, খাজা খয়ের রউদ্দিন, এ কে এম শফিকুল ইসলাম, মাওলান নুরুজ্জামান, হামিদুল হক চৌধুরী, মোহসিন উদ্দিন আহমেদ, এ টি সাদীসহ ১২ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের ষড়যন্ত্র করেন।

৬ এপ্রিল গোলাম আযম আবারও টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং  ষডযন্ত্রে অংশ নেন। ৪ ও ৬ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে গোলাম আযমসহ অন্যরা সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ৪ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে সারা দেশে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ এপ্রিল গোলাম আযম ও অন্যরা ঢাকায ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করেন।

১৯ জুন এই ষডযন্ত্রের ধারাবাহিকতায  গোলাম আযম রাওযালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইযাহিযা খানের সঙ্গে উচ্চপর্যাযরে একটি বৈঠক করেন। বৈঠকে  সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবিলার জন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান জানান।

১ ডিসেম্বর রাওযালপিন্ডিতে আবারও ইযাহিযা খানের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে মোকাবিলার জন্য রাজাকার বাহিনীর শক্তি বাডানোর পরামর্শ দেন মর্মে অভিযোগ আনা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয়  অনুপ্রবেশকারী, দৃস্কৃতকারী, বিশ্বাসঘাতক প্রভৃতি অভিধায় আখ্যায়িত করে তাদের ধ্বংস করার আহবান জানিয়েছেন মর্মে অভিযোগ করা আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে । 


অধ্যাপক গোলাম আযমের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :
অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর ব্রাèনবাড়িয়ার নবীনগরে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫০ থেকে ৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামে যোগদান করেন এবং ১৯৬৯ তেকে ১৯৭১ পর্যন্ত  এ দলের আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত একই দলের সেক্রেটারি জেনারেল এর দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর তিনি পাকিস্তানের উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন এবং ১৯৭৩ সালে লন্ডন যান। ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং  আবার জামায়াতের আমির নিযুক্ত হন । ১৯৯৯ সালে তিনি আমিরের দায়িত্ব থেকে অবসরে যান।

অধ্যাপক গোলাম আযম বেশ কিছু  আলোচিত  গ্রন্থের প্রনেতা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পলাশী থেকে বাংলাদেশ, ইকামতে দ্বীন, মনটাকে কাজ দিন, জীবনে যা দেখলাম। এছাড়া তার বেশ কিছু অনুবাদ গ্রন্থ রয়েছে।
বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার রূপকার  অধ্যাপক গোলাম আযম ছাত্র জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু জিএস নির্বাচিত হন। তিনি ভাষা আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেন। 


মামলায় নিযুক্ত আইনজীবী :
রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলার দায়িত্বে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউরটর সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ প্রমুখ।
আসামী পক্ষে ছিলেন চিফ ডিফেন্স কাউন্সেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মুন্সি আহসান কবির, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক, অ্য্ডাভোকেট  এস এম শাহজাহান কবির, তারিকুল ইসলাম, আসাদ উদ্দিন প্রমুখ।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন